একটি স্বপ্নের নিদারুণ অপমৃত্যুর গল্প শোনানো হয়েছে এই ছোট্ট উপন্যাসটিতে। স্বপ্নটির নাম সাম্যবাদ। খেটে-খাওয়া, নিরন্ন, নিরস্ত্র, অসহায়, বঞ্চিত, বিপন্ন, শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে নিয়ে একটি সমাজ গড়ার স্বপ্ন। যেখানে কেউ কাউকে হীন চোখে দেখবে না, কেউ কারো মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেবে না। সবাই হবে সমান।
পৃথিবীর নানা দেশে বহুবার এই সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের হাতে এই সুযোগ তুলে দ্যায়নি, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দ্বারা নিজেরাই ছিনিয়ে এনেছে সুযোগ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজেদেরই হাতে তারা ধ্বংস করেছে সেই সুযোগকে, সেই স্বপ্নকে। কলঙ্কিত করেছে সহযোদ্ধাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে।
দীর্ঘ ৩৪ বছরব্যাপী (১৯৭৭-২০১১) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান, বিবর্তন এবং পতনের গল্পটি সমগ্র পৃথিবীর সাম্যবাদী রাজনীতির নিরিখে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ এই রাজ্যে তারা ছিল : “the longest serving democratically elected communist-led government in the world”. কিন্তু আজকের দিনে এই রাজ্যে তাদের প্রাসঙ্গিকতা প্রায় নেই বললেই চলে। এবং তাদের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ দেখে মনে হয় না খুব শিগগির সেই প্রাসঙ্গিকতা আবার পুনরুদ্ধার করতে পারবে তারা।
কিন্তু স্বপ্ন অবিনাশী। বিপ্লব মরতে মরতেও বেঁচে থাকে। আমরা যারা নিজেদের জীবনের একটা বড়ো অংশ পার করেছি পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট আমলে, দেখেছি তাদের নিরঙ্কুশ রমরমা, উন্নাসিক দ্বিচারিতা এবং আদর্শের ক্রমিক অধঃপতন, আমাদের কাছে এই উপন্যাসের কাহিনিটি ভীষণ পরিচিত। তাদের পতনের প্রায় এক যুগ পরেও আমরা দেখতে পাই, সেই হারিয়ে যাওয়া সাম্যবাদী স্বপ্নটি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে দিগন্তের কাছাকছি— বহু দূরে— হাতের নাগালের অনেক বাইরে।
সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে বাংলা ভাষায় এখন আর রাজনৈতিক উপন্যাস লেখা হয় না (কিছু লেখা হলেও সেগুলো নিরীক্ষার ভারে জর্জরিত)। এই উপন্যাসটি ব্যতিক্রম। আটপৌরে গদ্যে লেখা উপন্যাসটিতে খানিকটা নাটকীয় উপাদান রয়েছে বটে, তবু ২০১১ সালের পালাবদলের মুহূর্তকে যথেষ্ট বিশ্বস্ততার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন সৌরভ মুখোপাধ্যায়। তাঁর রচনার এই অনায়াস অথচ প্রগাঢ় ভঙ্গিটি আমার বরাবর ভালো লাগে।
শ্রেণিবৈষম্যহীন একটি সমাজ গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব কিনা আমি জানি না। মার্ক্সবাদী অর্থনৈতিক এবং সামাজিক তত্ত্বগুলি নিছক অবাস্তব দিবাস্বপ্ন কিনা আমি জানি না। “সর্বহারার একনায়কত্ব” ব্যাপারটি একটি সোনার পাথরবাটি কিনা আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি, এই তত্ত্বটি বাস্তবে প্রয়োগ করার সুযোগ যারাই পেয়েছে, তারাই অপব্যবহার করেছে। কমিউনিজমের উচিত/অনুচিতের তর্ক নয়, একটি জনপদের অসংখ্য মানুষের সম্মিলিত আশাভঙ্গের একটি সাহিত্যিক দলিল হয়ে থাকবে এই উপন্যাসটি।
আমি ক্লান্ত যে, তবু হাল ধরো
আমি রিক্ত যে, সেই সান্ত্বনা
তব ছিন্ন পালে জয়পতাকা তুলে
সূর্যতোরণ দাও হানা
ও আলোর পথযাত্রী
এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না
এ বালুর চরে আশার তরণী তোমার যেন বেঁধো না
ও আলোর পথযাত্রী...