Stuff Matters

Stuff Matters

2013 • 272 pages

Ratings32

Average rating4.1

15

ব্রিটিশ ম্যাটেরিয়াল সায়েন্টিস্ট মার্ক মিদোভনিক-এর বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ বই স্টাফ ম্যাটারস। আমাদের আজকের দিনের পৃথিবীতে চারপাশে যেসব বস্তু নিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা কাজ করি, কীভাবে সেগুলো এলো, ইতিহাসের কতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবে আজ আমাদের নিত্য সঙ্গী হলো তারা তারই আখ্যান এ বই। ১০টি অধ্যায়ে উঠে এসেছে ধাতু, কাগজ, চকলেট, জেল, কাঁচ, গ্রাফাইট ইত্যাদির বৃত্তান্ত। সদ্য লব্ধ জ্ঞানের চুম্বক অংশ এখানে উগড়ে দিচ্ছি:

ধাতু কেন অত শক্ত হয়? এর কারণ, ধাতু মূলত ক্রিস্টাল বা স্ফটিকের সমন্বয়ে গঠিত; বিলিয়ন বিলিয়ন ধাতব ক্রিস্টাল একে অপরের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে ভীষণ শক্তিশালী একটি বন্ধন তৈরী করে, এই ক্রিস্টালগুলোর ভেতর পরমাণুরা বিশেষ সজ্জায় নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে গঠন করে একটি ত্রিমাত্রিক বূহ্য, যার দরুন ধাতুর কাঠামোটি অমন ‘ধাতব' হয়ে ওঠে। দাঁড়ি কামাবার রেজর যে কিছুদিন পরপর ভোঁতা হয়ে যায় তার কারণ, দাঁড়ির সাথে ক্রমাগত ঘর্ষণের ফলে রেজরের ধাতব ক্রিস্টালগুলোর আকৃতি বিকৃত হয়ে পড়ে, এলোমেলো হয়ে যায় তাদের সাজানো গোছানো সংসার। ধাতব পরমাণুগুলোকে যদি কোনভাবে জোর করে ফের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায়, তাহলেই রেজর বা ক্ষুরের ধার ফিরে আসে। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ধাতব ক্রিস্টালে নজর ফেললে দেখা যাবে ক্রিস্টালের গায়ে কিছু আঁকাবাঁকা দাগ রয়েছে, যাদের ডিজলোকেশন বলে। এই ডিজলোকেশনগুলো আসলে একরকম ডিফেক্ট বা খুঁত; পরমাণুগুলোর অবস্থানের কোন উল্টোপাল্টা ঘটলেই এই ডিজলোকেশন ঘটে। ধাতুকে পিটিয়ে, তাপ/ চাপ ইত্যাদি প্রয়োগ করে ইচ্ছেমতো আকার দেয়া সম্ভব, যে কারণে ধাতু গত কয়েক হাজার বছর ধরেই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর একটি। ধাতুর এই অনন্য গুণটির পেছনে হাত রয়েছে আসলে এই ডিজলোকেশনের।

আপনি যখন একটি পেপার ক্লিপকে বাঁকান, সেটি ভেঙে না গিয়ে দিব্যি বেঁকে যায় এর কারণ ক্লিপের ধাতব ক্রিস্টালের ডিজলোকেশনগুলো এক ক্রিস্টাল থেকে আরেক ক্রিস্টালে সরে পড়ে। নিজেরা সরে পড়ার সময়ে এই ডিজলোকেশনগুলো খুব ক্ষুদ্র পরিমাণে ধাতব পদার্থ ক্রিস্টালের এ মাথা থেকে ও মাথায় পাচার করে দেয়। এই পাচার করার কাজটি তারা করে শব্দের গতিতে। পেপার ক্লিপটিকে বাঁকালে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন (১০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০) ডিজলোকেশনের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। এই বিপুল পরিমাণ ডিজলোকেশনগুলোর প্রত্যেকেই যখন খুব অল্প পরিমাণে ধাতব পদার্থ কয়েক লাখ মিটার/ সেকেন্ড গতিতে পাচার করে, তখনই ধাতু বেঁকে যায়, আর আমরা আমাদের চাহিদামতো আকার বানিয়ে নিতে পারি, হোক সেটা তলোয়ার কি সেতু কি আলমারী কি চামচ। কোন একটি ধাতুর গলনাঙ্ক থেকে সে ধাতুটির পরমাণুগুলো কতটা শক্তভাবে একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে, আর ধাতুটির ডিজলোকেশনগুলো কতটা তাড়াতাড়ি সটকে পড়তে পারে তার একটা আন্দাজ আমরা করে নিতে পারি। সীসার গলনাঙ্ক বেশ কম, এর ডিজলোকেশনগুলো খুব সহজে ক্রিস্টাল থেকে ক্রিস্টালে সরে যেতে পারে, তাই সীসা অত্যন্ত নরম একটি ধাতু। বিপরীতে, তামার ডিজলোকেশনগুলোকে সরাতে বেশ শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, কারণ এর গলনাঙ্ক অনেক বেশী সীসার চেয়ে, তাই তামা অত শক্ত।

