Antigone

Antigone

1944 • 123 pages

Ratings18

Average rating4.2

15

অ্যান্টিগনির গল্পটা আমরা অনেকেই জানি। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম শতকে গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিস তাঁর বিখ্যাত ইডিপাস সাইকেল-এর নাটক ৩টি লিখেছিলেন (ইডিপাস রেক্স, ইডিপাস অ্যাট কলোনাস, এবং অ্যান্টিগনি), যেগুলো আজ থিবান প্লেইস নামে পরিচিত। সফোক্লিসের অ্যান্টিগনি গত আড়াই হাজার বছর ধরেই নানা কারণে আলোচিত হয়ে আসছে। সফোক্লিস-পরবর্তী যুগে ইতিহাস বা সাহিত্যের পাতায় যখনই কোন বিপ্লবী (বিশেষত) নারী চরিত্র এসেছেন, যিনি কী না কোন মহান উদ্দেশ্যে নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করেছেন, তাঁকেই সে যুগের অ্যান্টিগনি উপাধি দেয়া হয়েছে। অ্যান্টিগনি কে, এবং কেন তিনি ইতিহাসে বারবার আলোচিত হয়ে আসছেন-এ বিষয়ে যাঁদের জানা নেই, তাঁদের জন্য সংক্ষেপে অ্যান্টিগনির উপাখ্যানটি এখানে দিয়ে রাখছি। সফোক্লিসের অ্যান্টিগনি-পুরাণ এর কচকচি সেরেই আমরা জাঁ আনুইল-এর আধুনিক অ্যান্টিগনি-এর দিকে চোখ ফেরাবো।

রাজা লাইয়াস ও রাণী জোকাস্টার ঘর আলো করে যখন তাঁদের পুত্র সন্তান ইডিপাস জন্মগ্রহণ করেন, দেবতারা অভিশাপ দিয়ে বসেন (কারণ, অভিশাপ দেবার কাজটাই দেবতারা সবচেয়ে ভালো পারেন), ইডিপাস বড় হয়ে তাঁর আপন পিতা লাইয়াসকে হত্যা করবে, এবং মাতা জোকাস্টাকে বিয়ে করবে। এহেন ভয়ানক দৈববাণী শুনে লাইয়াস ও জোকাস্টা ইডিপাসকে নদীতে ভাসিয়ে দেন, কিন্ত দেবতাদের লীলাখেলা বোঝা বড় দায়! ইডিপাস বেঁচে যান, এবং ভিন্ন এক রাজ্যের রাজার পালিত সন্তান রূপে বড় হতে থাকেন। পরিণত বয়েসে ইডিপাস তাঁর পিতা লাইয়াসের রাজ্যে গিয়ে নিজের অজান্তেই লাইয়াসকে হত্যা করেন, এবং বিধবা জোকাস্টাকে বিয়ে করেন (সেও তাঁর অজান্তেই)। জোকাস্টার সাথে ইডিপাসের ৪টি সন্তান হয়ঃ দুই পুত্র পলিনেসেস, ও এটিওক্লেস, এবং দুই কন্যা ইজমিন, ও অ্যান্টিগনি।

