Ratings1
Average rating5
আমার সবচেয়ে প্রিয় তিনজন রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পীর মধ্যে একজন হলেন দেবব্রত ওরফে জর্জ বিশ্বাস (অন্য দুজন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সাহানা বাজপেয়ী)। একইসঙ্গে কণ্ঠের দৃপ্ত মাধুর্য এবং আবেগের বিহ্বলতা, দেবব্রত বিশ্বাসের গানে যতটা অনুভব করা যায়, আর কারো গানে আমি অন্তত অনুভব করিনি। তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত গায়কীর অনুকরণ করা সম্ভবত পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটা। দেবব্রত বিশ্বাসের তাই কোনো উত্তরসূরী নেই। তিনি একলা। অদ্বিতীয়। এবং জীবৎকালে ছিলেন ব্রাত্য। ক্যানো ব্রাত্য ছিলেন?
রবীন্দ্রনাথের নিজের খাস-এলাকা শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীর কতিপয় ইঁচড়ে পাকা এবং হিংসুটে “বিশেষজ্ঞ”, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের গানকে তালাচাবি দিয়ে বাক্সবন্দী করে রাখার সুবন্দোবস্ত করেছিলো। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান নতুনভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। অজস্র গায়ক তাদের অসংখ্য রেকর্ডের মাধ্যমে বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেছিলেন। ফলে, রবীন্দ্রসংগীতের একটা চওড়া বাজারমূল্য তৈরি হয়েছিল। বেচারা রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সৃষ্টিসম্ভারের কপিরাইট যেহেতু ছিল তাঁরই নিজের হাতে গড়া বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের হাতে (ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে!), ফলে রবীন্দ্রনাথের লেখা বই হোক কিংবা গান, বিশ্বভারতীর ছাড়পত্র ব্যতীত বাজারে বেরোনো সম্ভব ছিল না।
এরকম অবস্থায় যেটা হওয়ার কথা ছিল, সেটাই হলো। বিশ্বভারতীর ছোট-বড়-মাঝারি ফুটোমস্তানরা দাদাগিরি দেখাতে শুরু করে দিলো। তারা গায়কদের গানের “ভুলত্রুটি” ধরতে শুরু করলো। এবং সেই ভুলত্রুটি সংশোধন না-করা পর্যন্ত সেই গানের রেকর্ড বাজারে ছাড়ার অনুমোদন দেওয়া বন্ধ হলো। কেমন ভুলত্রুটি? শুদ্ধতা বজায় রাখার যুক্তি দেখিয়ে, প্রথাগত স্বরলিপি অনুযায়ী রবীন্দ্রসংগীত না-গাইলে অনুমোদন দেওয়া হবে না, এই বিষয়টা তবু না-হয় মেনে নেওয়া গ্যালো। কিন্তু আরো কিছু “ভুলত্রুটি”-র দু-একটা নমুনা দেওয়া যাক। “গানের সঙ্গে অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, ফলে গানের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে”। “বড্ডো বেশি আবেগ দিয়ে গাওয়া হয়েছে গানটা, ফলে গানের গাম্ভীর্য নষ্ট হয়েছে”। “গানটির যে মূল বক্তব্য এবং দর্শন রয়েছে, গায়ক সেটা বোঝাতে পারেননি”। এছাড়া গানের মধ্যে ছোটবড় উচ্চারণের ত্রুটি তো আছেই। বোঝাই যাচ্ছে, গায়কদের উপর ছড়ি ঘোরানোর পন্থা ছাড়া এসব আর কিছুই নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কস্মিনকালেও এইসব ফালতু বিষয়ে কোনোরকম “নির্দেশ” কিংবা “আদেশ” দিয়ে যাননি। তিনি তো ফুটোমস্তান ছিলেন না।
শুধু নবাগত কিংবা অখ্যাত নয়, এমনকি প্রতিষ্ঠিত এবং স্বনামধন্য সংগীতশিল্পীদের উপর এভাবেই খবরদারি চলছিলো। ঝামেলা এড়ানোর জন্যে বেশিরভাগ শিল্পী এই ব্যবস্থা মেনেও নিয়েছিলেন। বিগ-ব্রাদারদের নেকনজরে থাকার জন্যে রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পীদের জগতে একটা অস্বাস্থ্যকর রাজনীতি শুরু হলো। শিল্পীরা একে-অপরকে ল্যাং মারতে শুরু করলেন। দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন কিশোরগঞ্জের খাস-বাঙাল। তাঁর শিরদাঁড়াও ছিলো বাঙালসুলভ সোজা এবং শক্ত। বিশ্বভারতীওয়ালারা যখন তাঁর উপরেও খবরদারি করা শুরু করলো, তিনি রুখে দাঁড়ালেন। রবীন্দ্রসংগীতের শুদ্ধতা বজায় রাখার নামে এই হিটলারি বাঁদরামি তিনি বরদাস্ত করলেন না। ঘোষণা করলেন, তরা বইয়া বইয়া কাইজ্জা কর, গান আর আমি রেকর্ডই করুম না হালা! (ব্যক্তিগত আলাপচারিতা-কথোপকথনের ক্ষেত্রে তিনি “বাঙাল” ভাষা বর্জন করেননি আজীবন।)
