Ratings141
Average rating3.7
ডিস্টোপিয়া কাকে বলে-সে সংজ্ঞা ২০২৪ সালের দ্বিতীয় এই মাসে দাঁড়িয়ে নতুন করে আমাদের শেখার প্রয়োজন নেই আর। অসংখ্য বই, সিনেমা, নাটক, আর গল্পের বরাতে আমরা আজ দিব্যি জেনে গেছি, যে সমাজে আমরা শুনতে পাই “অতঃপর সকলেই সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকিলো”, সে সমাজেই অ-সুখটা সবচেয়ে বেশি। যে সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের বারবার নিশ্চিত করে সমাজের সক্কলেরই গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, আর পেটভরা গু রয়েছে, সে সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থাটি নিয়েই আমরা আজ সবচেয়ে বেশি সন্দিহান হয়ে উঠি (যদি সন্দিহান হবার সে অবকাশ বা ক্ষমতাটুকু আমাদের অবশিষ্ট থাকে)।
গল্প-উপন্যাস, কিংবা সিনেমায় আমরা বর্তমানে যে ধরনের ডিস্টোপিয়ান সমাজ বেশি দেখি, তাতে কয়েকটি বিষয়ই সচরাচর উঠে আসেঃ প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের দরুন পৃথিবীর আবহাওয়া, পরিবেশ ইত্যাদি বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, সীমিত সম্পদের সে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সংগ্রামটা খুব তীব্র, মানুষ হয়তো মাটির নিচে কিংবা পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণায়মান কোন উপগ্রহে এখন বাস করে...ইত্যাদি। তবে ডিস্টোপিয়া বলতে মোটাদাগে আমরা যা বুঝি তা হলো একজন সর্বগ্রাসী শাসকের অঙ্গুলিহেলনে চলা এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের প্রতিটি পদক্ষেপই শাসকের কড়া নজরে থাকে (চেক)। দম বন্ধ করা এ ব্যবস্থায় কথা বলার স্বাধীনতা থাকে না (চেক), নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করবার সুযোগ থাকে না (চেক), সমাজব্যবস্থাটির সমালোচনা করবার কোন উপায় নেই (চেক), সমাজটির গায়ে “ডিস্টোপিয়ান” তকমাটি লাগাবারও কোন রাস্তা নেই (চেক)। সবগুলো ঘরেই টিক চিহ্ন দিয়ে ‘চেক' করা হয়ে গেছে। কোথাও কি মিল পাচ্ছেন?
বাক এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাহীন সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার এ গল্পগুলো আজ আমাদের কাছে অনেকটাই ক্লিশে হয়ে উঠেছে; এর দায় কিছুটা ডিস্টোপিয়ান বই এবং সিনেমার, আর বাকি সবটার দায় আমাদের নিত্যদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার। আমরা ভালো করেই জানি, কীভাবে চুল রাখা উচিৎ সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে উত্তর কোরিয়ার সরকার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারনা চালিয়ে এসেছেন; সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়মের বাইরে নিজের ইচ্ছেমতো ফ্যাশনে চুল রাখবার উপায় সেখানে নেই। আমরা জানি ৩ দশক ধরে শাসন করে যাওয়া তুর্কেমেনিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান সাপারমুরাত নিয়াজভ ১২ মিলিয়ন ডলার খর্চা করে রাজধানীতে নিজের একটি বিশালাকার স্বর্ণমূর্তি বসিয়েছিলেন, যেটি সবসময় সূর্যের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। নিয়াজভ তাঁর নিজের লেখা বই ‘রুহনামা' দেশটির স্কুল, কলেজ, ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসেও অন্তর্ভুক্ত করেন। সরকারী চাকরীর ইন্টারভিউতে কিংবা ড্রাইভিং টেস্টে এই বইটি থেকেই প্রশ্ন করা হতো।
রাষ্ট্রপ্রধানের আত্নজীবনীমূলক বইয়ের ওপর চাকুরীপ্রার্থীদের পরীক্ষা দেবার ব্যাপারটি নিয়ে বছর কয়েক আগেও আমাদের দেশে হাসাহাসি করা হতো, এখন আর হয় না; কারণ, সময়ের পরিক্রমায় এ ধরনের আত্নজীবনী আমাদের দেশের চাকুরীপ্রার্থীদের পাঠ্যসূচীর তালিকাতেও ঢুকে গেছে। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্রশাসন কর্মকর্তাভেদে সকলকেই এখন এ বই পড়ে পরীক্ষায় বসতে হয়। নিজ নিজ বিষয়ের দক্ষতা এ পরীক্ষায় মুখ্য নয়, এ আত্নজীবনীকে কেন্দ্র করে কে কতখানি প্রশস্তিমূলক রচনা লিখতে পারেন, তারই পরীক্ষা মূলত এটি। টিক চিহ্ন দিয়ে চেক করবার জন্য আর কোন ঘর বাকি আছে কি? দেখা যাক...
