Autobiographical reminiscences of a Bengali author.
Reviews with the most likes.
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ব্যাপারে অনেক শুনেছি, তাই তাঁকে জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম। আহমদ ছফার বিখ্যাত বইটি পড়ে তাঁকে কতটুকু জানতে পেরেছি জানিনা, কিন্তু বেশ আশাহত হয়েছি। বইয়ের শুরু হয়েছে একটি প্রবচনকে (যেটি থেকে বইয়ের শিরোনামটি গ্রহণ করা হয়েছে) ভুল ভাবে উদ্ধৃত করে। সূচনাতেই সেই যে আমার ভ্রু কুঁচকে গেছিল, গোটা বইটি পাঠের সময় সেই ভ্রু স্বাভাবিক হয়নি। ভূমিকাতে লেখক অনুযোগ করেছেন যে, অনেকেই সন্দেহ করেছেন তিনি নিজের বক্তব্য অধ্যাপক রাজ্জাকের জবানিতে প্রকাশ করেছেন। সত্যি কথা বলতে, বইটি পড়ার পরে আমিও এই সন্দেহে ভুগছি।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে চেনার উদ্দেশ্যে এই বইটি হাতে তুলে নিয়েছিলাম। তিনি যেহেতু জ্ঞানচর্চা জগতের মানুষ, তাই তাঁর চিন্তাধারা, কাজের প্রেরণা, কাজ করার পদ্ধতি, মূলত এইসব বিষয় নিয়ে আগ্রহী ছিলাম। তিনি নিজে বিশেষ কিছু লেখেননি, কিন্তু তবু তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। এই বই থেকে তাঁর সেই কিংবদন্তিসম পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়েছি? নাহ, প্রায় গোটা বই জুড়ে তিনি বিদ্যাচর্চা এবং রাজনীতিজগতের বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে গসিপ করে গেছেন। নজরুল ইসলামের সঙ্গে দিলীপ রায়ের রেষারেষি ছিল। ফজলুল হক মিথ্যে অভিনয় করতে পারদর্শী ছিলেন। সোহরাওয়ার্দির নামের টাইটেলটা নকল, জীবনধারণের জন্যে তাঁকে “চাঁদার টাকার উপর ডিপেন্ড করতে অইত”। “রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা আছিল ঠিকই” কিন্তু তাঁর মধ্যে বড় মানুষের ছায়া নাই। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী নাকি তাঁর বইতে “এক্কেরে মনগড়া সব কথা লেইখ্যা থুইছে”। দীনেশচন্দ্র সেন “ওয়াজ রিয়্যালি এ গ্রেট ম্যান, এদিক সেদিক কিছু ব্যাপার আছে, তার পরেও”। কিন্তু ডাক্তার বিধান রায় খারাপ, কারণ দীনেশ সেন যখন অসুস্থ হয়েছিলেন, বিধান রায় দুই হাজার টাকা ফিস দাবি করেছিলেন। নীলরতন সরকার ভালো, কারণ তিনি ফিস মকুব করে দিয়েছিলেন। একই কারণে চিত্তরঞ্জন দাশ খারাপ, কারণ তিনি আলিপুর বোমা মামলায় ফিস নিয়েছিলেন। কিন্তু ভালো কে? ভালো হলেন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ, কারণ তিনি “একমাস ধরে তিলকের একটা মামলা করছেন, কিন্তু ফিস নেন নাই”। বঙ্কিমচন্দ্র মুহসিন স্কলারশিপের টাকায় পড়াশোনা করেছিলেন, তারপর “মুসলমানের বিরুদ্ধে কলম ধইর্যা সেই ঋণ শোধ করছিলেন”। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় বিদ্যাসাগর কঠিন প্রশ্ন করেছিলেন, বঙ্কিমকে গ্রেস মার্কস দিয়ে বিএ পাশ করতে হয়েছিল, তাই তিনি বিদ্যাসাগরের উপর খাপ্পা ছিলেন। অধ্যাপক রাজ্জাকের পিএইচডি গাইড হ্যারল্ড ল্যাস্কিও নাকি স্কলার হিসেবে অত উচ্চশ্রেণীর ছিলেন না। ক্ষীতিমোহন সেন (গোটা বইতে ক্ষিতিমোহন সেনের নামের বানান এটাই লেখা হয়েছে) নাকি “রাইগ্যা গেলে প্রচণ্ড অইয়া উঠতেন। আশু সেন (অমর্ত্য সেনের বাবা) আছিলেন ক্ষীতিমোহনবাবুর জামাই। যখন জানতে পারলেন, আগে আশুবাবু আরেকটা মেমসাহেব বিয়া করছিলেন, ক্ষীতিমোহনবাবু জামাইরে খুন করবার লইছিল”। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে-বিষয়ে পিএইচডি করেছিলেন, “সে বিষয়ে কাজ করার যোগ্যতা আছিল না”। মাওলানা আবুল কালাম আজাদের “সত্য কথা বলার অভ্যাস আছিল খুব কম, অ্যান্ড হি ওয়াজ এ কনজেনিটাল লায়ার”।
এইরকম ভিত্তিহীন, মনগড়া এবং কিছু কিছু রীতিমত আপত্তিজনক গসিপকে আমি “পাণ্ডিত্য” মানতে রাজি নই। এইসব হাবিজাবি মন্তব্য পড়ার জন্যে আমি এই বইটা হাতে নিইনি।
