Ratings1
Average rating4
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধগুলোকে তাঁরই লেখা অন্য একটি বইয়ের নাম অনুসরণ করে বলতে ইচ্ছে করে— হঠাৎ আলোর ঝলকানি! কিংবা “অবিরাম আলোর ঝলকানি” বললেও ক্ষতি নেই। একজন কবি যখন গদ্য লেখেন, কবি-মননের স্বভাবসিদ্ধ কাব্যিক ইঙ্গিতময়তা এসে আশ্রয় নেয় সেই গদ্যে। এইরকম কাব্যগন্ধী গদ্যকে প্রায়শই আমি উপভোগ করতে পারিনা। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হয়েও বুদ্ধদেব বসু এই “দোষে” দুষ্ট নন। তাঁর গদ্য আশ্চর্যরকম সাবলীল। খাঁটি প্রত্যক্ষ গদ্য। শুধুই গদ্য।
আলোচ্য সংকলনটিতে সবমিলিয়ে আটটি প্রবন্ধ রয়েছে। আলোচনায় প্রবেশ করার আগে বলে নিই, বুদ্ধদেবের প্রবন্ধকে “হঠাৎ আলোর ঝলকানি” বললাম ক্যানো। যেকোনো ভালো প্রবন্ধে দুরকম বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। গদ্যভাষার বলিষ্ঠ রম্যময়তা, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সৈয়দ মুজতবা আলির প্রবন্ধ। আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো, বিষয়বস্তুর বিদগ্ধ উজ্জ্বল বিশ্লেষণ, যার উদাহরণ... ধরা যাক অম্লান দত্ত। (এখানে বারবার “রম্য” শব্দটা ব্যবহার করছি, কিন্তু তাই বলে, ইয়ে, সঞ্জীব চাটুজ্যেমার্কা “কৃত্রিম ছদ্মপ্রাজ্ঞ ছ্যাবলামি” অর্থে ব্যবহার করছি না। এখানে রম্য মানে ভাষা ও ভাবের অকৃত্রিম সাবলীলতা/ সর্বজনীনতা।) একইসঙ্গে রম্য ভাষার ব্যবহার করেছেন এবং উদার বিশ্লেষণ করেছেন এরকম প্রবন্ধলেখকের সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ, আমার মতে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধে অতিরিক্ত যেটা আছে সেটা হলো, ভাষাপ্রয়োগের আশ্চর্য বনেদিয়ানা। বাংলা শব্দের উৎকৃষ্টতম প্রয়োগ। এবং হঠাৎ হঠাৎ আইডিয়ার ঝিলিকে পাঠককে চমৎকৃত করবার পারদর্শিতা। হঠাৎ আলোর ঝলকানি !
প্রতিটি প্রবন্ধ নিয়েই অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করছে। সেটা তো সম্ভব নয়। অল্প কিছু বলি। মূল সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণ (কিংবা সেটির বঙ্গানুবাদ) পড়েননি বুদ্ধদেব বসু। আমি যতোটুকু পড়েছি, তিনিও ততোটুকুই পড়েছেন। অর্থাৎ, উপেন্দ্রকিশোরের শিশুতোষ রামায়ণ, কৃত্তিবাসের “বাঙালি” রামায়ণ এবং রাজশেখর বসুর সারানুবাদ। সংকলনের প্রথম প্রবন্ধে (“রামায়ণ”), আরো অনেক প্রসঙ্গের পাশাপাশি, বহুলচর্চিত একটি বিতর্ককে নিজস্ব আঙ্গিকে দেখতে চেয়েছেন বুদ্ধদেব। বিষয়টি হলো, রামায়ণের রামচন্দ্র কি আসলেই একজন আদর্শ মানবচরিত্রের উদাহরণ? “যে-রামের নাম করলে ভূত ভাগে, সেই রাম নিষ্ঠুর অন্যায় করেছেন একাধিকবার।” ক্যানো করেছেন এইসব অন্যায় কাজ? বাজে লোক ছিলেন বলে? নাকি অন্য কোনোভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে রামচন্দ্রের নিষ্ঠুরতাকে? চমৎকার এই প্রবন্ধটি পড়ে খুব খুব আনন্দ লাভ করেছি। রামায়ণ বিষয়ে এমন দারুন প্রবন্ধ বাংলায় খুব বেশি নেই।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের “কীর্তি” বিষয়ক। এই প্রবন্ধেও ঝলসে উঠেছে বুদ্ধদেবের শাণিত যুক্তির তরোয়াল। এখানেও তিনি একটি সুপ্রাচীন ধারণাকে বিকল্প আঙ্গিকে পরখ করে দেখাতে চেয়েছেন। ধারণাটি হলো, মাইকেল তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্যে রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাইয়ের চেয়েও রাবণ-মেঘনাদ দুই বাপ-ব্যাটাকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। সত্যিই কি তাঁদের প্রাধান্য দিয়েছেন? সত্যিই মাইকেল বাংলা কাব্যের জগতে বৈপ্লবিক কাজ করেছিলেন? নাকি আমরা তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছি? এই প্রবন্ধে জানতে পারি, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একবার সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, প্রাচীন বাংলা সাহিত্য সাধারণত অপাঠ্য! (এর চেয়ে সত্যি কথা জগতে আর ক'টা আছে?) বুদ্ধদেবও প্রায় একইরকম সাহসী মন্তব্য করেছেন : “মাইকেল বাংলা জানতেন না”। এইসব কী শুনছি, অ্যাঁ?
