Ratings1
Average rating4
Selected novels by a Bengali author.
Reviews with the most likes.
পেশায় সাংবাদিক ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। সংবাদ-প্রতিবেদনে বাড়তি কথা ফেনিয়ে লেখার সুযোগ থাকেনা সাংবাদিকদের। পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে খুব তাড়াতাড়ি এবং স্পষ্টভাবে মূল বক্তব্যকে প্রকাশ করার তাগিদ থাকে। গৌরকিশোর ঘোষের উপন্যাসে সাংবাদিকসুলভ এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রত্যক্ষভাবে খুঁজে পেয়েছি। যদিও দৈনিক-পত্রিকায় খবর ছাপানোর তাড়াহুড়ো এবং সেইসব মুদ্রিত খবরের তাৎক্ষণিক সমসাময়িকতার বাইরে বেরিয়ে এই উপন্যাসগুলো হয়ে উঠেছে প্রকৃত অর্থে “সাহিত্য”। উঁচুদরের সাহিত্য। পাঠককে ভাবিয়ে তোলার মতো সাহিত্য। একবার পড়া হয়ে গেলে ঝালমুড়ির ঠোঙা তৈরি করা যাবেনা এই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো দিয়ে।
মোট ছয়টি উপন্যাস রয়েছে এই সংগ্রহে। সবকটাই সীমিত দৈর্ঘ্যের এবং প্রতিটির বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গি চমকপ্রদ। দুটো বিশেষ লক্ষণ গৌরকিশোরের উপন্যাসে দেখতে পেয়েছি। এক, তাঁর প্রধান চরিত্ররা প্রখরভাবে রাজনীতি এবং সময়-সচেতন। দুই, তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ছক ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্যে উদগ্রীব। গৌরকিশোরের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের ব্যাপারে খোঁজখবর করলে বোঝা যায়, এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিল। তাঁর উপন্যাসের চরিত্ররা সবাই অস্তিত্বের সংকটে ভুক্তভোগী। সমাজের সার্কাসে অদক্ষ জোকারের মতো তারা বিপজ্জনকভাবে ট্র্যাপিজের দড়ি ধরে ঝুলছে। কিন্তু প্রত্যেকেই নিজের অবস্থার ব্যাপারে তলিয়ে ভাবছে। বিশ্লেষণ করছে। শুধুই দিনগত পাপক্ষয় করতে শশব্যস্ত নয় তারা।
সবকটা উপন্যাস ধরে ধরে আলোচনা করার সুযোগ নেই। দরকারও নেই। গৌরকিশোর ঘোষের গদ্যভাষা তাঁর বক্তব্যের মতোই টানটান, ন্যাকামিবর্জিত, বলিষ্ঠ। যদিও তাঁর উপন্যাসের ন্যারেটিভ-গঠন গতানুগতিক নয়, বরং ভাষা এবং সংলাপ নিয়ে ক্রমাগত নিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। এবং প্রায় প্রতিটি নিরীক্ষাই আমার কাছে মৌলিক ও সার্থক বলে মনে হয়েছে। উপন্যাসগুলো ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে লেখা। আমরা সবাই জানি, এই সময়কালে বাংলা সাহিত্যে জাঁকিয়ে বসেছিলো আরো বেশকিছু বিকল্প সাহিত্যস্বর। কিন্তু গৌরকিশোরের মতো ভানহীন, ভন্ডামিহীন, কৃত্রিমতাহীন উৎকর্ষ আমি আর কারো মধ্যে দেখতে পাইনি। আর সেই জন্যেই, পাঠক হিসেবে আমি বারবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি।
সামাজিক অব্যবস্থাগুলো নিয়ে, মানুষের মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে, এরকম অদ্ভুত আতসকাচের ব্যবহার আমি আর কখনও দেখিনি যে! একবারের জন্যেও গৌরকিশোর সরাসরি আঙুল তুলে, মুখ থেকে থুতু ছিটিয়ে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশে ছুঁড়ে, কিংবা বাঁকা হেসে, সবজান্তা ভাব দেখিয়ে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গালিগালাজ করেননি (যেমন করাটাই “প্রতিবাদ” করার প্রতিষ্ঠিত রীতি— তখনও, এখনও)। তাঁর সমালোচনা করার পদ্ধতিটা নিস্পৃহ, মোহশূন্য, কিন্তু সত্যনিষ্ঠ। হাসপাতালের লাশকাটা ঘরের দরজা খুললে যেমন একইসঙ্গে ভেসে আসে হিমশীতল বাতাসের ঝাপটা এবং মৃতদেহের পচা দুর্গন্ধ (ডিসিনফেকট্যান্টের আপাতসুগন্ধ ছাপিয়ে)। গৌরকিশোর ঘোষের প্রতিটি উপন্যাস আমাকে উপলব্ধির সেই মৃতকল্প করিডোরে একলা ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। সেই করিডোরে দাঁড়িয়ে, আমাদের সমাজব্যবস্থার হাস্যকর অথচ নিদারুণ পরিস্থিতির নিখুঁত ভাষ্য হিসেবে আমি ফিরে ফিরে শুনতে পেয়েছি গৌরকিশোরের উপন্যাসের একটা সংলাপ :
ওরে, লাশটার পকেটগুলো ভালো করে দ্যাখ। যা পাস নিয়ে আয় এখানে। লিস্টি করে রেখে দিই। তারপর ওটাকে নিয়ে যা। গাদায় রেখে দে।
এই লাশটা কে? আমাদের জীবন্মৃত সমাজ? নাকি সমাজের সদস্য হিসেবে আলাদাভাবে আমরা সবাই?