The Elements of Style

The Elements of Style

1918 • 52 pages

Ratings69

Average rating4.3

15

একটা লেখার সবচেয়ে বড় গুণ কী? স্পষ্টতা। সাহিত্যের ভাষা অবশ্যই স্বতন্ত্র হবে। তাতে বিভিন্নরকম নিজস্বতা গুঁজে দিতে হবে। লেখক চাইবেন দশটা লেখার মাঝে নিজের সৃষ্টিটা অনন্য হোক। কিন্তু সাহিত্য লিখি কয়জন? গল্প উপন্যাস কবিতা লিখি কয়জন? আমরা বেশিরভাগ মানুষ বিবৃতি লিখি। কেউ ব্যক্তিগত বিবৃতি। কেউ উদ্দেশ্যমূলক বিবৃতি। ইন্টারনেট এসে আমাদের বিবৃতি লেখার এই ইচ্ছেটাকে দশদিকে প্রসারিত করে দিয়েছে। এই যে আমি এই লেখাটা লিখছি, এটাও তো একটা বিবৃতি। এটা সাহিত্য নয়। আজ থেকে মাত্র বছর-কুড়ি আগেও এমন সুযোগ ছিল না।

আমার পড়শী দেশ বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একটা অভূতপূর্ব আন্দোলন চলছে। আমার বাপের জন্মে আমি এরকম তীব্র আন্দোলন দেখিনি। দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নিজের দেশের অল্পবয়েসি ছাত্রদের, সাধারণ মানুষদের, নির্দ্বিধায় গুলি করে মারছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর সঙ্গে ফাজলামি করছেন। একটা ক্রূর ফাজলামি। উপমহাদেশের এই অঞ্চলের মানুষ স্মরণাতীত কাল থেকে অত্যাচারিত হয়ে এসেছেন। ইংরেজ আমলে জমিদারদের হাতে কৃষক প্রজারা অকথ্য অপদস্থ হয়েছেন। তারপর ইংরেজ গিয়ে এলো পাকিস্তান আমল। তখনও এই অঞ্চলের মানুষ লাঞ্ছনার মুখোমুখি হয়েছেন। তারপর দেশ স্বাধীন হয়েও শান্তি নেই। এই দেশটা কোনোদিন দীর্ঘমেয়াদীভাবে শান্তিতে থাকতে পারলো না।

আজ একবিংশ শতকের প্রায় সিকিভাগ পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রের তরফ থেকে ন্যূনতম মানবাধিকার পেলো না। এতদিন একটা নাম-কা-ওয়াস্তে গণতন্ত্রের “ম্যানেকিন” দাঁড় করানো ছিল। এবারের আন্দোলনের চোদনে ধাক্কায় সেই খেলনা পুতুলের কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছে। দুঃখের কথা হলো, এই পুতুলটাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে আমার নিজের দেশের প্রচুর অবদান আছে। আমি জানি এর পিছনে কিছু কূটনৈতিক কারণ রয়েছে, আমার দেশের স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু একজন সাধারণ বাঙালি হিসেবে আরেকটা দেশের সাধারণ বাঙালি মানুষের এই দুরবস্থা দেখতে ভালো লাগেনা আমার। কূটনীতির পাছায় ঝাঁটা মারতে ইচ্ছে করে।

এই গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ইশকুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির পড়ুয়ারা। এই অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েরা কয়েকদিন আগেও জীবনের প্রায় কিছুই দ্যাখেনি। কিন্তু এখন অনেক কিছু দেখে ফেলেছে! কতজন খুন হয়েছে এখনও পর্যন্ত? মিডিয়ার হিসেব যা-ই হোক, আমার সন্দেহ হয় সংখ্যাটা ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। শেখ হাসিনার এই সরকারকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সরকার বলার উপায় নেই আর। এই সরকার খুনি সরকার। এরা ফ্যাসিস্টও নয়। ফ্যাসিজমেরও একটা রাজনৈতিক দর্শন থাকে। এদের সেটাও নেই। সাদা বাংলায় বলতে হলে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই আওয়ামি লিগ সরকার একটা গণহত্যাকারী, হিংস্র, নির্দয়, ধান্দাবাজ, ক্ষমতার অহংকারে অন্ধ হয়ে যাওয়া সরকার। এমনকি গণতান্ত্রিক ব্যঞ্জনায় এদের “সরকার” বলতেও দ্বিধা হয়। এরা স্রেফ খুনি। প্যাথোলজিক্যাল মৃত্যুবিলাসী খুনি।

