Ratings1
Average rating5
“ফিরে এসো, চাকা” আমার পাঠকজীবনের একটি মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বই। প্রতিটি মানুষের চিন্তাভাবনায় কিছু স্ববিরোধ (contradiction) থাকে। পাঠক হিসেবে আমার স্ববিরোধটি হলো, গদ্যের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা, অস্পষ্টতা কিংবা উদ্দেশ্যহীন অবাস্তবতা আমার সহ্য হয়না ; অথচ আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি! গল্প-উপন্যাস পাঠের ক্ষেত্রে সুসঙ্গত প্লট এবং বক্তব্যের বোধগম্যতা আমার কাছে খুব জরুরি দুটো শর্ত। ফ্রাঞ্জ কাফকার “দ্য মেটামরফোসিস” ভালো লেগেছিলো কারণ, গল্পটির আপাত-absurdity সত্ত্বেও ওই দুটো শর্ত পূরণ হয়েছিলো। হুয়ান রুলফোর “পেড্রো পারামো” ভালো লাগেনি কারণ শর্তদুটো পূরণ হয়নি।
২৮ শে এপ্রিল ১৯৬২ সালে লিখিত নিচের এই লাইনগুলো, আজকে ভোরবেলা আমি যখন পুনরায় পাঠ করলাম, তখন আমি আরো একবার, আবারও একবার, এক রহস্যময় কিন্তু সুস্পষ্ট আচ্ছন্নতার প্রতি নিজেকে সমর্পণ করলাম।
কবে যেন একবার বিদ্ধ হ'য়ে বালুকাবেলায়সাগরের সাহচর্য পেয়েছিলো অলৌকিক পাখি।উদ্যত সংগীতে কবে ভরেছিলো হর্ম্যতল, তবুপেরেক বিফল হ'লো গহ্বরের উদ্ধার পেলো না।
যেমনটা শোনা যায়, হতে পারে এই বইটি একজন কবির ব্যর্থ প্রেমের এবং স্পর্শবঞ্চিত আকাঙ্ক্ষার, সুদীর্ঘ এপিটাফ। কিন্তু যখনই এই কবিতাগুলো পড়ি, কবির মানসিক ইতিবৃত্তান্তের কথা আমার খেয়ালে থাকে না। আমি দেখতে পাই একটা অচেতন টানেলের শেষপ্রান্তে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে একটা হলদে আলোর শিখা। শিখাটার নাম “বোধ”।
আগে এই শিখাটার নাম ছিলো “বিপন্নতা”। ২০০৯ সাল নাগাদ প্রথমবার এই কবিতাগুলো পড়ার আগে, কবিতাকে আমি জানতুম একধরণের অস্পষ্ট আবেশ হিসেবে। কবিতা পড়তে আমার ভালো লাগতো, কিন্তু তারা আমাকে বিপন্ন করতো। যা-কিছুর অর্থ আমার কাছে সম্পূর্ণ ধরা দিতো না, তা-ই আমাকে বিপন্ন করতো।
এমন বিপন্ন আমি, ব্যক্তিগত পবিত্রতাহীন।যেখানে-সেখানে মুগ্ধ মলত্যাগে অথবা অসীমেপ্রস্রাব করার কালে শিশুর গোপন কিছু নেই।ফলে পিপীলিকাশ্রেণী, কুসুমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
বিনয় মজুমদারের সান্নিধ্যে এসে আমি বুঝেছি, বিপন্নতা থেকে বোধে উত্তরণের নামই কবিতা। কবিতা মানে কেবল বিমূর্ত আবেশ নয়। সুন্দর সুন্দর শব্দ পাশাপাশি সাজিয়ে যাওয়া নয়। কিংবা, পাহাড়ি বালকের বাঁশির মতো সরল আত্মউন্মোচন নয়। ক্রোধজর্জর শ্লোগান তো নয়ই। কবি অবশ্যই নিশ্চিতভাবে কিছু একটা প্রকাশ করতে চাইছেন। হয়তো শুধু আমাকেই বলতে চাইছেন। কবি আর আমি মুখোমুখি। কিন্তু, যেহেতু কবিতার চেয়ে ব্যক্তিগত বিষয় খুব কম আছে পৃথিবীতে, নিজেকে প্রকাশ করার আগে আমার সামর্থ্য যাচাই করে নিচ্ছেন তিনি। টুকরো করে কাছি, আমি কি ডুবতে রাজি আছি?
এসো ক্লান্তি, এসো এসো, বহু পরীক্ষায় ব্যর্থ, হাঁসপুনরায় বলে, তার ওড়ার ক্ষমতাবলি নেই,নির্মিত নীড়ের কথা মনে আনে, বিস্মিত স্মৃতিতে।অজীর্ণ, তোমাকে নিয়ে আর কতো গান গেয়ে যাবো?
বোধের এই যে স্পষ্টতা, অথচ প্রকাশের ভাষাটি যেন এই জগতের নয়। তিনি জানতেন, আমিও ধীরে ধীরে জেনেছি, আমরা দুজনেই আসলে ভিনগ্রহী। অপার্থিব মহাজাগতিক ভিনগ্রহী নয়, আমার মাথার ভেতরেই অনেকগুলো বিকল্প গ্রহ আছে। যদিও কবির সঙ্গে আমার বাক্যবিনিময় পৃথিবীর পরিচিত ভাষায় হয়না, তবু বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, নিবিড় নিশ্চিত বোধগম্যতার সিঁড়িতে দৃঢ়পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে কবিতা। কবিতা যে ভাসমান বায়বীয় কুয়াশাচ্ছন্ন কোনও হিলস্টেশন নয়, রহস্যময় মানেই যে দুরূহ অস্পষ্টতা নয়, এই জরুরি দর্পণগুলো আমাকে সরবরাহ করেছিলেন কবি বিনয় মজুমদার। কবিতা ছলনা নয়, কবিতারও আছে সুসংগত প্লট, সনির্বন্ধ বোধগম্যতা। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে জীবনানন্দ দাশ যা-খুশি হতে পারেন— একজন কমলালেবু কিংবা ভোরের শঙ্খচিল। কিন্তু তাঁর কবিতা মোটেও “বিপন্ন বিস্ময়” নয়। কোনো কবিতা যদি প্রকৃতই কবিতা হয়ে থাকে, তাহলে তা ভীষণভাবে দৃশ্যমান! অবচেতনে নয়, আমার জ্যান্ত চেতনায়! এই উপলব্ধি, “ফিরে এসো, চাকা” পড়ার আগে আমার ছিলো না।
যখন কিছু না থাকে, কিছুই নিমেষলভ্য নয়,তখনো কেবলমাত্র বিরহ সহজে পেতে পারি।তাকেই সম্বল ক'রে বুঝি এই মহাশূন্য শুধুস্বতঃস্ফূর্ত জ্যোৎস্নায় পরিপূর্ণ, মুগ্ধ হতে পারে।
ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?