সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের বিষয় সেটা হলো, বাইরের দুনিয়ায় রাজশেখর বসুর ইমেজ ছিলো তাঁর লেখা গল্পের একদম উল্টো। তিনি নাকি ছিলেন ভয়ানক গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তাঁর মুখে হাসি দেখতে পাওয়া ছিলো বেগতিক বিরল ঘটনা। তিনি কথা বলতেন কম। যেটুকু বলতেন তাতে রসিকতার বাষ্পটুকুও থাকতো না। এমন একজন গেরামভারি মানুষের কলম দিয়ে, রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ কিংবা বিখ্যাত বাংলা অভিধানের জন্ম হলো, আচ্ছা তা নাহয় বোঝা গ্যালো, কিন্তু এতগুলো উপভোগ্য সরস গল্প কিভাবে বেরোলো?
বাংলা সাহিত্যে রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরামের আগেও সরস সাহিত্য রচিত হয়েছিলো অনেক। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় কিংবা ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কিংবা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় কিংবা সুকুমার রায় ততদিনে রসসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। কিন্তু তবুও, ১৯২৪ সালে রাজশেখর বসুর প্রথম হাসির গল্পের বই “গড্ডলিকা” প্রকাশ হওয়ার ঘটনাটিকে গোটা বাংলা সাহিত্যের নিরিখে একটা ‘ওয়াটারশেড মোমেন্ট' বলা যেতে পারে। কারণ, স্বয়ং চলন্তিকা অভিধানের স্রষ্টা যদি সবকিছু বাদ দিয়ে হাসির গল্প লেখেন, তাহলে রসসাহিত্য যে জাতে উঠে যাবে তা তো বলাই বাহুল্য।
জাতে উঠেও গ্যালো। রাজশেখরের কর্মস্থল বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিমোহিত হয়ে লেখককে পত্র দিলেন : “তোমার বই খুলিয়া পড়িতে পড়িতে আমি এই বৃদ্ধ বয়সে হাসিতে হাসিতে choked হইতেছি”। রবীন্দ্রনাথ পত্র দিলেন : “লেখার দিক হইতে বইখানি আমার কাছে বিস্ময়কর”। এই বিস্ময়ের স্রোত কিন্তু থেমে যায়নি। একের পর এক অনবদ্য হাসির গল্প উপহার দিয়ে গেছেন গোমড়ামুখো রাজশেখর। একটা কথা আছে, যে হাসতে জানেনা সে বাঁচতেও জানেনা। তাহলে বলতে হয়, রাজশেখর বসুর হাসির গল্পের ভাণ্ডার বাঙালিকে বাঁচতে সাহায্য করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ।
রাজশেখর বসুর হাসির গল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয় এর ভাষার কথা। রাজশেখরের গল্পের ভাষা নির্মেদ, ভাবাবেগবিহীন। পাঠককে জোর করে হাসানোর জন্যে তাঁকে কাতুকুতু দিতে হয়নি। স্রেফ চরিত্রনির্মাণ এবং ঘটনাবর্ণনার সাহায্যেই তিনি হাসিয়ে গেছেন। হাসির গল্পের একটা অন্যতম উপাদান হলো, মানবজীবনের অসঙ্গতি কিংবা খাপছাড়া ঘটনাগুলো। কিন্তু খাপছাড়া বিষয় দেখানোর জন্য রাজশেখর কাউকে খোঁচা কিংবা গুঁতো দেননি। তাঁর হাস্যরসকে এই কারণেই প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন “ইন্টেলেকচুয়াল লাফটার”।
প্রায় শ-খানেক হাসির গল্প লিখেছিলেন পরশুরাম। বেশিরভাগ গল্পেই দেখা যায় শহুরে প্রেক্ষাপটে শহুরে মানুষদের কীর্তিকলাপ। কখনও মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথের উক্তি আওড়ান : “বৈরাগ সাধন মুক্তি সো হমার নহি”। কখনও রোগীর জিজ্ঞাসায় বিরক্ত ডাক্তার জবাব দেন : “যদি বলি তোমার পেটে ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলস হয়েছে, কিছু বুঝবে?” কখনও “এক্সকিউজ মি প্রভু, আপনি কি জিসস ক্রাইস্টকে জানতেন?” এই প্রশ্নের উত্তরে ত্রিকালদর্শী মহাত্মা সাধু বলেন : “হাঃ হাঃ যিশু তো সেদিনকার ছেলে!” আবার এই কথা শুনে আরেকজন অবাক হয়ে মন্তব্য করেন : “ইনি তাহলে গৌটামা বুডঢাকেও জানতেন?”
যাই হোক, পরশুরামের হাসির গল্পের বিশ্লেষণ এই সীমিত পরিসরে করা যাবে না, আমার দ্বারা সম্ভবও নয়। সবচেয়ে ভালো হয় তাঁর গল্পসমগ্র জোগাড় করে ফেলা। তারপর একটার পর একটা গল্প তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা। তবে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা বলি। আগাগোড়া সমস্ত গল্প পরপর পড়ে যাওয়া উচিত হবে না। যেহেতু পরশুরামের গল্পের প্রেক্ষাপট এবং চরিত্রদের মধ্যে খুব বেশি বৈচিত্র্য নেই, তাই একাদিক্রমে পড়তে গেলে একঘেঁয়ে লাগতে পারে। মাঝেমাঝে একটা-দুটো গল্প চেখে দেখাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
বুজেচ?আজ্ঞে হাঁ।ছাই বুজেচ।