Ratings1
Average rating3
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
এই বইটিকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী বলা যাবে না। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে হিন্দুধর্মের অবস্থা কেমন ছিল? ব্রাহ্মণরা ভাবতো তারা জাতপাতের অবস্থানগত পিরামিডের একদম চূড়ায় বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে (যদিও, পিরামিডের একদম উপরের ছুঁচলো অংশটিতে বসে থাকা শারীরিকভাবে একটু অস্বস্তিকর)। আর সমাজের অন্ত্যজ মানুষরা, যারা বেদ বেদান্ত শাস্ত্র ফাস্ত্র এইসব বুঝতেন না, তারা নিজেদের সুবিধে মতো ধর্মপালনের উপায় খুঁজে বের করে নিয়েছিলেন।
হিন্দু ধর্মের মূল শাস্ত্রগ্রন্থগুলো পৌত্তলিকতাকে সমর্থন করে না। “অদ্বৈতবাদ” নামের একটি দার্শনিক চিন্তার লাইন ধরে সুদীর্ঘকাল মেইনস্ট্রিম হিন্দু দর্শনের বিশ্লেষণ এবং চর্চা হয়ে আসছিল। মোটামুটিভাবে “অদ্বৈতবাদ” = ঈশ্বর কোনও মানুষের মতো দেখতে থ্রি-ডাইমেনশনাল জিনিস নয়। রক্তমাংসের মনুষ্যের দ্বারা তাঁকে বোঝা, কল্পনা করা, অনুভব করা, বিশ্লেষণ করা, স্পর্শ করা, দর্শন করা— এইসব পার্থিব কোনোকিছুই করা সম্ভব নয়। তিনি “অবাঙ্মনসগোচর”। সাধারণ বোধবুদ্ধি দিয়ে তাঁকে বোঝা যায় না।
ঈশ্বরের এই যে দুর্বোধ্য অদ্বৈত রূপটির ধারণা, একজন সাধারণ অশিক্ষিত দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের মাথার দুই কিলোমিটার উপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। রুজি রোজগারের ধান্দায় সারাদিন পরিশ্রম করার পরে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এইসব ভজকট চিন্তাভাবনা করতে কার ভালো লাগে? ক্লাসের হিংসুটে ফার্স্ট বয় (কিংবা গার্লরা) যেমন নিজেদের “স্পেশ্যাল নোটস” অন্যদের থেকে লুকিয়ে রাখে, শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরাও তেমনি এইসব টেকনিক্যাল দার্শনিক ব্যাপার সাধারণ মানুষের থেকে লুকিয়ে রাখতো। সাধারণ মানুষ তখন ধুরশ্লা বলে নিজেরাই নিজেদের মতো ঈশ্বরের রূপ কল্পনা করে নিতে বাধ্য হলো।
কিন্তু এত সহজে সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ ঈশ্বরকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে, ঈশ্বরের মূর্তি তৈরি করে, পূজা করতে লাগলো। আর ওই হিংসুটে ফার্স্ট বয়রা (এই ক্ষেত্রে শুধু বয়, কারণ গার্লদের ক্ষেত্রে শাস্ত্রপাঠ নিষিদ্ধ ছিল) বললো, মাটি কিংবা ধাতু কিংবা পাথর দিয়ে তৈরি মূর্তি নিয়ে তোমরা যতোই লাফালাফি করো, ধর্মের আচার বিচার সংস্কার নিয়ম কানুনের ব্যাপারে জানতে হলে আমাদের কাছেই আসতে হবে। ঈশ্বরকে নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এই টানাপোড়েন বহু যুগ ধরেই চলছিল। ঠিক এই পরিস্থিতিতে চৈতন্যদেব এমন একটি উপায় বললেন, যাতে এক ঝটকায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে গ্যালো।
তিনি বললেন, ধর্মপালন করার জন্যে আচার বিচার নিয়ম নিষ্ঠা মন্ত্র তন্ত্র হাবিজাবি কিচ্ছু দরকার নেই। প্রাণের আনন্দে ভক্তিসহকারে উচ্চকণ্ঠে স্রেফ হরিনাম সংকীর্তন করলেই ঈশ্বরকে ডাকা হবে, ঈশ্বরকে পাওয়া হবে। সঙ্গে যদি খোল কর্তাল শঙ্খ মাদল জোগাড় করতে পারো তাহলে তো কথাই নেই। এইসব বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গলা ছেড়ে (ইচ্ছে হলে দুই হাত তুলে একটু নেচেও নিতে পারো, নো প্রবলেম) হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করলে আর কিছুর প্রয়োজন নেই। ব্যাস, মহাপ্রভুর এই আশ্বাস পেয়ে সাধারণ মানুষ উল্লাসে একেবারে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো। প্রথমে