যে কোন যুদ্ধে সবার প্রথমে যে “সত্য” খুন হয় এ জ্ঞান তো আমরা হেরোডটাস, থুসিদিদেস, জেনোফোনদের হাত ধরে কয়েক হাজার বছর আগেই পেয়ে গেছি। যুদ্ধে আধিপত্য বিস্তার করতে হলে আপনাকে উন্নত অস্ত্র বানাতে হবে, শক্তিশালী সামরিক বহর গড়তে হবে, নিশ্ছিদ্র বূহ্য সাজাতে হবে, সত্যকে খুন করতে জানতে হবে, আর...আর? আর একটি উপকরণ আছে, যেটি অনুচ্চারিত রয়ে যায়, যুদ্ধ জেতার কৌশলের কোন হ্যান্ডবুকে তার উল্লেখ থাকে না, কিন্তু প্রতিটি যুদ্ধেই প্রেজেন্ট ইন্ডেফিনিট টেন্সের চিরন্তন সত্যের উদাহরণের মতো অনিবার্যভাবে ব্যবহৃত হয়ঃ ধর্ষণ। যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতার প্রদর্শন; যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া ব্যক্তিটির পেশীটি কতখানি মাংসল, শিশ্নটি কতখানি বড় তার সংবাদই যুদ্ধের বরাতে আমরা পাই। যুদ্ধ ব্যাপারটি যেহেতু পুরুষপ্রধান, যুদ্ধের সাথে ধর্ষণ তাই হাতে হাত ধরে আসে। যুদ্ধে সত্য খুন হয় সবার আগে বটে, তবে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার আসলে নারী।

বাঙলাদেশের স্বাধীনতার মাহাত্ন্য বোঝাতে আমরা কথায় কথায় একটি মুখস্থ বুলি আউড়াই, “২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন করেছি আমরা”। “সম্ভ্রম” কোথায় থাকে? কী হয় এই সম্ভ্রম হারালে? সম্ভ্রম হারাবার পর এই নারীরা কোথায় যায়? কেমন জীবন কাটাতে হয় তাঁদের? তাঁদের মানসিক অবস্থাটাই বা কেমন থাকে? এ প্রশ্নগুলো নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবি না। আমাদের কাছে সংখ্যাটাই বড় হয়ে দেখা দেয়, সেটাকেই মোটা দাগে দাগিয়ে আমরা বিজ্ঞাপিত করি নিজেদের স্বাধীনতাকে। ২ লক্ষ না হয়ে যদি শুধু ১ জন নারী ধর্ষিত হতেন, তাহলে আমরা হয়তো সেই তথ্যটা আদৌ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজ্ঞাপনে আনতামই না। ২ লক্ষ হোক, কিংবা ১, সারাজীবনের জন্য মানসিকভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া এই নারীদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে যে যাতনা পোহাতে হয়েছে, তার মাত্রাটা বাইরের কারো পক্ষেই আন্দাজ করা সম্ভব নয়। ব্যাপকতার দিক দিয়ে ২ লক্ষ অনেক বড় একটি সংখ্যা, কিন্তু যন্ত্রণার প্রেক্ষিতে ১ আর ২ লক্ষ সমান সমান।

ইউগোস্লাভিয়ার পতনের পর ১৯৯১ সালে স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া যখন ইউগোস্লাভিয়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তখন বসনিয়া-হার্জেগোভিনার মুসলমানেরাও ভোটাভুটি করে নিজেদের জন্য একটি আলাদা দেশের প্রস্তাব উত্থাপন করে। বসনিয়ায় বাস করা খ্রীষ্টান সার্বরা এতে আতঙ্কিত হয়ে ভীষণভাবে প্রতিবাদ শুরু করে। তারাও নিজেদের একটি আলাদা সংবিধান রচনা করে। ঐতিহাসিকভাবেই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বসনিয়াতে মুসলমান-খ্রীষ্টানে ঠোকাঠুকি চলে আসছিলো প্রায় ৭০০ বছর ধরে। মার্শাল টিটো সমাজতান্ত্রিক ইউগোস্লাভিয়া গঠন করে বেশ শক্ত হাতে এই ঠোকাঠুকি অনেকটাই দমিয়ে এনেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকয়তার বোতল বন্দী দৈত্য আবারো বেরিয়ে আসে। ১৯৯২-এর ২৯ ফেব্রুয়ারি বসনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে; মাসখানেক পরেই ৬ এপ্রিল সার্বিয়ার রাষ্ট্রপতি স্লোবোদান মিলোসেভিচের আশীর্বাদ নিয়ে বসনিয়ান সার্বদের নেতা রাদোভান কারাদচিচ বসনিয়ান মুসলমানদের ওপর হামলা করে বসেন, শুরু হয়ে যায় ৩ বছর মেয়াদী বসনীয় যুদ্ধ।

