Ratings2
Average rating3.5
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
“যোগাযোগ” পড়া শেষ হলে মনের ভিতর প্রথম যে অনুভূতিটা জেগে উঠেছিল সেটা হলো অতৃপ্তি এবং হতাশা। কাহিনির পরিণতি কেমন হবে তার উপর পাঠকের হাত নেই। পাঠক হলো লেখকের হাতের পুতুল। কিন্তু লেখক নিজেও কি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের জীবন এবং মনের অন্দরমহলে?
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে (প্রথমবার পড়েছিলাম একেবারে কাঁচা বয়সে) বারবার অনুভব করেছি, সাহিত্যের যে-আঙ্গিকটাতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাপ্রদীপ সবচেয়ে কম উজ্জ্বল তা হলো উপন্যাস।
এই দ্বিতীয় দফায় তাঁর সবকটা উপন্যাস এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি, তবে অন্তত নৌকাডুবি, শেষের কবিতা এবং চতুরঙ্গ পড়ার পরে মনে মনে নিজেকে নিজে বলেছিলাম : রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস লিখতে পারতেন না। আজকে “যোগাযোগ” শেষ করে, তৃপ্ত হয়েছি বলবো না, তবে চিন্তার খোরাক পেয়েছি অনেক। আমার সব চিন্তাভাবনার কথা এখানে লেখার উপায় নেই। একটা-দুটো লিখি।
তৃতীয় বিশ্বের (বিশেষ করে, ধর্মকণ্টকিত আমাদের এই উপমহাদেশে) মেয়েদের জীবনযন্ত্রণা যে অনেকরকম, এই কথাটা নতুন করে বলার আর কিছু নেই। “যোগাযোগ” উপন্যাসের যিনি নায়িকা, কুমুদিনী (ডাকনাম কুমু)— রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছে করলেই তাঁকে দরিদ্র কিংবা নিদেনপক্ষে মধ্যবিত্ত ঘরের “সাধারণ মেয়ে” হিসেবে দেখাতে পারতেন।
সেরকম দেখালেই বরং কুমুর জীবনের প্রতিকূল অবস্থার বর্ণনা দেওয়া সহজ হতো। তাঁর প্রতি ঘটে যাওয়া অবমাননাগুলো “স্বাভাবিক” বলে মনে হতো। গরীব ঘরের মেয়ের আবার মান-অপমান কী? গত শতকের প্রথম দিকে সাধারণ বাঙালি পরিবারের মেয়ে হয়ে জন্মানো ছিলো যেন গতজন্মের মহাপাপের ফল। কিন্তু যোগাযোগের কুমুদিনী “সাধারণ ঘরের সাধারণ মেয়ে” ছিলেন না।
তিনি স্বচ্ছল বনেদি জমিদার পরিবারের (যদিও বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু) ইংরিজি-শিক্ষিত “refined” মানসিকতার মেয়ে। তিনি এসরাজ বাজিয়ে ক্লাসিকাল গান গাইতে পারেন। তিনি ছবি তুলতে পারেন। এমনকি বন্দুক চালাতে পারেন। কুমুর দাদা বিপ্রদাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জমানার ব্রাহ্মসমাজসুলভ সফিস্টিকেশনের আদর্শ উদাহরণ।
বিপ্রদাস অতীব সুদর্শন এবং অতীব ঈশ্বরবিদ্বেষী। তিনি নারীস্বাধীনতার সমর্থক। তিনি মুক্তচিন্তার অধিকারী। এমন enlightened দাদার আদরের বোন ছিলেন কুমু। কিন্তু সময়ের তুলনায় এতটা প্রাগ্রসর হয়ে থাকা সত্ত্বেও, বাঙালি নারী হয়ে জন্মানোর আবশ্যিক পরিণামগুলো এড়িয়ে যেতে পারেননি তিনি। এই একটা বিশেষ ব্যাপারে, এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ একটা দারুন চালাকি করেছেন!