ডিজলোকেশনের নড়াচড়া, গতিবিধি ইত্যাদির ওপরই যে ধাতুর শক্তি নির্ভর করে সে তো জানলাম। তাহলে ডিজলোকেশনের নড়াচড়া করাটা কঠিন করে দিলেই শক্ত ধাতু তৈরী করা সম্ভব-এ তো বোঝাই যাচ্ছে! মেটাল অ্যালয় বা সঙ্কর ধাতু প্রস্তুত করা হয় ঠিক এ ধারণাটিকে কাজে লাগিয়েই। মূল host যে ধাতুটি, সেটির ক্রিস্টালের একটি পরমাণুকে সরিয়ে সেখানে অপর একটি ধাতুর পরমাণু যোগ করে সঙ্কর ধাতু বানানো হয়। পরমাণুর এমন অপসারণ প্রকৃতিতে আকছারই ঘটছে। বিশুদ্ধ অ্যালুমিনাম অক্সাইডের ক্রিস্টাল বর্ণহীন হয়, কিন্তু যদি এতে অল্প পরিমাণে লোহা ইম্পিওরিটি বা ভেজাল আকারে মিশে যায়, তাহলেই এর বর্ণ হয়ে যায় নীল, যাকে আমরা নীলকান্তমণি বলে জানি। লোহার জায়গায় যদি ভেজাল ধাতুটি ক্রোমিয়াম হয়, তাহলে তা লাল বর্ণ ধারণ করে। এই পাথরটিকে আমরা রুবি বা চুনী নামে চিনি।

সঙ্কর ধাতুর অন্যতম উদাহরণ স্টিল বা ইস্পাত-লোহা এবং কার্বনের সমন্বয়ে যা তৈরী হয়। ইস্পাতের ওপর ভর করে আধুনিক সভ্যতা বেশ অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে। শুধু আধুনিক সভ্যতা কেন, রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম সব বড় কীর্তিগুলোর পেছনেও আছে ইস্পাতের বিশাল ভূমিকা। বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে, বহু ব্যর্থ প্রচেষ্টার পরই ইস্পাতের আধুনিক রূপটি আমরা পেয়েছি। অনেকেই হয়তো ধারণা করবেন লোহার সাথে কার্বন মেশালেই যেহেতু অত শক্ত ইস্পাত তৈরী হয়, তাহলে যথেচ্ছ কার্বন মেশালেই হয়! বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন; মাত্র ১ শতাংশ কার্বন যোগ করলেই ইস্পাত পাওয়া যায়, এর বেশী হয়ে গেলে সে ইস্পাত আর ব্যবহার উপযোগী থাকেনা, তা একেবারেই ঝুরঝুরে নরম হয়ে পড়ে।

প্রাচীন রোমানরা ছাড়াও আরেকটি সভ্যতা ইস্পাতের দারুণ ব্যবহার পৃথিবীকে শিখিয়েছে-জাপান। সামুরাইদের যে কাতানা তলোয়ার, সেটি আজও বিশ্ববাসীর কাছে একটি মহাবিস্ময়কর বস্তু। সামুরাইরা এই তলোয়ারটি বানাতো তামাহাগানে নামক এক ধরণের ইস্পাত থেকে। এই তামাহাগানের মূল উপকরণ ম্যাগনেটাইট নামক এক বিশেষ ধরণের লৌহ আকর; কম্পাসের কাঁটা তৈরী করা হয় এই ম্যাগনেটাইট থেকেই। কাতানা'র মাঝের অংশটুকুতে তারা কম কার্বন ব্যবহার করতো যাতে সে অংশটুকু দৃঢ় হয় এবং ঠোকাঠুকিতে ভেঙে না যায়, আর ধারালো অংশটুকুকে বেশী কার্বন দিয়ে তুলনামূলক নরম করে বানাতো যাতে ইচ্ছেমতো ঘষে এর ধার বাড়ানো যায় বহুগুণে।

