Ratings1
Average rating4
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
কলেজ স্কয়ারের “ধ্যানবিন্দু” দোকানে আমি যাই কবিতার বইয়ের খোঁজ করতে আর লিটিল ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা উল্টে দেখতে। সেখানেই পেয়ে গেলাম সালভাদোর দালি-র এই চমৎকার জীবনীটি। বিংশ শতাব্দীর চিত্রশিল্পীদের মধ্যে পাবলো পিকাসো এবং সালভাদোর দালি— এই দুজনের মধ্যে কে বেশি কিংবদন্তি ছিলেন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয় (দুজনেই স্প্যানিশ)। যদি চারিত্রিক বৈপরীত্যের তত্ত্বতালাশ করতে হয়, তাহলে দালি-র তুলনা শুধু চিত্রশিল্প জগতে নয়, পৃথিবীর যেকোনো সাংস্কৃতিক মাধ্যমেই পাওয়া দুষ্কর। অনতিদীর্ঘ এই বইটিতে একজন অবিস্মরণীয় শিল্পীর জীবন এবং কাজের খতিয়ান তুলে ধরা হয়েছে, যা আমার মতো সীমিত শিল্পবোধসম্পন্ন পাঠকের কাছে এক পরম পাওনা।
আমার দৃষ্টির ধার এত বেশি, এবং একাগ্রতা এত তীব্র, আর আমার সৃষ্টি প্রমাণ করছে যে এই শতাব্দীতে আমার চেয়ে বীরোচিত এবং বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব আর কেউ নেই। নিচাহ্ (Nietzsche) ছিলেন, কিন্তু উন্মাদ হয়ে জীবন শেষ করেছিলেন। আমি উন্মাদ নই আমি বিদূষকও নই। বাকি উন্মাদদের সঙ্গে আমার একটাই তফাৎ আছে— আমি উন্মাদ নই।
নিজের আত্মজীবনীতে এইভাবে নিজেই নিজের তারিফ করেছেন দালি। একবার দুবার নয়। সারাটা জীবন অক্লান্তভাবে নিজের গুণগান করে গেছেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, নিজের ঢাক নিজে পিটিয়েছেন। নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন, তিনি একজন “নার্সিসিস্ট”। নিজের মুখেই ঘোষণা করেছেন, দিনের মধ্যে দুই ঘণ্টা যদি ছবি আঁকার কাজে ব্যস্ত থাকেন, বাকি বাইশ ঘণ্টা বরাদ্দ থাকে স্বপ্ন দেখার কাজে। “সুররিয়ালিজম” ধারাটিকে প্রায় তর্কাতীতভাবে গণ্য করা হয় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে অভিনব এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে। এবং এই আন্দোলনের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাটি সালভাদোর দালির হাতেই ধরা ছিল, এই ব্যাপারে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। অথচ সেই দালি-ই দম্ভ ভরে ঘোষণা করেছেন :
বাদবাকি সুররিয়ালিস্ট শিল্পীদের সঙ্গে আমার পার্থক্য হলো, আমিই হলাম একমাত্র সুররিয়ালিস্ট।
এমন বলেছেন ক্যানো? শুধুই দম্ভ? না বোধহয়। ঠিক যেমন কবিদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে কিছু ধারণা থাকে : কবিদের বড় বড় চুল হয়, সেই চুল তারা আঁচড়ায় না, জামার বোতাম ছেঁড়া থাকে, পকেট থাকে গড়ের মাঠ। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীদের নিয়েও পূর্বধৃত কিছু ধারণা পোষণ করে থাকি আমরা। একটা মস্ত বড় ভুল তো আমরা প্রায় সবাই করি, সুররিয়ালিজম এবং অ্যাবস্ট্র্যাকশনিজম (বিমূর্ত শিল্পধারা)-কে অভিন্নরূপে গণ্য করি। “সালভাদোর” শব্দের অর্থ হলো Saviour বা ত্রাণকর্তা। নিজের নামের প্রসঙ্গ টেনে দালি নিজেই বলেছেন :
কিউবিজম, ডাডাইজম, অ্যাবস্ট্র্যাকশনিজম, ফভিজম, বাজারে ছেয়ে থাকা এইরকম গন্ডা গন্ডা “ইজম” থেকে চিত্রশিল্পকে বাঁচানোর জন্যেই আমার আবির্ভাব ঘটেছে।
কী দোষ করলো এইসব ইজম? দালি-র মতে, এইসব শিল্পীদের প্রায় কেউই ঠিকঠাক ড্রয়িং করতে পারেনা। মানবশরীর কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যকে দক্ষভাবে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা নেই এদের। এরা রঙের ব্যবহার জানেনা। পার্সপেক্টিভের জ্ঞান নেই এদের। আর নিজেদের অক্ষমতাকে ঢাকতেই এরা এইসব আজগুবি ইজমের ছাতার তলায় এসে জড়ো হয়েছে। দালি-র নিজের দৈনন্দিন জীবন ছিল অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নিজের কাজের ব্যাপারে ছিলেন প্রচণ্ড পরিশ্রমী (এই দিক দিয়ে পিকাসোর সঙ্গে মিল আছে তাঁর)। শিল্পে সিম্বলিজম বা প্রতীকের ব্যবহারকেও অশ্রদ্ধার চোখে দেখতেন তিনি। তাঁর মতে, যারা নিজেদের মনোভাবকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম, তারাই প্রতীকের উপর নির্ভরশীল হয়। যেকোনো শিল্প হলো প্রকৃতির সরাসরি উন্মোচন। প্রকৃতিতে “প্রতীক” বলে কিছু নেই, অ্যাবস্ট্রাক্ট বলে কিছু নেই, যা আছে সবকিছুই সরাসরি অর্থবোধক। ঠিক এই কারণেই “Art for art's sake” তত্ত্বকেও দুচ্ছাই করেছেন।
