Ratings1
Average rating4
Essays on Bengali motion picture.
Reviews with the most likes.
ভেবে দেখলে একটা কথা সত্যি। যে-লেখাগুলোর জন্যে সত্যজিৎ পরবর্তীকালে লেখক হিসেবে খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তালাভ করেছিলেন, ফেলুদা কিংবা প্রোফেসর শঙ্কু কিংবা তাঁর ছোটোগল্পগুলো, এই সবকিছুই তিনি লিখেছিলেন প্রয়োজনের খাতিরে। পারিবারিক পত্রিকা “সন্দেশ” যখন পুনরায় বের হওয়া শুরু হয়, সেই পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরাবার উদ্দেশ্যে রায়পরিবারের অনেক সদস্যকেই দুহাত খুলে লিখতে হয়েছিলো। প্রধান-সম্পাদক সত্যজিৎকে একটু বেশিই লিখতে হয়েছিলো। আরো পরে, তাঁর স্ত্রীর আত্মজীবনী “আমাদের কথা”-তে দেখতে পাই সত্যজিতের অকপট স্বীকারোক্তি : সিনেমা থেকে উপার্জন নয়, তাঁদের সংসার চলতো সত্যজিতের লেখা বইগুলোর রয়ালটির টাকায়। ভেবে দেখলে, তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলো কিন্তু পুরোপুরি এই গোত্রের নয়। অর্থাৎ গল্প-উপন্যাসের মতো ফরমায়েশি নয়। সিনেমা (এবং পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত) ছিলো সত্যজিতের সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়। অথচ সিনেমা বিষয়ে খুব বেশি লেখার সুযোগ তিনি পাননি। সিনেমা নির্মাণ করতেন সৃজনশীল সৃষ্টির উদ্দীপনায়। গল্প লিখতেন কিছুটা কর্তব্যের ডাকে, কিছুটা জীবিকার প্রয়োজনে। গুরুগম্ভীর সিরিয়াস প্রবন্ধ লেখার সময় কই? কিন্তু সত্যজিতের সৃষ্টিভাণ্ডারের দিকে চোখ বোলালে আমরা টের পাবো, খুব সামান্য কোনো কাজে হাত দিলেও তিনি সেই কাজটা দায়সারাভাবে করতেন না। “দায়সারা” শব্দটা তাঁর অভিধানে ছিলোই না। উদাহরণস্বরূপ, অনামা অখ্যাত “শারদীয় সোভিয়েত বিপ্লব পরিচয়” নামের পত্রিকাতে তিনি যখন “সোভিয়েত চলচ্চিত্র” নামের প্রবন্ধটি লিখেছেন, নিজের অভিজ্ঞানের পুরোটা ঢেলে দিয়েছেন। অথচ এই প্রবন্ধটি তাঁকে পরিচিতি দ্যায়নি, পয়সা দ্যায়নি, কিছুই দ্যায়নি।ঠিক এই কারণেই সত্যজিতের প্রবন্ধগুলো আমার কাছে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। অল্পবয়েসে “বিষয় চলচ্চিত্র” পড়েছিলাম। সিনেমার তখন কিছুই বুঝতাম না (এখনও বুঝিনা যদিও)। কিন্তু জটিল বিষয় নিয়ে যিনি ইচ্ছে করলেই পাণ্ডিত্য ফলাতে পারতেন, লম্বা লম্বা তত্ত্বকথা লিখতে পারতেন সহজেই, সেই মানুষটা সযত্নে পরিহার করেছেন পণ্ডিতি করার লোভ। সারাজীবন। আজীবন। তাই “চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে” নামক মাত্র দুইপৃষ্ঠার রচনাতে তিনি আমার মতো গণ্ডমূর্খকে এমন অনেককিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন যেটা হয়তো এই বিষয়ের একটা গোটা বই পড়লেও আমি বুঝতে পারতাম না। “সংলাপ যদি স্বাভাবিক না হয় তাহলে অভিনয় স্বাভাবিক হওয়া মুশকিল”— হঠাৎ শুনতে খুব সামান্য মনে হলেও, সিনেমার নির্মাণগত দিকটা নিয়ে যারা বিন্দুমাত্রও আগ্রহী, তারা এই কথাটার মূল্য বুঝতে পারবেন! এরকম মূল্যবান উদাহরণ আমি ভুরি ভুরি দিয়ে যেতে পারি।