কার্বন আর লোহার সমন্বয়ে দৃঢ় কাঠামোর ইস্পাত তো তৈরী হলো, কিন্তু মরিচা ধরে যাওয়া থেকে একে বাঁচাবার উপায় কি? বাতাসের অক্সিজেন ইস্পাতের সাথে বিক্রিয়া করে আয়রন (III) অক্সাইড গঠন করে, যাকে আমরা জং ধরা বা মরিচা পড়ে যাওয়া বলে জানি। ইস্পাতের এক একটি স্তর অক্সিজেন দ্বারা ক্রমাগত আক্রান্ত হতে থাকে এবং মরিচা পড়ে গোটা কাঠামোটিই ঝুরঝুরে হয়ে পড়ে। মরিচা ঠেকাবার জন্য তাই ইস্পাতের সাথে অল্প পরিমাণে ক্রোমিয়াম যোগ করা হয়; ক্রোমিয়াম ইস্পাতের আগেই অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্রোমিয়াম অক্সাইডের একটি স্বচ্ছ আস্তরণ তৈরী করে ফেলে; ইস্পাত বেঁচে যায় অক্সিজেনের আক্রমণ থেকে। ক্রোমিয়াম সংবলিত এই ইস্পাতকে আমরা স্টেইনলেস স্টিল বলে চিনি। মজার ব্যাপার হলো ক্রোমিয়ামের এই আস্তরণটি কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা কিছু অংশ উঠে গেলে তা নিজে নিজেই সেরে যায়! ক্রোমিয়ামের আরো একটি দুর্দান্ত কেরামতি আছে; আধুনিক সময়ের আমরা স্টেইনলেস স্টিলের চামচ দিয়ে খেতে অভ্যস্ত। চামচের ক্রোমিয়াম আমাদের থুতুর সাথে কোন বিক্রিয়া করেনা, ফলে আমাদের মুখে চামচের বাড়তি কোন স্বাদ আমরা টের পাইনা। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের মানুষেরা অতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না! তাঁরা রূপার তৈরী তৈজসপত্র ব্যবহার করতেন, যা থুতুর সাথে বিক্রিয়া করে, ফলে খাবারের পাশাপাশি জিভে রূপার একটি তেতো স্বাদও যুক্ত হতো।

ইস্পাত ছাড়া আধুনিক কোন সভ্যতা যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি কাগজ ছাড়াও আমরা আজ এক মুহুর্তও ভাবতে পারিনা। গাছ থেকে কাগজ আসে এ তো আমরা সবাই জানি। গাছের কাঠামোটি গঠন করে সেলুলোজ নামক অসংখ্য ছোট ছোট আঁশ যারা কী না লিগনিন নামক এক ধরণের জৈব আঠার সহায়তায় একে অপরের সাথে জুড়ে থাকে। এই লিগনিনের এতটাই শক্তি যে শত শত বছর ধরে সেলুলোজের এই কাঠামোটি অক্ষত থাকে। লিগনিনের এই বন্ধন ভাঙা চুল থেকে চুইং গাম সরাবার মতোই দুঃসাধ্য একটি কাজ। কাগজ প্রস্তুত করবার জন্য প্রথমে উচ্চ তাপ ও চাপ প্রয়োগ করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় লিগনিন সরিয়ে সেলুলোজের মণ্ড তৈরী করা হয়, যা কার্যত তরলীকৃত গাছ। এই তরলটিকে সমতল কোন পৃষ্ঠে লেপে শুকালে কাগজ পাওয়া যায়। এই ধরণের প্রাথমিক পর্যায়ের কাগজ বাদামী বর্ণের হয়। আমরা যে অভিজাত সাদা কাগজের সাথে পরিচিত, সেটি প্রস্তুত করতে হলে ক্যালসিয়াম কার্বনেটের সাদা গুঁড়ো মেশাতে হয়।

