Ratings1
Average rating5
আমি প্রথম শার্লক হোমস পড়েছিলাম চুরি করা টাকায়, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়। কার পকেট মেরেছিলাম, কীভাবে মেরেছিলাম, এইসব বৃত্তান্ত আপাতত “ক্লাসিফায়েড” থাকুক। কিন্তু একটা বিষয় অনুধাবন করতে পেরেছিলাম— বই কেনার জন্যে হাতসাফাই খুবই তৃপ্তিদায়ক একটি কাজ। চুরির টাকায় কেনা বইটিতে শার্লকের ছোটগল্প এবং উপন্যাস সমস্তকিছু একটা খণ্ডেই আঁটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনুবাদক ছিলেন নচিকেতা ঘোষ (কামিনী প্রকাশনী)। অনুবাদটা ভালো ছিল না।
তারপর পড়েছিলাম “তুলি-কলম” থেকে প্রকাশিত শার্লকের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা অনুবাদ। অনুবাদকের নাম মণীন্দ্র দত্ত। অনুবাদের মান আগেরটার চাইতে ভালো ছিল। ততদিনে শার্লক হোমসের মহিমা আমি বেশ ভালোমতোই ধরে ফেলতে পেরেছি। একই কাহিনি একাধিকবার পড়লেও আশ মিটছে না। দ্য হাউন্ড অভ দা বাস্কারভিলস উপন্যাসটা সারাজীবনে আমি বোধহয় দশবার পড়েছি।
মূল ইংরিজি লেখাগুলো পড়েছিলাম কলেজে পড়ার সময়। প্রায় সবক'টা গল্পই আগে থেকে পরিচিত থাকায় ইংরিজি রচনাশৈলী উপভোগ করতে আরেকটু বেশি সুবিধে হয়েছিল। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সেই প্রথম আমি বুঝতে পারি, বাঙালি অনুবাদকরা তাঁদের অনুবাদে বেশ খানিকটা জল মিশিয়ে রেখেছেন। কোনো লাইনকে আক্ষরিকভাবে বঙ্গায়িত করার প্রচেষ্টায়, কিংবা আপন মনের মাধুরী মেশানোর চক্করে, শার্লক হোমসের প্রকৃত চেহারা পুরোপুরি সফলভাবে ফুটে ওঠেনি। অনুবাদে অনুবাদ-অনুবাদ গন্ধ রয়ে গেছে।
শার্লকের যে-বাংলা অনুবাদটা পড়ে প্রথম পুরোপুরি তৃপ্তি পেয়েছিলাম সেটা হলো মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা “বাস্কারভিলস”-এর অনুবাদ। তারপরে পড়লাম মানবেন্দ্রবাবুরই “দ্য সাইন অভ ফোর”-এর অনুবাদ। দুঃখের বিষয় তিনি শার্লকের আর কোনো অনুবাদ করেননি। বাঙালি শার্লকপ্রেমীদের জন্যে সেই অভাব পূরণ করে দিয়েছেন দ্য গ্রেট অদ্রীশ বর্ধন মশাই।
বেঙ্গল পাবলিশার্স নামে অধুনা-বিলুপ্ত একটি প্রকাশন সংস্থা ছিল। অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদে শার্লকের সমস্ত রচনা পাঁচটা আলাদা খণ্ডে পাওয়া যেত। আমার কাছে প্রথম চারটে ছিল। সে-ই পুরোনো লেটারপ্রেসে ছাপা বই। কিন্তু পঞ্চম খণ্ডটা বহু খুঁজেও জোগাড় করতে পারিনি। অসম্পূর্ণ সেই সেটটা আলমারিতে মাঝে মাঝে দেখতাম আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়তাম। আমার বোন আমার এই ফোঁস ফোঁস শব্দে হতাশ দীর্ঘশ্বাসের কারণটা জানতো।
বছর সাতেক আগে এক ভাইফোঁটায় আমার বোন কাগজে মোড়ানো বেশ ভারী একটা উপহার দিলো আমাকে। হাতে নিয়েই বুঝেছিলাম বই, কিন্তু মোড়ক খুলে আমার খাদের ধারে দাঁড়ানো প্রফেসর মরিয়ার্টির মতো হতভম্ব অবস্থা। লালমাটি প্রকাশন থেকে সদ্য প্রকাশিত খুব চমৎকার দুই খণ্ডে অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদ করা শার্লক হোমস সমগ্র! ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান, খাওয়া দাওয়া, সবকিছু মাথায় উঠলো।
অদ্রীশ বর্ধনের কাজটাই আমার পড়া শার্লকের সবচে ভালো বাংলা অনুবাদ। বাংলা রহস্য এবং সায়েন্স ফিকশন সাহিত্যের জগতে অদ্রীশবাবু নিজেই এক একক প্রতিষ্ঠান। শার্লক ছাড়াও তিনি জুল ভার্নের সব রচনা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এডগার অ্যালান পো-র সমস্ত কাহিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। ফাদার ব্রাউনের গল্পের অনুকরণে তৈরি করেছেন ফাদার ঘনশ্যাম নামের একটি চরিত্র। বিশাল আয়তনের “কথাসরিৎসাগর” বইয়ের পুরোটা অনুবাদ করেছেন (তাঁর এই কাজটি খুব বেশি পরিচিতি পায়নি)। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায় হোমসের অনুবাদই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এই দুর্দান্ত কাজটিকে লালমাটি প্রকাশন যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে প্রকাশ করেছে।
প্রত্যেক শার্লকপ্রেমীই সিডনি প্যাজেট-এর অলংকরণের কথা জানেন। এছাড়া বিলিতি দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। লালমাটি প্রকাশনের এই বইটিতে পুরোনো সেইসব অলংকরণ এবং আনুষঙ্গিক আরো অনেক কিছু পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। ফলে বইটির নান্দনিক মূল্য এক লাফে অনেকটা বেড়ে গেছে। এছাড়া নতুন এই সংস্করণের আরো একটি আকর্ষণ আছে।
এমনিতে কোনো বইতে খুব বেশি টীকাটিপ্পনী আমার ভালো লাগেনা। শার্লক এবং অদ্রীশ বর্ধন যুগলবন্দীর এই নতুন সংকলনে প্রচুর প্রচুর প্রচুর টীকা সংযোজিত হয়েছে। টীকাগুলো আমার খুব কাজে লেগেছে। শার্লক-সমকালীন পুরোনো ইংল্যান্ডকে জানতে (ইতিহাস এবং ভূগোল— দুই দিক দিয়েই) ; তৎকালীন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, যেগুলোর সঙ্গে গল্পের যোগসাজশ রয়েছে ; কিংবা একটি গল্পকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে সাহায্য করা, ইত্যাদি সবকিছু বিবেচনা করলে এই টীকাগুলো খুবই উপাদেয় বস্তু। প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত এবং সৌম্যেন পাল প্রশংসনীয় এবং পরিশ্রমী কাজ করেছেন।
যদি কেউ বাংলা ভাষায় তৃপ্তিসহকারে শার্লক হোমসের গল্প-উপন্যাস উপভোগ করতে চান, চোখ বন্ধ করে এই সংস্করণটি বেছে নিতে পারেন। অনুবাদের মুনশিয়ানা, অলংকরণের প্রাচুর্য, দৃষ্টিনন্দন গ্রন্থনির্মাণ— সব দিক দিয়ে এই সংস্করণটি দুর্দান্ত। সবার শার্লক-পাঠ আনন্দময় হোক!
(“শার্লক হোমসের মৃত্যু”, সিডনি প্যাজেটের অলংকরণ)