কী হয় আসলে যদি একটি সমাজের কেউ নিজের ইচ্ছেমতো তরিকায় চুল কাটতে না পারে? কিংবা নিজের কথাগুলো বলতে বা লিখতে না পারে? কিংবা সে সমাজটির সবচেয়ে বড় পাণ্ডাটির জীবনী তাকে মুখস্থ করতে বাধ্য করা হয়? তাঁর ভাস্কর্যের সামনে মাথা নুইয়ে চলতে শেখানো হয়? মানুষ স্বাধীনচেতা প্রাণী; এ ধরণের জোর জবরদস্তির মাধ্যমে মূলত মানুষের মানবিক দিকগুলো কেড়ে নেয়া হয়। একক কোন ব্যক্তি বা সংঘ বা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই তখন যান্ত্রিক একটি সমাজ গড়ে ওঠে, যেখানে সবাইকে চোখ কান নাক বুজে কাজ করে যেতে হয় শুধু সেই ব্যক্তি বা সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই। এ ধরণের সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কোন মূল্য থাকে না; একটি দলের বা মতের অনুসারীরাই শুধু সে সমাজ দাবড়ে বেড়ান, তাঁরাই নির্ধারণ করে দেন মানুষের মুখের বুলি। কী বলা যাবে, আর কী যাবে না, তার বিষয়ে নানান নির্দেশনা আসে এই দলটির কাছ থেকে। মানুষের কল্পনার ডানা ছেঁটে ফেলে তাকে সমাজপতির ক্রীড়নকে পরিণত করা এ শাসন ব্যবস্থাটির সারকথা, ফলে এখানে মানসম্পন্ন শিল্প-সাহিত্যও কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না; শিল্পের নামে যা হয় তা মূলত তোষামোদী। ব্যক্তিজীবনের নিয়ন্ত্রণ, গোপন বাহিনী কর্তৃক উঠিয়ে নিয়ে যাবার সার্বক্ষণিক ভীতি জারি রাখা, আর দাসত্বের শৃঙ্খল-ব্যাস, এই-ই তো আদর্শ ডিস্টোপিয়ান সমাজ তৈরীর রন্ধনপ্রণালী।
ইয়েভগেনি জামিয়াতিন তাঁর ‘উই' উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৯২২ সালে, এর ইংরেজি অনুবাদটি বেরোয় আজ থেকে গুনে গুনে ঠিক ১০০ বছর আগে, ১৯২৪ সালে। এই ১০০ বছরে জামিয়াতিন প্রতিদিনই আগের দিনের চেয়ে বেশী প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন, বিশ্বময় একের পর এক ডিস্টোপিয়ান সমাজের উত্থানে। গত ১০০ বছরে-জামিয়াতিনের নিজের জন্মভূমি রাশিয়া সমেত-অসংখ্য দেশে ডিস্টোপিয়া গেঁড়ে বসেছে, ঠিক যেমন ডিস্টোপিয়া জামিয়াতিন কল্পনা করে গেছেন “উই”তে। এ উপন্যাসের চরিত্রদের কারো নাম নেই, সবার পরিচয় এক একটি সংখ্যা মাত্র। এর কারণ, উপন্যাসে বর্ণিত যে “ওয়ান স্টেট”, তা এর নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না; সমাজের সকলে মিলে “আমরা”, এখানে “আমি”'র কোন মূল্য নেই। প্রত্যেকের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেয়া রয়েছে ওপর মহল থেকে, সে মোতাবেকই কাজ করে চলে সবাই, যেন বৃহৎ কোন মেশিনের এক একটি ক্ষুদ্র অংশ আপন আপন নির্দেশ পালন করে চলেছে। কাজের ধরণের ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেকের রয়েছে বিভিন্ন বর্ণের উর্দি। নাগরিকেরা সবাই এক তালে পা ফেলে নিজ নিজ বর্ণের উর্দি চাপিয়ে কাজে যায়, কাজ করে, দিনশেষে বাড়ি ফেরে।
