Your Inner Fish

Your Inner Fish

2008 • 229 pages

Ratings23

Average rating3.8

15

“মানুষ কোথা থেকে এলো”- এ প্রশ্নটি তো আমাদের সব্বাইকেই একবার না একবার বিব্রত করেছেই। ধর্মগ্রন্থের সরল ব্যখ্যা যাঁরা মেনে নিতে চান না, তাঁদের জন্য তো প্রশ্নটি আরো বেশী বিব্রতকর! বিজ্ঞানের ব্যখ্যা যাঁরা মানতে নারাজ, তাঁরা “বিজ্ঞান বলে মানুষ বাঁদর থেকে এসেছে” বলে একটি অপপ্রচার চালান। বিজ্ঞান যে দাবীটি মূলত করে সেটি হলো বাঁদর ও মানুষ একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। বাঁদর আমাদের মানুষদের “বাবা” নয়, “খালাতো”/ “চাচাতো”/ “মামাতো” ভাই-বোন। তাহলে এই সব cousin-গোত্রীয় প্রাণীদের common যে পূর্বপুরুষ, সেই “পরদাদা” প্রাণীটি কোনটি? এর উত্তর লুকিয়ে আছে ৩৭৫ মিলিয়ন বছর পুরনো ফসিলে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নেইল শ্যুবিন ডাঙায় চলাচলকারী সকল মেরুদণ্ডী প্রাণীদের “পরদাদা” যে প্রাণীটি, তার ফসিলের সন্ধান পেয়েছিলেন ২০০৪ সালে। সেই চমকপ্রদ আবিষ্কার নিয়েই তাঁর বই “ইওর ইনার ফিশ”, যা আপনাকে আপনার অভ্যন্তরীণ মাছটির সন্ধান দেবে!


ফসিল শিকারী বিজ্ঞানীরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের ফসিল কীভাবে খুঁজে বের করেন? তাঁরা কি চোখ বন্ধ করে ‘অপু দশ বিশ তিরিশ চল্লিশ' জপে আন্দাজে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দেন? উত্তরটা অবশ্যই ‘না'। মাটির নিচে ফসিলকৃত শিলা আসলে সময়কাল অনুযায়ী স্তরে স্তরে সুবিন্যাস্ত থাকে; যে শিলা (বা ফসিল) পৃথিবীর যতো গভীরে, তা ততো প্রাচীন। ওপরের স্তরগুলোতে ওঠার সাথে সাথে নতুনতর শিলা এবং ফসিলের দেখা মিলতে থাকে। এ ব্যাপারটি যে সবসময়ের জন্যই অমোঘ সত্য তা ঠিক নয়; ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে শিলার স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকতেই পারে। বিশেষতঃ বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের চাপ ও তাপে আগের পরের অনেক শিলাস্তর মিশে একাকার হতেই পারে, তবে এর ভেতর থেকেও সঠিকভাবে সময়কাল অনুযায়ী স্তরগুলোকে আলাদা করা সম্ভব।

যে কোন শিলায়ই কি তবে ফসিল থাকে? এর উত্তরও ‘না'। ফসিল সংরক্ষণের জন্য আদর্শ শিলা মূলত চার রকমঃ চুনাপাথর (limestone), বেলেপাথর (sandstone), পাললিক শিলা (siltstone), এবং অপেক্ষাকৃত নরম শিলা যা শেইল (shale) নামে পরিচিত। এ ধরণের শিলা গঠিত হয় মূলত নদী, সমুদ্র, বা হ্রদের গতিপথের কারণে। প্রাণের বিকাশ ও বিস্তার এমন পরিবেশে হবে সেটিই স্বাভাবিক। পাললিক প্রক্রিয়ার কারণেও এ ধরণের শিলাতে ফসিল প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত থাকে শত শত মিলিয়ন বছর ধরে। বিপরীতে, আগ্নেয় শিলা (volcanic rock) এবং রুপান্তরিত শিলা (metamorphic rock) মূলত পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রচন্ড তাপ ও চাপে তৈরী হয়, এমন পরিবেশে প্রাণের বিকাশ না হবার সম্ভাবনাই বেশী, তাই ফসিল শিকারীরা সে পথ বেশী একটা মাড়াননা। মূলত জনপ্রাণহীন বিরান অঞ্চলগুলোতেই সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত ফসিলগুলো পাওয়া যায়; মরু বা মেরু অঞ্চলে যেহেতু গাছপালা নেই, মনুষ্য নির্মিত দালানকোঠা, গাড়ী-ঘোড়া নেই, মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে ফসিলগুলো তাই দিব্যি অবিকৃত থাকতে পারে। সাহারা, গোবি, ইউটাহ ইত্যাদি উষ্ণ মরু অঞ্চল তো বটেই, উত্তর গোলার্ধের তুষার মরুও (arctic desert) ফসিল শিকারের জন্য আদর্শ জায়গা।

