Ratings1
Average rating5
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
কোনও এক মাকোন্দো গ্রামের কোনও এক বুয়েন্দিয়া পরিবারের গল্প। ভিন্ন মহাদেশের ভিন্ন সমাজ, ভিন্নরকম মানুষের ভিন্ন ভিন্ন লোকাচার, স্বভাবচরিত্তির, পাগলামি। আমার কাছে এইসব অপরিচিত লাগে। তবু ভালো লাগে। আমি তো নিশ্চিন্দিপুরও চিনতাম না। দস্তইয়েভ্স্কির সেইন্ট পিটার্সবার্গও না। আর কে নারায়ণের মালগুড়িও না। তবু তো তারা অনুভূতির গভীরে অনুরণন তুলতে পেরেছিল। মাকোন্দোও পেরেছে ভীষণভাবে! শুধু তার অপার বিস্ময়ঘেরা পরিবেশ আর সময়ের সঙ্গে তার ঝিমধরা সম্পর্কের কারণেই নয়, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের অতুলনীয় গদ্যশৈলীর কারণেও। যে গদ্য কিনা, বাংলা অনুবাদ সংস্করণের ভূমিকায় সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের অবলোকনে : “বাস্তবকে গলিয়ে আলোময় প্রবাহে পরিণত করেছে”। কাহিনি নয়, চরিত্র নয়, এই অপ্রতিম গদ্যই উপন্যাসটির সবচেয়ে বড় সম্পদ।
অথচ এই গদ্য আমার কাছে এসেছে দুই দফা হাতফেরত হয়ে। স্প্যানিশ থেকে ইংরিজি, ইংরিজি থেকে বাংলা। গতবছর এই বইটি পড়েছিলাম গ্রিগোরি রাবাসার চমৎকার ইংরিজি তর্জমায়। কিন্তু বাংলা অনুবাদ পড়তে যেহেতু সবসময় আমি আগ্রহী হয়ে থাকি— ভালো বাংলা অনুবাদ হাতে পেলে কদাপি ইংরিজি অনুবাদ পড়িনা— তাই জি এইচ হাবীবের এই অনুবাদটি তো একদিন আমার পড়ার কথাই ছিল! ইংরিজি অনুবাদটি আগে পড়ার কারণে আরও ভালো বুঝতে পেরেছি, কী অসম্ভব মেধাবী একটা কাজ করেছেন অনুবাদক। মাকোন্দোর দুনিয়া শুধু আমার পরিচিত দুনিয়ার চেয়েই আলাদা নয়, এই দুনিয়ার যেকোনো দুনিয়ার চেয়ে আলাদা। রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শশুদ্ধু তাকে সার্থকভাবে বাংলায় উপস্থাপন করা যে কতটা গভীর অভিনিবেশের কাজ, প্রথম কয়েকটা পৃষ্ঠায় প্রবেশ করলেই পাঠক সেটা বুঝে ফেলবেন! এমন উৎকৃষ্ট বাংলা অনুবাদ থাকলে ইংরিজি অনুবাদ পড়ার আদৌ প্রয়োজন নেই বোধহয়।
লাতিন আমেরিকার ‘জাদুবাস্তব' ঘরানার ব্যাপারে অজস্রবার আলোচনা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে, তাই এই বিষয়ে নতুন করে আমার আর কিছু বলার নেই। আমি কিন্তু বইটিকে কোনও ঘরানার ছাঁচে ফেলে পড়িনি। এইভাবে সাহিত্য পড়তে পারিনা আমি। আমি তো সাহিত্যের তাত্ত্বিক পাঠক নই, সাধারণ ছাপোষা পাঠক। কেবল আনন্দের জন্য বই পড়ি। তাই এই উপন্যাস যদি আমাকে টেনে ধরে রাখতে না পারতো, স্রেফ “বিখ্যাত” কিংবা “অবশ্যপাঠ্য” কিংবা “অন্যরকম” হওয়ার কারণেই উপন্যাসটি আমি জোর করে গিলতাম না (তাও আবার দুবার)। উপন্যাসটির কাহিনিবিন্যাস আমার অভ্যস্ত রুচির বাইরে হওয়া সত্ত্বেও আমি অসম্ভব উপভোগ করেছি। ক্যানো? কারণ আমার মনে হয়েছে, উপন্যাসটি লেখার সময় লেখক “নতুন একখান তাকলাগানো জিনিস লিখছি রে ভাই” জাতীয় কোনও ভণিতার আশ্রয় নেননি। জিনিস নতুন বটে, কিন্তু সৃজনশীল অনুপ্রেরণার খুব সৎ এবং অকৃত্রিম বহিঃপ্রকাশ ছাড়া এইরকম ঘোরগ্রস্ত রচনা সম্ভব নয়।
উপন্যাসের শিরোনামে “নিঃসঙ্গতা” শব্দটি রয়েছে। নিঃসঙ্গতা কি “বিষন্নতা” শব্দের সমার্থক? সবসময় নয়। “একাকিত্ব” শব্দটি যেমন সবসময়ই বিষন্নতার সহচর। একটি পরিবারের প্রায় ছয়/সাতটি প্রজন্মের সদস্যদের মোটামুটি জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি যাপনচিত্র বর্ণিত হয়েছে উপন্যাসে। কিন্তু আবার স্মরণ করছি, গতানুগতিক রচনারীতির মতো সরলরৈখিক নয় এই বর্ণনা। তবে কি কাহিনির চলন বঙ্কিম? তাও নয়। তাহলে কাটাকুটি? এলোমেলো? এদিক সেদিক? এবড়ো খেবড়ো? তাও নয়। তাও নয়। তাও নয়। এই উপন্যাসের রচনারীতি নিঃসঙ্গতার মতোই অধরা রহস্যময়। কখনও এর রূপ বিষন্ন। কখনও বিরক্তি উদ্রেক করে। কখনও এর স্পর্শে পুলক জাগে। বারতিনেক পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। যেন স্বপ্নের ভেতর বৃষ্টি পড়ছিল। আমি বৃষ্টিপতনের সেই শীতল শব্দ পান করছিলাম। ঘুম ভেঙে আবার খুলেছি বইটির পৃষ্ঠা। তারপর ডুবতে গিয়েও ভেসেছি। আবার ভাসতে ভাসতে তলিয়ে গেছি কখন যেন। নিঃসঙ্গতার কুহেলি শিশিরে ভিজে গেছে আমার পাঠকহৃদয়, পাতার পোশাক...