এই যান্ত্রিক রুটিনের বাইরে কেউ যায় না, যাবার কথাও কারো মাথায় আসে না কখনো। সবাই শুধু জানে মাথার ওপরে একজন সর্বজ্ঞ পৃষ্ঠপোষক রয়েছেন- উপন্যাসে যাঁকে benefactor বলা হয়েছে-তিনি ওয়ান স্টেটের প্রতিটি নাগরিকের গতিবিধি লক্ষ্য করেন, তাঁর চোখ এড়াবার কোন উপায় নেই। থাকবেই বা কীভাবে? এ রাজ্যের প্রত্যেকেরই যে বাস কাঁচের তৈরী স্বচ্ছ দেয়ালের বাড়িতে! শুধু বিশেষ কয়েকটি দিনে বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া সে দেয়ালে গোলাপী একটি পর্দা ঝোলানো হয় আধ ঘন্টার জন্য। সে দিনটি ভালোবাসাবাসির দিন। রাষ্ট্র তথা বেনিফ্যাক্টর নির্ধারণ করে দেন কোন দিনটিতে কে কার সাথে বিছানায় যাবে, কার দেয়ালে আধ ঘন্টার জন্য ঝুলবে গোলাপী পর্দা...
রাষ্ট্রকর্তৃক শয্যাসঙ্গী ঠিক করে দেবার ব্যাপারটি অনেকের কাছেই হাস্যকর এবং অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে বাস্তবে এমন ঘটনা সত্যিই ঘটেছে। সত্তরের দশকে পল পট যখন কম্বোডিয়াতে তাঁর খেমার রুজের শাসন প্রতিষ্ঠান করেন, তিনি জামিয়াতিনের এ মডেলেই দেশ চালান। ৮ বছর বয়স হলেই শিশুদের বাবা মা'র কাছ থেকে সরিয়ে বিশেষ শিবিরে নিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেন তিনি যেখানে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিয়ে আর দিনভর সরকারী প্রচার প্রচারণামূলক গরম গরম বক্তৃতা শুনিয়ে এই শিশুদের “প্রকৃত দেশপ্রেমী” নাগরিকে পরিণত করতেন। একটি কথাই তাদের মনে দৃঢ়ভাবে গেঁথে দেয়া হতোঃ রাষ্ট্রই হলো প্রকৃত দেশপ্রেমী নাগরিকের সত্যিকার অভিভাবক, জন্মদাতা/ দাত্রী বাবা-মা নয়; যারা এ কথা মানে না, তারা রাষ্ট্রের শত্রু, তাদের খতম করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব । পল পটের তৈরী রাষ্ট্রীয় সে যন্ত্র নির্ধারণ করে দিতো কার সাথে কার বিয়ে হবে, নিজের ইচ্ছেয় নিজের পছন্দের মানুষকে বেছে নেবার কোন সুযোগ সেখানে ছিলো না। “উই” লেখার ৫ দশকের মাঝেই ভিন্ন একটি সংস্কৃতির দেশে জামিয়াতিনের কল্পনার সে ডিস্টোপিয়া বাস্তবায়িত হয়।
যাঁরা জর্জ অরওয়েল-এর ‘১৯৮৪' পড়েছেন, তাঁদের কাছে “উই”'র এ গল্প খুব নতুন কিছু শোনাবে না, এর কারণ, অরওয়েল তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসটি লেখেন “উই”-এর আদলেই। জামিয়াতিনের উপন্যাসে নাগরিকেরা কেউ বেনিফ্যাক্টর-এর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না, অরওয়েল সে ধারণাটিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছেন, সেখানে “বিগ ব্রাদার”-এর বিপক্ষে কোন কিছু ভাবাও অপরাধ! বিশেষ এক পুলিশ বাহিনীর সাথে অরওয়েল আমাদের পরিচিত করিয়ে দেন যারা কী না নাগরিকদের বাড়ির আনাচে কানাচে নজরদারীর বিভিন্ন যন্ত্র বসিয়ে তাদের মনের খবর উদ্ধারে সদা তৎপর। “১৯৮৪” লেখার পর ৭০ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের তবুও মনে হয় অরওয়েল স্রেফ যেন গেল সপ্তাহেই বইটি লিখলেন। অরওয়েলের সময় যা ছিলো কল্পবিজ্ঞান, আজ তা-ই ধ্রুব সত্য হয়ে উঠেছে। "উই"-এর বেনিফ্যাক্টর, এবং "১৯৮৪"-এর বিগ ব্রাদার-এ দুই শাসকের নাম নির্বাচনের ব্যাপারটিও লক্ষণীয়। এ ধরণের ডিস্টোপিয়ান সমাজে এমন সর্বগ্রাসী শাসকেরা আমাদের মনে খোদাই করে লিখে দেন, তাঁরাই রাষ্ট্রটির সবচেয়ে দয়ালু মানুষ, তাঁদের বিকল্প কেউ নেই। বিকল্পহীন কৃপাময় এই মানুষদের ছাঁচটি আজ আমাদের অনেকের কাছেই যেন কিছুটা অস্পষ্টভাবে চেনা চেনা ঠেকে, তবুও আমরা চিনে নিতে চাই না।
ডিস্টোপিয়ান সমাজ বলতে আমরা আজ যা বুঝি, তা আমাদের শিখিয়েছে মূলত ৩টি বইঃ “ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড”, “১৯৮৪”, এবং “ফ্যারেনহাইট ৪৫১”। বিষয়গত দিক দিয়ে “উই”, “ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড”, এবং “১৯৮৪” প্রায় একইরকম। “উই”তে যেমন দেখতে পাই নির্দিষ্ট বর্ণের উর্দি পরে নাগরিকেরা নির্দিষ্ট কাজ করে চলেছে, “ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড”-এ আল্ডুস হাক্সলি সে ধারণাটির ওপরই আরেকটু রং চড়ান;হাক্সলির নতুন সে সাহসী পৃথিবীতে মানুষ আর স্বাভাবিক যৌন প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দেয় না, যে পেশায় যতজন প্রয়োজন তা হিসেব করে সে মোতাবেক কারখানায় ফরমায়েশ দেয়া হয়, পেশার চাহিদা অনুযায়ী বুদ্ধিমত্তার স্তর কম বেশ করে ফরমায়েশ মতো মানুষ বানিয়ে দেয় কারখানার কল। ছয় দশক পর “দ্যা মেইট্রিক্স” চলচ্চিত্রটি “ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড”-এর এ গল্পটিই নতুন করে শুনিয়েছে, তবে আরো ঢের গম্ভীর স্বরে। জর্জ অরওয়েল দাবী করে গেছেন তাঁর নিজের মতোই আল্ডুস হাক্সলিও জামিয়াতিনের “উই” থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। সে হিসেবে “উই” হলো আধুনিক সব ডিস্টোপিয়ান গল্পের গ্র্যাণ্ডফাদার।
এ তালিকার সর্বশেষ বই “ফ্যারেনহাইট ৪৫১”, যাতে রে ব্র্যাডবারি এমন এক পৃথিবীর ছবি আঁকেন, যেখানে কেউ বই পড়ে না, কারো বাড়িতে বই আছে এমন খবর পেলে বিশেষ দমকল বাহিনী এসে বই সমেত গোটা বাড়িটাই পুড়িয়ে দিয়ে যায়। রাষ্ট্রপ্রধানের বিরোধী মতটি তাই কখনো শোনা যায় না। ব্র্যাডবারির সে সমাজে মানুষ সস্তা বিনোদনে মেতে থাকে, ভাবনা-চিন্তার ঝামেলায় যায় না, প্রশ্ন করে না। দূর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে সে মৃত্যুও তাদের স্পর্শ করে না। এ বইটি লিখে ব্র্যাডবারি ঘোষণা করেন, “একটি সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে বই পোড়াতে হয় না, বই পড়ার অভ্যাসটা তুলে দিলেই হয়”। সম্মানিত বাঙলাদেশী পাঠক, ব্র্যাডবারির কল্পনার সে সমাজের সাথে কোথাও কি মিল দেখতে পাচ্ছেন?