অথচ মানুষটা একটু সময় নিয়ে, একটু যত্ন নিয়ে, একটু আরাম করে, প্রবন্ধ লেখার সুযোগ পেলেন না। এটা একটা বড় আফসোস। তাঁর প্রবন্ধগুলো পড়লেই বোঝা যায়, হাজাররকম কাজের ফাঁকে চটজলদি সময় বের করে নিয়ে লেখা হয়েছে সেগুলো। তাই সিংহভাগ প্রবন্ধই দৈর্ঘ্যে যৎসামান্য। প্রবন্ধের ভাষাতে যদিও সত্যজিতের ট্রেডমার্ক সহজতা এবং মিতবাচনের চিহ্ন আছে। প্রতিটা রচনাতেই কিছু-না-কিছু নতুন অন্তর্দৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়। এমনকি তাঁর নিজের তৈরি সিনেমাগুলো নিয়ে ছোটো ছোটো যে লেখাগুলো লিখেছেন, সেখানেও তিনি পাঠকের সময় ফালতু নষ্ট করেননি। নতুন কোনো আঙ্গিকে চিনিয়েছেন তাঁর চিরচেনা ছবিকে। “অপুর সংসার” তৈরির সময় অপু চরিত্র এবং অপু-অপর্ণার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে দেড়পৃষ্ঠার একটা নোট লিখে দিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। এই নোটটি যেন সত্যজিতের পুরো জীবনকে, পুরো প্রতিভাকে, পুরো মানুষটাকে, এক লহমায় চিনিয়ে দ্যায়। সহজ, মিতবাক, স্পষ্ট, প্রাঞ্জল, কিন্তু চিন্তার গভীরতায় ও বক্তব্যের বিশ্লেষণে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত। অনন্য!তাঁর প্রবন্ধ নিয়ে আরো অনেক কথা বলে ফেলা যায়। আমার বিশেষভাবে ভালোলাগা প্রবন্ধগুলো নিয়ে আরো কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে। তাঁকে নিয়ে আমার কথার শেষ নেই। চারশোর কিছু বেশি পৃষ্ঠার এই বইটিতে তাঁর লেখা শুধু বাংলা প্রবন্ধগুলোই স্থান পেয়েছে। তাঁর ইংরিজি মৌলিক প্রবন্ধগুলো, যা আপাতত দুটো আলাদা আলাদা বইতে সংকলিত হয়েছে, [b:Our Films, Their Films 670580 Our Films, Their Films Satyajit Ray https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1363702482l/670580.SY75.jpg 656613] এবং [b:Deep Focus 13385130 Deep Focus Reflections On Cinema Satyajit Ray https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1337760534l/13385130.SX50.jpg 18615535]— সেগুলোও অসামান্য, অসাধারণ— বলাই বাহুল্য! ইংরিজি এবং বাংলা এই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে দিয়ে সত্যজিতের একটা ভিন্ন, অপরিচিত রূপ আমাদের সামনে প্রকাশিত হয়। একজন চিন্তাশীল সত্যজিৎ। ভাবুক সত্যজিৎ। যে-বিষয়টা আমরা সবচেয়ে ভালোবাসি, আমাদের প্রাণের সবচেয়ে কাছাকাছি, সেই বিষয়ে কথা বললেই তো সবচেয়ে ভালো চিনতে পারা যায় আমাদের, তাইনা?একেক সময় মনে হয় যদি সময় পাই, অবকাশ আসে, তখন শুধু বাখ মোৎজার্ট বেটোফেন শুনবো!