সূর্য কাঁদলে সোনা
সূর্য কাঁদলে সোনা
আমেরিকার নাম “আমেরিকা” না হয়ে “কলম্বিয়া” হতে পারতো। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্রিস্টোফার কলম্বাস জেদ ধরে বসেছিলেন যে তিনি এশিয়া মহাদেশ খুঁজে বের করেছেন, সম্পূর্ণ নতুন একটি মহাদেশ নয়। কলম্বাসের কপাল মন্দ, তাঁকে উপেক্ষা করে আমেরিকা মহাদেশের নামকরণ করা হয়েছে ইতালিয়ান অভিযাত্রী আমেরিগো ভেসপুচি-র নামে। উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা মিলিয়ে গোটা মহাদেশকে সেই সময় “নিউ ওয়ার্ল্ড” নামে ডাকা হতো, অর্থাৎ কিনা পূর্বে অজ্ঞাত সম্পূর্ণ নতুন একটি জগৎ। নতুন জগৎ মানে নতুন সম্ভাবনা। নতুন ধরনের মানুষ। নতুন ধরনের সভ্যতা। নতুন ঐশ্বর্য। নতুন লোভ। নতুন রক্তপাত।
ইয়োরোপীয় ঐতিহাসিকরা ঘটা করে সেই যুগটার নাম রেখেছেন “এইজ অভ ডিসকভারি”— “আবিষ্কারের যুগ”। আবিষ্কারের যুগ ঠিকই, কিন্তু নতুন মহাদেশ কিংবা নতুন সম্ভাবনার আবিষ্কার নয়। সত্যি কথা যদি মানতে হয়, মানুষ নামক একটি প্রাণীর রক্তপিপাসা (অন্য কোনও প্রাণীর নয়, মানুষেরই রক্ত), সম্পদের লালসা, অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা, অবিশ্বাস্য বর্বরতা, এইসব গুণগুলো নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল সেই সময়। নানারকম বৈজ্ঞানিক উন্নতির হাত ধরে মানুষ যত বেশি “সভ্য” হয়েছে, মানুষের জান্তব নগ্ন রূপটা তত বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের দুঃখ করার কারণ নেই। “মৃত্যুর পরপার” বলে যদি কিছু থাকে, সেখানে বসে তিনি নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছেন, তাঁর খুঁজে বের করা সামুদ্রিক রাস্তা দিয়ে ধেয়ে গেছে একের পর এক পৈশাচিক অভিযাত্রীদের দল, এবং লুটেপুটে তছনছ করেছে “নিউ ওয়ার্ল্ড” নামের সম্পদভাণ্ডারকে।
১৫২১ সালে এর্নান কর্তেস নামের একজন স্প্যানিশ অভিযাত্রী দক্ষিণ আমেরিকার মেহিকো অঞ্চলের “অ্যাজটেক” নামের একটি আঞ্চলিক সভ্যতাকে জয় করেছিলেন। তখনকার এই স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের “কনকিস্তাদর” (conquistador) নামে ডাকা হতো। অ্যাজটেক ছিল একটি সুসংবদ্ধ এবং সম্পদশালী সভ্যতা। পরাজিত এই সভ্যতাকে ধর্ষণ করে, তার সম্পদ লুণ্ঠন করে, পাঠানো হলো স্পেনের রাজার দরবারে। সেই সম্পদের পরিমাণ দেখে রাজাগজা থেকে শুরু করে স্পেনের সাধারণ মানুষ, সবার চক্ষু চড়কগাছ। শোনা গ্যালো এই নাকি শেষ নয়, নিউ ওয়ার্ল্ডে আছে এরকম আরও অনেক সভ্যতা। সেখানে আছে আরও অনেক সম্পদ। অফুরন্ত সম্পদ! ব্যাস, আর কী, কনকিস্তাদর নামের অভিযাত্রীরা দলে দলে পাড়ি জমাতে থাকলো অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে সেই নতুন পৃথিবীতে।
ফ্রান্সিস্কো পিজারো নামের একজন কনকিস্তাদর শুনেছিলেন এমনই একটি নতুন সভ্যতার কথা। সূর্য থেকে যেমন অঝোরধারায় রশ্মি ঝরে পড়ে, সেই দেশে নাকি স্বর্ণের সেরকমই অকল্পনীয় প্রাচুর্য। কিন্তু কোথায় সেই সভ্যতা? কীভাবে যাওয়া যায় সেখানে? দুবার চেষ্টা করেও বিফল হলেন পিজারো। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। তৃতীয়বারের চেষ্টায় খুঁজে পেলেন, দক্ষিণ আমেরিকারই নতুন আরেকটি সভ্যতা, আয়তনে এবং প্রাচুর্যে যারা মেহিকোর অ্যাজটেকদের চেয়েও বৃহৎ। সেই সভ্যতার নাম “ইনকা” (বর্তমানে পেরু এবং চিলে নামের দেশ যেখানে আছে, সেখানেই ছিল এই সভ্যতা)। সেইসময় ইনকাদের জনসংখ্যা ছিল এক কোটিরও বেশি। সেখানকার সম্রাট ছিলেন অতুল প্রতাপশালী। বিপুল শক্তিসম্পন্ন তাঁর সৈন্যবাহিনী। এই ভয়ংকর ইনকাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে পিজারোর অধীনে রয়েছে মাত্র... শুনলে হাসি পাবে... মাত্র ১৬৮ জন স্প্যানিশ সৈন্য!
শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কিন্তু আর হাস্যকর রইলো না। মুষ্টিমেয় ওই কয়েকজন সৈন্য নিয়েই, স্রেফ নৃশংস চতুরতা এবং অবিশ্বাস্য কপালজোরে, ইনকাদের প্রবল পরাক্রমশালী সম্রাট অ্যাতাহুয়ালপা-কে বন্দী করে ফেলেছিলেন ফ্রান্সিস্কো পিজারো! কীভাবে সম্ভব?! হ্যাঁ সম্ভব তো হয়েছিল বটেই, পরবর্তী ঘটনাক্রম ছিল আরো মর্মান্তিক। সুগঠিত একটি প্রাচীন সভ্যতাকে প্রায় চোখের নিমেষে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল আগন্তুক স্প্যানিশ নেকড়ের দল। প্রেমেন্দ্র মিত্রের “সূর্য কাঁদলে সোনা” উপন্যাসটি ইনকা-বিজয়ের সেই চমকপ্রদ (এবং দুঃখজনক) কাহিনিকে ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। প্রায় চারশো পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি শুধু ঘনাদা সিরিজের নয়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা সবচেয়ে বড় উপন্যাস। এই উপন্যাসটিকে বাংলায় লেখা সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছি না। যারা ইতিমধ্যে পড়েছেন (কিংবা ভবিষ্যতে পড়বেন) তারাও দ্বিধা করবেন না এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
বাংলা কিশোর সাহিত্যে অনেক দাদা আছেন। এঁদের মাঝে ঘনাদা (ভালো নাম ঘনশ্যাম দাস) একটু অন্যরকম দাদা। যদিও তিনি একজন প্রতিভাবান গুলবাজ, কিন্তু তার গুলমার্কা গল্পগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে বিজ্ঞান কিংবা ভূগোল কিংবা ইতিহাসের কোনও চিত্তাকর্ষক বৃত্তান্ত। সত্যি কথা বলতে, পাঠক হিসেবে বয়স যখন অল্প ছিল, ঘনাদাকে আমি পছন্দ করতাম না। ইশকুলের বইপত্রে বিজ্ঞান ইতিহাস ভূগোলের গুঁতোয় এমনিতেই জর্জরিত হয়ে ছিলাম। গল্পের বইতেও এইসব পড়ে (তা যতোই চিত্তাকর্ষক হোক না ক্যানো) উপভোগ করার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্তর আমি ছিলাম না। তাই ঘনাদা-গল্পের মজা পেয়েছি অনেক পরে (ইশকুলের বইপত্রের গুঁতো যখন একটু স্তিমিত হয়ে এসেছে)। অনেক পরে বুঝেছি, প্রেমেন্দ্র মিত্র একজন জিনিয়াস। অনেক পরে বুঝেছি, ঘনাদাকে নিয়ে আরও অনেক বেশি মাতামাতি হওয়া উচিৎ!
“তথাকথিত বাংলা কিশোর উপন্যাস”-এর চাইতে “সূর্য কাঁদলে সোনা” একটু আলাদা। বাংলা কিশোর সাহিত্যে নারী চরিত্রদের সচরাচর দূরে সরিয়ে রাখা হয় (খুকুদের সংস্পর্শে এলেই নির্বোধ খোকারা যদি দুষ্টু হয়ে যায়!) কিন্তু এই কাহিনিতে বেশ গুরুতর দুজন নারী চরিত্র আছেন। তাদের মধ্যে একজন তো আবার গল্পের নায়ককে সিডিউস করতে উঠে পড়ে লেগেছেন! কিন্তু নারীঘটিত ব্যাপারটা বাদ দিলেও আরেকটা বড় রহস্য আছে। এমন দুর্ধর্ষ ঐতিহাসিক প্লট, রচনার এমন চমৎকার শৈলী, গল্পের এতরকম রুদ্ধশ্বাস বাঁকবদল, দুর্দান্ত উপস্থাপনা, আকর্ষণীয় সব চরিত্র (বাস্তব এবং কাল্পনিক, দুরকমই), সবমিলিয়ে এমন জমজমাট এবং রোমাঞ্চে ভরপুর একটি উপন্যাস, যা কিনা অন্য যেকোনো কিশোর উপন্যাসকে দশ গোলে ধরাশায়ী করতে পারে (হ্যাঁ, “চাঁদের পাহাড়”কে ধরে নিয়েই বলছি)— তবু এই উপন্যাসটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই নেই। কোনো মাতামাতি নেই। কোনো লাফালাফি নেই। ক্যানো?!
ক্যানো?! ক্যানো?!! ক্যানো?!!!