Ratings1
Average rating4
প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলো যেদিন, ভারতবর্ষ সেদিন দ্বিধাবিভক্ত। দীর্ঘদিনের অমানুষিক সংগ্রাম শেষ হওয়ার পরে দেখা গ্যালো, সারা দেশে আনন্দের আতশবাজি নয়, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার আগুন জ্বলছে। দেশমায়ের কর্তিত শরীর থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্মৃতিচারণামূলক বইটির একদম অন্তিম বাক্যটি হলো : History alone will decide whether we had acted wisely and correctly.
তারপর পঁচাত্তর বছর কেটে গেছে। ইতিহাসের রায় এখন কী বলছে? গান্ধীজির নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সবচেয়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন যাঁরা, কতটা সঠিক ছিলো তাঁদের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত? কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন তাঁরা? অকল্পনীয় অত্যাচার ও অপমানের বদলে “স্বাধীনতা” নামের যে-বস্তুটি লাভ করেছিলো দেশের সাধারণ মানুষ, তারা আস্থা রেখেছিলো এই নেতাদের উপর। আস্থার কতটুকু দাম দিতে পেরেছিলেন সেই নেতৃবৃন্দ?
মৌলানা আজাদের বইটি পড়ে মালুম হয়, দূরদৃষ্টি থাকা তো অনেক দূরের কথা, সমসাময়িক দেয়াললিখনটাও তাঁরা ভালোভাবে পড়তে পারেননি। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতির যেটা সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, আমজনতাকে “মুরগি” বানানো, সাধারণ মানুষের জীবন ও ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলার প্রবণতা, এই ট্র্যাডিশনের সূত্রপাত অনেক আগেই ঘটিয়ে ফেলেছিলেন মহান জননায়করা। খুব খুব স্পষ্ট ভাষায় সেই বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন মৌলানা আজাদ। বইটির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এখানেই।
কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি মৌলানা। গান্ধীজি, পণ্ডিত নেহরু, সর্দার পটেল এবং তাঁদের আরো যত কংগ্রেসী সাঙ্গপাঙ্গ, সক্কলের বিচ্যুতিকে, ব্যর্থতাকে, অপদার্থতাকে, সোজাসুজি আঙুল তুলে দেখিয়েছেন। দেশভাগ কিংবা পাকিস্তান-সৃষ্টির ট্র্যাজেডি, যেটা আজকের দিনেও কুরে কুরে খাচ্ছে উপমহাদেশের মানুষকে, তার জন্যে এককভাবে দায়ী করা হয় জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগকে। কিন্তু আরো কয়েকজন মানুষ এর জন্যে দায়ী ছিলেন। পাইকারি হারে স্তব-স্তুতির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে সেই নামগুলো। এই বই খোঁজ দিয়েছে তাদের।
বইটির তিনটি ত্রুটি চোখে পড়েছে আমার। এক, স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানকে খুব হাস্যকরভাবে এড়িয়ে গেছেন লেখক। দুই, সকলের দোষত্রুটি দেখিয়েছেন, কিন্তু নিজের ব্যাপারে কেবল ভালো ভালো কথা বলেছেন— “সব্বাই ভুল, শুধু আমি ঠিক”। তিন, বইটি আদপে মৌলানা নিজে লেখেননি। মৌলানার সঙ্গে বিস্তারিত কথাবার্তা-সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরে বইটি লিখেছিলেন হুমায়ুন কবীর। হুমায়ুনের লেখার ভাষা আমার কাছে বেশ নিরস ও বিরক্তিকর ঠেকেছে। বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ছিলো, তাই পড়ে শেষ করতে পেরেছি। কিন্তু এই ত্রুটিগুলো থাকা সত্ত্বেও বইটির সামগ্রিক মূল্য অপরিসীম।
কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র সর্দার বল্লভভাই পটেলকে কেজি কেজি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার মোড়কে ক্যানো ঢেকে দিচ্ছে নরেন্দ্র মোদি অ্যান্ড কোম্পানি, বিপুল টাকা খরচ করে পটেলের বৃহদাকার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হলো ক্যানো (পৃথিবীর উচ্চতম স্ট্যাচু), এইসব জটিল প্রশ্নের সহজ উত্তরও পেয়েছি বইটা থেকে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ বারোটা বছরকে একটা নির্লজ্জ রাজনৈতিক প্রহসন বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না!