Ratings1
Average rating5
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের আত্মজীবনীর নাম রেখেছিলেন “অর্ধেক জীবন”। তাঁর জীবনের বাকি অর্ধেকটা খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর লেখা কবিতায়। আমরা যারা সুনীলের কবিতার মুগ্ধ পাঠক, সেই আমাদের জীবনেরও বেশ কিছুটা অংশ কি ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই এইসব কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে? গত প্রায় একমাস ধরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রের চারটে খণ্ড পড়ে শেষ করার পরে, বাতাসে ভাসমান একাকী তুলোর বীজের মতো আমার মনে ভাসছে প্রথমবার তাঁর কবিতা আবিষ্কার করার স্মৃতি। মফস্বল শহরের বাংলা ইশকুলের অন্ধকার লাইব্রেরির বৃদ্ধ আলমারি থেকে বের করে আনা কীটদষ্ট বইটার নাম ছিলো “জাগরণ হেমবর্ণ”। সেই বইয়ের একটি কবিতার প্রথম লাইন : “যে লেখে, সে আমি নয়/ কেন যে আমায় দোষী করো!” যে-ছেলেটা বইটা পড়ছিলো সেও তো আমি ছিলাম না! “সে কখনো আমার মতন বসে থাকে/ টেবিলে মুখ গুঁজে?”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৫৮ সালের শীতকালে। পৌষমাসে। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। বইটির নাম ছিলো “একা এবং কয়েকজন”। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছিলো “আমার প্রিয় কবিদের প্রতি”। সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু বইয়ের কবিতাগুলো মোটেও সুবিধের ছিলো না। এই বইটিকে নিয়ে সুনীল পরবর্তীকালে নিজের দ্বিধা প্রকাশ করেছিলেন। পাপস্খালনের মতো আফসোস-স্খালনের জন্যে একই নামের একটি বড়ো আকারের উপন্যাস লিখেছিলেন। কবি হিসেবে সুনীলের প্রকৃত আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে, প্রথম বই প্রকাশের আট বছর পরে। বাংলা কবিতার জগতে গুটিকয় অবিস্মরণীয় বইয়ের অন্যতম সেই বইটির নাম— “আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি”। ভাবতে অবাক লাগে, এই বইয়ের অধিকাংশ কবিতা তিনি আমেরিকায় বসে লিখেছিলেন।
বইটির ভূমিকায় তিরিশ বছর বয়েসি কবি লিপিবদ্ধ করেছেন কিছু অকপট বাক্য : “অসীম ধৈর্যের সঙ্গে ওষ্ঠাধর সঙ্কুচিত করে পড়তে হয় নিজের পুরোনো কবিতা। যেগুলি পছন্দ হয় না এবং শরীর রি-রি করে, সেগুলি মাটিতে ফেলে দিই। ক্রমে আমার ঘরময় বিবর্ণ কাগজ উড়তে থাকে, ঘরের মেঝেতে ও হাওয়ায় ব্যর্থ কবিতা ছড়িয়ে যায়। ...জানি, যে-কবিতা আমি লিখতে চাই, এখনো তার মর্ম স্পর্শ করতে পারিনি।” পরবর্তী অর্ধশতাব্দব্যাপী, ২০১২ সালে তাঁর জীবনাবসান পর্যন্ত, সুনীলের কবিতায় যেন ক্রমাগত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁর সেই অকপট স্বীকারোক্তিরই নানাবিধ সংস্করণ। নানাবিধ উচ্চারণ। কবিতা লিখে তিনি সমাজ বদলাতে চাননি। প্রতিষ্ঠা পেতে চাননি। ঠাট্টা করে একবার লিখেছিলেন বটে, কিন্তু আদৌ কখনও কবিতা লিখে রাজপ্রাসাদ বানাতে কিংবা পন্টিয়াক গাড়ি কিনতে চাননি। নিজের কবিতায় আজীবন শুধু একটাই কথা বলতে চেয়েছেন : তিনি কী রকম ভাবে বেঁচে আছেন।
আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে পঞ্চাশের দশক ছিলো মোহভঙ্গের দশক। পাটভাঙা ধপধপে পোশাক পরিহিত রাজনৈতিক নেতাদের বচনবলিষ্ঠতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নির্ভেজাল ধাপ্পাবাজিকে প্রথমবারের জন্যে চিনতে পেরেছিলো দেশের মানুষ। তিরিশের দশকের ব্যাপারে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এই দশকে “বাংলা কাব্যের” মুক্তি ঘটেছিলো। তাহলে বলতে হয় পঞ্চাশের দশক ছিলো “বাংলা কবিতার” মুক্তির দশক! এই মুক্তি এতটাই নির্মম, এতটাই “উন্মার্গগামী” যে, রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতার ব্যান্ডমাস্টার স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু স্বীকার করে নিয়েছিলেন : আধুনিক কবিতা তিনি ভালো বুঝতে পারছেন না! বন্ধ করে দিয়েছিলেন নিজের সাধের “কবিতা” পত্রিকা। সেই “দুর্বোধ্য” আধুনিকতাকে ট্যাঁকে গুঁজে বাংলা কবিতার নতুন নৌকা তৈরি হলো যার নাম “কৃত্তিবাস” পত্রিকা। সেই নৌকার অবিসংবাদিত মাঝির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
কবি সুনীল যে ভবিষ্যতে গদ্যকার সুনীল হিসেবে অধিক পরিচিত হবেন সেটা তাঁর কবিতা পড়লে আন্দাজ করা যায়। কবিতার নতুন ভাষাকে স্বীকার করে নিয়েও, প্রয়োগসর্বস্ব আঁতেলগন্ধী নিরীক্ষাপ্রবণতাকে শুরু থেকেই তাচ্ছিল্য করেছিলেন তিনি। “আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি”র ঠিক পরের কবিতার বই “বন্দী, জেগে আছো”তে লিখলেন : “কাঁচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে/ দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি.../ ...ইচ্ছে করে লণ্ডভণ্ড করি এবার পৃথিবীটাকে/ মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি/ আমার কিছু ভাল্লাগে না!” এই যে অনুভূতিময় প্রত্যক্ষ প্রকাশভঙ্গিমা, দৃশ্যের পরে দৃশ্যকে সাবলীল বুনে যাওয়া, শব্দ ও বাক্যের সহজিয়া মগ্নতা, এইসমস্ত লক্ষণ তো একজন গদ্যশিল্পীর লক্ষণ। পঞ্চাশের দশকের সবচেয়ে বড় এবং বহুপ্রজ কবির নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ঠিক কথা। কিন্তু সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী কবিতাগুলো লিখেছেন সুনীল। কবিতা সবসময়ই মুষ্টিমেয় পাঠকের জন্যে নির্দিষ্ট ছিলো। আজও আছে। কিন্তু কবিতার লাইনও যে হয়ে উঠতে পারে পপুলার কালচারের অংশ, মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে পারে কবিতার টুকরো, কবিতার এই ক্যাজুয়াল স্বর সুনীলের নিজস্ব অর্জন। এত বেশি উদ্ধৃতিযোগ্য পঙ্ক্তি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং জীবনানন্দ দাশ ছাড়া অন্য কোনো বাঙালি কবির কাব্যকৃতিতে নেই। এখানে রবীন্দ্রনাথের নাম উল্লেখ করা উচিত হবে না। উনি তো মানুষ নন, “ঠাকুর”!