যতই দিক না যুদ্ধ, খণ্ডকাল হবে পরাজিতএই তো জেনেছি শাস্ত্রে, যতোটুকু হয়েছে অধীত।অখণ্ড কালের পক্ষপাতধন্য আমি মহাশয়,আমাকে রাঙাবে চোখ, এতো শক্তি রাখে না সময়।
(নবনীতা দেব সেন)
উপন্যাসটিতে কয়েকজন অত্যাশ্চর্য নারীচরিত্রের দেখা পাই। এরকম চরিত্রবহুল একটি উপন্যাসে একটিমাত্র চরিত্রকে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ করানো যায় না। তবু উরসুলা ইগুয়ারান নামের একজন নারীকে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে আমার। ভেবে দেখলে, উপন্যাসের নামটি খুব সহজেই “উরসুলার নিঃসঙ্গতার একশ বছর” রাখা যেতেই পারতো। লক্ষ্য করলাম, উপন্যাসের পুরুষচরিত্রগুলি প্রত্যেকে কমবেশি প্রায় একইরকম (তাদের নামের মতোই)। কিন্তু নারীচরিত্রগুলি নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য নিয়ে জ্বলজ্বল করছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে পুরুষরা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছেন, উদ্দাম জীবনযাপন করেছেন, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে অনুপ্রাণিত করেছেন বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত ‘ওপেনিং লাইন'-টি লেখার জন্য (“বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে, কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা...”)। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, প্রকৃত বৈপ্লবিক কাজগুলো, অচিন্তনীয় কাজগুলো, সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তারী কাজগুলো, আদপে করেছেন এই উপন্যাসের নারীরা। আমার হৃদয়কে সবচেয়ে গভীরভাবে স্পর্শ করেছেন তারাই।
বিপ্লবের কথায় মনে পড়লো, লাতিন আমেরিকার বিপ্লবজারিত অস্থির সমাজের বয়ান এই উপন্যাসের পৃষ্ঠায় খুব সন্তর্পণে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন লেখক। এই মহাদেশটির রাজনৈতিক সচেতনতা পৃথিবীর বাকি অংশের চেয়ে আলাদা। একইসঙ্গে চরম প্রতিবাদমনস্কতা এবং প্রহসনসদৃশ অত্যাচারী ক্ষমতাসীন কতিপয় জন্তুর পেশীপ্রদর্শন— দক্ষিণ আমেরিকার এই রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে আমরা প্রত্যেকেই পরিচিত। কেমন সুকৌশলে সেই বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের আন্তঃসম্পর্কটি যেন মঞ্চনাটকের উইংসের পিছনে সবসময় প্রস্তুত রেখেছেন লেখক। যখন দরকার দর্শকের সামনে এনেছেন, আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন। আর এই উপন্যাসের কথন যেন একটা সুবিস্তৃত অর্কেস্ট্রার মতো। কতো অদ্ভুত যন্ত্র একসঙ্গে বাজছে। সুরের পর্দা উঠছে, নামছে। সিম্ফনি ছড়িয়ে পড়ছে অডিটোরিয়ামের আনাচে কানাচে। উপন্যাসটির মূল বক্তব্যটি কাহিনির একদম শেষের দিকে হঠাৎ আমার চোখে পড়ে গেছে। একইসঙ্গে অপরূপ এবং বিচিত্র এক ভাষায় লেখা দুর্গম এই উপন্যাসটির মর্মার্থ যেন খুব আবছাভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি সেই লাইনটি পড়ে :
“...ওরা যেখানেই থাকুক না কেন একথা যেন সবসময় মনে রাখে যে অতীত একটা মিথ্যে ছাড়া কিছু নয়, স্মৃতির দিকে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়, চলে যাওয়া বসন্তের দিন আর ফেরবার নয়, আর, সবচেয়ে উন্মত্ত, সবচেয়ে একনিষ্ঠ প্রেমও শেষঅব্দি একটা ক্ষণস্থায়ী সত্য ছাড়া কিছু নয়।”
আদৌ উপলব্ধি করতে পেরেছি কি? লেখকও মনে হয় চাননি আমি পুরোপুরি উপলব্ধি করি। মানুষের একটা গোটা জীবন কেটে যায় নিঃসঙ্গতাকে উপলব্ধি করতে করতে...
(আমার সঙ্গে একই সময়ে বইটি পাঠ করেছেন আমার বন্ধু আঞ্জুমান লায়লা নওশিন। উপন্যাসটি অবলম্বনে নেটফ্লিকস প্রযোজিত নতুন টিভি-সিরিজটির খবর এবং এই উপলক্ষ্যে বইটি আরেকবার পড়ে ফেলার পরামর্শ— দুটোই তিনি দিয়েছেন। মার্কেজ-অনুরাগী নওশিনকে কৃতজ্ঞতা!)