শ্যুবিন এ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন আর্ক্টিকের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কী অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে তাঁরা শিলা সংগ্রহ করেছেন। পদে পদে মেরু ভালুকের আক্রমণের আশঙ্কা, রসদ ফুরিয়ে যাবার ভয়, তুষার ঝড়ে আটকা পড়ে হারিয়ে যাবার চিন্তা...এমন হাজারো বিপদ মাথায় নিয়ে মানুষের বিজ্ঞানযাত্রাকে ঋদ্ধ করার কাজটি এঁরা করে গেছেন নাক মুখ গুঁজে। গোটা বছরের হাতেগোণা অল্প ক'টা দিনেই শুধু আর্ক্টিকে কাজ করা সম্ভব। একদিন এদিক ওদিক হলেই খারাপ আবহাওয়ার খপ্পরে পড়তে হয়। যে ভয়ানক দুর্গম খাড়া পাহাড়ী অঞ্চলে শ্যুবিন ও তাঁর গবেষক দলকে হেলিকপ্টার নামিয়ে দিয়ে যায়, সেখান থেকে নিকটতম বেইস ২৫০ মাইল দূরে। হেলিকপ্টার কতখানি ওজন বইতে পারবে তারও ধরাবাঁধা সীমা আছে, চাইলেই বড় এক টুকরো শিলা ভেঙে নিয়ে চলে আসা যায় না। বরফশীতল পরিবেশে জীবন হাতের মুঠোয় ধরে ছোট একটি হাতুড়ি দিয়ে টুকটুক করে বাছাই করা শিলা কেটে চলা...এ মোটেই কোন সহজ কাজ নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শত শত মাইল জুড়ে শুধু বরফ দেখে যাওয়াটাও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব সুখকর কিছু নয়। বিরান এই অঞ্চলে কোন গাছপালা বা বাড়ীঘর যেহেতু নেই, দূরত্বের ঠাহরও পাওয়া যায় না; চোখে ধাঁধা লাগে, ১ মাইল আর ৫ গজ দূরের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না মানব মস্তিষ্ক। এইসব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে, ১৫০০ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শিলা ঘেঁটে, ৩ বার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর শেষতক কাঙ্ক্ষিত সেই ফসিল উদ্ধার করে শ্যুবিনের দল; মানবজাতির উদ্ভব ও বিকাশের ব্যখ্যা অনেকটাই লুকিয়ে আছে যেখানে।

২০০৪ সালে শ্যুবিনরা ৩৭৫ মিলিয়ন বছর পুরনো যে ফসিলটি খুঁজে পান, সেটির নাম রাখা হয় টিকটালিক; ইনুকটিউট ভাষার এই শব্দটির অর্থ ‘মিঠাপানির বড় মাছ'। এই আবিষ্কারটি এত গুরুত্বপূর্ণ, এর কারণ, বেশ কিছু দিক থেকেই প্রাণীটি অনন্য। আমরা জানি, মাছের ঘাড় থাকে না; তাদের মাথা এবং কাঁধ একসাথে জোড়া লাগানো থাকে কয়েকটি হাড়ের সংযোগে। টিকটালিকের আগের সময়ের যতো মাছের ফসিল পাওয়া গেছে, সেগুলোর কোনটিতেই ঘাড় নেই; চলার পথে বাঁক নিতে গেলে গোটা শরীরের সাথে মাথাটাও এদের ঘোরাতে হতো। একমাত্র টিকটালিকেই ঘাড়ের সন্ধান পাওয়া যায়; এরা শরীর না বাঁকিয়েও মাথা ঘোরাতে পারতো (যেমনটা আমরা পারি)। আমাদের পাশাপাশি এই বিশেষত্বটি আছে উভচর, সরিসৃপ, পাখি, এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝেও।