কাগজ পুরনো হয়ে গেলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে এটি আমরা অসংখ্যবারই লক্ষ্য করেছি। মূলত দু'টি কারণে কাগজ হলদেটে হয়ে যায়। প্রথমত, লিগনিন পৃথকীকরণের ধাপটি যদি ভালোভাবে সম্পন্ন করা না হয়, মণ্ডে যদি যথেষ্ঠ পরিমাণে লিগনিন রয়ে যায়, তাহলে তা আলোর উপস্থিতিতে বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে ক্রমে হলদেটে হয়ে ওঠে। সময় বাড়বার সাথে সাথে এই হলদেটে ভাবও বাড়তে থাকে। নিউজপ্রিন্ট জাতীয় সস্তা কাগজ এভাবেই প্রস্তুত করা হয়। দ্বিতীয় যে কারণে কাগজ হলদেটে বর্ণ ধারণ করে সেটির কারণ অ্যালুমিনাম সালফেট (Al2(SO4)3); এ রাসায়নিক দ্রব্যটি মূলত পানি পরিশুদ্ধ করবার কাজে ব্যবহৃত হতো, তবে কাগজের খসখসে ভাবটিকে কমিয়ে আনবার জন্য ১৮ এবং ১৯ শতকে মণ্ডের সাথে Al2(SO4)3 মেশানো শুরু হয়, যার ফলে কাগজটি অ্যাসিডিক বা অম্লীয় হয়ে পড়ে। অম্লীয় এই কাগজের সেলুলোজগুলো হাইড্রোজেন আয়নের সাথে বিক্রিয়া করে কাগজের বর্ণ হলদেটে বানিয়ে দেয়, সেই সাথে কাগজের স্থায়ীত্বও কমে যায়। এ ধরণের কাগজকে আমরা অ্যাসিড পেপার নামে জানি আজ।

জীবন যাপনের সুবিধার্থে হরেক কিছিমের কাগজ-ই তো আমরা এখন নিত্য ব্যবহার করছি। এতসব রকম কাগজের মাঝে বিশেষ এক রকম কাগজ হলো থার্মাল পেপার যা আধুনিক মুদি দোকানগুলোর ক্যাশ রেজিস্টারে আমরা দেখতে পাই। ক্যাশ রেজিস্টারে কালি শেষ হয়ে গেছে বলে রসিদ ছাপাতে পারছেনা-এমন কথা আমরা কখনো শুনিনি, এর কারণ, ক্যাশ রেজিস্টারে আদৌ কোন কালি থাকেনা! থার্মাল পেপারে আগে থেকেই কালি মেশানো থাকে, লিউকো ডাই এবং অ্যাসিড রূপে। রসিদ ছাপাবার সময় সামান্য একটু তাপ প্রয়োগ করে কাগজের অ্যাসিড এবং লিউকো ডাই-এর বিক্রিয়া ঘটানো হয়, যার দরুন স্বচ্ছ ডাইটি কালো কালিতে পরিণত হয়। যেহেতু বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে (তাপ) সাময়িকভাবে কালির রং বদলাতে হয়, কিছুদিন পর তাই সেই লিউকো ডাইটি ফের তার আগের স্বচ্ছ বর্ণে ফিরে যায়, ফলে রসিদের লেখাগুলোও মুছে যেতে দেখি আমরা।

কাগজের সবচেয়ে বড় ব্যবহারটি আমাদের সবারই ভীষণ প্রিয়ঃ টাকা! কাগজ তো এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজলভ্য বস্তুগুলোর একটি, তাহলে কেন সবাই ঘরে ঘরে কাগজে টাকা ছাপিয়ে নিতে পারছেনা? এর কারণ, আমরা মূলত গাছ থেকে প্রাপ্ত সেলুলোজ ভিত্তিক কাগজ ব্যবহার করি, আর টাকা বানানো হয় সচরাচর তুলা দিয়ে (ডলারের ৭৫% তুলা, বাকী ২৫% লিনেন)। সেলুলোজ-এর কাগজ দিয়ে তুলা থেকে তৈরী সত্যিকার টাকার নকল বানানো ভীষণ কঠিন। এছাড়াও, টাকার যে জগত ভোলানো কড়কড়ে আওয়াজ, সেটিও তুলা ছাড়া অসম্ভব। নকল টাকা শনাক্ত করবার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আয়োডিনের কলম ব্যবহার করা হয়। সেলুলোজের তৈরী নকল টাকায় স্টার্চ (শ্বেতসার) রয়ে যায়, যা আয়োডিনের সাথে বিক্রিয়া করে কালো বর্ণ ধারণ করে। বিপরীতে, তুলায় যেহেতু কোন স্টার্চ নেই, আয়োডিনের কলম দিয়ে দাগ দিলেও তাতে কোন কিছু ফুটে ওঠে না।

