Ratings30
Average rating3.8
‘ডাইভিং বেল' হলো ডুবুরীদের সমুদ্রের গভীরে পাঠাবার বিশেষ এক ব্যবস্থা। বাতাসকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত সরল এই যন্ত্রটির ব্যবহার শুরু সম্ভবত অ্যারিস্টটল এর সময়কাল থেকে। ছোটবেলায় গোসল করতে গেলে প্রায়ই একটা খেলা খেলতাম। মগের ভেতর শুকনো গামছা দলা পাকিয়ে ভরে মগটিকে উপুড় করে বালতির পানিতে চাপ দিয়ে দিয়ে ভেতরে ঠেলতাম। মগের পুরোটাই পানির তলায় চলে গেলেও ভেতরের গামছায় পানির স্পর্শ লাগতো না, কারণ মগের ভেতরের বাতাস পানিকে ভেতরে ঢুকতে দেয় না। এই একই কার্যপ্রনালী ব্যবহার করেই ডাইভিং বেল তৈরী করা। ঘন্টা আকৃতির নিচের দিকে খোলা এই যন্ত্রতে করে ডুবুরীদের নামিয়ে দেয়া হতো গভীর পানিতে। গন্তব্যে পৌঁছাবার আগ পর্যন্ত ডুবুরীকে ডাইভিং বেল এর ভেতরে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো (ছবি দ্রষ্টব্য):
ছোট্ট একটু সময়ের জন্য এক-দুজন মাত্র ডুবুরী বয়ে নিতে হতো বলে আগেকার যুগের ডাইভিং বেলগুলোর আয়তন খুব বেশী হতো না, তাই ভেতরের সঞ্চিত বাতাসের পরিমাণও খুব সামান্যই হতো। জানালাবিহীন, অন্ধকার, বদ্ধ খুব ছোট একটি খোলস, যেখানে প্রতি নিঃশ্বাসের সাথে সাথে অক্সিজেন কমে আসছে, সেখানে অল্প কিছুক্ষণ সময় কাটানোটাই কত কষ্টকর হতে পারে মনে মনে তার মোটামুটি একটি ধারণা আমরা বোধহয় করতে পারি। নিতান্ত পেশা বলেই ডুবুরীদের এই যন্ত্রের ভেতর বসে থাকতে হতো, তা-না হলে কে আর যেতে চাইবে দম বন্ধ করা অন্ধকার এই কুঠুরির ভেতর?
দি ডাইভিং বেল অ্যান্ড দি বাটারফ্লাই হলো এমনই এক অন্ধ কুঠুরির ভেতর আটকে পড়া একজন মানুষের স্মৃতিকথা। তবে, এ ক্ষেত্রে, ডাইভিং বেল শুধুই একটি রূপক। স্মৃতিকথার লেখক জাঁ দমিনিক বোবি আটকা পড়েছিলেন তাঁর নিজের শরীরের ভেতর, দারুণ দুরারোগ্য এক রোগে আক্রান্ত হয়ে। ১৯৯৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ফরাসী ফ্যাশন ম্যাগাজিন এলের সম্পাদক বোবি হঠাৎ এক ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। বেখ সুখ মেখ (Berck-Sur-Mer) হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর বোবি আবিষ্কার করেন কী ভয়ানক এক অভিশাপ নেমে এসেছে তাঁর ওপর। হার্ট অ্যাটাকের পর বিরল যে রোগটিতে তিনি আক্রান্ত হন তার ডাক্তারী নাম ‘লকড ইন সিনড্রোম' (Locked In Syndrome)। এ রোগে আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কের বোধবুদ্ধি নিয়ন্ত্রণকারী অংশটুকু শতভাগ সক্রিয় থাকে, অসাড় হয়ে যায় গোটা শরীর। হার্ট অ্যাটাকের বিশ দিন পর হাসপাতালে জেগে উঠে বোবি আবিষ্কার করেন তাঁর শরীরে কোন সাড় নেই, হাত পা নাড়াবার ক্ষমতা নেই, নেই বাকশক্তিও। শুধু দুটি চোখ আর ঘাড়ের সামান্য একটু অংশ সচল। কারো প্রশ্নের কোন জবাব দেবার উপায় তাঁর নেই, নাকের ওপর বসা সামান্য মাছিটাকে তাড়াবার শক্তিও নেই, শুয়ে শুয়ে কেবল চোখ দুটো দিয়ে যতদূর দেখা যায় ততটুকু দেখা। এই সুখও খুব বেশীদিন সইলো না। ইনফেকশন হবার ভয়ে ডাক্তার তাঁর ডান চোখ সেলাই করে দেন। বহির্বিশ্বের সাথে বোবির যোগাযোগের একমাত্র উপায় এখন তাঁর বাম চোখ। এই বাম চোখ দিয়েই বোবি তাঁর ১৩০ পৃষ্ঠার স্মৃতিকথা লিখেন হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে!
