Ratings1
Average rating5
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
তুষার রায় ছিলেন ষাটের দশকের একজন উজ্জ্বল ও সুপরিচিত কবি। মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। ধীরে ধীরে প্রবেশ করেন বিস্মৃতির অন্তরালে। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিলো তিনলাইনের ফিচেল কিন্তু অর্থবহ একটি ছড়ার মাধ্যমে :
পুলিশ ওরে পুলিশ,কবির কাছে আসার আগেটুপিটা তোর তুলিস।
তারপর আমিও ভুলেছি তাঁকে। তিনিও আমাকে। বছরদেড়েক আগে, কোনো এক পত্রিকার পৃষ্ঠায় হঠাৎ একটি কবিতা পড়ে মনে মনে ভাবি, “আপনাকে তো কালটিভেট কর্ত্তে হচ্চে মোশাই...“। পুরো কবিতাটা তুলে দিই এখানে :
বিদায় বন্ধুগণ, গনগনে আঁচের মধ্যেশুয়ে এই শিখার রুমাল নাড়া নিভে গেলেছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন পাপ ছিল কিনা।এখন আমার কোন কষ্ট নেই, কেননা আমিজেনে গিয়েছি দেহ মানে কিছু অনিবার্য পরম্পরাদেহ কখনো প্রদীপ সলতে ঠাকুর ঘরতবু তোমরা বিশ্বাস করোনিবার বার বুক চিরে দেখিয়েছি প্রেম, বার বারপেশী অ্যানাটমি শিরাতন্তু দেখাতে মশায়আমি গেঞ্জি খোলার মতো খুলেছি চামড়ানিজেই শরীর থেকে টেনেতারপর হার মেনে বিদায় বন্ধুগণ,গনগনে আঁচের মধ্যে শুয়ে এই শিখাররুমাল নাড়ছিনিভে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেনপাপ ছিল কিনা।
কবির কোনো বইই খুঁজে পাচ্ছিলাম না কলেজ স্ট্রিটে। একেতেই লকডাউন, তার উপর ঘূর্ণিঝড়। অনেক খোঁজার পরে পেলাম তাঁর কাব্যসংগ্রহ। কবিতাগুলো পড়ে খুব অবাক হলাম। ফস্ করে ভেবে ফেলি, এতটা ব্যতিক্রমী কাব্যভাষা নিয়ে এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলেন? ব্যতিক্রমী এবং বৈপ্লবিক। ব্যর্থ প্রেমের কবিতা তো ঢের পড়েছি। কিন্তু প্রেমহীনতার এরকম অব্যর্থ অভিব্যক্তি আমি আর দেখিনি। এটা কী? ক্রোধ? নাকি ক্রোধের পরের শীতলতা? নাকি অপ্রাপ্তির ধিকিধিকি অভিমান?
তুমি সেই লাল ডিভানেতে শুয়ে বুঝলে নাআমি তো তৃষ্ণার্ত হরিণ হয়ে নামতাম জলেতুমি খেতে চাইলে, নিজের মিটুলি খুবলে—রাখতাম তোমার ঠোঁটের সামনে,তোমার জন্যে রেসের ঘোড়া হয়ে বাজি মারতাম প্রত্যহতোমার একটি চুম্বনের জন্য শাহেন শাহ হয়েপাঁচ লক্ষ দিনার কিংবাউপযুক্ত পাছায় গুনে ঠিক পাঁচ লাথি,তুমি কিছু বুঝলে নাঅর্থহীন হলুদ সাবমেরিন হয়ে চলে গেলেঝোলাগুড় নিয়ে মরিশাসেআমি মরি হতাশ্বাসে, তুমি...তুমি কিছু বুঝলে না— বোবা কালাবেডপ্যান তুমিতুমি ভাঙা বাথরুমে ঝকঝকে মুতের বেসিন।
চমক আমার ভালো লাগেনা এমনিতে। কিন্তু তাঁর কবিতায় এরকম নির্বিকার চমক তিনি বারবার দিয়েছেন। যেটা আমার খুব ভালো লেগেছে। তাঁর অসহনীয় ক্রোধ আমি টের পেয়েছি। কিন্তু তিনি যেন ক্রোধের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা-বাছা বলে সেই ক্রোধকে শান্ত করেছেন। পরিমিত করেছেন। কীসের ক্রোধ? সবচেয়ে বড় ক্রোধ যা থাকে মানুষের। নিজের উপর ক্রোধ।
তবে কেন লিখেছি কবিতা, গান কেন হয়েছে রচিততারকা খচিত ওই আকাশেতে কেন তবে ওঠে চাঁদবিষাদ দুচোখ ছোঁয় সে কবির অশ্রু ঝরে নিভৃত নয়নেশেষের শয়নে তবে শুতে দাও, আমাকেও লাশ করোফাঁসি দাও গাছের ডালেতে, বুলেটে ঝাঁঝরা করোআমাকেও ওইভাবে, শোনোতারপর কখনো পাতক, তুমি শর্ত করো হবে না ঘাতক।
চপেটাঘাতের মতো ছিটকে আসা অসন্তোষ দেখে মনে হয়েছে, এরকম তো মাইরি আর কাউকে লিখতে দেখিনি :
আপনারা থাকুন এই থকথকে হড়হড়ে জীবনআর কলাবাগানের রাজনীতি নিয়ে,জেনে নিয়ে থোড় মোচা নটে শাক কতোবার মুড়োবে ছাগলেফের গজাবেই জেনে— জেনে নিয়ে আপনারা থাকুন!
ষাটের দশকে বসে, বুদ্ধদেব বসু, কৃত্তিবাস কিংবা আনন্দবাজারের সমস্ত অমোঘ হাতছানি অগ্রাহ্য করে নিজের মতো লিখে গেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এরকম অভাবনীয় কবিতা। তারপর কি তিনি শীতসন্ধ্যায় কুয়াশাভ্রমিত ময়দানের ভেজা ঘাসে খালিপায়ে দাঁড়িয়ে একলা পড়ে শুনিয়েছেন এইসব কবিতা, নির্বান্ধব কোনো বিষন্ন বাদামওয়ালাকে?
অস্ত বেলায় আকাশ এমন লালদেখছি ধূসর বেলায় দাঁড়িয়ে একা,একাই এসেছি একা চলে যাবো কাল।
কবিতার এমন তছনছ ভাষ্যকারকে নিয়ে ক্যানো শুনিনি কোনো আলোচনা এতদিন? কে লেখে নিজের প্রেমিকার প্রতি এমন দৃপ্ত অঙ্গীকার?
আমি ম্লান মুখ তাড়িখোর জানি আমিরসে তীব্র বিষ আছে,তবু নীল মাছি হয়ে দেখো আমিমরে ভাসবো তোমার সায়রে।
ভাগ্যিস খুব বেশি কবিতা লেখেননি তুষার রায়। নইলে হাড়েমজ্জায় এরকম দৃঘাংচু হয়ে বসে থাকতাম, এখন যেমন বসে আছি, জৈষ্ঠ্যের আধপাগল এই সন্ধ্যাবেলায়। আর মাথার ভেতর গগনচুম্বী চিলের মতো চক্রাকারে ঘুরে যেতো এরকম আরো কতো লাইন :
গনগনে আঁচের মধ্যে শুয়ে এই শিখাররুমাল নাড়ছিনিভে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেনপাপ ছিল কিনা।