মাথা এবং ঘাড়ের এই ‘নতুন' বিন্যাস আরো অনেকগুলো দরজা খুলে দেয়। ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিখ্যাত অ্যানাটমিস্ট স্যার রিচার্ড ওয়েন বিভিন্ন প্রাণীর শরীর ব্যবচ্ছেদ করে প্রানী জগতের একটি ‘নীলনকশা' আবিষ্কার করলেন। ‘হাত' এবং ‘পা' সংবলিত সকল প্রাণীরই এই প্রত্যঙ্গগুলো আসলে একই ছাঁচে গঠিত। আমাদের জন্য যা ‘হাত' এবং ‘পা', প্রাণীবিশেষে তা কখনো ডানা, কখনো হাত, কখনোবা সাঁতার কাটার ফ্লিপার। প্রত্যঙ্গগুলোর গঠনের দিকে তাকালে আমরা একটি সূত্রই দেখতে পাই সবার ক্ষেত্রেঃ প্রথমে একটি হাড় (হাতের ক্ষেত্রে হিউমেরাস, পায়ের ক্ষেত্রে ফিমার), এরপর দু'টি হাড় (হাতের ক্ষেত্রে রেডিয়াস এবং আলনা ও পায়ের ক্ষেত্রে টিবিয়া এবং ফিবুলা), আর সবশেষে একগোছা ছোট ছোট হাড় (আঙুল)। ওয়েনের এ আবিষ্কারের কিছুদিন পরই ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদের তত্ত্বটি সামনে আনেনঃ এই প্রাণীগুলোর গঠন-প্রকৃতি একরকম কারণ, এদের সবারই উৎপত্তি একই পূর্বপুরুষ থেকে। সোজা বাঙলায়, এই প্রাণীরা সবাই একে অপরের চাচাতো/ জ্যাঠাতো / ফুপাতো ভাই-বোন!

টিকটালিকের অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য হলো, মাছটির হাত-পায়ের মতো প্রত্যঙ্গ ছিলো, যেটি এর আগের কোন মাছে দেখা যায়নি। শুধু তাই-ই নয়, হাড়ের কাঠামো সাক্ষ্য দেয় মাছটি রীতিমতো বুকডনও দিতে পারতো! বুকডন দেবার সময় আমাদের কনুই ভাঁজ হয়ে আসে, বুকের পেশীগুলোর সংকোচন প্রসারণের মাধ্যমে আমরা নিজেদের ধাক্কা দিয়ে ওপরে নিচে ওঠানামা করাতে পারি; টিকটালিক এর সবই করতে পারতো। আমরা যে কনুই সোজা রেখেও ওপরে নিচে ইচ্ছেমতো বুড়ো আঙুলটা নাড়াতে পারি, এর কারণ, আমাদের হিউমেরাস ও রেডিয়াসের সংযোগস্থলে থাকা কোটরসন্ধিটি (ball-socket joint)। ভাত বা ডালের বাটি থেকে হাতা দিয়ে তুলে পাতে ঢালতে আমরা দু'টি বিপরীত ভঙ্গিতে হাত ঘোরাইঃ supination (বাটি থেকে ভাত তোলা) ও pronation (পাতে ভাত ঢালা)। হিউমেরাস ও রেডিয়াসের কোটরসন্ধির এ গঠনটি টিকটালিকের মাঝেই প্রথম দেখা যায়, এর আগের কোন প্রাণীতে এমন কোন বৈশিষ্ট্য ছিলো না।

