Ratings1
Average rating3
ঔপনিবেশিক ইয়োরোপের সবজান্তা ঐতিহাসিকরা দীর্ঘদিন যাবৎ একচক্ষু হরিণের মতো প্রাচীন গ্রিক সভ্যতাকে চিহ্নিত করতো সভ্য মানবসমাজের সূচনাবিন্দু হিসেবে। সেই হরিণদের আরেকটি চোখের ঠুলির নিচে চাপা দেওয়া ছিল চৈনিক সভ্যতা, আরব্য সভ্যতা এবং উপমহাদেশীয় সভ্যতার উৎকর্ষের কথা (পৃথিবীর আরো নানাবিধ প্রাচীন “ইন্ডিজেনাস” এবং প্রান্তিক অতি উন্নত সভ্যতাগুলোর কথা না হয় আপাতত বাদই দিলাম)। গ্রিক সভ্যতার পরে আরো প্রবল বেগে এলো রোমান সভ্যতা। প্রাচীন গ্রিক আর রোমান— এই দুটি সভ্যতা গোটা ইয়োরোপ মহাদেশের শৌর্য, বীর্য, চিন্তা, দর্শন, বিজ্ঞান এবং শিল্প-সাহিত্যের মাপকাঠি বেঁধে দিয়েছিল।
মহাপরাক্রমশালী সেই রোমান সভ্যতার পতন ঘটেছিল বড় মর্মান্তিকভাবে। এবং সেই পতনের পরে সমগ্র ইয়োরোপব্যাপী যে-অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল, টানা ১০টি শতাব্দী জুড়ে সেই মহাদেশ ডুবে ছিল এক অতল অনড় কুম্ভীপাকের গহ্বরে। ১০ শতাব্দী, মানে এক হাজার বছর (পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতক)— বড় কম কথা নয়। মনুষ্যত্বহীনতার সেই থিকথিকে কাদা ঠেলে, পুনরায় জেগে উঠেছিল যে দেশটি তার নাম ইতালি। সেই দেশের তাসকেনি নামের একটি ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর প্রদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহরের নাম ফ্লোরেন্স। পৃথিবীর অল্প যে কয়েকটি শহরের নাম মানুষের পক্ষে কোনোদিন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, ফ্লোরেন্স তার একটি। শুরু হলো ইয়োরোপীয় ইতিহাসের রেনেসাঁস পর্ব।
সেই রেনেসাঁস যুগকে বাংলা ভাষায় কাহিনি-আকারে পড়বো বলেই সদ্য প্রকাশিত এই বইটা কিনে ফেলেছিলাম। সদ্য প্রকাশ হওয়া ফিকশন বই আমি সচরাচর পড়ি না। কিন্তু এই বইটির ক্ষেত্রে নিয়মভঙ্গ করেছিলাম দুটো কারণে। একটি কারণের নাম লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। আরেকটি কারণের নাম মিকেলঅ্যাঞ্জেলো। ফরাসি “রেনেসাঁস” শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো পুনর্জাগরণ। মানে, হারিয়ে যাওয়া কোনো গৌরবকে পুনরায় জাগরিত করা। মানুষ নতুন কীর্তি গড়তে পারে, কিন্তু মাটির অনেক নিচে চাপা পড়ে যাওয়া গৌরবকে উদ্ধার করতে এমন মানুষের দরকার হয়, যাঁদের কাঁধ সাধারণের চেয়ে বেশি চওড়া। লিওনার্দো এবং মিকেলঅ্যাঞ্জেলো ছিলেন সেই গোত্রের মানুষ। এরকম দুজন অতিমানবকে ৪৩০ পৃষ্ঠায় মোটামুটি ঠিকঠাক ধরে ফেলা খুব কঠিন কাজ। আমাদের লেখক সেই কঠিন কাজটি করতে পারেননি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “সেই সময়” উপন্যাসের ব্লার্বে একটা কথা লেখা আছে, বইটির নায়ক কোনো মানুষ নয়, নায়ক হলো সময়। “সময়কে