পলিনেসেস ও এটিওক্লেস-কথা ছিলো এ দু'ভাই মিলে পালা করে দেশ শাসন করবে। একজন এক বছর, তো অপর জন পরের বছর। কিন্তু ক্ষমতার লোভ দু'জনকেই পেয়ে বসে; দু'জনই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, এবং দু'জনই এ যুদ্ধে প্রাণ খোয়ায়। রাজ্য শাসনের ভার এবার এসে পড়ে তাদের মামা, জোকাস্টার ভাই ক্রেওণের ওপর (যিনি মূলত ইডিপাসেরও মামা)। ক্রেওণ সিংহাসনে বসে প্রথমেই ঘোষনা দেন, এটিওক্লেস যেহেতু পূর্ববর্তী রাজা ছিলো, তাই মহাসমারোহে তার শেষকৃত্য সম্পাদন করা হবে, আর রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা বদমায়েশ পলিনেসেস-এর মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে থাকবে, তা শেয়াল-কুকুর-শকুনে ঠুকরে খাবে। কেউ যেন সে মৃতদেহের ধারেকাছে না যায়, বা কবর দেবার চেষ্টা না করে। এর ব্যত্যয় ঘটলেই মৃত্যুদণ্ড। ক্রেওণ-এর এ ঘোষণায় অ্যান্টিগনি-এর তীব্র ভ্রাতৃপ্রেম জেগে ওঠে, এবং সে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে পলিনেসেস-এর পঁচে গলে যাওয়া মৃতদেহ কবর দেবার অভিযানে নামে। শেষরক্ষা হয় না, অ্যান্টিগনি হাতেনাতে ধরা পড়ে, এবং প্রহরীরা তাকে টেনেহিঁচড়ে ক্রেওণের সামনে এনে হাজির করে। এখানে বলে রাখা ভালো, অ্যান্টিগনি ক্রেওণের ভাগনিই নয় শুধু, ক্রেওণের পুত্র হিমনের দয়িতাও বটে। হবু পুত্রবধুকেই নিজের আদেশ অমান্য করতে দেখে ক্রেওন যারপরনাই বিস্মিত ও রাগাণ্বিত হন, এবং এহেন বেয়াড়া আচরণের হেতু কী জানতে চান। জবাবে অ্যান্টিগনি বলে নিজের রক্তের সম্পর্কের জন্য সবরকম ত্যাগ স্বীকার করতে সে প্রস্তুত; নিজের পরিবারের একজন সদস্যের সম্মান রক্ষায় সে মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করতে জানে। একদিকে হবু পুত্রবধূকে শায়েস্তা না করতে চাইবার ইচ্ছে, অপরদিকে শাসক হিসেবে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করবার প্রেষণা-এ দুইয়ের যাঁতাকলে পড়ে যাওয়া ক্রেওণ শেষতক অ্যান্টিগনিকে মৃত্যুদন্ডেই দণ্ডিত করেন।

নিজ ধর্ম এবং পারিবারিক সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে অ্যান্টিগনি হেরে গিয়েও জিতে যায় এবং যুগে যুগে বিপ্লবীরা অ্যান্টিগনির অবতার হয়েই ফিরে আসে-মোটামুটি এই বক্তব্য দাঁড় করিয়ে অ্যান্টিগনিকে ট্র্যাজিক হিরো বানিয়ে সফোক্লিস তাঁর নাটকের উপসংহার টেনেছেন।

অ্যান্টিগনির মতো এমন ট্র্যাজিক হিরোর উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় বেশ কয়েকটিই আছে; তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণটি প্রায় সাতশ বছর আগের। ১৪ শতকে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের একশ বছর ধরে চলা যুদ্ধে ফ্রান্স যখন প্রায় ব্রিটেনের করাল থাবায়, যুদ্ধের ডামাডোলে ভয়ানক অর্থকষ্টে ভোগা ফ্রান্সের জনগণকে ফরাসী জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলো ১৮ বছরের এক কিশোরী-যাকে আজ আমরা জোয়ান অফ আর্ক নামে জানি। রাজনীতির প্যাঁচে ফেলে ফরাসী ক্যাথলিক চার্চ ও ব্রিটিশরা জোয়ানকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে। ফরাসীরা জোয়ানের মাঝে অ্যান্টিগনির ছায়াই খুঁজে পান। সফোক্লিসের অ্যান্টিগনির বয়েস ছিলো ২০, আর জোয়ানের ১৮। এঁরা দুজনই যাঁর যাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিলেন। জোয়ান দাবী করতেন, তিনি নাকি স্বপ্নে নির্দেশপ্রাপ্ত হতেন ফ্রান্সের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে। যে দুজন সন্ত জোয়ানের স্বপ্নে এসে তাঁকে বিপ্লবের এ উৎসাহ দিয়ে যেতেন, তাঁরা হলেন সেইন্ট ক্যাথেরিন, ও সেইন্ট মার্গারেট। এ দু'জনই ১৩/১৪ বছর বয়েসে নিজেদের খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন রোমানদের হাতে। ধর্ম রক্ষার তাগিদে ক্যাথলিক চার্চ ও অর্থোডক্স চার্চ এই দুই কিশোরীকে পূজোর সামগ্রী বানিয়েছে। ওদিকে সফোক্লিসের অ্যান্টিগনি যে তার ভাই পলিনেসেস-এর অনাদরে ফেলে রাখা মৃতদেহটির সৎকার করতে চায়, সেও প্রাচীন রীতিনীতি ও ধর্ম রক্ষার তাগিদেই। ক্রেওণ যখন জিজ্ঞেস করে কেন ভাইয়ের কবর দেয়া নিয়ে অ্যান্টিগনি অত উতলা, তার জবাব আসে,

“মরা লাশের কবর হইলো আসমানী হুকুম;
ব্যাবাকেরই দরকার এইটা, যেমুন দরকার বাথরুম”

নৃপতির হুকুম অমান্য করে আপন ভাইকে কবর দিতে গিয়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অ্যান্টিগনি (কিংবা সফোক্লিস) আমাদের একটা ছবক দিতে চেয়েছেনঃ পরাজয় নিশ্চিত জানবার পরও নিজের যা কিছু আপন (দেশ, ধর্ম, রাজনৈতিক দল, জাতীয়তাবাদ, পরিবার...), সেগুলোর পক্ষে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হয়, নিজের অবস্থানটা শক্তভাবে জানিয়ে দিতে হয়। বিপ্লবীরা জানেন, তাঁদের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা সবসময়ই শূণ্যের কোঠায়, তবুও তাঁরা নিজেদের দাবীর সাথে কখনো আপোষ করেন না। অ্যান্টিগনি, জোয়ান অফ আর্ক, প্রীতিলতা...এঁরা সবাই একই মালার পুঁতি বিশেষ।

কিন্তু...কিন্তু, নিজের যা কিছু আপন, সেগুলো কি সবসময়ই ‘ভালো'? যেকোন পরিস্থিতিতেই কি নিজের একান্ত আপন ব্যক্তি বা বস্তু বিশেষের জন্য আনুগত্য দেখানো উচিৎ? ঠিক এ প্রশ্নে এসেই জাঁ আনুইল আড়াই হাজার বছর ধরে গড়ে তোলা অ্যান্টিগনির সুউচ্চ বিপ্লবী মূর্তিটি ভেঙে চুরমার করে দেন। আপনার নিজের যে দেশ বা জাতি বা পরিবার বা ধর্মবিশ্বাস, সেটির প্রতি আপনার লাগামহীন ভালোবাসা থাকতেই পারে, কিন্তু সার্বিক বিচারে আপনার জাতি বা দেশটি বা পরিবারটি বা ধর্মবিশ্বাসটি কি আপনার এমন শর্তহীন ভালোবাসা আর আনুগত্যের উপযুক্ত? আপনার এই একান্ত ব্যক্তিগত আপন জিনিষগুলো গোটা বিশ্বের মানবসমাজের জন্য আদৌ কতটুকু উপকারী? আপনার নিজের যে জাতি বা দেশ বা পরিবার বা বিশ্বাস-সেগুলোর প্রতি আপনার আনুগত্য থাকা না থাকায় পৃথিবীর কতটুকু এসে যায়? ধরা ছোঁয়া বা শোঁকা যায়না এমন সব বিষয়ের পেছনে আপনার সময়, শ্রম, শক্তি, অর্থ ইত্যাদি ব্যয় করা সবসময় আদৌ কি পোষায়?

