Ratings1
Average rating4
বই নিয়ে আমাদের প্রায় সবারই কমবেশি রোমান্টিকতা আছে। কেউ হয়তো কাগুজে বই পড়তে পছন্দ করেন, কেউ ইবুক, কেউ বা কাজের ফাঁকে অডিওবুক। একটা বই পড়ার পরে আমরা সেই বইটির বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করি। গুডরিডসে/ফেসবুকে রিভিউ লিখে আমাদের ভালোলাগা/মন্দলাগার কথা আরো পাঁচজনকে জানাই। কেউ কেউ ইউটিউবে ভিডিও বানিয়ে বইটির ব্যাপারে কথা বলি। কিন্তু সবকিছুর বাইরে গিয়ে, শুধুমাত্র “বই” নামক বস্তুটিকে নিয়ে কতোটা চিন্তা করি? বইয়ের প্রচ্ছদ, কাগজ, হরফের রকমসকম, বাঁধাই, অলংকরণ— পাঠক হিসেবে আমাদের অবচেতনে এই বিষয়গুলো ঘোরাফেরা করে হয়তো, কিন্তু বইয়ের নির্মাণগত দিকটি নিয়ে আমরা প্রায় কেউই সচেতনভাবে চিন্তা করিনা।
কীভাবে তৈরি হয় একটা বই? একটা বইয়ের “বই” হয়ে ওঠার পিছনে সবটুকু দায় কি লেখকের? নাকি প্রকাশকও সেই দায়ের ভাগীদার? বইটি যিনি মুদ্রণ এবং বাঁধাই করলেন, তিনি ভাগীদার নন? বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো যিনি ডিজাইন করলেন? যিনি অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে প্রুফ সংশোধন করলেন? এমনকি, বইটি যিনি বিক্রি করলেন, তিনি?
একজন খ্যাতনামা প্রকাশক গ্রন্থনির্মাণকে বলেছিলেন “অদৃশ্য শিল্প”। বইতে ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে সেগুলো আমাদের চোখে পড়ে এবং আমরা বিরক্ত হই (বেশি বিরক্ত হলে সোচ্চার হই)। কিন্তু ত্রুটির পরিমাণ যখন কম থাকে কিংবা বইটির পরিবেশনগত গুণমান যখন আমাদের পছন্দসই হয়, আমরা কিন্তু প্রায় কখনোই বলিনা, আহ, বইয়ের হরফগুলো দেখতে কী সুন্দর! বইয়ের কাগজের রংটা চোখের পক্ষে কী আরামদায়ক! পৃষ্ঠার লে-আউটটা কী চমৎকার! অথচ কেউ-না-কেউ যত্ন নিয়ে এইসব ভেবেছেন এবং তাঁর ভাবনাকে গ্রন্থটি নির্মাণের কাজে প্রয়োগ করেছেন। এটা জেনেও যে, তিনি তাঁর পরিশ্রমের কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পাবেন না। সেই জন্যই, গ্রন্থনির্মাণ একটি “অদৃশ্য শিল্প”।
যদিও অনেকেই কিন্তু “বই” নিয়ে ভাবছেন। মুদ্রণসৌষ্ঠবকে আরও পাঠকবান্ধব করার জন্য মাথা ঘামাচ্ছেন। নতুন নতুন টাইপফেস (আমরা যাকে খানিকটা ভুল করে “ফন্ট” নামে ডাকি) ডিজাইন করছেন। বইনির্মাণের সঙ্গে যুক্ত হাজারো খুঁটিনাটি বিষয়ে প্র্যাকটিকাল উদ্যম ব্যয় করছেন। এই বইটির লেখক তেমনই একজন মানুষ। বইয়ের ৩৮টি ছোট ছোট প্রবন্ধে তিনি পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন একটি অদৃশ্য দিগন্ত। যে-দিগন্তে আমরা প্রতিনিয়ত ঘুরেফিরে বেড়াই, অথচ চোখ মেলে তাকাই না।
বইটা পড়ে আমি প্রভূত আনন্দলাভ করেছি। এতোটাই যে, ইচ্ছে করেই একটানা পড়িনি, যাতে শেষ না হয়ে যায়। কত যে আকর্ষণীয় এবং অভিনব তথ্যে ভরপুর এই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো! একটা উদাহরণ দিই। “প্যানগ্রাম” কাকে বলে আমরা অনেকেই জানি। কোনো ভাষায় লেখা সাধারণত অর্থবহ এমন একটি বাক্য, যাতে সেই ভাষার বর্ণমালার যাবতীয় অক্ষরসমূহ স্থান পায়। ইংরিজি ভাষার সবচেয়ে পরিচিত প্যানগ্রামটি আমরা সবাই জানি :
The quick brown fox jumps over a lazy dog.
এই বাক্যটিতে A থেকে Z সবকটা অক্ষর আছে। কিন্তু বাংলা ভাষারও যে প্যানগ্রাম আছে তার ব্যাপারে আমি অন্তত এতোদিন কিছুই জানতাম না। এই বইতে উল্লেখিত দুটো বাংলা প্যানগ্রামের একটা :
বিষন্ন ঔদাসীন্যে ঊষাবৌদি বাংলা ভাষায় প্রচলিত ঈশপের নিখুঁত গল্পটির অর্ধেক বলতেই ঋতু ভুঁইঞা আর ঐন্দ্রিলা দারুণ হৈ হৈ করে উঠল— ওঃ, ব্যাস্, এবার থামো! বুঝেছি, বড্ডো পুরানো ঢঙের কেমন এক গল্প যার নীতিবাক্য হল— ‘মূঢ় আড়ম্বর ও আত্মশ্লাঘার ফল জীবনে বিঘ্ন ও বৃহৎ ক্ষতি'— তাই না, অ্যাঁ?
(প্যানগ্রামটি তৈরি করেছেন মনোজকুমার মিত্র)
“বই” নামক অতিপ্রিয় বস্তুটির হালহদিশ জানবার এমন বই বাংলা ভাষায় এখনও পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। ইংরিজিতেও আছে কি? বাংলা হোক বা ইংরিজি, কারো জানা থাকলে দয়া করে আমাকে জানাবেন।
পুনশ্চ : প্রতিক্ষণ প্রকাশনীর বইয়ের গুণমান এমনিতেই সুরুচিসম্পন্ন হয়; কিন্তু বিষয়বস্তু এবং সৃজনশীল নির্মাণ— দু'দিক দিয়েই বইটি এত দুর্দান্ত, হাতে নিলে আর নামিয়ে রাখতে ইচ্ছে করেনা!