Ratings39
Average rating4
The Power of Myth বইটি বস্তুত বিল ময়ার্স নামক একজন জনপ্রিয় সাংবাদিকের কাছে জোসেফ ক্যাম্পবেলেরসাক্ষাৎকারের লিখিত রূপ বলা চলে। বিল ময়ার্স আমাদের দেশের সমকালীন সাংবাদিকদের মত নন তা আমি বইটি পড়ে বুঝতে পেরেছি। যথেষ্ট জ্ঞানী একজন মানুষ। অপরপক্ষে জোসেফ ক্যাম্পবেল অ্যাকাডেমিশিয়ান। জুটিটা ভালো ছিল।
ক্যাম্পবেল কাহন
বইটা পড়তে শুরুতে কিছু খটকা লাগছিল আমার। ব্যক্তিগত জীবনে ঈশ্বর আমার কাছে অস্তিত্বহীন, ধর্ম অবান্তর। বইটা পড়ে ক্যাম্পবেলকে আমার কেমন মনে হয়েছে সেটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। কেন করি তা ক্রমশ প্রকাশ্য।
ক্যাম্পবেল যুক্তিবাদী। তবে ঈশ্বরে তাঁর বিশ্বাস আছে। তিনি বড় হয়েছেন ক্যাথলিক হিসেবে। তার পড়াশোনার বিষয়বস্তু তুলনামূলক পুরাণতত্ব (Comparative Mythology)। যেসব পুরাণ আজ পর্যন্ত টিকে আছে তার সামান্যই মৌলিক। তাই বিভিন্ন পুরাণের তুলনামূলক বিচারের সাথে সাথে পুরাণকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়ার বদলে প্রতিকী অর্থে নেওয়া ক্যাম্পবেলের একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। ফলত, তাঁর ঈশ্বর ঠিক ধর্মগ্রন্থের ঈশ্বর নয় এবং বিজ্ঞানের সাথেও সাংঘর্ষিক নয়। একথা মনে রাখা প্রয়োজন, বিজ্ঞানের জগতটা অনেকটা এগিয়েছে, তাঁর সময়ে তিনি অনেককিছু জানতেন না বা অন্যভাবে জানতেন। বস্তুত, তিনি অবিশ্বাস ও বিশ্বাসের সীমানায় বিশ্বাসের পাশে দাঁড়ানো খানিকটা বিশ্বাসী, খানিকটা প্রকৃতিবাদী একজন মানুষ।
বই প্রসঙ্গে
প্রথমত, এই বইটি থেকে বৈজ্ঞানিক সত্যতা আশা করা ঠিক হবে না। এটি ভাববাদ ঘেঁষা অনেকভাবেই। তাছাড়া, আমাদের কাছে ধর্ম আর পুরাণ পরিপূরক। ধর্ম বস্তুত একটি কাঠামো, জীবনাচরণ। কিছু ব্রত, কিছু পালনীয় মিলে তৈরী হয়। মিথ বা পুরাণে আমরা পাই সেই ব্রত বা নিয়মের পিছনের গল্প। ধর্মে প্রায়শই পৌরাণিক গল্পের কারণের চেয়ে কাজটা প্রাধান্য পায়। ওইখানেই অন্ধতা ও কূপমণ্ডুকতার শুরু। এই বইতে ধর্মকে বিশেষ পাত্তা দেওয়া হয়নি। বইটিতে পুরাণের তাৎপর্য, এর চিরায়ত গুণাবলি, দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে কথা বলা হয়েছে। আছে প্রচুর পৌরাণিক গল্প। ক্যাম্পবেলের ভাষা চমৎকার, আগ্রহ ধরে রাখে অবলীলায়। ইউরোপীয়, আফ্রিকান ও এশীয়, একেশ্বরবাদী, বহুত্ববাদী ও প্রকৃতিবাদী, হরেকরকম পুরাণের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য, অন্তর্নিহিত দর্শন উঠে এসেছে বইটিতে।
তার দীর্ঘজীবনের পুরাণ সম্পর্কিত পড়াশোনা তার নিজস্ব জীবনদর্শনে বড়সড় প্রভাব ফেলেছে। সেই দর্শনকে তিনি নিজের ভাষায় বলেন, “Follow your bliss.” ধর্মীয় সংস্কারের বিশ্বাসের তুলনায় তার দর্শন মৌলিকভাবে আলাদা। তার বিশ্বাস সহনশীল কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নে অনমনীয়। প্রকৃতির সাথে একাত্মতা এবং পৃথিবীর দুঃখ-বেদনা মেনে নিয়ে বেঁচে থাকা, ভালোবাসা তার দর্শনের অংশ। ক্যাম্পবেলের চরিত্রের বয়ানের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। বস্তুত তার দর্শন ও তার জীবনাচরণের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। ধর্ম এবং এর হাজারো নিয়ম থেকে মুক্ত হয়ে তিনি পুরাণকে প্রতিকী অর্থে নিয়ে তা থেকে জীবনদর্শন ও নৈতিকতার কাঠামো তৈরী করেছেন। এজন্যই বৈজ্ঞানিক সত্যগুলোকে মেনে নিতেও তার দ্বিধা হয়নি।
শেষ কথা
সব মিলিয়ে, অন্তত আমার ক্ষেত্রে বইটি চিন্তার খোরাক ছিল। ছিল দীর্ঘজীবন কাটিয়ে আসা একজন মানুষের অভিজ্ঞ চোখে অন্য মানুষের ভেতরটা দেখার একটা সুযোগ। মানুষের জীবন ও সভ্যতার চিরায়ত কিছু প্রশ্নের উত্তরে আমি ক্যাম্পবেলের সাথে একমত। পার্থক্য এই যে আমাদের পথ আলাদা।