তাঁর জনপ্রিয়তায় কিন্তু একচুল ভাঁটা পড়লো না। রেকর্ড না-হয় নাই-বা করলেন, কিন্তু অনুষ্ঠানে-মঞ্চে গাইবার জন্যে তো আর বিশ্বভারতীর লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই। মারাত্মক হাঁপানির রোগে সারাজীবন জর্জরিত ছিলেন। কিন্তু যতদিন বেঁচে ছিলেন, জাগতিক সমস্ত বাধাবিপত্তিকে কাঁচকলা দেখিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের জগতে ছিলেন জ্বলন্ত সূর্যের মতো অধিষ্ঠিত। অন্য শিল্পীদের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে শ্রোতারা রবীন্দ্রসংগীত শুনতে যেতো। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত নয়, তারা যেতো “জর্জদার গান” শুনতে। আজকে সকালেও আমি যখন তাঁর কণ্ঠে “যেতে যেতে একলা পথে নিভেছে মোর বাতি” গানটা শুনছিলাম, একজন অভিমানী কিন্তু আপোষহীন মানুষের সংগ্রামের কথা চিন্তা করে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো!
এই বইটিতে তাঁর নিজের জীবনের কথা আছে খুবই কম। সেই অর্থে আত্মজীবনী বলা যায় না বইটিকে। বইয়ের লেখনীও বেশ খাপছাড়া। শুরুর দিকে বেশ একঘেঁয়ে লাগছিলো। রাবীন্দ্রিক-শাখামৃগদের সঙ্গে জর্জ বিশ্বাসের আজীবন সংগ্রামের কিছুটা আভাস পাওয়া যায় বইটা থেকে। এটাই এই বইয়ের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। একইসঙ্গে পাওয়া যায় রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনার কথা। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা। তাঁর জীবনদর্শন তাঁর গায়কীর মতোই আবেগদৃপ্ত কিন্তু উচ্চকিত নয়। সর্বার্থেই জর্জ বিশ্বাস একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। আজকে সকালে শোনা গানটির কথা আবারও মনে পড়ে যাচ্ছে। এই গানটি রবীন্দ্রনাথ যেন জর্জ বিশ্বাসের কথা মাথায় রেখেই লিখেছিলেন!
যেতে যেতে একলা পথে
নিবেছে মোর বাতি।
ঝড় এসেছে, ওরে,
এবার ঝড়কে পেলেম সাথি।
আকাশ-কোণে সর্বনেশে
ক্ষণে ক্ষণে উঠছে হেসে,
প্রলয় আমার কেশে বেশে
করছে মাতামাতি।
ইচ্ছে হলে এখানে গানটি শুনে নিতে পারেন। দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে এই গানটি ইউটিউবেও আছে, কিন্তু স্পটিফাই-এর এই ভার্শনটা আমার বেশি ভালো লাগে।
[একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও এখানে উল্লেখ করে রাখি। কলকাতার “ব্রাত্যজন” নামক নাট্যদল-দ্বারা প্রযোজিত বিখ্যাত “রুদ্ধসংগীত” নাটকটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার (নাট্যকৃতি ও পরিচালনা - ব্রাত্য বসু)। সেই নাটকে দেবব্রত বিশ্বাসের ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদারের অসামান্য অভিনয়কে এই সুযোগে আরো একবার কুর্নিশ জানিয়ে রাখি। নাটকটা আমি দুবার দেখেছি। কেউ যদি কখনও কোনোভাবে “রুদ্ধসংগীত” নাটকটি দেখার সুযোগ পায়, সেই সুযোগ হাতছাড়া করাটা খুব বড় নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। নাটকটির প্রযোজনা সম্ভবত এখন বন্ধ আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি আবার সুযোগ পাই, আমি আবার দেখবো।]