দহন
1996 • 174 pages

Ratings1

Average rating4

15


আমি তিনদিন আগেও তর্ক করেছি বন্ধুদের সঙ্গে। অমুক রাজনৈতিক নেত্রীকে যদি সরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তমুক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়ে যাবে। অমুকের চেয়ে তমুক তো আরো বেশি ক্ষতিকর! রাত দখলের মিছিল করার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? বাজারে এতো গুজব ছড়াচ্ছে কারা? কী উদ্দেশ্যে? মেয়েটির হাত নাকি চেপে ধরে রেখেছিল আরেকটি মেয়ে (অর্থাৎ আরেকবার প্রমাণিত হলো যে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু)। তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কোনোকিছু মেনে নিতে রাজি নই আমি। আমি তো মূলত একটি অরাজনৈতিক প্রাণী, তাই আমার চিন্তাভাবনা নির্মোহ। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু এটা মেনে নিতে দ্বিধা নেই যে বুকের ভিতরে কেউ একজন হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত। সমস্ত রাজনৈতিক তরজা আর লাভ-ক্ষতির হিসেবের বাইরে সেই হাতুড়ির দুম দুম দুম শব্দ শয়নে স্বপনে জাগরণে শুনতে পারছিলাম আমি। ধর্ষণের যেটুকু বর্ণনা, অত্যাচারিতার প্রাণহীন শরীরের যেটুকু বিবরণ, পোস্ট-মর্টেম ঘরের পিচ্ছিল দেয়াল ভেদ করে বাইরে এসেছে, নীতি-আদর্শের ছাল-বাকলা ছাড়িয়ে আমার তর্ক আর যুক্তিগুলো ক্রমশ অর্থহীন হয়ে যাচ্ছিল। ঘরে বাইরে অফিসে বাজারে সদরে অন্দরে আমি শুধু কল্পনা করার চেষ্টা করে গেছি, ওই জায়গায় আমি নিজে থাকলে ঠিক কেমন লাগতো? তার জায়গায় আমি শুয়ে থাকলে? ধরা যাক আমার পা দুটোকে কেউ...

আমার পক্ষে সম্ভব নয় যদিও, এই চিন্তাকে পূর্ণতা দেওয়া। আমার পৌরাণিক যৌনাঙ্গটি বাধা সৃষ্টি করে নিজেকে একজন নারীরূপে কল্পনা করতে। আমি কিছুতেই নিজেকে নিচে-শুয়ে-থাকা-অবস্থায় কল্পনা করতে পারিনা। আমি তো পুরুষ। আমি ভালোবাসতে পারি, কিংবা ধর্ষণ করতে পারি, কিন্তু কখনোই নিচে শুয়ে থাকতে পারিনা। আমি তো পুরুষ। প্রেম কিংবা প্রয়োজন কিংবা পৌরুষপ্রদর্শন— আমি সবসময়ই উপরে থাকি।

তাই নিচে শুয়ে থাকার, শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে ছিন্নভিন্ন হওয়ার, বাসে ট্রেনে ভিড়ের মাঝে অশ্লীল স্পর্শলাভ করার, পথে ঘাটে ইভ-টিজড হওয়ার, কর্মক্ষেত্রে উপরওয়ালার অবাঞ্ছিত অস্বস্তিকর “অ্যাটেনশন” সামলানোর, নিজের স্বাভাবিক জৈবিক শরীরী আকাঙ্ক্ষার উন্মোচনে “বেশ্যা” খেতাব লাভ করার, স্বামীর দ্বারা যথেচ্ছ ব্যবহৃত হওয়ার জন্য “বিবাহ” নামক লাইসেন্স প্রদান করার, পারিবারিক সদস্যের দ্বারা যৌনলাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাকে লোকলজ্জার ভয়ে সারাজীবন গোপন রাখতে বাধ্য হওয়া, সমাজের তুলাদণ্ডে নিজেকে প্রতিনিয়ত পুরুষের বাটখারায় মাপতে বাধ্য হওয়া— এই সবকিছু সবকিছু সবকিছু জানতে হলে আমাকে তাকিয়ে থাকতে হয় একজন সুচিত্রা ভট্টাচার্যের দিকে, একজন আশাপূর্ণা দেবীর দিকে, একজন মহাশ্বেতা দেবীর দিকে, একজন ইসমাত চুঘতাইয়ের দিকে, একজন সিলভিয়া প্লাথের দিকে, একজন জেন অস্টেনের দিকে। কোনো পুরুষ লেখক (যতোই শক্তিশালী হোক না তাঁর কলম) নিজের পুরুষাঙ্গের বিপুল ওজন উপেক্ষা করে কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন না মেয়েদের যাপনচিত্রের যাবতীয় বে-দাগ বে-রং বে-জুবান কালার-কম্বিনেশনগুলোকে। একজনও না!