প্রযুক্তি-নির্ভর আজকের দিনে কাগজের বই অনেকের কাছেই একটি বাড়তি বোঝা; সে জায়গায় চলে এসেছে কিন্ডল, আইপ্যাড, কোবো ই-রিডার ইত্যাদি যন্ত্রগুলো। শুনতে অবাক লাগবে, কিন্তু এই যন্ত্রগুলোর যে পর্দা, যেটিকে ইলেক্ট্রনিক পেপার বলা হয়, সেখানেও সত্যিকার কালি ব্যবহৃত হয়! এই কালি ই-বই রিডারের পর্দায় জ্যানাস পার্টিকেল নামক এক বিশেষ রকম কণার আকারে লেপে দেয়া হয়। এই কণাগুলোর এক পাশ থাকে কালো-যা ঋণাত্নক চার্জ যুক্ত, আর অপর পাশ সাদা (ধনাত্নক চার্জযুক্ত)। ই-রিডারের বুদ্ধিমান চিপটি প্রয়োজন মাফিক ভোল্টেজ প্রয়োগ করে চার্জের কম বেশী ঘটিয়ে কণাগুলোকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে পর্দার এক একটি পিক্সেলে গোটা পৃষ্ঠার লেখাগুলো আমাদের সামনে এনে দেয়। জ্যানাস পার্টিকেলের নামকরণ করা হয়েছে দুই মাথা সংবলিত প্রাচীন রোমান দেবতা জ্যানাস-এর নামে। ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের পর্দার লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লেতে পিক্সেলগুলো খুব তাড়াতাড়ি বদলে যেতে পারে যে কারণে চলচ্চিত্র বা ভিডিও দেখা সম্ভব হয়; কিন্তু জ্যানাস পার্টিকেলকে চলচ্চিত্রের দৃশ্যগুলোর গতি অনুযায়ী অত জলদি উল্টেপাল্টে ফেলা যায়না, তাই জ্যানাস পার্টিকেল সংবলিত ই-বই রিডারে চলচ্চিত্র বা ভিডিও দেখা যায় না।

সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য সুদৃঢ় দালানকোঠা যা কিনা প্রকৃতি ও সময়ের সাথে যুঝে শতকের পর শতক টিকে থাকতে পারে। এ ধরণের দালান নির্মানে আজ আমাদের প্রথম পছন্দ কংক্রিট। কংক্রিটের মূল উপাদান লাইমস্টোন বা চুনাপাথর থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম কার্বনেট, যার সাথে মেশানো হয় সিলিকন ও অক্সিজেনের সমন্বয়ে তৈরী সিলিকেট। চুনাপাথর তৈরী হয় ভূত্বকে, যখন জৈবিক প্রাণীদেহ পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রচণ্ড চাপ ও তাপে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে চিঁড়েচ্যাপটা হতে থাকে। আর সিলিকেট মূলত কাদামাটি; ভূত্বকের ৯০ শতাংশই গঠিত এই সিলিকেট দিয়ে। এই দুইয়ের মিশ্রণে তৈরী কংক্রিট সেই রোমান আমল থেকে আজও আমাদের নিত্যসঙ্গী। রোমানদের তৈরী বহু কংক্রিটের দালান আজ কয়েক হাজার বছর পরও দিব্যি টিকে আছে, তবে কংক্রিটের কিছু দুর্বলতাও আছে। কংক্রিটের রাস্তায় বা বাড়ীঘরের দেয়ালে আমরা প্রায়ই ফাটল দেখতে পাই; এই ফাটলগুলো ধরে মূলত সূর্যের তাপে কংক্রিটের ক্রমাগত সংকোচন প্রসারণের কারণে। বর্তমানে আমরা কংক্রিটের ঢালাইতে ইস্পাতের একটি কাঠামো যোগ করে দৃঢ়তা বহুগুণে বৃদ্ধি করতে পারি। আমাদের ভীষণ সৌভাগ্য যে কংক্রিট ও ইস্পাতের এক্সপ্যানশন কোএফিশিয়েন্ট (সম্প্রসারণ সহগ) খুব কাছাকাছি, তাই এই দুইয়ের মিশ্রণে রিইনফোর্সড কংক্রিট বানানো সম্ভব হয়েছে।