বসনিয়ান মুসলমান বা বসনিয়াকদের মানসিকভাবে ভেঙে দিতে সার্বরা ধর্ষণের এক মহোৎসবে নামে। জায়গায় জায়গায় ধর্ষণের ক্যাম্প বানিয়ে বন্দী নারীদের ওপর চলে দিনরাত নির্যাতন। মাতাল সার্ব সৈনিকেরা ইচ্ছেমতো সময়ে এসে যাকে পছন্দ হয়েছে টেনে নিয়ে গেছে নিজেদের ঘরে। কিশোরী থেকে বৃদ্ধা-১২ থেকে ৭০-কেউই ছাড় পায়নি। গবেষকেরা আজ বসনিয়ায় ধর্ষিত নারীদের সংখ্যা ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার পর্যন্ত ধারণা করেন। সংখ্যার ব্যাপকতার বিহবলতায় আমরা জানতে পাই না বা চাই না কীভাবে সে নারীরা এই ক্যাম্পগুলোতে দিন কাটিয়েছেন। কী চলেছে তাঁদের মনে। ক্রোয়েশিয়ান সাংবাদিক স্লাভেঙ্কা দ্রাকুলিচ এই ক্যাম্প বন্দী হতভাগ্য নারীদের গল্পই আমাদের শুনিয়েছেন তাঁর এস. উপন্যাসে।

এস. উপন্যাসের নামচরিত্র “এস”। এস কে? সাফিয়া? সায়রা? সেলমা? আমরা জানতে পাই না। যেমন জানতে পাই না “এস”-এর বান্ধবী “এন”, “এল” দের নামও। তাদের একটাই পরিচিতিঃ ধর্ষণ ক্যাম্পের বন্দী তারা, ঘন্টায় ঘন্টায় যাদের ডাক পড়ে সৈনিকদের ঘরে। ক্যাম্পে আসবার আগে এরা কেউ নার্স ছিলো, কেউ ছিলো শিক্ষক, গৃহিণীও ছিলো অনেকেই। এখন আর কারো কোন আলাদা পদমর্যাদা নেই; সবাই সবার সামনে একইরকম নগ্ন। সবাই এরা জানে কার সাথে কী হয়েছে। প্রতি সকালেই সার্ব সৈনিকেরা এদের সবাইকে মাঠে একসাথে বসিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারতে বাধ্য করে। পশুর মতো অবস্থায় থাকতে থাকতে কি “এস”দের সব মানবিকতাও লোপ পাবে? তারা কি কেবলই লালসা মেটাবার বোধ-বুদ্ধিহীন বস্তুতে পরিণত হবে? দিনের পর দিনের পর দিন ধর্ষণের ফলে যে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ভেতর দিয়ে যেতে হয় এদের অনেককেই, তারা কি করবে এই সন্তানদের নিয়ে? সার্ব সৈনিকদের এই সন্তানদের কি জন্মের পরপরই মাটিতে আছড়ে মেরে কিংবা নাক টিপে শ্বাসরোধ করে ক্যাম্পের বন্দীরা তাদের অক্ষম প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করবে? গোটা উপন্যাস জুড়ে দ্রাকুলিচ এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছেন।

দ্রাকুলিচ নিজে ক্রোয়েশিয়ান, প্রতিবেশী বসনিয়ান নারীদের দুর্ভোগ খুব কাছ থেকে দেখেছেন, সাংবাদিক হিসেবে বসনীয় যুদ্ধের ওপর প্রতিবেদন লিখেছেন, তাই তাঁর বয়ান প্রাসঙ্গিক। উপন্যাস হিসেবে এস. খুব সুখপাঠ্য নয়, বেশ অনেকটাই পত্রিকার রিপোর্টের ধাঁচে লেখা, তবুও এটি বসনীয় যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। দ্রাকুলিচ বসনীয় যুদ্ধের টুকরো টুকরো ভয়াবহতার কথা দেখিয়েছেন তাঁর উপন্যাসে; ধর্ষণ-শিবিরে জন্ম নেয়া বহু শিশুকে জন্মের পরপরই তাদের হতভাগ্য মায়েরা প্রবল ঘৃণায় হত্যা করেছে, সার্বরা বসনীয় পিতাদের বাধ্য করেছে সবার সামনে আপন আপন কিশোর বয়েসী পুত্রদের ধর্ষণ করতে। হয় নিজ পুত্রকে ধর্ষণ করতে হবে, নয় বন্দুকের গুলি-এমন বিকৃত বিকল্পের সম্মুখীন হয়ে বহু বহু পরিবার চিরদিনের জন্য মানসিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে। এই ক্যাটাটোনিয়া থেকে মুক্তির উপায় কী কারোই জানা নেই। যুদ্ধ ও নারীর গল্পগুলো আসলে একই; দেশ কাল জাত ভেদে একই ঘটনাই ঘটে চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। বসনীয় যুদ্ধের সার্ব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎজি, নানকিং-এর জাপানী বাহিনী, ১৯৭১-এর পাকিস্তানী হানাদার... এরা সবাই একে অপরের অবতার মাত্র। স্থান, কাল, আর চরিত্রগুলো ঢেকে দিলে কে যে কে তা আর ঠাহর করা যায় না।

যুদ্ধের বরাতে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসে, মানুষের গতিবিধি জানবার আর পাইকারী হারে খুন করবার এক একটা অস্ত্র গবেষণাগারে বিপুল বেগে তৈরী হতে থাকে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে সেই প্রযুক্তির নতুন অন্য কোন ব্যবহার সভ্যতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। চিরবিষণ্ণ “এস”রা সেই সভ্যতার বুকে দগদগে এক ঘা।


December 30, 2022