জলের উপর পানি

জলের উপর পানি

432 pages

Ratings1

Average rating5

15

প্রথমেই স্বীকার্য, গত কুড়ি বছরে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্য আমি খুব বেশি পড়িনি। তাই সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের হালচাল আমি খুব ভালো জানিনা। পূজাবার্ষিকীর কল্যাণে আগে নিয়মিত সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাণী বসু কিংবা সুনীল-শীর্ষেন্দু পড়তাম। কে জানতো, এইসকল আনন্দবাজারীয় ধনুর্ধরদের পাশাপাশি, আমার মতো অনেক বে-খবর পাঠকের অগোচরে, অসামান্য সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন দু-একজন প্রতিভাবান সাহিত্যিক। এদের মধ্যে স্বপ্নময় চক্রবর্তী, খুব সম্ভবত, সৃষ্টির উৎকর্ষতার দিক দিয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন।

স্বপ্নময়কে আমি চিনতাম মূলত ছোটোগল্পের লেখক হিসেবে। একটাই উপন্যাস পড়েছিলাম, “চতুষ্পাঠী”— এবং পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সাপ্তাহিক “রোববার” পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার সময়ে “হলদে গোলাপ” উপন্যাসটি বিচ্ছিন্নভাবে পড়তে গিয়ে বুঝেছি, বৃহৎ আকারের উপন্যাস রচনাতেও স্বপ্নময়ের কব্জি যথেষ্ট চওড়া। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে “হলদে গোলাপ” একটি মাইলস্টোন। কিন্তু স্বপ্নময়ের ম্যাগনাম ওপাস যদি বলতে হয়, আমার মতে “হলদে গোলাপ” নয়, সেটা অবশ্যই “জলের উপর পানি”।

আমরা যখন কোনো মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশি, সেই মানুষটার একটা মানসিক অবয়ব তৈরি হয় আমাদের মনে। সেই মানুষটার ব্যাপারে একটা ধারণা তৈরি করি আমরা। তার সঙ্গে নিজের পছন্দ-অপছন্দ সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা করি। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়। ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনার আদানপ্রদান করার পরিসর তৈরি হয়। কিন্তু একদিন যদি হঠাৎ বুঝতে পারি, মানুষটিকে যেমনটা চিনতাম সে আদৌ সেরকম নয়। একদিন যদি মনে হয়, কে এই মানুষটা? এর সঙ্গেই কি মিশেছি এতদিন! আয়না ভেঙে গিয়ে প্রতিচ্ছবি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের চেতনার উতরাই সিঁড়িতে।

ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষরা যখন তাদের আজন্মের বাসভূমি ত্যাগ করে নতুন দেশে পদার্পণ করে, তাদের মনে অনেকটা একইরকম চিন্তার উদয় হয়। বহুদিনের পরিচিত ভূখণ্ডের যে-প্রতিচ্ছবি তারা হৃদয়ে লালন করে এসেছে জন্মাবধি, সেটা ভেঙে ছত্রখান হয়ে যায়। নিজের পুরাতন জগৎকে মনে হয় স্বপ্ন। নিজের সত্তাকে মনে হয় অচেনা। অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকা একটা সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে সে ভাবতে থাকে, যা চিনেছি যা বুঝেছি যা দেখেছি যা মেনে এসেছি এতদিন, সবই কি তবে ভ্রম? সবই কি ভুল? সাঁকোর দুলুনি ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