শুধু ভিত্তিহীন নয়, কিছু মন্তব্য পুরোপুরি অসত্যও বটে। দুটো উদাহরণ দিই।
(এক) বইতে আছে “রামমোহনরে বিলাত পাঠানোর সময় রাজা টাইটেল দিলেন বাহাদুর শাহ”। ভুল তথ্য। রামমোহনকে রাজা টাইটেল দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর। এই ফাঁকে অবশ্য রামমোহনের ব্যাপারেও গসিপ করে নিয়েছেন : “ঘুষ খাওন থেইক্যা শুরু কইর্যা তার গুণের অন্ত আছিল না”। রামমোহন রায় তাঁর প্রথম বইটি লিখেছিলেন ফারসি ভাষায় : “তুহফাত-উল-মুহাহহিদিন”, কিন্তু অধ্যাপক রাজ্জাকের মন্তব্য : “ইচ্ছা করলেই আরবি উর্দু ফারসি সংস্কৃত ইংরিজি সব ভাষাতেই লিখতে পারতেন। এক্কেরে ডাইনে বামে না তাকাইয়া হি চুজ টু রাইট ইন বেঙ্গলি, এইডাই তার বড় কাজ”।
(দুই) “লাইফ ম্যাগাজিন ইন্ডিয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্সের ওপর একটা কভার স্টোরি করছিলো। অগ্নিহোত্র অনুষ্ঠানে নেহরু খালি গায়ে বইস্যা মন্ত্র পড়ছেন”। স্বঘোষিত নাস্তিক জওহরলাল নেহরুর ব্যাপারে এই বর্ণনা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছি! কোথা থেকে পেলেন এইসব জিনিস? স্বপ্নে?
তারপর আছে অধ্যাপক রাজ্জাকের “নিজস্ব মতামত”। এই মতামতগুলো দেখে আজকালকার সবজান্তা ফেসবুক পণ্ডিতদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার। যেসব মতামতের পিছনে কোনো লজিক নেই, আছে কেবল গায়ের জোর। তিনটে উদাহরণ :
১) “গান্ধি ছাড়া ইংরেজ আমলের আর কারো ইংরিজি লেখাই টিকব না”। জওহরলাল নেহরুর লেখা? “উঁহু টিকব না”।
২) কবি সমর সেন যদি বাংলায় লিখতেন তাহলে তিনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে যেতেন।
৩) ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পঞ্চাশ বছর পরেও ভারতীয়রা একটা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা তৈরি করতে পারেনি, তাই “তারা একলগে থাকব কী কইর্যা আমি ত চিন্তা করবার পারি না”। [ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্যময় এবং বহুধাবিস্তৃত জাতীয় চরিত্রটির ব্যাপারে সামান্যতম ধারণা যদি কারো থাকে, তাহলে তিনি এই মন্তব্য করতে পারেন না!]
এরকম আরো বিবিধ অদ্ভুত মন্তব্য, মতামত এবং “বিশ্লেষণে” ভর্তি হয়ে আছে এই বইটির পৃষ্ঠা। কিছু কিছু কথাবার্তাকে তো সোজাসুজি মনগড়া ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নাকি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যাপারে বলেছিলেন, “যে মানুষ চৌদ্দটা পোলা মাইয়ার জন্ম দিছেন, হে সাধনা করবার সময় পাইল কখন!” কোথায় পেলেন তিনি এইসব গাঁজাখুরি কথা?! সমগ্র বই জুড়ে আছে অধ্যাপক রাজ্জাকের সরল জীবনযাপন এবং ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলার জন্যে গুণগান। পাণ্ডিত্যের সঙ্গে এই দুটোর সম্পর্ক কোথায়? তাঁর সরল জীবন এবং ঢাকাইয়া জবানের পরিচয় দিতে গিয়ে পাণ্ডিত্যের বিষয়টাই অগ্রাহ্য করা হয়েছে অত্যন্ত খাপছাড়া এবং অপরিকল্পিতভাবে রচিত এই বইতে। খুব খুব অবাক হয়েছি এইসব পড়ে। মাঝে মাঝে শুধু অবাক নয়, হতবাক হয়েছি। হতবাক হওয়া একটি অংশের উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করবো এই রিভিউ।
আমি বললাম, বাংলার ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু বলেন।স্যার বললেন, বাংলার ভবিষ্যত সম্পর্কে আমি আর কী কমু। সে ত আপনেগো উপর। মিঃ জিন্নাহ ত বেঙ্গল আপনেদেরে দিয়া দিছিলেন, আপনেগো চিত্তে সুখ অইল না, বেঙ্গল পার্টিশন করলেন।
এইসব পড়ার পরে, সত্যিই আমার মনে সন্দেহ জেগেছে, সত্যিই কি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতো একজন বিদগ্ধ মানুষ এইসব কথা বলতে পারেন? নাকি অন্য কোনো রহস্য আছে যা আমি ধরতে পারিনি?