Ratings1
Average rating2
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
ঔপন্যাসিক সুবোধ ঘোষ এবং ছোটোগল্পকার সুবোধ ঘোষ দুজন ভিন্ন ব্যক্তি, এটা আমি আগেও টের পেয়েছি। তবুও তিলাঞ্জলি পড়া শুরু করেছিলাম কারণ, পঞ্চাশের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে বলতে গেলে প্রায় কিছুই লেখা হয়নি। বাংলা তেরোশো-পঞ্চাশ (ইংরিজি ১৯৪৩) সালের দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিলেন প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ। প্রকৃত মৃত্যুসংখ্যা আরো অনেক বেশি ছিল, কারণ এটা সরকারি হিসেব। পঞ্চাশের মন্বন্তরকে শুধু “দুর্ভিক্ষ” বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। ঠান্ডা মাথায় ও সুপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত গণহত্যা বললে ঠিক বলা হবে। অথচ এই মর্মান্তিক ঘটনাটিকে নিয়ে বাংলাভাষার সাহিত্যিকরা আশ্চর্যরকম নিশ্চুপ। বিভূতিভূষণের “অশনি-সংকেত” ছাড়া বলার মতো কোনো উপন্যাস নেই। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কয়েকটা ছোটগল্প ছাড়া বলার মতো ছোটগল্প নেই। বিজন ভট্টাচার্যের “নবান্ন” ছাড়া নাটক নেই। সুকান্ত ভট্টাচার্য ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা একমুঠো কবিতা ছাড়া কবিতা নেই।
এই উপন্যাসটা পড়ে খুব অবাক হলাম। পঞ্চাশের মন্বন্তরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলো এই যুক্তিতে যে, “মহান” সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ইংরেজরা ফ্যাসিস্টবিরোধী গাঁটছড়া বেঁধেছে। ফলে এমনিতে যারা “দুনিয়ার মজদুর এক হও”, “সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক”, “সাম্রাজ্যবাদীর কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও” এইসব হ্যানাত্যানা বুলি কপচায়, তারা লজ্জার মাথা খেয়ে বাংলার অগণিত সাধারণ মানুষের অভুক্ত থাকার বিষয়টা অগ্রাহ্য করেছিলো। ফ্যাসিস্টবিরোধিতাই ছিলো তাদের মূল অ্যাজেন্ডা। পঞ্চাশের মন্বন্তর এমন একটা ঘটনা, যেখানে খেতে-না-পাওয়া মানুষদের পাশে কেউ ছিলো না। ইংরেজ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তাদের ভারত ছাড়ো আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। কমিউনিস্ট পার্টি তাদের রাশিয়ান ভেঁপু বাজাতে ব্যস্ত ছিলো। বাংলার প্রাদেশিক সরকার কালোবাজারিদের পায়ে তেলমালিশ করতে ব্যস্ত ছিলো। ব্যবসায়ীরা নিজেদের গুদামে চাল মজুত করতে ব্যস্ত ছিলো। বাংলার স্বচ্ছল মানুষরা কালোবাজার থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে সেই চাল কিনতে ব্যস্ত ছিলো।
দুটো ভাতের জন্যে দলে দলে মানুষ গ্রাম-গঞ্জ-মফস্বল থেকে শহরে চলে এসেছিলো। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের গল্পে এইসব ঘটনার কথা আমরা কিছু কিছু পড়েছি। কলকাতার রাস্তায় পোকামাকড়ের মতো বসবাস করছিলো মানুষ। পোকামাকড়ের মতো বেঘোরে মারা যাচ্ছিলো। যদিও তাদের কোনোভাবেই মানুষ বলা যায় না। চেহারায়, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, মানসিকতায়, সেই লক্ষ লক্ষ হাভাতের দল সমবেতভাবে নিজেদের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিলো। নাগরিক সমাজ বড় বিব্রত ছিলো এই পোকামাকড়দের নিয়ে। তাদের কর্কশ “ফ্যান দাও ফ্যান দাও” চিৎকারে আকাশবাতাস ভারী হয়ে থাকতো রাত্রিদিন। হ্যাঁ, এটা সত্যি কথা যে, তথাকথিত “সর্বহারাদের পার্টি” মোক্ষম সময়ে সর্বহারাদের পাশে দাঁড়ায়নি। কিন্তু এই উপন্যাসের লেখক কমিউনিস্টদের বিপরীতে জাতীয় কংগ্রেসকে প্রায় ভগবানের আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। উপন্যাসটা লেখা হয়েছিলো ১৯৪৪ সালে, অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের কয়েকমাস পরেই। জাতীয় কংগ্রেসের ঢালাও গুণগান পড়তে পড়তে মনে মনে হাসছিলাম আর ভাবছিলাম, আর তিন/চার বছর অপেক্ষা করলেই লেখকমশাই জাতীয় কংগ্রেসের আসল খেল দেখতে পেতেন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার লাইন মনে পড়ে যাচ্ছিলো বারবার।
আমি কি চেয়েছি এতো রক্তের দামে
এতো কষ্টের, এত মৃত্যুর, এতো জখমের দামে
বিভ্রান্তির অপচয়ে ভরা এই ভাঙা ঘরখানি?
আমি কি চেয়েছি কুমির তাড়ায়ে বাঘের কবলে যেতে?