“বাংলা শিশুসাহিত্য” প্রবন্ধটি সম্ভবত বাংলা শিশুসাহিত্য বিষয়ক আমার পড়া সবচেয়ে দুর্দান্ত প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধেও রয়েছে হঠাৎ হঠাৎ ছিটকে আসা আইডিয়ার আলোর ঝলকানি। দেখতে পাচ্ছি, সে-ই ১৯৫২ সালেই তিনি লীলা মজুমদারকে বাংলাভাষার প্রতিনিধিস্থানীয় শিশুসাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন! একই সঙ্গে স্পষ্ট বুঝিয়ে বলেছেন, বাচ্চাদের জন্যে সাহিত্য রচনা করা যার-তার কাজ নয়। এমনকি রবীন্দ্রনাথও পারেননি (অথচ অবনীন্দ্রনাথ পেরেছেন)। একজায়গায় লিখেছেন : “বাংলা দেশে এত বড়ো দুর্ঘটনাও ঘটেছিলো যে ‘আবোল তাবোল' অনেক বছর ছাপা ছিলো না!” পরপর তিনবার পড়লাম বাক্যটা। খানিক বাদে আবার পৃষ্ঠা উল্টে ফিরে এসে পড়লাম। আরো অনেকবার পড়লাম। বারবার ফিরে ফিরে আসতে হলো এই বাক্যটার কাছে।
এই সেরেচে, রিভিউ তো গড়গড়িয়ে লম্বা হয়ে যাচ্চে! আচ্ছা এবার সংক্ষেপে সারছি। রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী কারা? বিশেষত কবি রবীন্দ্রনাথের? রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন, তখন তাঁর আশেপাশে বলবার মতো বাঙালি কবির নাম একটাও ছিলো না। নিজে হাতে ইট পুড়িয়ে, বালি-সিমেন্ট মেখে, মজদুরি করে তিনি দাঁড় করিয়েছেন বাংলা কবিতার ভিত্তিমূল। তারপর? “রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক” নামের প্রবন্ধে দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথ নামক একদা আকস্মিক বজ্রপাত কীভাবে আজকে বাংলা কবিতার রক্তমাংসে মিশে গেছেন। তিনি সবকিছুতেই আছেন, থেকেও আছেন, না-থেকেও আছেন। “রবীন্দ্র-জীবনী ও রবীন্দ্র-সমালোচনা” নামের আরেকটি প্রবন্ধ পড়ে বুঝতে পারলাম, আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের একটাও ভালো জীবনী লেখা সম্ভব হলোনা ক্যানো! রবীন্দ্রনাথ নাকি নিজেই এর জন্যে দায়ী!
যারা ছন্দের ব্যাকরণ বিষয়ে জানেন না, তাদের কাছে “বাংলা ছন্দ” প্রবন্ধটি বিরক্তিকর মনে হতে পারে। সংকলনের এই একটি প্রবন্ধ আমার মতো আমজনতার জন্যে নয়। খুবই টেকনিক্যাল। কিন্তু সংকলনের শেষ দুটি প্রবন্ধ শেষপাতে ক্ষীরের চমচমের মতো (আমার ক্ষীরের চমচম পছন্দ তাই এটার নাম লিখলাম, আপনারা নিজের নিজের পছন্দের নাম বসিয়ে নিতে পারেন)। “সাংবাদিকতা, ইতিহাস, সাহিত্য” নামের প্রবন্ধে বুদ্ধদেব দেখিয়েছেন, ইনফরমেশন-সর্বস্ব আজকের এই জমানায় সাহিত্যের মধ্যেও পাঠক “ইনফরমেশন” খুঁজে চলেছেন। “সংবাদ” খুঁজে চলেছেন। “অমুক রচনাটি আজও প্রাসঙ্গিক”— নিজস্ব দেশকালের সঙ্গে তাৎক্ষণিক প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে চলেছেন। অসামান্য এই প্রবন্ধটির একদম শেষদিকে চোখে পড়লো সুগভীর একটি বাক্য : “ঠিক ততটুকুই আমরা উচ্চারণের অধিকারী, যতটুকু আমাদের উপলব্ধি, আর অধিকার অতিক্রম করবার প্রলোভন ত্যাগ করতে করতেই উপলব্ধির পরিধি বাড়ে।”
বইয়ের অন্তিম প্রবন্ধ “শিল্পীর স্বাধীনতা”-তে বুদ্ধদেব বসু একটি চমৎকার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে। কোনও আদর্শ কিংবা মতবাদের ছাতার তলায় না এসেও, লাল নীল গেরুয়া কিংবা সবুজ রঙের পতাকা দিয়ে নিজের সত্তাকে মুড়ে না-ফেলেও, একজন শিল্পী নিজেকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন? সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ! — সকল পপুলার এবং ফেমাস রং ত্যাগ করে আমার যেটা রং, সেই রঙে নিজেকে রাঙাও। সংস্কৃত শ্লোকটা পড়ে প্রথমে মনে হয়, এই “আমি”টা হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাঁকে অনুসরণ করতে। ভুল কথা! এই আমিটা তো আসলে আমি নিজেই। আমার পতাকার রং হবে আমার নিজের পছন্দের। সবচেয়ে ভালো হয়, এইসব পতাকা-ফতাকার ঝামেলাই না থাকলে!
.