রোমান অক্ষর ব্যবহার করা ভাষাগুলোর (যেমন ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান, ইতালিয়ান ইত্যাদি) একটি মজার ব্যাপার আছে। ভাষাগুলোর যার যার ব্যবহারের প্রেক্ষিতে অক্ষরগুলোকে ব্যবহারের ক্রম অনুযায়ী সাজানো যায়, অর্থাৎ, সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত অক্ষরটি থেকে সবচেয়ে কম ব্যবহৃত অক্ষর পর্যন্ত একটি তালিকা তৈরী করা যায়। ইংরেজীতে এটিকে ‘লেটার ফ্রিকোয়েন্সি' বলে (যাঁরা এডগার অ্যালান পো'র দি গোল্ড বাগ পড়েছেন তাঁদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার, এবং এটুকু পড়ে তাঁরা হয়তো মনে মনে হাসছেন! হেমেন্দ্রকুমার রায় এই গোল্ড বাগের ছায়া অবলম্বনেই যখের ধন লেখেন)। ফরাসী ভাষায় ব্যবহারের ক্রম অনুযায়ী অক্ষরগুলোর তালিকাটা এরকমঃ
ESARINTULOMDPCFBVHGJQZYXKW
বাকশক্তি রহিত বোবিকে বেশীর ভাগ সময় হ্যাঁ অথবা না বাচক প্রশ্ন করতে হতো, যার জবাব তিনি চোখ টিপে দিতেন। একবার চোখ টিপলে ‘হ্যাঁ', দুবার টিপলে ‘না'। বোবির সামনে তাঁর স্মৃতিকথার লেখিকা ক্লদ মেঁদিবিল লেটার ফ্রিকোয়েন্সির ওপরের তালিকাটা নিয়ে বসতেন এবং এক এক করে অক্ষরগুলো পড়ে যেতেন। যখনই বোবির চাহিদামাফিক শব্দটি আসত, বোবি চোখ টিপে বোঝাতেন। এভাবে এক একটি করে অক্ষর দিয়ে দিয়ে একটি শব্দ তৈরী হতো। এ কায়দায় একটি শব্দ লিখতে গড়ে দু মিনিট সময় লাগতো! বোবি প্রতিদিন গড়ে চার ঘন্টা ‘ডিকটেশন' দিতেন। ধীরে ধীরে দশ মাসের অসামান্য পরিশ্রমের পর অবশেষে বইটি লেখা শেষ করেন বোবি। গোটা বইটি লেখার ডিকটেশন দিতে বোবিকে মোটামুটি দু লক্ষ বার চোখ টিপতে হয়েছে।
লকড-ইন সিনড্রোম নিয়ে জানবার পর প্রথম যে কথাটি আমার মনে হয়েছিলো, আমি যদি এই রোগে আক্রান্ত হই, আমি কি আর বই পড়তে পারবো না? কক্ষনো কিছু লিখতে পারবো না? ছবি দেখতে পারবো না? প্রিয় মানুষগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে পারবো না? জাগতিক বিষয়ে তাঁদের সাথে নানা কুতর্কে জড়াতে পারবো না? শিক্ষার একধরণের কুফল আছে, মানুষকে এটি অতিরিক্ত কৌতূহলী করে তোলে, জানতে চাইবার জন্য মনকে ছটফট করায়। আমি জানি না অক্ষরজ্ঞানহীন কেউ এ রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর মানসিক অবস্থা কেমন হবে; আমার কেবলি মনে হয়, তাঁর জন্য কষ্টটা হয়তো তুলনামূলক কম হবে, হতে পারে এটি আমার হঠকারী একটি চিন্তা-শিক্ষিত/অশিক্ষিত ভেদে যেই হোন, কষ্টটা তো মানুষই ভোগ করবে-তবুও মনের কোনায় অন্ধ এক বিশ্বাস বাস করে, জগতের বেশীরভাগটাই দেখা হলো না, জানা হলো না এই ভীষণ সত্যটি যিনি জেনে গেছেন, তাঁর আফসোস আর অসহায়ত্বটাই বেশী।
