তখন গল্পের তরে

তখন গল্পের তরে

2022 • 152 pages

Ratings1

Average rating4

15

কবিতা বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের সত্যিকারের গর্ব করার মতো জিনিস যদি কিছু থাকে তা হল ছোটগল্প। সেই রবীন্দ্রনাথ আর প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু। তারপর বিভূতিভূষণ পরশুরাম সতীনাথ তারাশঙ্কর মানিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র প্রেমেন্দ্র মিত্র জগদীশ গুপ্ত গৌরকিশোর ঘোষ মতি নন্দী কমলকুমার হাসান আজিজুল হক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আশাপূর্ণা মহাশ্বেতা সত্যজিৎ রায় রমাপদ চৌধুরী বিমল কর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হুমায়ূন আহমেদ শ্যামল গাঙ্গুলি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ইত্যাদি দিকপালদের (দিকপাল আরো অনেক আছেন অবশ্যই, এখানে শুধু আমার প্রিয়দের নামোল্লেখ করলাম) সৃষ্ট অজস্র মণিমুক্তো পেরিয়ে এসে আজকে বেশ জোরগলাতেই বলা যায় : ছোটগল্পের মতো এরকম বহুমুখী সমৃদ্ধ শাখা কি বাংলা সাহিত্যে আর কিছু আছে?

কিন্তু গত শতকের নব্বই দশকের পরে কী যে হলো, যেমনটা বোধহয় হলো বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই, বাংলার আঞ্চলিক নিজস্বতা এবং স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে আন্তর্জাতিকতার গড্ডলিকা-স্রোতে ভেসে গেলেন বেশিরভাগ সাহিত্যিক (“গড্ডল” শব্দের অর্থ ভেড়া। ভেড়ারা তাদের দলের একজন যেদিকে যায়, পিছে পিছে বাকি সবাই সেদিকেই যায়)। শীর্ষেন্দু সুচিত্রা দেবেশ স্বপ্নময়দের মতো কয়েকজন টিমটিম করে জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন খাঁটি বাংলা ছোটগল্পের চিরাচরিত ধারাটি ; কিন্তু নতুন শতাব্দীতে প্রবেশ করে “চিরাচরিত” কিংবা “ধ্রুপদী” শব্দগুলো গালিগালাজে পরিণত হল। আরো আরো আরো বেশি আধুনিকতার খোঁজে নেমে পড়লাম আমরা সবাই। লেখক পাঠক প্রকাশক সম্পাদক সমালোচক— সব্বাই! সরলরৈখিক ছাপোষা প্লটের দিন ফুরাইলো। বাংলা ভাষার দিশি আম্রবৃক্ষশাখে ঝুলতে লাগলো লাতিন আমেরিকার “পোস্ট-মডার্ন” ফল কিংবা পূর্ব ইয়োরোপের বিপ্লবী সুগন্ধে ভরপুর exotic ফল কিংবা জাপানি “বিজার” ফল কিংবা...

বিপদে পড়লো আমার মতো নির্বোধ নিপাট নিরীহ পাঠকরা। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত গল্পে আমরা নিরিবিলি প্লট খুঁজতে লাগলাম। একটা সোজাসাপটা এবং সাদামাটা (এই শব্দ দুটোও বর্তমানে গালিগালাজে পরিণত হয়েছে) গল্প খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু চারিদিকে দেখি শুধু ফর্মের নতুন নতুন কায়দা নিয়ে কচলাকচলি। ভাষার প্রচলিত আদবকে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে নতুন রূপের সন্ধান চলছে। হৃদয় নয়, লেখকরা চাইলেন পাঠকের মস্তিষ্ককে উজ্জীবিত করতে। যে লেখা সহজেই পড়ে ফেলা যায়, যে লেখা পড়তে হলে মগজের কোষকে যোগব্যায়াম করতে হয়না, সেগুলো এলেবেলে সাহিত্য। হুমায়ূন আহমেদ কিংবা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মতো সাবলীল (এটাও গালিগালাজ) গদ্যকাররা “বাজারি লেখক” খেতাব অর্জন করলেন।

এরই মধ্যে দেখতে দেখতে চোখের সামনে উপস্থিত হলো নতুন উপদ্রব। বাংলা সাহিত্যের দুকূল ছাপিয়ে বইতে লাগলো ভূত-প্রেত তন্ত্র-মন্ত্র সাই-ফাই স্পেকুলেটিভ-ডিস্টোপিয়ান— আরো কীসব অত নামও জানিনা ছাই! অগত্যা, আমি “আধুনিক” লেখাপত্তর পড়া বন্ধ করলাম। ফিরে গেলাম আমার চিরপরিচিত আটপৌরে (গালিগালাজ) বাংলা সাহিত্যের পুরোনো জগতে। যেখানে চরিত্ররা সবাই মানুষ, প্রেক্ষাপট আমাদের পরিচিত বাস্তব (গালিগালাজ) পৃথিবী, বিষয়বস্তু প্রাসঙ্গিক। চারিপাশে সবাই যখন আধুনিক (এবং আন্তর্জাতিক) হয়ে উঠতে লাগলো, আমি একটা আশাপূর্ণা দেবীর ঘরোয়া (গালিগালাজ) গল্প, কিংবা একটা গজেন্দ্র মিত্রের গ্রাম্য (গালিগালাজ) গল্প, কিংবা বিমল করের নাগরিক (এই শব্দটা এখনও গালিগালাজ হয়নি) গল্প পড়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে লাগলাম। অনেক চেষ্টা করেও বন্ধুরা আমাকে “আজকালকার সাহিত্য” পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে পারলো না। কেউ ভাবলো আমার নাক উঁচু, কেউ ভাবলো পাঠক হিসেবে আমার “কোয়ালিটি” নিচু। আসল ব্যাপারটা খুব কম মানুষই বুঝলো।