টিকটালিকের সাথে আমাদের বাহ্যিক গঠনগত বৈশিষ্ট্যগুলোর পর এবার একটু অন্যদিকে চোখ ফেরানো যাকঃ জিনতত্ত্ব! ১৯৫০ এবং '৬০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা মুরগীর ভ্রুণের ওপর গবেষণা চালানো শুরু করেন। তাঁরা মূলত ভ্রুণের এক অংশ থেকে টিস্যু অপসারণ করে অন্য অংশে প্রতিস্থাপন করলে এর ফলাফল কী দাঁড়ায় তা-ই দেখতে চাইছিলেন। আমাদের হাতে বা পায়ে যেমন বুড়ো আঙুল থেকে কনিষ্ঠা পর্যন্ত ৫টি হাড়ের ভাগ রয়েছে, পাখির ডানাতেও তেমনি অনেকগুলো ভাগ রয়েছে, বোঝার সুবিধের জন্য যেগুলোকে আমরা বৃদ্ধাঙুল, তর্জনি, মধ্যমা, অনামিকা, কনিষ্ঠা ইত্যাদি হিসেবে কল্পনা করে নিতে পারি। ভ্রুণের টিস্যু গ্র্যাফটিং-এর গবেষণায় দেখা গেলো, যে টিস্যুটি পাখির ডানার ‘কনিষ্ঠা' গঠন করে, সেটিকে যদি বিপরীত পাশের ডানার টিস্যুতে প্রতিস্থাপন করে হয়, তাহলে সেখানে স্বাভাবিক ডানাটির গঠন তো হয়ই, সাথে সাথে বিপরীত যে পাশের ডানা থেকে টিস্যু নিয়ে আসা হলো, সে অংশের পূর্ণ একটি ডানাও গজিয়ে যায়। এই টিস্যুটির নাম দেয়া হয় জোন অফ পোলারাইজেশন অ্যাকটিভিটি (জিপিএ)। ডানা বা হাতের বৃদ্ধাঙুলের গঠন যে কনিষ্ঠার চেয়ে ভিন্ন তার জন্য দায়ী এই জিপিএ। এই পরীক্ষাগুলো থেকে বিজ্ঞানীরা উপসংহার টানলেন, এই জিপিএ থেকে কিছু একটা নিশ্চয়ই নিঃসরিত হয়, যা আঙুলগুলোর গঠন কেমন হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে (স্পয়লারঃ জিন!)।

মুরগীর ভ্রুণের ওপর চালানো এ গবেষণা নতুন দুয়ার খুলে দেয়। বিজ্ঞানীরা শিগগীরই আবিষ্কার করলেন, মাছির একটি বিশেষ জিন রয়েছে, যা মাছির শরীরের বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন গঠন-রূপ দেয়; জিনটির নাম দেয়া হয় হেজহগ। মাছির পর এবার মুরগীর ওপর পরীক্ষা করেও হেজহগ জিনটির খোঁজ পাওয়া গেলো, তবে সেটি মুরগীর নিজস্ব সংস্করণ, যার নাম দেয়া হয় সনিক হেজহগ। গবেষণায় দেখা গেলো, হাত/ পা (limb) সংবলিত যেকোন প্রাণীরই যেখানেই জিপিএ টিস্যুটি রয়েছে, সেখানেই কেবল হেজহগ জিনটি কাজ করে। মাতৃগর্ভে থাকবার সময় অষ্টম সপ্তাহে যদি এই হেজহগ জিনটি তার কাজ করা শুরু না করতো, তাহলে হয়তো আপনার বাড়তি কিছু আঙুল থাকতো, কিংবা আপনার বৃদ্ধাঙুল আর তর্জনি হয়তো দেখতে একই রকম হতো। হাত/ পায়ের গঠন, প্রতিটি আঙুলের আকারের ভিন্নতা, ডান দিক-বাঁ দিকের প্রতিসমতা-এই সবকিছুই নিশ্চিত করে হেজহগ জিন। মুরগী, ব্যাঙ, ইঁদুর...হাত/ পা সংবলিত যে কোন প্রাণীর ডিএনএ রেসিপি আদতে আসলে একই।

সনিক হেজহগ জিনটি যেহেতু হাত/পা সংবলিত প্রাণীদের হাড়ের কাঠামো গঠন করে, তাহলে যেসব প্রাণীতে হাড়ের গঠন একেবারেই ভিন্ন, তাদের ক্ষেত্রে কী হয়? তখনও কি সনিক হেজহগ কাজ করে? ইঁদুর, মুরগী, ব্যাঙ, বাদুড়-“একইরকম” হাড়ের কাঠামোর এসব প্রাণীদের বেলায় সনিক হেজহগের একই ভূমিকা আবিষ্কার করবার পর বিজ্ঞানীরা এবার গবেষণা শুরু করলেন হাঙর নিয়ে। হাড়ের কাঠামোর দিক দিয়ে হাঙর এবং সমগোত্রীয় মাছেরা (যেমন স্কেইট) আমাদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। আমাদের কঙ্কালের কাঠামোটি যেমন বয়েস বাড়বার সাথে সাথে শক্ত হাড়ে পরিণত হয়, হাঙরদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনা; তাদের কাঠামোটি আজীবন নরম কার্টিলেজের-ই রয়ে যায়, যে কারণে এদের কার্টিলেজিনাস মাছ বলা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেলো এই কার্টিলেজসর্বস্ব হাঙরদেরও (কিংবা স্কেইটদের) একটি ‘হাঙর সনিক হেজহেগ জিন' (স্কেইটদের বেলায় স্কেইট সনিক হেজহগ জিন) রয়েছে।