দেশভাগ এবং উদ্বাস্তুজীবন নিয়ে কথকতা বাংলা সাহিত্যে অসংখ্যবার করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অতি সমৃদ্ধ একটা অংশ জুড়ে রয়েছে অগণিত ছিন্নমূল মানুষের অশ্রুবাষ্প, বিষাদকুয়াশা। পঁচাত্তর বছর পূর্বের দেশভাগের ক্ষতচিহ্ন আজও রয়ে গেছে বাঙালিজাতির সম্মিলিত মননে। তাই সমাজসচেতন কথাসাহিত্যিক এতযুগ পরেও দেশভাগের বিপন্নতার মধ্যে থেকে খুঁজে নেন তাঁর উপন্যাসের রসদ, তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা। এই উপন্যাসটি লেখার জন্যে যে-বিশদ গবেষণা করেছেন স্বপ্নময়, দুই বাংলা ব্যাপী যে-বর্ণময় পটভূমির বিস্তার করেছেন, তা আমাকে বিস্মিত করেছে। “মুগ্ধ করেছে” বলতে পারতাম, কিন্তু যন্ত্রণার কোরাকাগজে মুগ্ধতার জলছাপ ফুটে ওঠেনা।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা অদৃষ্টের হস্তক্ষেপে দেশভাগ হয়নি। দেশভাগ হয়েছিলো মুষ্টিমেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সীমাহীন অপদার্থতার কারণে। দেশভাগ বিষয়ক কিছু পড়তে গেলে আমি খুব অবাক হই। ঈশ্বর নাকি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। ঈশ্বরের ক্ষমতা কি মানুষের চেয়েও বেশি? ঈশ্বর কি পারেন নিজের অহংকে তৃপ্ত করার উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে? ঈশ্বর কি পারেন ধর্মের নামে মানুষের পশুপ্রবৃত্তির বগলে সুড়সুড়ি দিতে? আমার মস্তিষ্কে দামামার মতো বাজতে থাকে— এই দেশভাগ হওয়ার কথা ছিলো না। এই দেশভাগ আটকানো সম্ভব ছিলো। খুব নিশ্চিতভাবে সম্ভব ছিলো। সত্যিই কি সম্ভব ছিলো?

হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং একাত্মবোধ নিয়ে কতো ভাবনা ছড়িয়ে আছে। মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ। স্বাধীনতাপূর্ব অবিভক্ত বাংলাদেশের আর্থসমাজব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্কের যা-কিছু বিবরণ আমি শুনেছি/ পড়েছি, তার পরে এই ধরণের ছড়াকে ছেলেভুলানো ছড়া বলে মনে হয়। যদি একই বৃন্তে দুটি কুসুম হতো, তবে মুসলমানদের খেতে দেওয়ার জন্যে আলাদা থালা-বাটি-গ্লাসের ব্যবস্থা রাখতে হতো না। আলাদা হুঁকো-তামাকের ব্যবস্থা রাখতে হতো না। একে অপরের অন্দরমহলে অবাধ প্রবেশ করার “অধিকার” থাকতো। উঠোনে দাঁড়ালে সেই মাটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ফেলে দেওয়া হতো না। এই চূড়ান্ত অপমানজনক সহাবস্থান যখন দীর্ঘদিন যাবৎ চলতে থাকে, এবং সেই সঞ্চিত অপমানরাশি যদি একদিন ভিসুভিয়াসের মতো লাভা উদগীরণ করে, তবে কাকে দায়ী করবো? মানুষকে? রাজনীতিবিশারদকে? নাকি স্বয়ং ঈশ্বরকে?

স্বপ্নময় চক্রবর্তীর এই উপন্যাসের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি অনেক অপ্রিয় সত্যিকথাকে পরিত্যক্ত কুয়োর গভীর থেকে উঠিয়ে এনেছেন। দেশভাগ-বিষয়ক সাহিত্যের স্বাভাবিক রোমান্টিসিজমকে বজায় রেখেও তিনি উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বুনে দিয়েছেন তিক্ত প্রশ্নের বীজ। মানুষ মানুষের সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করেনি। মানুষই তৈরি করেছে মানুষের নিয়তি। সেই নিয়তির কুঠারের আঘাতে মানুষ হারিয়েছে নিজের প্রাণ, নিজের প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মসম্মান, মনুষ্যত্ব, মান ইজ্জত, ভিটে মাটি, পুকুর দীঘি, দীঘির জলে প্রতিবিম্বিত আকাশের চাঁদ, ভোরের পাখির কূজন, বিকেলের চন্দনচর্চিত হাওয়া, সন্ধ্যার নিবিড় কুহেলিকা, একত্রে মিশে যাওয়া শঙ্খের ধ্বনি আর আজানের আহ্বান। নির্নিমেষ স্তব্ধতা।

লাল জামা গায়ে নীল জামা গায়ে
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রঙ বদলায়
দিন বদলায় না।

October 11, 2022