যে-বইটি নিয়ে আলোচনা করবো বলে এই বিস্তারিত শিবের গাজনটি গেয়ে শোনালাম, সেই বইয়ের শিরোনামটি নেওয়া হয়েছে একটি বিখ্যাত বাংলা কবিতা থেকে। এই কবিতাটির রচয়িতা আমাদের দেখিয়েছিলেন, আঞ্চলিকতার লক্ষণ এবং স্থানিক বিষয়বস্তুকে পরিত্যাগ না করেও কীভাবে আধুনিকতার চূড়ান্ত চর্চা করা সম্ভব। কবিতাটির নাম “বনলতা সেন”। কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। আলোচ্য বইটির ব্লার্বে কিছু ভুল কথা লেখা রয়েছে। গল্পগুলোকে বলা হয়েছে “নতুন যুগের গল্প”, “একবিংশ শতকের গল্প”। বলা হয়েছে গল্পগুলো “পুরুষের চোখে” নয়, “নারীর চোখে” দেখা হয়েছে। ইত্যাদি।

কিন্তু বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছে, আসলে তো গল্পগুলো চিরায়ত! ধ্রুপদী বাংলা ছোটগল্পের সুগন্ধে ভরপুর! আসলে তো গল্পগুলো আলাদাভাবে নারীর কিংবা পুরুষের নয়। এগুলো মানুষের গল্প! নারীচরিত্রগুলোকে পাল্টে দিয়ে পুরুষচরিত্র হিসেবে দেখালেও হিসেবের বিশেষ হেরফের হতো না। এমন সহজিয়া সাবলীল গদ্যভাষা, প্লটের এমন সুবিন্যস্ত গঠন, আটপৌরে ঘরোয়া প্রেক্ষাপটের ছায়ায় ঢাকা, বাস্তব মানুষের বাস্তব ঘরদুয়ার, অন্দর বাহির, মনের গহীন জটিলতা, মানুষের দৈনন্দিন মাপা-হাসি এবং চাপা-কান্নার এরকম সাবেকি প্রকাশ— বহু বহুদিন পরে আমার দৃষ্টিগোচর হলো! মুগ্ধ হয়েছি রিফাত আনজুম পিয়া-র ছোটগল্পগুলি পড়ে। বোদ্ধা পাঠকদের মগজের পুষ্টিসাধন হবে কিনা জানিনা, তবে লেখকের গল্পবলার মুন্সিয়ানা যে আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে, এ কথা আমি হলপ করে বলতে পারি।

এই বই আমার কিছুতেই পড়া হতোনা, বন্ধু আঞ্জুমান লায়লা নওশিনকে যদি জিজ্ঞেস না করতাম যে, ২০২২ সালে তার পড়া সবচেয়ে প্রিয় বই কোনটা। সে আমাকে বইয়ের নাম বলেই চুপ থাকেনি, বইটা কিনে সটান পাঠিয়ে দিয়েছে আমার বাড়িতে। তখন ভেবেছিলাম এ হয়তো নেহাতই তার সহৃদয় বন্ধুকৃত্য। বইটা পড়ার পরে এখন বুঝতে পারি, আমিও হয়তো এই একই কাজ করতাম। পরিচিত পাঠক, যাঁরা আমার মতো “সরল সোজা” গল্প পড়তে পছন্দ করেন, তাদের হাতে বইটা তুলে দিয়ে বলতাম, বইটা প্লিজ পড়ুন। লেখকের প্রথম বই, এখনও তেমন পরিচিতি অর্জন করেননি, কিন্তু তবুও পড়ুন। নওশিনের মতোই বইয়ের ভিতরে দৃঢ় অক্ষরে লিখে দিতাম : “পৃথিবীটা বইপড়ুয়াদের হোক!” এবং তার মতোই বারবার তাড়া দিতাম : বইটা পড়েছেন? পড়েছেন বইটা? এখনও পড়া শুরু করেননি? শুরু করেননি এখনও? সেকি!

শেষ হয়েও রয়ে যায় গল্পগুলোর শীতাতপ রেশ, চরিত্রদের উপস্থিতি ঘুরতে থাকে মাথার ভেতর। মনে পড়ে যায় “বনলতা সেন” কবিতাটির অন্তিম কয়েকটা লাইন :

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতনসন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজনতখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল ;সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন ;থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার...

আরো অনেক পাঠকের হাতে উঠে আসুক এই দারুন গল্পগুলো।


November 26, 2023