প্রযুক্তির দানবিক অগ্রগতি, বই পড়া ও গঠনমূলক চিন্তার প্রতি মানুষের অনাগ্রহ, একের পর এক ছোটলোকদের ক্ষমতায় আরোহন...বিশ্বময় এই ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করে সচেতন পাঠক-গবেষকদের অনেকেই এখন সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছেন। ডিস্টোপিয়ান সাহিত্যের তিন মহারথী যে যে ভয়ানক সমাজগুলো কল্পনা করে গেছেন, আমরা নাকি এখন তার সবগুলোর ভেতর দিয়েই যাচ্ছি। পর্যবেক্ষণটি সত্যি হয়ে থাকলে চিন্তার ব্যাপারই বটে; একই সঙ্গে ৩ রকম ডিস্টোপিয়ার মাইনকার চিপায় মানবসমাজ বোধহয় আগে পড়েনি!
বাঙলাদেশ পৃথিবীর বাইরের কোন দেশ নয়। গোটা পৃথিবীবাসীই যখন নিজেদের বিভিন্নরকম ডিস্টোপিয়ার অংশ বলে মনে করছে, বাঙলাদেশ এর ব্যক্তিক্রম কেন হবে? প্রশ্ন হলো কোন ধরণের ডিস্টোপিয়াটি বাঙলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক? প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে; “উই”'র শিল্পোন্নত সমাজ, কিংবা “ব্রেইভ নিউ ওয়ার্ল্ড”-এর কারখানায় ফরমায়েশ মোতাবেক মানুষ বানাবার ব্যাপারগুলো তাই খাটে না দেশটির জন্য। এখানে মুক্তবাকের সুযোগ নেই, ওপর মহলের কুদৃষ্টিতে পড়লে বরং ফ্রাঞ্জ কাফকার “দ্যা ট্রায়াল” উপন্যাসের মতোই রহস্যজনক লোকেরা এসে দরজায় কড়া নাড়ে, ফ্রিজ খুলে আপেল বের করে খেয়ে ফেলে, অজানা এক মামলায় আদালত থেকে আদালতে ঘোরাতে থাকে জীবনের শেষ দিনটি অব্দি... কাফকা ট্রায়াল লিখেছিলেন ১৯১৪ সালে, কিন্তু বাঙলাদেশের কারো যদি এ বই পড়ে মনে হয় কাফকা আসলে গত ২ সপ্তাহের খবরের কাগজে দেশের সংবাদ পড়ে বইটি লিখেছেন, তাঁকে বোধহয় খুব বেশী দোষ দেয়া চলে না। “উই”-এর সাথে বড় একটি মিল অবশ্য রয়েছে বাঙলাদেশের; এখানেও একজন বেনিফ্যাক্টর রয়েছেন যাঁকে কেন্দ্র করে দেশটির সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ বেনিফ্যাক্টর-এর পৃষ্ঠপোষক যে বেনিফ্যাক্টর রয়েছেন, তাঁর নীতির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করলে খুন হয়ে যেতে হয়। এখানেই “উই”-এর সাথে পার্থক্য। অতটা দূরদর্শী কল্পনাশক্তির পরিচয় খোদ জামিয়াতিন নিজেও দিয়ে যেতে পারেননি।
তবে, বাঙলাদেশের বাস্তবতায় সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস সম্ভবত “ফ্যারেনহাইট ৪৫১”; এখানে নির্দিষ্ট একটি মতের বিরোধীতা করে কোন বই ছাপানো যায় না, ৪৫১ ফ্যারেনহাইটে তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। শুধু বই নয়, ৪৫১-এর লেলিহান সে শিখা গ্রাস করে নেয় বিরোধী মত ধারণ করা মানুষদেরও। ২০২৩ সালের এক গবেষণাতেই উঠে এসেছে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের ৭১.