নায়ক” বানানোর এই ব্যাপারটা তারপর বাংলা সাহিত্যে একটা ক্লিশে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বহু চরিত্রের সমাবেশ ঘটলেই, কিংবা একাধিক শক্তিশালী চরিত্রের উপস্থিতি থাকলেই, লেখক “সময়” নামক বস্তুকে নায়ক বানিয়ে ফেলেন। এই বইয়ের মলাটের পিছনেও লেখা আছে, বইটি “খুঁজতে চেয়েছে সেই সময়কে”। কিন্তু সময় তো চলিষ্ণু একটি বস্তু, তাই তাকে খুঁজতে হলে সময়ের অগ্রপশ্চাৎকেও খুঁজতে হয়। ব্যাকগ্রাউন্ডকে যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে চরিত্ররা অসহায় হয়ে উপন্যাসের পৃষ্ঠায় থমকে থমকে চলাফেরা করতে বাধ্য হয়। রেনেসাঁসের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়কে ধরার জন্যে যে গভীরতার প্রয়োজন আছে, উপন্যাসটিতে সেই গভীরতার অভাব রয়েছে।
এই উপন্যাসে রেনেসাঁসের পশ্চাদপট হিসেবে প্রায় কিছুই দেখানো হয়নি। অন্ধকারময় মধ্যযুগের আঁধার কাটিয়ে ক্যানো ঘটেছিল এই নবজাগরণ? রেনেসাঁসের কুশীলব ছিলেন যাঁরা, কীসের তাড়নায় বিচ্ছুরিত হয়েছিল তাঁদের চোখধাঁধানো প্রতিভা? খামচা খামচাভাবে দুই-তিন জায়গায় উল্লেখ আছে বটে যে, এই সময়ে শিল্পের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটেছিল— ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবার। কিন্তু এই পয়েন্টটা ইতালিয়ান রেনেসাঁসের ক্ষেত্রে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আরো বিশদে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত ছিল। খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, অমিতপ্রতিভাধর লিওনার্দোকে একেবারেই যথাযথভাবে আঁকতে পারেননি লেখক (মিকেলঅ্যাঞ্জেলোকে তবু কিছুটা পেরেছেন)।
উল্টে অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, লিওনার্দোকে “রক্তমাংসের” দেখাতে গিয়ে, মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর সঙ্গে তাঁর দ্বৈরথ দেখাতে গিয়ে, কেমন ভিলেন বানিয়ে ফেলা হয়েছে তাঁকে! তাঁর রত্নখনির মতো নোটবইগুলো, সময়ের থেকে অনেক অগ্রগামী তাঁর বিস্ময়কর চিন্তাভাবনা— এইসব নিয়ে প্রায় কিছুই বলা হয়নি। এবং সবচেয়ে আফসোসের কথা, লিওনার্দো এবং মিকেলঅ্যাঞ্জেলো— দুজনেরই শিল্পকর্মগুলো নিয়ে ব্যাখ্যামূলক আলোচনা থেকে বিরত থেকেছেন লেখক (কেবল আহা, বাহা, কী-অপূর্ব, কী-চমৎকার, এই জাতীয় জেনেরিক বিশেষণ ছাড়া)। শিল্প ছাড়া শিল্পীর কোনো অস্তিত্ব আছে? শিল্পটাই যদি ভালো করে না চিনলাম তাহলে শিল্পীর জীবন জেনে কী লাভ আমার? কী এমন শৈল্পিক বিশেষত্ব আছে মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর তৈরি “ডেভিড” নামের ভাস্কর্যে যে এখনও সেটিকে সর্বকালের সবচেয়ে সেরা মার্বেল ভাস্কর্য হিসেবে গণ্য করা হয়?