তাহলে কেমন ছিল সালভাদোর দালি-র নিজস্ব শৈল্পিক মনোজগৎ? গুগল থেকে দালি-র যেকোনো বিখ্যাত ছবি খুঁটিয়ে দেখলেই একটা ব্যাপার বোঝা যায় (এই বইয়ের ভেতরেও রয়েছে অসংখ্য সুমুদ্রিত ছবি)— একনজরে এই ছবিগুলোকে বিমূর্ত এবং আজগুবি বলে মনে হলেও আসলে তা শিল্পীর অবচেতন মন এবং অবিশ্বাস্য কল্পনাশক্তির মূর্ত প্রকাশ। এর মধ্যে প্রতীকী কিছু নেই, অকল্পনীয় কিছু নেই, উদ্ভট কিছু নেই (তাঁর নিজের ছবির মধ্যে প্রতীক খুঁজতে নিষেধ করেছেন)। দালি ছিলেন অস্ট্রিয়ান মনস্তত্ত্ববিদ সিগমান্ড ফ্রয়েডের ভক্ত। দালি-র ছবির এই আপাত উদ্ভটজগৎ আসলে ফ্রয়েডীয় অবচেতন মন এবং স্বপ্নসন্ধানের প্রতিফলন। ঘুমের মধ্যে আমাদের দেখা স্বপ্নগুলো যেমন অবাস্তব হয়েও বাস্তব, দালি-র ছবিও তেমনি। একইসঙ্গে দালি একে বলেছেন তাঁর অতীন্দ্রিয়সত্তার বহিঃপ্রকাশ। ভাবতে খুবই আশ্চর্য লাগে, সুররিয়ালিজম-এর সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন গভীরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী (এবং বামপন্থার বিরোধী)। আধুনিক চিত্রশিল্পের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বটি মধ্যযুগের রেনেসাঁস খ্রিস্টান ভক্তিবাদী চিত্রকলা থেকে নিজের বেশিরভাগ আইডিয়া আহরণ করেছিলেন!
একে যদি চারিত্রিক বৈপরীত্য না বলা হয় তাহলে আর কাকে বলা হবে? দালি-র অভিনব ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে আরও অনেক কিছু বলে ফেলা যায়। স্বঘোষিত নার্সিসিজমের ব্যাপারে তো আগেই বলেছি। তিরিশের দশকের স্পেনের মানুষ হয়ে (স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ) এবং চল্লিশের দশকের ইয়োরোপের মানুষ হয়ে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ), তিনি ছিলেন ঘোরতরভাবে অরাজনৈতিক। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় পালিয়েছিলেন রোমে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকাতে। কিন্তু এই ব্যাপারে কোনও লুকোছাপা ছিল না তাঁর। সরাসরি বলেছেন :
আমি ইতিহাসপ্রবণ মানুষ নই, আমি যেমন অরাজনৈতিক, তেমনি আমার ইতিহাস প্রবণতাও কম। হয়তো আমি আমার সময় থেকে এগিয়ে রয়েছি অনেক গুণ, কিংবা সময় থেকে পিছিয়ে আছি অনেকটা। কিন্তু তাই বলে সমসাময়িক এই পিংপং খেলায় আমি নেই!
আত্মপ্রচারে ছিলেন দ্বিধাহীন। পয়সা রোজগারের ব্যাপারে ছিলেন নির্লজ্জ (“টাকাপয়সা ভীষণ ভালোবাসি আমি”)। বিখ্যাত ফরাসি কবি পল এলুয়ার-এর স্ত্রী, দালি-র চেয়ে দশ বছরের বড় গালা-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল শিল্পের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পৃথিবীতে আর কোনও শিল্পী নিজের প্রেরণাদাত্রী (muse)-কে নিয়ে এত বেশি মাতামাতি করেননি। নিজের অসংখ্য ছবিতে গালা-কে এঁকেছেন। মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন, গালা-র সঙ্গে জীবন না কাটালে তিনি দালি হয়ে উঠতে পারতেন না।
বিয়ে করেছিলেন এই নারীকে এবং পাঁচ দশকব্যাপী ঝড়ের মতো উদগ্র দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন। একদিকে গালা ছিলেন তাঁর বিবিধ এবং উন্মত্ত যৌননিরীক্ষার সঙ্গী, আরেকদিকে দালি-র টাকাপয়সা ও বিপুল সম্পদের হিসেবরক্ষক। একটা সময় নিজে অমর হতে চেয়েছিলেন (তাত্ত্বিকভাবে অমর নয়, আক্ষরিক “অমর”)। মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পেতেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়েসে জীবনসঙ্গিনীর মৃত্যুর পরে ঠিক করেন নিজেও মৃত্যুবরণ করবেন। জল খাওয়া ত্যাগ করেন। পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। চুরাশি বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে একবার ফিসফিস করে বললেন, “যবনিকা পতন”, তারপর বললেন :
আমার ঘড়িটা কোথায়?