We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
সঙ্গত কারণেই এই উপন্যাসটি নিয়ে এপার বাংলায় কোনো আলোচনা নেই। বর্তমান জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক পরিবেশে তো আলোচনার পরিসর আরো সীমিত। বাঙালি এমনিতেই ইতিহাস লিখতে পারেনা, লিখলেও লেখে রাজারাজড়ার প্রশস্তি। সত্যি কথা বলতে, ১৯৪৯ সালে নীহাররঞ্জন রায় “বাঙ্গালীর ইতিহাস” বইটি লেখার আগে পর্যন্ত সাধারণ বাঙালি গণমানুষের ব্যাপারে কেউ কিছু লেখার চেষ্টা করেনি। সেই কবেকার চর্যাপদ কিংবা বৈষ্ণব সাহিত্য কিংবা মহাকাব্যের অনুবাদ কিংবা মঙ্গলকাব্যগুলোতে বাঙালি মানুষ এবং সমাজের ছবি ফুটে ওঠে বটে, কিন্তু এগুলোকে তো আর “ইতিহাস” বলা যায় না। বাঙালির ইতিহাস নেই।
তাই আজকের হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের মূল কারণ (এবং সমাধান) খোঁজার বদলে কেবল পারস্পরিক খিস্তি খেউড় চলে। এপার বাংলার হিন্দুয়ানি মস্তানরা “ঘর ওয়াপসি” নামক সামাজিক প্রকল্প চালু করে। ভারতে বসবাসকারী বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দ্যায়। বাংলাদেশকে লুঙ্গিদেশ নামে ডেকে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে (অথচ নিজের পাছাতেও কাপড় নেই)। আর ওপার বাংলার মুসলমানি মস্তানরা ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার বৃত্তান্ত বিষয়ে গবেষণাধর্মী থিসিস পাবলিশ করে (পিয়ার রিভিউড)। কিংবা সেভেন সিস্টার্সকে “জয় বাংলা” করার জন্য “লুকিং ফর শত্রুজ” স্লোগানকে তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে নামিয়ে আনে। এবং আগামী দুর্গাপূজায় কী হবে সেটা এখনও বলতে পারছি না। এইসব ফুটোমস্তানি করেই দিন কাটে বাঙালি জাতির। ছোটবেলায় ইশকুলে পড়ার সময় বন্ধুরা একে অপরের প্যান্ট আচমকা পিছন থেকে টেনে নামিয়ে দিয়ে মস্করা করতাম, সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনকালের একদম অন্তিম পর্যায়ের একটি কালখণ্ড চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসে। একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের বৃত্তান্ত। বুড়ো রাজা লক্ষ্মণ সেন রাজ্যশাসনের প্র্যাকটিকাল দায়দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন সামন্ত আর উচ্চবর্ণের গুন্ডাদের হাতে। শাসনের দায়ভার থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে শেষ জীবনটা অতিবাহিত করছেন তীর্থস্থান নবদ্বীপ শহরে। যোগ্য শাসকের অনুপস্থিতির সুযোগে ওই “তত্ত্বাবধায়ক” শাসকরা আক্ষরিক অর্থে যথেচ্ছ ধর্ষণ করছে গৌড়বঙ্গের আমজনতাকে। ঐতিহাসিক উপন্যাসে কল্পনার বিস্তার থাকে, তবু কল্পনার জন্যেও তো তথ্যের দরকার হয়। যৎসামান্য তথ্যকে আশ্রয় করে একটা বাস্তবসম্মত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন শওকত আলী। তৎকালীন গৌড়বঙ্গের নিম্নবিত্ত জনসাধারণের যে অসহায় রূপটি দেখিয়েছেন, পড়তে পড়তে দমবন্ধ হয়ে আসে। চৈতন্য মহাপ্রভুর নেতৃত্বে সামাজিক গণজাগরণের প্রায় তিনশো বছর আগে, বঙ্গদেশের এত বিপুল সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল ক্যানো— এই কূটপ্রশ্নটির একটা লজিক্যাল উত্তরের আভাস আছে এই উপন্যাসে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে উপন্যাসটি অবশ্যই সার্থকতা অর্জন করেছে। কিন্তু আমার দুটো প্রশ্ন আছে।
প্রথম প্রশ্নটি উপন্যাসের নামকরণ নিয়ে। প্রদোষ মানে তো সন্ধ্যাবেলা। সন্ধ্যার পরে রাত্রি আসে। কিন্তু বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের পরে রাত্রি কি এসেছিল? লেখক কি পরবর্তী সাড়ে-পাঁচশো বছরব্যাপী ইসলামি শাসনকালকে রাত্রি হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন? দ্বিতীয় প্রশ্নটি উপন্যাসের তৎসমবহুল ভাষা নিয়ে। কয়েকটা উদাহরণ দিই। “তোমাদের খুরে দণ্ডবৎ একশতবার”, “শূকরপুত্র” (শুয়োরের বাচ্চা গালি বোঝাতে), “চুপ কর দগ্ধমুখী” (চুপ কর পোড়ামুখী বোঝাতে), “ললাটে সম্মার্জনী” (কপালে ঝাঁটা), “চক্ষুর মস্তকটি কি ভক্ষণ করে বসে আছিস?” (চোখের মাথাটা কি খেয়ে বসে আছিস?)— এরকম আরো অনেক। প্রশ্ন হলো, আটশো বছর আগেকার প্রাত্যহিক বাংলাভাষায় কি এইসব আপাত-আধুনিক বাগধারা ব্যবহার করা হতো?
এই দুটো খটকা বাদ দিলে উপন্যাসটিকে অবশ্যপাঠ্য বলে মনে হয়েছে আমার। বাংলা ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ধর্মীয় রাজনীতির অচলায়তনে আটকে না-থেকে, বাঙালি এবার সত্যিকারের প্রশ্ন করতে শিখুক, তবেই তো সত্যিকারের উত্তর খুঁজে পাবে। উপন্যাসের “প্রদোষ” শব্দটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, কিন্তু ফুটোমস্তান বাঙালিজাতির সত্যিকারের প্রদোষকাল কি সমাসন্ন?