এই দ্বীপ, এই নির্বাসন

এই দ্বীপ, এই নির্বাসন

405 pages

Ratings1

Average rating3

15

দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাস করেছেন এমন কোনো বাঙালি লেখক, নিজের প্রবাসজীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লিখেছেন, এরকম কোনো উদাহরণ আমার জানা ছিলো না। ভাগ্যের পরিহাসই হবে হয়তো, এমন উপন্যাস সত্যিই একটি আছে, কিন্তু সাধারণ বাঙালি পাঠকের খোঁজখবরের প্রায় বাইরে। ক্যানো যে এই উপন্যাসটির নাম শুনিনি কোনোদিন, কোনো আলোচনা পড়িনি, দেখিনি কোথাও কোনো উল্লেখ, চোখে পড়েনি মুদ্রিত কোনো সংস্করণ, এই ব্যাপারটাকে একটা রহস্যই বলা যায়। ইলেকট্রনিক ভার্শনে বই পড়তে আমি স্বচ্ছন্দ নই। তবু চারশো পৃষ্ঠার উপন্যাসটা মোবাইলের স্ক্রিনে পড়ে ফেলতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। মোবাইলে পড়া ছাড়া আর উপায়ও ছিলো না।

অসুবিধে না-হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ উপন্যাসটির নির্মেদ লিখনশৈলী। কাহিনিবিন্যাস, চরিত্রনির্মাণ কিংবা পটভূমি বর্ণনা— সবদিক দিয়েই লেখক মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। বিশ্বাসই হয়না এটি লেখকের প্রথম এবং একমাত্র উপন্যাস। ইন্টারনেট ও বিশ্বায়নের দৌলতে আমেরিকান জীবন আমাদের কাছে এখন খুবই পরিচিত। কিন্তু ১৯৬৫ সালে, উপন্যাসটা যখন লেখা হয়েছিলো, আমেরিকা তখন ছিলো রূপকথার দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর “বেবি বুম” জমানার, কোল্ড-ওয়ার জমানার, ঘটনাবহুল সেই ষাটের দশক। বিত্ত, বৈভব, ঐশ্বর্য্য এবং রাজনৈতিক মহিমায় এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ঘোড়ার মতো দৌড়চ্ছে আমেরিকা। ভারতের মতো একটি দরিদ্র দেশের কোনো মানুষের কপালে যদি সেই সময়ে আমেরিকায় বাস করার শিকে ছেঁড়ে, কেমন হবে তার জীবন? তার চিন্তাধারা? তার স্ট্রাগল?

ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, মানুষ যখন ছিন্নমূল হয়, তখন সে যেন একটা দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে যায়। মানসিক অস্তিত্বের দিক দিয়ে এমনিতেই প্রত্যেকটি মানুষ একাকী। তার উপর যখন তাকে ছেড়ে যেতে হয় নিজের শহর কিংবা গ্রাম, নিজের দেশ, তখন যেন তার শেকড় উপড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। নতুন দেশের মাটিতে নতুন একটা স্বপ্নকে ধাওয়া করে মানুষ। বেশ কিছুদিন আবিষ্ট থাকে সেই স্বপ্নের কুহকে। কিন্তু একটা সময় সে বুঝতে পারে, আজন্মের পরিচিত ভাষা, মানুষ, দৃশ্য, শব্দ, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ, সবকিছুই তার হাতের নাগাল থেকে বহুদূরে সরে গেছে। তাকে যেন নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। নির্বাসিত, দ্বীপান্তরিত, সেই মানুষদের জীবনের একটা সার্থক পরিচয় পেয়েছি, খুব সহমর্মিতার সঙ্গে লিখিত এই উপন্যাসটা পড়ে।

প্রায় ষাট বছর আগে লেখা চমৎকার এই বইয়ের গল্পটা আজকের দিনেও একটুও পুরোনো হয়ে যায়নি, প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। শেকড়শুদ্ধু উৎপাটন করে ভিনদেশে পুঁতে দিলেই আমগাছে কমলালেবু ফলতে শুরু করেনা। তৃতীয় বিশ্বের মধ্যবিত্ত জীবনের ভয়, আশঙ্কা, লজ্জা, দ্বিধা, অস্থিরতা, পূর্বজীবনের স্মৃতি— সেই ছিন্নমূল মানুষদের পিছু ধাওয়া করে যায় আজীবন। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে, নতুন দেশের নতুন ছাঁচে নিজেকে গড়ে তুলতে। কিছু কিছু অতিনাটকীয়তা রয়েছে এই উপন্যাসে। গল্পের গতি এবং উপভোগ্যতা সবজায়গায় সমান ছিলো না। তবু বাংলা সাহিত্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। একটি বিশিষ্ট উপন্যাস। এই উপন্যাসটিকে নিয়ে আরো অনেক বেশি আলোচনা হওয়া উচিত। আশ্চর্য! কীভাবে হারিয়ে যায় এমন দারুন একটা লেখা?

July 20, 2022