এই উন্মাদ খুনিদের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচাতে হবে। শয়ে শয়ে ছাত্র, শয়ে শয়ে সাধারণ নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ, বেঘোরে প্রাণ দিয়েছেন। রোজ মারা যাচ্ছেন তারা! গুলি খেয়ে মরছেন, অস্ত্রের আঘাতে মরছেন, চিকিৎসার অভাবে মরছেন, পুলিশ কাস্টডিতে মরছেন। কতো মানুষ মারাত্মক আহত হচ্ছেন। কেউ হয়তো সারাজীবনের মতো অন্ধ হয়ে যাবেন। কেউ পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকবেন। কারো ভাই মারা গেছে, কারো বোন, কারো সন্তান, কারো অভিভাবক, কারো প্রেমিক, কারো প্রেমিকা, কারো প্রিয় বন্ধু। এই মানুষগুলোর মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যদি কিছুই করার মতো না খুঁজে পাই, তাহলে কিছু বিবৃতি তো লিখতে পারি। বিবৃতি সাহিত্য নয়, জানি। কিন্তু অক্ষরের শক্তি অসীম। নির্জলা স্পষ্ট ভাষায় লেখা, কয়েকটি সোজাসাপ্টা বাক্য দিয়ে গঠিত, একটা বিবৃতির শক্তি অনেক! আর অনেকগুলো বিবৃতির শক্তি—সীমাহীন!

গুডরিডস ছাড়া আমার আর লেখার জায়গা নেই। তাই আমার বিবৃতিটা আমি এখানে লিখলাম। যদিও একটা বইয়ের রিভিউ লেখার ভান করে এই বিবৃতিটা লিখছি, কিন্তু রিভিউটা পুরোটা ভান নয়। কীভাবে নিজের মনের কথা স্পষ্ট লিখিত ভাষায় প্রকাশ করা যেতে পারে, সেটা শেখার জন্য এই বইটার দ্বারা আমি বহুভাবে উপকৃত হয়েছি। বইটার উদ্দেশ্য যদিও ইংরিজি ভাষায় লেখালিখির নিয়মকানুন শেখানো, কিন্তু এই বইটার অনেক নিয়ম যেকোনো ভাষাতে লেখার কাজে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সামান্য কিছু নমুনা দিই।

প্রথমেই সবচেয়ে মূল্যবান নিয়মটা বলি। বিবৃতি লেখার সময় জটিল বাক্য লিখবেন না। বাক্যের দৈর্ঘ্য বড় করবেন না। ছোটো ছোটো সরল বাক্যে লিখবেন। যেমন : দেশের প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে থাকার যোগ্যতা নেই শেখ হাসিনার।

পরিচিত শব্দ ব্যবহার করবেন। নিজেকে পণ্ডিত প্রমাণ করার জন্য অহেতুক কঠিন শব্দ ব্যবহার করবেন না। যেমন : আমি জানি আমারও প্রাণের ভয় আছে, কিন্তু আজ যদি আমি ভয় পেয়ে চুপ করে বসে থাকি, তাহলে সারাটা জীবন ভীতু হয়ে বেঁচে থাকতে হবে (দেখুন এই বাক্যে একটাও কঠিন শব্দ নেই, অথচ আপনার মতামত স্পষ্টভাবে জানানো হলো)।