শিল্প সাহিত্যের সমঝদার জাতি হিসেবে ফরাসীদের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। ফরাসী বোবি তাঁর বইয়ে সে প্রমাণ রেখেছেন। আকাশজোড়া অবসর সময় কাটাতে বোবি স্মরণ করেছেন তাঁর অসংখ্য প্রিয় চলচ্চিত্র আর বইকে। সমুদ্রের বালুকাবেলার দিকে তাকিয়ে জাঁ লুক গদা আর অরসন ওয়েলস এর চলচ্চিত্রগুলোর শুটিং চালিয়েছেন মনে মনে। আফসোস করেছেন সামনেই পড়ে থাকা এমিল জোলার বইটি পড়তে না পেরে। নিজের অবস্থা বর্ণনায় ব্যবহার করেছেন অভিজাত কাব্যিকতা। যে চমৎকার সেন্স অফ হিউমার এর পরিচয় এই বইয়ে দিয়েছেন বোবি, তাতে করে সংবেদনশীল পাঠকের জন্য এতো বুদ্ধিদীপ্ত একজন মানুষের এই পরিণতি মেনে নেয়াটা কিছুটা কষ্টকর-ই হবে। অনেকেই হয়তো মৃত্যুই কামনা করবেন এ অবস্থায়, বোবি তা চাননি। শারীরিক ভাবে বোবি আটকা পড়েছিলেন তাঁর পক্ষাঘাতগ্রস্ত শরীরের ডাইভিং বেলে, কিন্তু মন ছিলো তাঁর প্রজাপতির মতোই অস্থির, তা ছুটে বেড়িয়েছে বোবির ৪৩ বছরের সঞ্চিত অগণিত স্মৃতির পাতাগুলোয়। জাঁ দমিনিক বোবির স্মৃতিকথা প্রকাশের পরপর প্রচন্ড সাড়া ফেলে দেয়, তবে বোবি এ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। বইটি প্রকাশের দু'দিন পরই, ১৯৯৭ সালের ৯ মার্চ বোবির ইহজগতের কষ্টের শেষ হয় আকস্মিক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে।
আমাদের অনেকেরই স্লিপ প্যারালাইসিস এর ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আছে, বাংলায় যাকে বলে ‘বোবায় ধরা'। ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে আবিষ্কার করা শরীর অচল হয়ে আছে, জিভ নাড়াবার উপায় নেই, শুধু গলার ভেতরের এক ধরণের অসহায় গোঁ গোঁ আওয়াজ জানিয়ে দেয় ‘বেঁচে আছি'। কী নিঃসীম শূণ্যতা আর শীতল আতঙ্ক, সেই বেঁচে থাকার অনুভূতিতে! স্লিপ প্যারালাইসিস এর গড় সময়কাল মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড। যাঁদের এ অভিজ্ঞতা আছে কেবল তাঁরাই হয়তো কিছুটা বুঝবেন বিশ দিন পর জেগে উঠে প্রথম ধাক্কাটা সামলাতে বোবির কেমন লেগেছে, কেমন লেগেছে অথর্ব ভাবে এই দেড়টা বছর বেঁচে থাকাটা।
পুনশ্চঃ লকড-ইন সিনড্রোম নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে অন্য আরেকটি ঘটনার কথা জানলাম। কিছুটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক সম্ভবত নয়। ১৯৭৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে ভারতীয় নার্স অরুণা সেনবাগ তাঁর হাসপাতালের আর্দালি দ্বারা আক্রান্ত হন। আর্দালি তাঁকে কুকুর বাঁধার শিকল দিয়ে শ্বাসরোধ করে পায়ুপথে ধর্ষণ করে। অরুণা ‘ভেজিটেটিভ স্টেট' এ চলে গিয়েছিলেন, বেয়াল্লিশ বছরেও যে ঘুম ভাঙ্গেনি (ভেজিটেটিভ স্টেট এর সাথে কোমা'র পার্থক্য হলো, কোমায় রোগীর কিছু বোধশক্তি থাকে, ভেজিটেটিভ স্টেট এ রোগীর মস্তিষ্কের কার্যকলাপ আরো অনেক কমে যায়)। ২০১১ সালে অরুণা ৬৬ বছর বয়েসে মারা যান। অরুণার পক্ষে আবেদন করা হয়েছিলো তাঁকে ‘শান্তিপূর্ন মৃত্যু'র অনুমতি দেয়া হোক। আদালত তা খারিজ করে দেয়। অরুণার ধর্ষণকারীর ৭ বছরের জেল হয়েছিলো ডাকাতির অভিযোগে, ধর্ষণের বিষয়টি আদৌ আদালতে আসেনি, কারণ ১৯৭৩ সালের ভারতীয় আইনে পায়ুপথে ধর্ষণ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিলো না! আমি নিশ্চিত হতে পারছি না কোন বিষয়টি অধিকতর নিষ্ঠুরঃ অরুণা'র ধর্ষণ, নাকি তাঁকে ৪২ বছর ‘ভেজিটেবল' হিসেবে বাঁচিয়ে রাখা, নাকি সাধারণের অগম্য আইনের জটিল মারপ্যাঁচ?