ইস্পাত দিয়ে কংক্রিটের দৃঢ়তা বাড়ানো গেলেও বড় একটি সমস্যা রয়েই যায়ঃ ইস্পাতে মরিচা পড়ে যাওয়া। ইস্পাত ও কংক্রিটের মিশ্রণে একটি ক্ষারীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় যার ফলে ইস্পাতের ওপর আয়রন হাইড্রোঅক্সাইডের একটি আস্তরণ তৈরি হয়। আদর্শিকভাবে, এ আস্তরণটি ইস্পাতকে মরিচা পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাবার কথা, কিন্তু ক্রমাগত সংকোচন প্রসারণের ফলে কংক্রিটের গায়ে যে ফাটল দেখা দেয়, তা দিয়ে বিন্দু বিন্দু পানি ঢুকে পড়ে। ঠাণ্ডায় এই পানি জমে যায়, সংকোচিত হয়, ফের গরমে প্রসারিত হয়... এভাবে বিশেষত ঠাণ্ডার দেশে সামুদ্রিক পরিবেশে লবণাক্ত পানি কংক্রিটের ভেতরের ইস্পাতকে আক্রমণ করে পুরো কাঠামোটিকেই ধ্বসিয়ে দিতে পারে। বড় বড় পাহাড়ের প্রাকৃতিকভাবে যে ক্ষয় হয় (ইরোশন), সেটিও হয় ঠিক এই একই কারণেই। তাহলে কি পানির হাত থেকে কংক্রিটের কাঠামোকে বাঁচাবার কোনই উপায় নেই?

সাম্প্রতিক সময়ে একধরণের ‘সেলফ হিলিং' কংক্রিট তৈরী করা সম্ভব হয়েছে, যা ফাটল ধরা পড়লে নিজে নিজেই মেরামত করে নেয়! এই স্ব-নিরাময়টি সম্ভব হয়েছে বিশেষ এক জাতের ব্যাকটেরিয়ার কল্যানে; B. pasteurii নামক এই ব্যাকটেরিয়ার বাস আগ্নেয় ছাইয়ে ঘেরা ভীষণ ক্ষারীয় এক পরিবেশে, যেখানে pH-এর মাত্রা ৯ থেকে ১১ অব্দি। এমন ক্ষারীয় পরিবেশের মুখোমুখি হলে মানবশরীরের চামড়া তৎক্ষণাৎ পুড়ে যাবে, কিন্তু এই ব্যাক্টেরিয়ার জন্য এটি স্বর্গ বিশেষ! B. pasteurii-এর মলে বিপুল পরিমাণে ক্যালসাইট থাকে (ক্যালসিয়াম কার্বনেটের একটি বিশেষ রূপ), যা কংক্রিটের মূল উপাদান। এই ক্যালসাইট ফাটলগুলোকে বন্ধ করে দেয় আর কাঠামোটিকে আগের মতোই শক্তিশালী করে তোলে। কংক্রিটের ভেতর দশকের পর দশক ধরে জমে থাকতেও এই ব্যাক্টেরিয়াদের মোটেই কোন আপত্তি নেই। এ ধরণের সেলফ হিলিং কংক্রিটের ভেতরে ব্যাক্টেরিয়ার খাদ্য হিসেবে স্টার্চ বা শ্বেতসারের একটি প্রলেপ লেপে দেয়া হয়; ব্যাক্টেরিয়ারা আটকে থাকে ক্যালসিয়াম সিলিকেট হাইড্রেইট-এর একটি বন্ধনে। যখনি কংক্রিটে ফাটল ধরা পড়ে ও পানি ঢোকা শুরু হয়, তখনি সে বন্ধনটি কেটে যায় আর ব্যাক্টেরিয়ারা আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। এরপর শ্বেতসারের সেই প্রলেপ খেয়ে যাওয়া আর মলত্যাগ করে যাওয়া...