৫% অংশ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করাকে অনিরাপদ মনে করে। ভয়ের এ সংস্কৃতিতে কথা বলতে না পেরে জনগণ তাই ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে ওঠে বিনোদনের সবচেয়ে সস্তা রাস্তাগুলোর ওপর। জীবনে একটিও বই না পড়া, একটিও গঠনমূলক প্রশ্ন না করা শূণ্য মগজগুলোতে যখন নিম্নমানের বিনোদনের মাধ্যমগুলো সুড়সুড়ি দেয়া শুরু করে, মানবিক সম্পর্কগুলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ভেঙে পড়তে থাকে। একের পর এক কিশোর গ্যাং-এর উত্থান ঘটতে থাকে, যাদের বিনোদনের অন্যতম উৎস সাধারণ পথচারীদের কব্জি কেটে সে কাটা হাত নিয়ে টিকটক ভিডিও বানানো। ঠিক এমনটিই তো দেখে গেছেন রে ব্র্যাডবারি, তাই না?
ডিস্টোপিয়ার এ ধারা বহমান; তার জোরালো স্রোতে ভেসে যায় পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধনও। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যাবার টাকা যোগাড় করবার জন্য আপন নানাকে খুনের সাম্প্রতিক এক সংবাদে সংক্ষুব্ধ হয়ে ডিস্টোপিয়ান কবি আব্দুল্লাহেল হেলফায়ার তিতিবিরক্ত হয়ে একটি ডিস্টোপিয়ান পদ্য লিখে বসেনঃ
বুইড়া হালায় খবিসচোদা, টেগা চাইলেই “না না”
ইয়াং বয়েসের ধাড়কান কী বোঝে না আমার বালের নানা
দোস্তরা মিল্লা ফাঁস দিছি হালারে, টেগাও পাইছি নগদে নগদ
কিলিক কইরা লগেই থাকেন, আইতাছে এইবার ককশোবাজারে টিক্টক।
“উই” উপন্যাসে বেনিফ্যাক্টর-এর বিরুদ্ধে একসময় মানুষ বিদ্রোহ করে। বেয়াড়া এই নাগরিকদের বশে আনতে বেনিফ্যাক্টর নতুন একটি আইন বানানঃ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রত্যেকের মগজের সৃষ্টিশীল অংশটিকে নষ্ট করে দিতে হবে। মানুষের মানবিক দিকগুলোকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে তাকে স্রেফ আজ্ঞাবহ এক যন্ত্রমানবে পরিণত করাই বেনিফ্যাক্টর-এর মূল লক্ষ্য। বাঙলাদেশের শাসনের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, যাঁরা আছেন, যাঁরা থাকবেন, তাঁদের কাউকেই নাগরিকদের “মস্তিষ্ক প্রক্ষালন”-এর জন্য আলাদা আইন বানানো নিয়ে কখনো মাথা ঘামাতে হয়নি, হবে না। কারণ, এখানে “ফ্যারেনহাইট ৪৫১” বহু আগেই বাস্তবায়িত হয়ে গেছে। এখন আর সরকার প্রধানকে আয়োজন করে বই পোড়াতে হয় না, বই পড়ার এবং প্রশ্ন করবার অভ্যাসটাই উঠে গেছে। এ দেশের মানুষ প্রক্ষালিত মস্তিষ্ক নিয়েই জন্মায়। ২০ কোটি প্রক্ষালিত মস্তিষ্কের একটি জাতি আমরা-“ উই ”।