তাহলে উৎসাহী আধুনিক পাঠক, যাঁরা বিভিন্ন ডকুমেন্টারি দেখে, কিংবা বই পড়ে, কিংবা ইন্টারনেট ঘেঁটে ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছেন রেনেসাঁসের ব্যাপারে অনেক তথ্য, তাঁরা এই বইটি ক্যানো পড়বেন? চেনা চরিত্রগুলোকে স্রেফ ফিকশনাল ভার্শন হিসেবে দেখবার প্রয়োজনে? অনেক সম্ভাবনা থাকলেও উপন্যাসটি একটি গড়পড়তা ঐতিহাসিক উপন্যাস হয়ে থাকবে আমার কাছে। আচ্ছা বেশ, তাহলে ভালো কিছুই নেই এই বইতে? আছে। দুটো খুব ভালো দিক আছে। এক, আজকালকার “গবেষণাধর্মী” (মানে খান-পঞ্চাশেক বইপত্র পড়ে প্লটের মালমশলা জোগাড় করা আরকি) উপন্যাসের মতো রাশি রাশি ইনফর্মেশনের আবর্জনা পাঠকের মাথায় উপুড় করে ঢেলে দেওয়া হয়নি এই বইটিতে। লেখক পড়াশুনা করেছেন বিস্তর, কিন্তু তাঁর সেই অধীত জ্ঞান জামার কলার তুলে সোল্লাসে প্রদর্শন করার চেষ্টা করেননি। দ্বিতীয় ভালো দিক, লেখকের চমৎকার মসৃণ গদ্য। বিষয়বস্তু মোটেও সহজ ছিল না, তবুও ৪৩০ পৃষ্ঠার বইটি অনায়াসে পড়ে ফেলতে পেরেছি। প্লটের গঠন খাপছাড়া মনে হলেও একটি বিষয়ে লেখক লেটার মার্কস পেয়ে উৎরে গেছেন, সেটি হলো তৎকালীন সমাজজীবনের পরিবেশ বর্ণনা। বইটি পড়ার সময় মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল, নিশ্চিত আমি সশরীরে পৌঁছে গেছি সেই যুগে।
আক্ষেপ সত্ত্বেও লেখককে আমি সাধুবাদ জানাবো এই বিষয়টি বেছে নেওয়া এবং নিজের সাধ্যমতো পরিবেশনের চেষ্টা করার জন্যে। হাবিজাবি বিষয়বস্তু অধ্যুষিত বর্তমান বাংলা সাহিত্যে এমন একটি অফবিট বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখার সাহস দেখিয়েছেন লেখক, এটা অনেক বড় কথা। উপন্যাসটির কাহিনি এখনও সমাপ্ত হয়নি। বইয়ের অন্যতম মুখ্য চরিত্র, মোনা লিসা, প্রায় নাগালের বাইরে রয়ে গেছেন বলা যায়। উপন্যাসের অন্তিমে লেখক পরবর্তী আরেকটি খণ্ড লেখার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। বর্তমান খণ্ডটি পড়ে পুরোপুরি তৃপ্তি পাইনি ঠিকই, তবুও পরের খণ্ডের জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করবো আমি। শেষ একটি কথা না বললেই নয়। সুবিনয় দাস পরিকল্পিত প্রচ্ছদটি দারুন। তীব্র লাল বর্ণের জমিতে অধরা মাধুরীর মতো ফুটে উঠেছে দুটি বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম। আবেদনে রহস্যময় অথচ অনুভবে প্রগাঢ়। এবং হৃদয়ের গভীরে রক্তাক্ত। বইটির প্রধান দুই চরিত্রের অন্তর্জগৎ ঠিক যেমনটা ছিল।
it's not
the
history
of countries
but the lives of men.
fables are dreams
not lies,
and
truth changes
as
men change,
and when
truth becomes stable
men
will
become dead.
(Charles Bukowski, “It's Not Who Lived Here”)