এর মানে কি হাঙর/ স্কেইট ইত্যাদি কার্টিলেজিনাস প্রানীদের চেয়ে আমরা একেবারেই ভিন্ন? স্কেইটের পাখনায় হাড়ের যে রডগুলো রয়েছে, তা সবই দেখতে একইরকম (আমাদের হাতের পাঁচটি আঙুলই যদি দেখতে একই রকম হতো, তেমন)। এমন কোন উপায় কি আছে যাতে ভিন্ন কোন সনিক হেজহগের মাধ্যমে এই রডগুলোর আকারে ভিন্নতা আনা যায়? স্কেইটের ভ্রুণে ইঁদুরের সনিক হেজহগ প্রবেশ করিয়ে একটি পরীক্ষা করা হলো। এই পরীক্ষার দু'টি ফল হতে পারেঃ এক. কিছুই হবে না, সেক্ষেত্রে বোঝা যাবে স্কেইট বা হাঙরেরা আমাদের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন প্রাণী, আমাদের মাঝে কোনই সম্পর্ক নেই, আর দুই. যদি স্কেইটের মতো একটি মাছের ভ্রুণে ইঁদুরের মতো একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর জিন কাজ করে, যদি স্কেইটের পাখনার রডগুলো ভিন্ন ভিন্ন আকারে গঠিত হয়, তাহলে বোঝা যাবে মাছ ও স্তন্যপায়ী প্রানী খুব আলাদা কিছু নয়, মাছের ডিএনএ নতুন কোন ডিএনএ নয়; আদিমতম ডিএনএ'র অভিযোজিত একটি সংস্করণ মাত্র। এবং, কার্যতই, সে পরীক্ষায় দেখা যায় ইঁদুরের হেজহগ জিন স্কেইটের রডগুলোকে হাতের পাঁচ আঙুলের মতো ভিন্ন ভিন্ন আকার দিয়েছে। হাঙরের সাথে আমাদের আত্নীয়তার একটি সংযোগ এবার প্রতিষ্ঠিত হলো!

হাড় নিয়ে হড়বড় করে এত্তগুলো কথা খর্চা করে ফেললাম, প্রাণীজগতে এই হাড়ের উৎপত্তিটা কোথায়? মেরুদণ্ডে? চোয়ালে? নাকি শরীরের বাহ্যিক আস্তরণে? অনেকের কাছেই আশ্চর্য ঠেকবে, কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে হাড়ের উৎপত্তি আসলে দাঁতে! ১৮৩০-এর দিকে ২৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বছরের পুরনো কিছু প্রাচীন সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিলের খোঁজ পাওয়া যায়, এদের নাম দেয়া হয় কনোডন্টস। ছোট আকৃতির নরম শরীরের এই প্রাণীগুলোতে একধরণের শক্ত শক্ত কাঁটার দেখা মেলে যা বাইরের দিকে মেলে থাকে। এই কনোডোন্টসরা যে আসলে কী, সে নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেকদিন তর্ক করেছেন; কেউ বলেছেন এরা উদ্ভিদ, কেউ বলেছেন এরা আসলে প্রাকৃতিক মিনারেল, আর অল্প কেউই এরা যে প্রানী তার পক্ষে রায় দিয়েছেন। এই রহস্যের সমাধান হয় যখন ল্যাম্প্রে নামক এক ধরণের আদিম মাছের সন্ধান মেলে। চোয়াল বিহীন এই ল্যাম্প্রে মাছগুলো অন্য মাছের গায়ে আটকে থেকে সে মাছের তরল অংশটুকু চুষে খেয়ে নিতো। ল্যাম্প্রের ফসিলে কনোডোন্টস-এর সেই ধারালো কাঁটা দেখতে পাওয়া যায়।