সাহিত্য রচনার জন্য নানারকম পরিশীলিত প্রক্রিয়া আছে। সাহিত্যে উপমা ব্যবহার করা হয়। রূপক ব্যবহার করা হয়। অলংকার ব্যবহার করা হয়। বিরোধাভাস ব্যবহার করা হয়। এরকম আরো গাদা গাদা পদ্ধতি আছে রচনাকে সাহিত্যগুণসম্পন্ন করার জন্য। কিন্তু এই দুঃসময়ে নিজের বিবৃতি থেকে এইসব পদ্ধতি বাদ দিলেই ভালো হয়। তার চেয়ে বরং একেবারে সহজ ভাষায়, সাদামাটা ভঙ্গিতে লিখলে বিবৃতি অনেক বেশি জোরদার হবে। যেমন : আমি অনেক সহ্য করেছি। এই অপদার্থ সরকারের পতন এবার ভীষণ জরুরি। এরা নির্বিচারে মানুষ খুন করছে। তারপরেও এরা অনুতপ্ত হচ্ছে না। এদের কথায় আমি আর কীভাবে বিশ্বাস করবো? অসম্ভব!

কোনো বিখ্যাত লেখক কিংবা কবি কিংবা সাহিত্যিকের থেকে পঙক্তি ধার করার চেয়ে নিজের মনের কথা নিজস্ব ভাষায় লেখা ভালো। নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার লাইনকে বারবার ব্যবহার করলে সেই লাইনের তীক্ষ্ণতা এবং মৃত্যু উপত্যকার উচ্চতা—দুটোই কমে যায়। এই দুঃসময়ে অন্যের লেখা কবিতার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ালে এটা প্রমাণ হয় যে আপনার নিজের ভাষায় লেখার সাহস নেই। কিংবা আপনি ঘুরিয়ে নাক দেখাচ্ছেন। আপনার সাহিত্যরুচি প্রদর্শন করার সুযোগ, বেঁচে থাকলে পরবর্তী সময়ে অনেক পাবেন। এমনও হতে পারে কালকে আপনার নিজের ভাই গুলি খেলো। কিংবা আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কিংবা আপনার বাবা? মা? স্ত্রী? সন্তান? যার সঙ্গে একবেলা কথা না বললে আপনার ভালো লাগে না, সে? যে আপনার দিকে তাকিয়ে হাসলে আপনার সারাটা দিন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে? এমনকি কালকে স্বয়ং আপনি নিজেই চন্দ্রবিন্দু হয়ে যেতে পারেন, হঠাৎ-ছিটকে-আসা একটা গুলির আঘাতে। মরে গেলে তো এমনিতেও লিখতে পারবেন না। কোনো জনপ্রিয় সেলিব্রিটি কিংবা বেস্টসেলার সাহিত্যিকের বিবৃতির অপেক্ষায় থাকবেন না। প্রত্যেকেরই নিজস্ব ধান্দা আছে, যাকে যার ইচ্ছেমতো থাকতে দিন। এই দুর্দিনে নিজের মনের কথা নিজেই লিখুন। যেমন:

তুমি আর কতো গুলি করবে শেখ হাসিনা? পাকিস্তান যেমন তোমার বাবাকে দাবায়ে রাখতে পারেনি, তুমিও আমাকে দাবায়ে রাখতে পারবে না। এবার হয় তুমি থাকবে, নয় আমি। তোমার এবং তোমার সাঙ্গপাঙ্গদের এই নৃশংস নাটক আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার সহ্যের সব সীমা এখন পেরিয়ে গেছে। বুঝলে না ব্যাপারটা?

কিভাবে সহজ ভাষায় স্পষ্ট ভঙ্গিতে নিজের মনের ভাব লিখিত বাক্যে প্রকাশ করা যায়, সেটা বোঝার জন্য এই বইটা সত্যিই দারুণ! যারা দেশের দুঃসময়েও স্পষ্ট ভাষায় দরকারি কথা লিখতে পারছেন না, অবস্থার পরিবর্তন হলে, ভাবগম্ভীর আঁতেলমার্কা কেতাব পাশে সরিয়ে রেখে সবার আগে এই বইটা পড়বেন। কারণ স্পষ্ট কথার অনেক ওজন!