সেলফ হিলিং কংক্রিটের মতো সেলফ ক্লিনিং কংক্রিটও তৈরী করা সম্ভব হয়েছে! এ ধরণের কংক্রিটে টাইটেনিয়াম ডাই অক্সাইডের (TiO2) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা থাকে যারা সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল আয়ন তৈরী করে। যে কোন জৈবিক ধূলিকণাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে এই আয়নগুলো। বাকী ধ্বংসাবশেষ বৃষ্টির পানিতে কিংবা বাতাসে ভেসে যায়। রোমের একটি গীর্জা (দিভেস ইন মিসেরিকরদিয়া) বানানো হয়েছে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যা নিজেই নিজেকে পরিষ্কার করে নিতে পারে। TiO2-এর আরেকটি বড় গুণ হলো এটি বাতাসের নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে, ঠিক গাড়ীর ক্যাটালাইটিক কনভার্টার-এর মতো। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো পরিবেশ রক্ষায় TiO2-এর আরো বহু ব্যবহারই আমরা দেখবো।

কাগজ, ইস্পাত, কংক্রিট-এগুলো তো সবই আমাদের বেশ চেনাজানা উপকরণ। এবার একটু অচেনা একটি বস্তুর দিকে নজর ফেলা যাকঃ সিলিকা অ্যারোজেল। পৃথিবীর সবচেয়ে হালকা এ বস্তুটির ব্যাপারে জানতে গেলে আগে ‘জেলী' কী সেটা একটু জেনে আসা প্রয়োজন। জেলী মূলত এমন একটি তরল যা একটি কঠিন পদার্থের কারাগারে ভেতর আটকা পড়ে আছে। এই কারাগারটিকে আমরা মেশ বলতে পারি। খাওয়ার যে জেলী, সেটিতে এই কারাগারের কাঠামোটি তৈরী করে জেলাটিন। আমাদের চামড়া তৈরী করে যে প্রোটিনটি, সেটির নাম কোলাজেন; জেলাটিন উৎপন্ন করা হয় এই কোলাজেন থেকেই। পানির সংস্পর্শে জেলাটিনের অণুগুলো একে অপরের সাথে জোড়া লেগে মেশ বা কারাগার তৈরী করে যার ভেতরে জেলীর তরলটি আটক থাকে। তরলের পৃষ্ঠটান বা সারফেইস টেনশনের কারণে মেশের ভেতরের তরলটি বেরোতে পারেনা। আমাদের মুখের ভেতর ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপে জেলাটিনের মেশের কারাগারটি ভেঙে যায়, ফলে আমরা ভেতরের তরলের স্বাদটি গ্রহণ করতে পারি।

জেলের ভেতর যে তরলটি আটক থাকে, সেটিকে যদি বিশেষ একটি মাত্রার তাপ প্রয়োগ করে এমনভাবে বাষ্পীভূত করে ফেলা যায় যাতে মেশের কাঠামোটির পক্ষে আর ‘বোঝা সম্ভব না হয়' যে ভেতরে গ্যাস রয়েছে না তরল রয়েছে, তাহলেই কেল্লাফতে! খুব ধীরে ধীরে এরপর এই গ্যাসটিকে অত্যন্ত সন্তর্পনে বের করে আনলে দেখা যাবে মেশের কাঠামোটি অবিকৃত রয়েছে, যদিও এর ভেতরে এখন শুধুই বাতাস। কাঁচ তৈরী করা হয় যে সিলিকন ডাইঅক্সাইড দিয়ে, সেটির মেশের কাঠামোটির ভেতরে তরল পুরে সেটিকে বাষ্পীভূত করেই সিলিকা অ্যারোজেল তৈরী করা হয়। কাঁচের ভেতর দিয়ে যখন আলো প্রবাহিত হয়, তার কিছু অংশ বেঁকে যায়, যাকে প্রতিসরণ বলে জানি আমরা। একই উপকরণ দিয়ে তৈরী সিলিকা অ্যারোজেলের ভেতরটা যেহেতু পুরোটাই ফাঁপা, আলো তাই সরাসরি প্রবাহিত হয়, কোন প্রতিসরণ ঘটেনা। ঠিক এ কারণে হালকা রঙয়ের আলোর পরিবেশে সিলিকা অ্যারোজেলকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য মনে হয়। কিন্তু চমকটা হলো, গাঢ় রঙের পরিবেশের সাপেক্ষে অ্যারোজেলের বর্ণ নীল মনে হয়, যদিও এটি তৈরী বর্ণহীন কাঁচ থেকে। এ ব্যাপারটি কেন হয় সেটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহুদিন মাথা ঘামিয়েছেন। অবশেষে সে উত্তরটি পাওয়া গেছে!