এ প্রশ্নগুলোই বারবার উঁকি দেয় আনুইল-এর অ্যান্টিগনিতে, উঠে আসে এক চরম সত্য; সাম্রাজ্যের দখল নিয়ে লড়াইয়ে নামা দুই ভাই পলিনেসেস ও এটিওক্লেস, এদের কেউই আসলে মহান নয়। দু'ভাই-ই সমান লোভী, এবং এদের কারো শোকেই অশ্রুপাত করা চলে না। ক্রেওণ আমাদের জানান তিনি ঘোষণা দিয়ে এটিওক্লেসের শেষকৃত্য সম্পন্ন করছেন আর পলিনেসেস-এর লাশ মাঠে ফেলে রেখেছেন বটে, কিন্তু ভেতরের সত্যটা হলো, রণক্ষেত্রে দু'ভাই এর লাশই এমনভাবে তালগোল পাকিয়ে মিশে গেছে, কোন অংশটি কার সেটি আর আলাদা করবার উপায় নেই। ক্রেওণ নিজেই জানেন না তিনি কাকে কবর দিচ্ছেন, আর কাকে মাঠে ফেলে রেখেছেন; স্রেফ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করবার জন্যই এটিওক্লেসকে কবর দিতে হচ্ছে তাঁর। সিংহাসনে বসে নৃপতি যদি তাঁর আগেরজনকে ইজ্জত না দেন, নিজের বেলাতেও যে জনরোষে ইজ্জতহানির আশঙ্কা থাকে-ইতিহাসের চিরাচরিত এ শিক্ষা ক্রেওণের ভালোই জানা ছিলো।

কেন আমরা আমাদের দেশকে অন্ধভাবে ভালোবাসি? কেন আমাদের নিজেদের জাতীয়তাবাদকে রক্ষা করতে আমরা বদ্ধপরিকর? কেন আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আমরা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, সর্বস্ব পণ করে আঁকড়ে ধরে থাকি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরে আমরা যা বলি, তাতে আবেগটাই বেশী থাকে, যুক্তি থাকে কম। স্পর্শ করা যায় না এমন একটি বিমূর্ত মনগড়া কাঠামোর ওপর আমরা আমাদের আনুগত্য, ভালোবাসা ইত্যাদি দাঁড় করাই। এই অনুভূতির ব্যাপারগুলো আবেগ-তাড়িত বলে আমরা আমাদের পছন্দের পক্ষ অবলম্বনের পেছনে এমন সব কারণ দেখাই যেগুলোর হয়তো কোন অস্তিত্বই বাস্তবে নেই। অ্যান্টিগনি পলিনেসেস-এর কবর দিয়েই ছাড়বেন বলে যে ধনুকভাঙ্গা পণটি করেছেন, সেটির কারণ হিসেবে তিনি বারবার ছেলেবেলায় ভাইয়ের সাথে তাঁর মধুর সম্পর্কের ইতিহাসকে দেখিয়েছেন, আপন মায়ের পেটের ভাইকে কবর না দিয়ে কীভাবে জীবনভর তিনি এ অপরাধবোধ টেনে চলবেন এ প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু এর সব কি আসলেই সত্যি? নাকি অ্যান্টিগনি চোখ দিয়ে নিজের মনকে ঠারিয়েছেন?

অ্যান্টিগনির বোন ইজমিনের বয়ানে আমরা পাই কীভাবে দু' ভাই-ই ছোটবেলায় তাঁদের দু'বোনকে পীড়ন করতেন; ক্রমেই আমাদের কাছে পষ্ট হয়ে আসে, অ্যান্টিগনির অমন ভীষণ প্রতিজ্ঞার পেছনে দাঁড় করানো কারণগুলো সবই তাঁর মনগড়া, নিজের কল্পনাপ্রসূত। ক্রেওণকে দিয়ে জাঁ আনুইল বলিয়েছেন, আসলে অ্যান্টিগনির মরবার একটা ছুতো দরকার, ভ্রাতৃপ্রেম ট্রেম ওসব স্রেফ বকওয়াস। ঊনিশ-কুড়িতে থাকবার সময় আবেগ মানুষকে গিলে খায়, শহীদী মর্যাদা পাবার ইচ্ছেটা সবচেয়ে জোরালো হয় বোধহয় এ সময়েই। ফরাসী বিপ্লব বলুন, বলশেভিক বিপ্লব বলুন, নকশাল আন্দোলন বলুন, হলি আর্টিজান বলুন, আর নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন বলুন-সৃষ্টিশীল বা ধ্বংসাত্নক যেকোন আন্দোলনের ‘ভ্যানগার্ড' আসলে ঐ ঊনিশ-কুড়ির তরুণ (কিংবা তরুণী) সমাজ। তিরিশ কী চল্লিশ-এ এসে মানুষ কদাচিৎ-ই বিপ্লবী হয়। সমাজের সবচেয়ে সবুজ অংশটি যদি রোমান্টিকতার মাদকতায় গা ডুবিয়ে অ্যান্টিগনির মতোই স্রেফ মরবার একটি ছুতোর সন্ধানে বিপ্লবী হয়, তার ফলাফল কী হতে পারে তার শিক্ষা ইতিহাস বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে। এবং, কার্যতই, আনুইল-এর এ নাটকটিরও একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকা রয়েছে।