নবদ্বীপ শহর, তারপর গোটা গৌড়বঙ্গ, তারপর ভারতের আরও নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো ঈশ্বর ভজনার এই অভিনব সহজিয়া পন্থা। প্রতিষ্ঠিত হলো “গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন”। (এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানানো যেতে পারে। হরিনাম সংকীর্তনের বার্তাটি চৈতন্যদেব সর্বপ্রথম, নবদ্বীপেরও আগে, প্রচার করেছিলেন পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টে— বর্তমান সিলেট)।
আজকের দিনের বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করলে এই পুরো বৃত্তান্তকে “আরো একটি নতুন কিসিমের কুসংস্কারগ্রস্ত ধর্মীয় পাগলামি” বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চিরাচরিত সামাজিক কাঠামোর সীমা লঙ্ঘন না করেও, তৎকালীন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে, ধর্মকে সংস্কার করার এই সাহস দেখাতে চৈতন্যদেবের আগেও কেউ পারেননি, পরেও কেউ পারেননি। এমনকি আজকের দিনের মুক্তচিন্তার ফুরফুরে মলয় বাতাসেও ধর্মকে নিয়ে বেশি খোঁচাখুঁচি করার পরিণাম কেমন হতে পারে তা আমরা সবাই জানি।
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তাঁর নিজস্ব বিশ্লেষণের আলোকে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক চিন্তার জগৎকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই বিষয়ে অনেক নতুন কিছু জানতে পেরেছি বইটা পড়ে, অনেক অন্ধকার দূর হয়েছে। রিভিউর সীমিত পরিসরে মহাপ্রভু প্রবর্তিত বৈষ্ণব দর্শনের ব্যাপারে প্রায় কোনোকিছুই আমি লিখতে পারলাম না। তাঁর মতো যুগন্ধর মানুষকে “ঈশ্বরের অবতার” হিসেবে গণ্য করা হবে, এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু আদপে তো তিনি ছিলেন আপনার আমার মতোই রক্তমাংসের মানুষ। কেউ বলে তিনি শ্রীকৃষ্ণের অবতার, কেউ বলে তিনি প্রথম বাঙালি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী (তথা “প্রলেতারিয়েতদের মসিহা”), কেউ বলে তিনি হিন্দুধর্মের একজন সংস্কারক, কেউ বলে তিনি কিসুই না, স্রেফ একজন বায়ুরোগগ্রস্ত প্রায়োন্মাদ।
কিন্তু সব মসিহার যেরকম অবস্থা হয় মহাপ্রভুরও একই অবস্থা হয়েছে। যিনি কিনা মানুষের উচ্চনিচ ভেদাভেদ দূর করে সবাইকে একই পঙ্ক্তিতে দাঁড় করাবার জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করলেন, তাঁর নিজের শহর নবদ্বীপে গেলে আজকে দেখা যাবে, তাঁর নামাঙ্কিত “মহাপ্রভু মন্দিরে” অব্রাহ্মণদের প্রবেশ করতে হলে কাঠের বাক্সের ভিতরে ভেট গুঁজে দিয়ে তবে ঢুকতে হয় (ভেট = entry fee)। তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পার্ষদ, মুসলমান ধর্মাবলম্বী হরিদাসকে মিছিলের মধ্যিখানে রেখে যিনি অত্যাচারী কাজির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেই মহাপ্রভুর ভক্তরা তাদের মন্দিরে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যাপারে আপত্তি না জানালেও নজরুলগীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যিনি সবাইকে হতে বলেছেন “তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা” (তৃণের মতো সামান্য, বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু), তাঁরই নামে কপালে তিলক কেটে ISKCON-এর ছোকরা সন্ন্যাসীমহারাজ ইউটিউবের ভিডিওতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দকে বাঁদরের মতো মুখ ভ্যাংচায়। চেষ্টাচরিত্র করে দেখলে কুকুরের ল্যাজ সোজা হলেও হতে পারে, কিন্তু মানুষের ল্যাজ সোজা করা মহাপ্রভুরও কম্মো নয়।