তাহলে আমার মতো কল্পনাশক্তির অ্যানিমিয়ায় ভোগা মানুষের পক্ষে কীভাবে সম্ভব সেই মেয়েটির জায়গায় নিজেকে চিন্তা করা? কীভাবে চিন্তা করবো একজন মেয়েকে যখন টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের সামনে ভরসন্ধ্যেবেলায় শত শত মানুষের চলমান দৃষ্টির সামনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করা হয়? কী চলে তখন সেই নারীটির মনে? ঝড়? সাইক্লোন? বন্যা? নাকি ধ্বস? নাকি শূন্যতা? এই অপমানের সমতুল্য কিছুই তো খুঁজে পাইনা নিজের জীবনে। পাশাপাশি রেখে বিচার করার মতো কিছুই খুঁজে পাইনা! সুচিত্রা ভট্টাচার্য লিখে না গেলে এই পাহাড়প্রমাণ অপমানের অস্তিত্বই থাকতো না আমার চেতনায়।

আজ যখন ঘটে গেছে আরেকটা পাহাড়প্রমাণ অপমানের ঘটনা (যেটা আবারও আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে, কারণ আমি কিছুতেই নিজেকে তার জায়গায় কল্পনা করতে পারছি না), কলেজজীবনে হোস্টেলে বন্ধুদের সঙ্গে মধ্যরাত্রে বসে বিস্ফারিত চোখে দেখা পর্নোগ্রাফিগুলো আমাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। রাস্তা ঘাটে উপভোগের দৃষ্টিতে কতোই তো দেখেছি নারীশরীরের সৌন্দর্য, আজ তারা বুমেরাংয়ের মতো আমাকে প্রত্যাঘাত করে যাচ্ছে। কতোই তো নারীইঙ্গিতবাহী গালি দিয়েছি জীবনে (কারণ নারীর অনুষঙ্গ জড়িয়ে না-থাকলে খিস্তি মেরে সুখ পাওয়া যায় না)— মাদারচোদ, বাঞ্চোত, খানকিমাগী, চুতমারানি, গুদমারানি— কিংবা আরো “পরিশীলিত” (কারণ ভাষা ইংরিজি)— মাদারফাকার, সান অভ আ বিচ।

সেই যাবতীয় গালিগালাজ আজ আমার দিকে ধেয়ে আসছে দশগুণ তীব্রতায়। আমার যাবতীয় রাজনৈতিক আর সামাজিক তর্ক আর যুক্তি আর বিচার আর প্রজ্ঞাকে ন্যাতানো বিস্কুটের মতো মনে হচ্ছে। কারণ পুরুষ হিসেবে আমি নাকি অনেক কিছু করতে পারি, যেহেতু আমার আছে অসীম ক্ষমতাবান একটি পুংলিঙ্গ। এই পৃথিবী নাকি পুরুষের। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! (“বসুন্ধরা” একটি স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ, সুতরাং বীর মানেই পুরুষ— “বীরপুরুষ”! আর ভীতুরা সবাই “pussy”!) আমি নাকি সব পারি কিন্তু কিছুতেই একটা নারীর জায়গায় রেখে নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা। গত পাঁচ দিন ধরে চেষ্টা করেও পারছি না। কোনোদিন পারবো না। আজকে সকালে দৈনিক পত্রিকার পৃষ্ঠায় দেখলাম আমার এই আজন্মলালিত পৌরুষের প্রতি লিখেছেন গায়ক-সাংবাদিক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় : যদি একজন্ম-দুইজন্ম বলে কিছু থাকে, তবে যেন পরজন্মে কুকুর হয়ে জন্মাই। যেন চেরা কামুক জিভ হয় আমার, যেন নির্বীর্য, পঙ্গু হয় শিশ্নদণ্ডটি। নারীজন্মের অপমান যেন গিলে খায় পুরীষ পুরুষজন্মকে। যে-অহংকার পুরুষাঙ্গ দিয়েছে আমাকে, সে যেন মাথা তুলে আর দেখতে না পায় এই তপ্ত তমসার ভুবনকে।

যদি বলি পুরুষ হিসেবে আজকে আমার লজ্জা লাগছে— আমার এই ঢঙের লজ্জা ধুয়ে কি জল খাবে সেই মেয়েটি! সেই মেয়েরা! সব মেয়েরা!