আনুইল যখন অ্যান্টিগনি লেখেন, সেই ১৯৪৪ সালে ফ্রান্স ছিলো নাৎজি জার্মানির দখলে। ফ্রান্সের শাসনদণ্ডটি তখন নাৎজিদের পুতুল ভিচি সরকারের হাতে। জার্মানীর সাথে হাত মিলিয়ে ভিচি সরকার তার নিজের দেশের প্রায় ৭৫ হাজার ইহুদীদের ধরিয়ে দিয়েছিলো, যাদের ৯০ শতাংশই প্রাণ হারায় বিভিন্ন গ্যাস চেম্বারে। ইহুদী নিধনে ভিচি সরকারের ব্যাপক এ সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারণ ফরাসী জনগণের ইহুদীবিদ্বেষ (আমরা তো জানিই, শাসক ঠিক তেমনই হন, যেমনটি হয় দেশের মানুষ)। ফ্রান্সের তরুণ সমাজ সে সময়টায় ফরাসী জাতীয়তাবাদের চেতনায় টগবগ করে ফুটছে, ভিচি সরকারের প্রতি তাদের অগাধ আস্থা; তাদের বিশ্বাস, নিজ দেশের ইহুদীদের মেরে তাড়িয়ে দিলেই ফ্রান্স তরতর করে উন্নতির মহাসড়কে উঠে যাবে। জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত পিলটি গলাধঃকরণ করে ফ্রান্সের তরুণ সমাজ যেন নাৎজিদের ক্রীড়নকে পরিণত না হয় তার আহবান-ই সম্ভবত আর সবকিছুকে ছাপিয়ে এই নাটকে উঠে আসে।

সফোক্লিসের ক্রেওণ একগুঁয়ে, স্বেচ্ছাচারী। আনুইল-এর ক্রেওণ ট্র্যাজিক অ্যান্টিহিরো। অ্যান্টিগনির মৃত্যুসংবাদে ক্রেওণের পুত্র হিমন ও স্ত্রী ইউরিডাইস দুজন'ই আত্নহত্যা করে। স্ত্রী, পুত্র, হবু পুত্রবধূকে একসাথে হারিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়া ক্রেওণ পরের মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নেন, কারণ বিকেল ৫টায় সভাসদদের সাথে তাঁর আলোচনা সভা আছে। শাসককে যে ব্যক্তিগত অনুভূতি, রোগ, শোক, উত্তাপ-এসবের ঊর্ধ্বে উঠতে হয়! ওদিকে লাশের পাহারায় থাকা প্রহরীরা তাস খেলেই যেতে থাকে। অ্যান্টিগনি কে, কোন উদ্দেশ্যে সে প্রাণের মায়া ত্যাগ করেছে, কেন রাজপরিবারের অন্য দুই সদস্য হিমন এবং ইউরিডাইস আত্নহত্যা করেছে, সেসব বিষয় তাদের সায়েব বিবি গোলাম নক্কা টেক্কার হিসেবে কোন ভূমিকা রাখে না...

...কারণ, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, ধর্মবিশ্বাসের মর্যাদা ...ওসব নিরাকার কিন্তু অসম্ভব ভারী কথা দু'বেলা খাবারের সন্ধানে থাকা ছাপোষা সাধারণ মানুষের পেট ভরায় না। এসব রক্ষা না রক্ষায় সৌরজগতের মায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছুই এসে যায় না।

July 6, 2022