ইচ্ছা করেই তিনি কুমু চরিত্রটি “অনন্যসাধারণ” রূপে গড়ে তুলেছেন। এই সত্যটা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যে, সমসাময়িক সমাজ এবং আবহমান সংস্কারের কুদৃষ্টি তোমার উপর পড়বেই (কিছু কিছু সংস্কার তো তুমি নিজেই সযত্নে পুষে রেখেছো)। তুমি ফর্সা হও বা কালো (পলিটিক্যাল কারেক্টনেস বজায় রাখার জন্যে যাদের “শ্যামলা”, “চাপা গায়ের রং”, “মাজা গায়ের রং”, “শ্যামবর্ণা”, “উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা” এইসব কাব্যিক নামে ডাকা হয়), তোমার পরিবার ধনী হোক বা হতদরিদ্র, তুমি শিক্ষিত হও বা নিরক্ষর, কুরূপা কিংবা সুরূপা, ছলনাময়ী কিংবা সরলসোজা, বুদ্ধিমতী কিংবা গর্ধব— তুমি যে-ই হও, মেয়ে হয়ে পৃথিবীতে এসেছো মানেই কিছু কিছু আবশ্যিক অপমান এবং অত্যাচার তোমাকে সহ্য করে নিতেই হবে। পালাবার পথ নেই।
কুমুও পালাতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছে করলেই, পাঠককে খুশি করার জন্যে, তাঁকে পালাতে দিতে পারতেন। “নারীশক্তির জয়”, “নারীচেতনার উদ্বোধন”— এইসব প্রমাণ করে হাততালি কুড়োতে পারতেন। উপন্যাসটা শেষ করে এই কারণেই আমি নিদারুণ হতাশ (এবং কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ) হয়েছিলাম। কিন্তু খানিকক্ষণ চিন্তা করে দেখলাম, পরিবার, পরিবেশ, সময় এবং সমাজের দ্বারা টেনে দেওয়া গণ্ডিকে মেয়েরা আদৌ প্রত্যাখ্যান করতে পারে? কোনোদিন পেরেছে কি?
তখনকার কথা বাদ দিলাম, আজকের দিনেও কি পারে? কেউ কেউ পারে (গণনায় যারা যৎসামান্য), কিন্তু অধিকাংশ মেয়েরা পারে? আজও কি সবাই সাহসী হতে পারে? সবাই কি নিজের ভিতর জাগ্রত করতে পারে তথাকথিত নারীবাদসম্মত মুক্তিচেতনা? রুখে দাঁড়াতে পারে? হতে পারে নির্ভীক? হতে পারে “ব্যতিক্রমী”? হতে পারে “বেপরোয়া বেহায়া অসভ্য নির্লজ্জ মেয়েছেলে”? দৃঢ় কন্ঠে বলতে পারে, “পরোয়া করিনা!”
নাহ, পারে না। যারা পারে, তারা কয়জন? আপনি বলুন দেখি কয়জন? কয়জন “ব্যতিক্রমী” মেয়েকে চেনেন আপনি?
বেশ কিছু গঠনগত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও “যোগাযোগ” একটি জরুরি উপন্যাস। অনেক বিখ্যাত নারীবাদী উপন্যাসের চেয়ে বেশি বাস্তবসম্মত। কুমুদিনীর অপমান আমার বুকে এসে বেজেছে। সেই অপমানের নিষ্পত্তি করে কুমুদিনী মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেননি, এটা দেখে আমার মাথা নিচু হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কুমুদিনীকে জিতিয়ে দেননি, কারণ কুমুদিনীরা তখনকার দিনেও পরাজিত হতো, আজও পরাজিত হয়। আর পাঠক হিসেবে আমরা অতৃপ্ত কণ্ঠে আফসোস করি : ধুর, গল্পের এন্ডিংটা মনের মতো হলো না!
ছোট হয়ে নেমে পড়ুন মশাইসরু হয়ে নেমে পড়ুন মশাইচোখ নেই ? চোখে দেখতে পান না ?সরু হয়ে যান, ছোট হয়ে যান !আরো কত ছোট হব ঈশ্বর ?ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে !আমি কি নিত্য আমারও সমানসদরে, বাজারে, আড়ালে ?