আমরা জানি, সূর্য থেকে বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ক্রমাগত ঠিকরে আমাদের চোখে এসে পড়ছে। সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো সমানভাবে বিচ্ছুরিত হয় না। আকাশের রং লাল না হয়ে নীল, এর কারণ ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল আলো বিচ্ছুরিত হয় বেশী; লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশ বড়, এর বিচ্ছুরণও তাই অনেক কম। এ ব্যাপারটিকে র‍্যালে স্ক্যাটারিং বলে আমরা জানি। কোন স্বচ্ছ পদার্থের ভেতর যদি অল্প পরিমাণে বাতাস আবদ্ধ থাকে, যেখানে ঐ পদার্থের বিলিয়ন বিলিয়ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পৃষ্ঠতলে আলো বিচ্ছুরিত হতে পারে, তাহলেই র‍্যালে স্ক্যাটারিং ঘটা সম্ভব। গাঢ় বর্ণের পরিবেশে অ্যারোজেলের ভেতর ঠিক এ ব্যাপারটিই ঘটে, ফলে আমরা নীল বর্ণ দেখতে পাই। অ্যারোজেলের আরেকটি দুর্দান্ত কেরামতি হলো এর অসম্ভব তাপ প্রতিরোধ ক্ষমতা। একটি পাতলা অ্যারোজেলের পর্দার একপাশে একটি বুনসেন বার্নার জ্বালিয়ে (১০০০-১৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) অপর পাশে একটি ফুল রাখলে কয়েক মিনিট অব্দি সে ফুলটির গন্ধ দিব্যি শোঁকা যাবে!

অ্যারোজেলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ফায়দাটি নিচ্ছে নাসা। মহাকাশে তো অগণন মহাকাশীয় ধূলিকণা ও নুড়ি বিপুল বেগে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাদের উৎপত্তি পৃথিবী সৃষ্টিরও ঢের ঢের আগে। এই space dust গবেষণাগারে নিয়ে পরীক্ষা করতে পারলে সৃষ্টিরহস্যের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর যে পাওয়া যেতে পারে এ তো বোঝাই যাচ্ছে! কিন্তু ঘন্টায় ১৮ হাজার মাইল বেগে ছুটে বেড়ানো এই ফেরারী আসামীদের ধরতে গেলেই তো কামানের গোলার মতো সব ফুটো করে তারা বেরিয়ে যাবে; ভয়ানক সেই সংঘর্ষে এই space dust গুলো নিজেরাও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে, ফলে তাদের আদি অবস্থায় পরীক্ষা করা তো সম্ভব নয়। সমাধান সিলিকা অ্যারোজেল। অত্যন্ত কম ঘনত্বের এই বস্তুটি space dust-এর জন্য নরম তুলোর বালিশের মতো কাজ করে। ১৯৯৭ সাল থেকেই নাসা অ্যারোজেলের জাল বানিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মহাকাশীয় নুড়িপাথর আটক করে বেড়াচ্ছে।

চুম্বক অংশ টুকে রাখার নোটটা যাচ্ছেতাই রকম লম্বা হয়ে গেছে, তাই এখানেই যবনিকা টানছি। মিদোভনিকের এই বইটি তো শুধু কঠিন পদার্থ নিয়ে; তরল পদার্থ নিয়েও তাঁর একটি বই রয়েছে, ‘লিকুইড ম্যাটারস'। সে বইটিও লিস্টিতে উঠিয়ে রাখলাম...

September 4, 2023