ছবি সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

যে উপাদানটির উপস্থিতি দাঁতকে অত শক্ত বানায় সেটিকে বলে হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট। হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট এতটাই শক্ত যে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পরেও তা ফসিলে অবিকৃত থাকে, এবং ফসিলের দাঁত থেকে বুঝে নেয়া যায় প্রাণীটি মাংসাশী ছিলো নাকি উদ্ভিদ্ভোজী (মাংসাশী প্রাণীর দাঁত সূক্ষ্ম, ধারালো ও সূঁচালো হয়, মাংস কেটে বসবার জন্য; উদ্ভীদ্ভোজীর দাঁত হয় সমান, যাতে তা সহজে বাদাম জাতীয় ফল ভেঙে ফেলতে পারে)। কনোডন্টস-এর দাঁতে পাওয়া হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট ইঙ্গিত করে, প্রাণীজগতে হাড়ের উদ্ভব প্রতিরক্ষার জন্য নয়, খেয়ে পরে বেঁচে থাকবার জন্য! শ্যুবিন মন্তব্য করেছেন, প্লাস্টিক উদ্ভাবনের পর যেমন গাড়ীর কলকব্জা থেকে শুরু করে ইয়ো ইয়োতে তা ব্যবহৃত হয়েছে, দাঁতের ব্যাপারটাও ঠিক অমনি। যখনই খেয়ে বেঁচে থাকবার জন্য প্রাণীকুলে দাঁতের উৎপত্তি ঘটেছে, পরিপার্শ্ব এবং অবস্থানের প্রেক্ষিতে অভিযোজিত হয়ে হয়ে এ দাঁত আস্তে আস্তে অন্যান্য অঙ্গের জন্ম দিয়েছে; দাঁত না থাকলে শরীরে আঁশ, পালক, বা স্তন এসবের কিছুই নাকি হতো না!

হাঙরের সাথে আমাদের আত্নীয়তার কথা তো একটু আগেই জেনেছি। হাঙর ও মানুষের ভ্রুণের দিকে নজর ফেরালে বেশ কিছু মিল চোখে পড়ে। উভয় ক্ষেত্রেই চোয়াল গঠিত হয় ভ্রুণের ৪টি খাঁজের প্রথমটি থেকে (ছবির arch 1)



হাঙরের সাথে পার্থক্য হলো, মানুষের বেলায় প্রথম এ খাঁজটি থেকে চোয়ালের পাশাপাশি কানের কিছু হাড়ও গঠিত হয়, হাঙরের বেলায় তা হয় না। হাঙরের ভ্রুণে দ্বিতীয় খাঁজের কোষগুলো বিভাজিত হয়ে কার্টিলেজ ও পেশী গঠন করে, মানুষের বেলায় মধ্য কান ও গলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৈরী করে, যার মাঝে অন্যতম হাইওয়েড নামের ছোট হাড়টি। ঢোঁক গেলা, গান শোনা এই কাজগুলো আমরা করতে পারি এই হাইওয়েডের জন্যই। বস্তুতঃ মাছ, সরিসৃপ, ও স্তন্যপায়ী-সব্বার ক্ষেত্রেই ভ্রুণ গঠিত হয় তিনটি স্তর থেকে, যাদের জার্ম লেয়ারস বলা হয়। প্রতিটি মেরুদণ্ডী প্রাণীর ক্ষেত্রেই-যতই তারা ভিন্ন হোক-হৃৎপিণ্ড গঠিত হয় এই জার্ম লেয়ারের একই স্তর থেকে, মস্তিষ্ক গঠিত হয় আরেকটি ভিন্ন স্তর থেকে।

