Ratings1
Average rating4
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একদম শুরুর দিকের উপন্যাস এটি। পরের দিকে মানিক তাঁর উদ্ভাবিত নিজস্ব স্টাইলে মানুষের মনের দূরতম অন্দরমহলে গভীর সার্চলাইট ফেলে পর্যবেক্ষণ করতেন, কিংবা প্রচলিত বাংলা উপন্যাসের গঠন থেকে সরে এসে নিজের লেখাতে নিরীক্ষা আর নতুনত্ব নিয়ে আসতেন ; কিন্তু এই উপন্যাসে সেই ট্রেডমার্ক মানিক কিছুটা অনুপস্থিত। তবু একটা দিক দিয়ে এই উপন্যাস আমাকে ভাবিয়েছে, তা হলো মানিকের তীব্র তীক্ষ্ণ রিয়েলিজম।
জননী মানেই তো নিঃস্বার্থ, দরদী, ভালোবাসার অপার আশ্রয়— পৃথিবীর সব মা যেমন হয়ে থাকেন— সাহিত্যে! মানিক এইসব চিরাচরিত রোমান্টিসিজমকে নিজের সাহিত্যজীবনের শুরু থেকেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ‘জননী' উপন্যাসের শ্যামা নামের মুখ্য চরিত্রটি দোষে-গুণে, ক্রোধে-কান্নায়, লাজে-ভয়ে, স্বার্থপরতায়-স্বার্থহীনতায়, আহ্লাদে এবং অভিসম্পাতে, বুদ্ধি এবং নির্বুদ্ধিতায়, চালাকি এবং চতুরতায়, শোকে এবং সাবধানতায়— সব দিক দিয়ে একজন রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষ। নিছক সস্তা বাঙালি সেন্টিমেন্টের ধার ধারেননি মানিক। জীবনের শুরুতেই ঘোষণা করেছেন : আমি এসে গেছি পাঠক, আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত তো?
আধুনিক “ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়া” পাঠকদের কাছে ত্রিশের দশকে রচিত এই উপন্যাসের অনেক কিছুই আপত্তিকর মনে হবে। রমণীর অচ্ছেদ্য পতিপ্রেম (তা হোক-না সেই পতিদেব একজন মার্কামারা অপদার্থ এবং শারীরিক অত্যাচারকারী), কিংবা ভাগ্যের হাতে মেয়েদের অসহায় আত্মসমর্পণ, কিংবা সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষের হৃদয়— এইসব দেখে অনেকে ভয়ানক অপমানিত বোধ করতে পারেন। কিন্তু সমাজ তো তখন এমনই ছিল (এখনও যেন কতো শুধরেছে!)। লেখকের কাজ “আদর্শ সমাজ”-এর রূপরেখা ফুটিয়ে তোলা নয়, সমাজে ঠিক যেমনটা দেখা যায় তেমনটা পাঠকের সামনে তুলে ধরা— উপন্যাসটি পড়ার সময় এটা ভুলে গেলে চলবে না। আমি মাঝেমাঝে ভুলে গিয়ে ভীষণ অপমানিত বোধ করছিলুম, তারপর আবার নিজেকে বোঝাচ্ছিলুম, চিল ব্রো, এটাই তো স্বাভাবিক চিত্র।
বহু বছর আগে পড়েছিলাম এই উপন্যাসটা। সেই অল্প বয়েসে কী যে বুঝেছিলাম কিছুই মনে নেই। এবার আবার পড়তে গিয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অসামান্য চরিত্র-বিশ্লেষণ দেখে অবাক হলাম। কেমন অন্ধকার গোপন গহীন ফাঁকফোকরে পোকামাকড়ের সূক্ষ্ম নড়াচড়াও খুঁটিয়ে দেখবার নজর ছিল তাঁর! মানুষের মনের পোকামাকড়।
স্বতই বিমর্ষ হয়ে ভদ্রসাধারণচেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়েআরও বেশি কালো-কালো ছায়ালঙ্গরখানার অন্ন খেয়েমধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসাব ডিঙিয়েনর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠেনর্দমায় নেমে—ফুটপাথ থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাথে গিয়েনক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা মরে যেতে জানে।এরা সব এই পথে ওরা সব ওই পথে— তবুমধ্যবিত্তমদির জগতে আমরা বেদনাহীন— অন্তহীন বেদনার পথে।