Ratings1
Average rating3
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
খুব আশ্চর্যের কথা। হিন্দু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থগুলো, যেমন রামায়ণ, মহাভারত, প্রাচীনতর পুরাণ গ্রন্থ— কোথাও শ্রীরাধিকার উল্লেখ নেই। রাধার প্রথম দেখা পাওয়া যায় অনেক পরে, দ্বাদশ শতকে, মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জয়দেবের সংস্কৃত ভাষায় লেখা “গীতগোবিন্দ” কাব্যে। সুতরাং আমরা কল্পনা করে নিতেই পারি, ঐতিহাসিক না-হোক, এমনকি পৌরাণিক সূত্রেও শ্রীরাধিকার অস্তিত্ব ছিল না। তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে অনেক পরে, কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। কী উদ্দেশ্যে?
হিন্দু দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো ভক্তিবাদ। ভক্তিবাদের মতো একটি সুগভীর দর্শনকে সামান্য কয়েকটা কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বলা যায়, শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে মেনে নেওয়া সত্ত্বেও, তিনি “একাই একশো” নন। তাঁর মতো দিগ্বিজয়ী মানুষেরও একটা দ্বৈত অথচ বিপরীত সত্তা থাকতে হবে। একটা প্রবল পিছুটান থাকতে হবে। শ্রীরাধিকা হলেন কৃষ্ণের সেই পিছুটান। ভক্তিবাদের এই দারুন দুঃসাহসিক তত্ত্বটি সমগ্র ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের প্রাণ স্পর্শ করেছিল একসময়। রাধাই হলেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। “হ্লাদিনী” মানে - আনন্দের উৎস। The fountain of bliss!
বৈষ্ণব পদাবলীতে, যেখানে শ্রীরাধিকার প্রাসঙ্গিকতা এমনকি কৃষ্ণেরও উপরে, সেই পদাবলী সাহিত্য পড়লে বোঝা যায়, পুরুষ হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ হতে পারেন সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু তাঁর অস্তিত্বের মূলটি গাঁথা রয়েছে রাধার হৃদয়ে। কানু বিনা যেমন রাই নেই, রাই বিনা তেমনি কানুও অসম্পূর্ণ হয়ে আছেন। তাঁরা দুজন সারাজীবন কাছে থাকতে পারেন নি। তাঁদের প্রেম সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। তবু বৈষ্ণব সাহিত্যে এই প্রেমকেই সবচেয়ে উঁচুতে জায়গা দেওয়া হয়েছে।
অভিমান, বিরহ, বিষাদ এবং দিগন্ত প্রসারিত প্রতীক্ষারই আরেক নাম দেওয়া হয়েছে “প্রেম”। এই যে বুকফাটা অসহায় তৃষ্ণা, এই শূন্যতার অনুভূতিকেই যুগ যুগ ধরে ব্যক্ত করার চেষ্টা করে এসেছে মানুষ। প্রেমিক মানুষ। ভিখারি মানুষ। রাধাকে বলেছিলেন কৃষ্ণ, আলিঙ্গনও যদি না করো, একবার আমার দিকে না-ও যদি তাকাও, একবার স্পর্শ না করো, তোমার ওই খণ্ডিত চন্দ্রকলার মতো পায়ের নখে অন্তত একবার চুম্বন করতে দিও? ভগবানকে এভাবে ভিখারি বানাতে পারা কম সাহসের কথা নয়!
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।এ ভরা বাদর মাহ ভাদরশূন্য মন্দির মোর।
মহাভারতের সফিস্টিকেটেড কৃষ্ণের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীর এই প্রেমিক কৃষ্ণের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আসামের কামরূপী আঙ্গিকের একটা লোকসংগীত আছে। “ও রে কলঙ্কিনী রাধা, কদম ডালে বসিয়া আছে কানু হারামজাদা, মাঈ তুই জলে না যাইও”। যাঁকে দেবতা বলে স্তুতি করা হয়, সেই দেবতাকেই “হারামজাদা” নামে সম্বোধন করা হয়েছে! দেবতার সঙ্গে এই যে বন্ধুর মতো আচরণ, সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যের এটাই essence! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এই উপন্যাসে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের এই লৌকিক এবং ক্যাজুয়াল বৈশিষ্ট্যকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
পুরোপুরি সফল হননি তিনি। আবহমানকাল ধরে চলে আসা রাধাকৃষ্ণের কাহিনিকে তাঁর স্বকীয় পাকা হাতে effortlessly প্রকাশ করতে পারেননি তিনি। তবু দুইজন নরনারীর পারস্পরিক প্রণয়ের সর্বগ্রাসী আকুতিকে বেশ খানিকটা দেখাতে পেরেছেন। রাধা আর কৃষ্ণের ব্যতিক্রমী প্রেমের গল্পটা জানার জন্যেও খুব সম্ভবত এই বইটির চেয়ে ভালো উপায় আর নেই। অন্তত বাংলায় বোধহয় নেই। আজকে দোল পূর্ণিমার দিন বিকেলবেলা বইটা পড়া শেষ করে, রাধা আর কৃষ্ণের চিরন্তন বেদনাকে উপলব্ধি করতে করতে মাথায় ঘুরছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখা একটা গানের কয়েকটা লাইন।
ধীরে ধীরে পহুঁছত যমুনা কে তীরসুনসান পনঘট মৃদুল সমীরক্ষণ ক্ষণ মাধব বিরহ মদিরউসে কাহে ভুল না পাও ?মথুরা নগরপতী কাহে তুম গোকুল যাও ?
প্রায় একই কথা ভানুসিংহ ঠাকুরও লিখে গেছেন।
বজাও রে মোহন বাঁশিসারা দিবসক বিরহদহনদুখমরমক তিয়াষ নাশি।রিঝ-মন-ভেদন বাঁশরিবাদনকঁহা শিখলি রে কান ?
তিনি কোথায় শিখেছেন এই বাঁশি বাজানোর কায়দা, তা আমি জানিনা। তবু বাঁশির আওয়াজ যে আজও শোনা যায় এই কথাটা কে অস্বীকার করতে পারে? আগুনের শিখার মতো বিরহের এই গল্পটা এভাবেই চলতে থাকবে যুগ যুগ ব্যাপী। যতদিন মানুষ প্রেমিক থাকবে। যতদিন মানুষ প্রতীক্ষারত থাকবে। যতদিন মানুষ ভিখারি থাকবে।
আর কি কখনো কবে এমন সন্ধ্যা হবে ?জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা।