Ratings1
Average rating5
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
“কথা ও কাহিনী” রবীন্দ্রনাথের একটি ব্যতিক্রমী কাব্যগ্রন্থ। এই বইটি লেখার ঠিক আগেই তিনি “কণিকা” নামের একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন। কণিকা-র ছোটো ছোটো কবিতাগুলোর সঙ্গে বাঙালি ইশকুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা, “ভাবসম্প্রসারণ” নামক একটি ঝামেলাবহুল কাজের সূত্রে, খুব ভালো ভাবে পরিচিত।
আম্র কহে— একদিন, হে মাকাল ভাই,আছিনু বনের মধ্যে সমান সবাই।মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি,মূল্যভেদ শুরু হল সাম্য গেল ঘুচি।
খুব সরল ভাষায় লেখা, উপদেশ কিংবা নীতিকথামূলক এই কবিতাগুলো জ্ঞানের ভারে কিংবা দার্শনিক চিন্তার গভীরতায় জর্জরিত নয়, বরং বেশ উপভোগ্য। উপদেশ দিয়েছেন বটে, কিন্তু পরিহাসের ছলে। সমাজ-সংসারের নানাবিধ বৈসাদৃশ্যকে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু কাউকে আঘাত না-দিয়ে। এই যে সহজ সরল ভাষায়, নিপুণ ছন্দে গাঁথা, গল্প শোনানোর ছলে কবিতা লেখার নবলদ্ধ স্টাইলটি উদ্ভাবন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, “কথা ও কাহিনী” কাব্যগ্রন্থে সেই ন্যারেটিভ স্টাইলটিকে আরো বিস্তারিতভাবে, আরো মনোহর ভঙ্গিতে, প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। যেসব পাঠক কবিতা উপভোগ করতে পারেন না, তারাও এই বইটি পছন্দ করে ফেলবেন। কারণ কবিতা লেখার ছলে আসলে তিনি আমাদের নির্ভেজাল গল্প শুনিয়েছেন।
বইটির দুটো ভাগ। “কথা” অংশে মোট চব্বিশটি নাতিদীর্ঘ কবিতা রয়েছে। এই কবিতাগুলোর কাহিনিবস্তু বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্র, প্রাচীন মরাঠি-পাঞ্জাবি-রাজস্থানি ইতিহাস, বৈষ্ণব সাহিত্য— এইসব সূত্র থেকে সংগ্রহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর পাঠ-পরিধি এবং উৎসাহের দিগন্ত যে কতোটা বিস্তৃত ছিল, এই বইয়ের কবিতাগুলো তার প্রমাণ। যদি বৌদ্ধ কাহিনি খুঁজতে হয়, তাহলে খুব সহজেই তিনি “জাতক” কাহিনির শরণাপন্ন হতে পারতেন। কিন্তু সহজ পথে না হেঁটে, আখ্যানের সন্ধানে “অবদানশতক” কিংবা “মহাবস্ত্ববদান”-এর মতো স্বল্পপরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থের পৃষ্ঠা উল্টিয়েছেন তিনি। কাহিনি, ছন্দ এবং বক্তব্যের ত্রিবেণীসংগমে “কথা” অংশের কবিতাগুলো ভীষণ উপভোগ্য। বারবার পড়া যায়। অনেকবার পড়া যায়। অনেককিছু উপলব্ধি করা যায়।
এই বইয়ের “কাহিনী” অংশের প্রায় প্রতিটি কবিতা বাঙালি পাঠকদের কাছে সুপরিচিত, বহুলপঠিত। যারা আবৃত্তিচর্চা করেন, তারা তো এই কবিতাগুলো নিজেদের হাতের তালুর মতো চেনেন। “কাহিনী”-তে মোট সাতটি কবিতা আছে। এগুলোকে সাধারণ কবিতা না-বলে “নাট্য-কবিতা” নামে ডাকা যেতে পারে। এই অংশের কবিতাতেও কবিতা লেখার ছলে আদপে গল্প শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ছন্দের অপরূপ অথচ বলিষ্ঠ মাধুর্যে এবং বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে, এই কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যের বিশেষ সম্পদ। “দেবতার গ্রাস” কিংবা “বিসর্জন” কিংবা “গান্ধারীর আবেদন” কিংবা “কর্ণকুন্তী-সংবাদ”— কতোবার যে পড়েছি, তবু আশ মেটেনা।
“কাহিনী” অংশের কয়েকটা কবিতার ব্যাপারে আলাদাভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন। কিন্তু এইখানে সেই আলোচনা করার পরিসর নেই। মহাভারতের মনোযোগী পাঠক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। “গান্ধারীর আবেদন” এবং “কর্ণকুন্তী-সংবাদ”— এই বিখ্যাত দুটি কবিতার প্লট তিনি মহাভারত থেকে নিয়েছেন। মহাভারতের অন্যতম অবহেলিত চরিত্রের নাম গান্ধারী। গান্ধারী কৃষ্ণের মতো সেলিব্রিটি ছিলেন না, ভীষ্মের মতো “মহান” ছিলেন না, কুন্তীর মতো তাঁর জীবন “সেনসেশনাল” ছিল না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একজন পরিপূর্ণ মানবীরূপে দেখিয়েছেন। এই কবিতায় ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনকেও একটা ভিন্ন আলোকে দেখতে পাই আমরা। পরিচিত ক্যানভাসে পরিচিত রং দিয়ে কেমন এক অপ্রত্যক্ষ ট্র্যাজেডির ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ!
“কর্ণকুন্তী-সংবাদ” পড়লে আমার মনে হয় এটা কবিতা নয়, একটা কাকচক্ষু সুগভীর দীঘি। এপিক সাহিত্যের সুপরিচিত চরিত্রদের এই যে একটা নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, এটা আমাকে মুগ্ধ করে। গোটা কবিতাটি সংলাপে গাঁথা। আর ছন্দের কী অসাধারণ বিস্তার। প্রথম স্তবকটি যতবার পড়ি, একটা আসন্ন ঝড়ের সংকেত আমার মাথায় বেজে ওঠে। সন্ধেবেলার ঝড়। বিষন্ন, বিপর্যস্ত, অন্ধকার, একাকী, সুন্দর।
পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যা-সবিতারবন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার,অধিরথ সূতপুত্র, রাধাগর্ভজাত,সেই আমি— কহ মোরে তুমি কে গো মাতঃ!
কুন্তীর বুকে কেমন ধাক্কা লেগেছিল, নিজের পুত্রের মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনে?
“কথা ও কাহিনী” তাই রবীন্দ্রনাথের একটি অপরূপ সৃষ্টি। বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন : “একদিন এল যখন আর-একটা ধারা বন্যার মতো মনের মধ্যে নামল। কিছুদিন ধরে দিল তাকে প্লাবিত করে। এর আনন্দবেগ যেন থামতে চাইল না।”
আমিও প্লাবিত হয়েছি বারবার এই ধারাস্রোতে। আমার মনের আনন্দও একই বার্তা শুনিয়েছে বারে বারে, নিজেকেই নিজে।
কথা কও, কথা কও।স্তব্ধ অতীত, হে গোপনচারী,অচেতন তুমি নও—কথা কেন নাহি কও!তব সঞ্চার শুনেছি আমারমর্মের মাঝখানে,কত দিবসের কত সঞ্চয়রেখে যাও মোর প্রাণে!হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনেকাজ করে যাও গোপনে গোপনে,মুখর দিনের চপলতা-মাঝেস্থির হয়ে তুমি রও।হে অতীত, তুমি গোপনে হৃদয়েকথা কও, কথা কও!