জার্ম লেয়ারের এই তিনটি স্তরের নাম যথাক্রমে এক্টোডার্ম, এন্ডোডার্ম, ও মেসোডার্ম। এক্টোডার্ম গঠন করে চামড়া ও স্নায়ুতন্ত্র। ভেতরের স্তর এন্ডোডার্ম গঠন করে পরিপাকতন্ত্র, আর মাঝের স্তর মেসোডার্মের কাজ আমাদের হাড় ও পেশী তৈরী করা। এই ব্যবস্থাটিকে অনেকটা একটি টিউবের ভেতর আরেকটি টিউব হিসেবে দেখা যায়। এ ব্যাপারটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? ১৯২০-এর দশকে হিল্ডে ম্যানগোল্ড একটি পরীক্ষা করেন; তিনি স্যালামান্ডারের একটি ভ্রুণে অন্য প্রজাতির একটি প্রাণীর জার্ম লেয়ারের একটি টিস্যু লাগিয়ে দেন। এ কাজটি করবার জন্য যে হাতের ওপর দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন সে তো বলা বাহুল্য। স্যালামান্ডারের গোলাকার এই ভ্রুণের ব্যাস ছিলো ১ ইঞ্চির ১/১৬ ভাগ! হিল্ডের পরীক্ষায় দেখা গেলো অন্য প্রাণী থেকে এনে জোড়া লাগিয়ে দেয়া সেই টিস্যুর বরাতে যমজ স্যালামান্ডারের জন্ম হয়েছে! এই টিস্যুটিকে পরবর্তীতে অরগ্যানাইজার নাম দেয়া হয়। জিন প্রকৌশলে এটি সম্ভবত আজতক সবচেয়ে বড��� আবিষ্কার; স্তন্যপায়ী, মাছ, পাখি, সরিসৃপ-সবারই অরগ্যানাইজার আছে। কাট, স্লাইস, অ্যান্ড ডাইস; মুরগীর অরগ্যানাইজার কেটে এনে স্যালাম্যান্ডারের ভ্রুণে লাগিয়ে দিন, ব্যাস, পেয়ে গেলেন যমজ স্যালাম্যান্ডার!


ছবিসূত্রঃ Know your meme

পৃথিবীর বয়েস সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছর। আধুনিক মানুষের আবির্ভাব মাত্রই লাখখানেক বছর আগে। এই গোটা সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছরকে যদি এক বছরে প্রকাশ করতে হয়, ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর, তাহলে জুন মাসেই কেবল এককোষী প্রাণীরা এলো। মাথা ওয়ালা প্রাণীদের আবির্ভাব অক্টোবরে, আর মানুষের আবির্ভাব আজকের দিনে, ৩১ ডিসেম্বরে। অসম্ভব লম্বা একটি রাস্তা পেরিয়ে, বহু বহু পরিবর্তনের বাঁকে ঘুরে তবে মানুষ আজ আজকের এই অবস্থায় এলো। পানির মাছেদের বিবর্তন ঘটে ঘটে, তাদের বহু বৈশিষ্ট্য নিয়ে দিয়ে থুয়ে ডাঙার আমরা আজ মঙ্গলে উপগ্রহ পাঠাচ্ছি। এই বই লিখে নেইল শ্যুবিন মূলত দু'টি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। প্রথমত, আমরা সব প্রাণীরাই একে অপরের আত্নীয় কোন না কোনভাবে। কুমির, বাদুড়, বিড়াল, পাখি, মাছ, বাঁদর-এরা সবাই আসলে একটু একটু আমরা, আর আমরা একটু একটু ওরা। এ ব্যাপারটিকে অনুধাবন করতে না পারলে “মানবিকতা” আমাদের কাছে সবসময়ই অভিধানের একটি আলঙ্কারিক শব্দ হয়ে থাকবে। কোন আসমানী কিতাব দিয়েই আমরা নিজেদের মানবিক করে তুলতে পারবো না।

দ্বিতীয়ত, এই অসম্ভব বড় পরিবর্তনগুলোর হাত ধরে যে আজ আমরা মানুষ হলাম, সেই কনোডন্টস-এর প্রাথমিক দাঁত থেকে আজকের আমরা, এর পেছনের কারণটা হলো আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে ক্রমশঃ অবস্থা ও পরিপার্শ্বের সাপেক্ষে নিজেদের বদলেছি; আমাদের জন্মই হয়েছে গতিশীল থাকবার জন্য। আমরা যদি কোন শারীরিক পরিশ্রম না করি, নিজেদের জীবনকে ক্রমাগত পরিবর্তন করতে না থাকি, শুধুই সোফায় শুয়ে মুখে চিপস গুঁজে নেটফ্লিক্স-বিলাস করতে থাকি, বিবর্তনের উল্টো রাস্তায় হেঁটে আমরা ডোডো পাখির মতোই বিলীন হয়ে যাবো। দূর সম্পর্কের এক জ্যাঠাতো ভাইয়ের হঠাৎ অন্তর্ধানে প্রাণীজগতের কারোরই তাতে কিছুই এসে যাবে না।

October 31, 2022