Ratings4
Average rating3.5
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
“জাতীয়তাবাদ হলো হামের মতো চরম ছোঁয়াচে একটি রোগ, যাতে মানবজাতি শিশুকাল থেকেই আক্রান্ত হতে শুরু করে।”
-আলবার্ট আইনষ্টাইন
“নিজের সাথে নিজেই যখন ক্রমাগত মিথ্যা কথা বলে আর অভিনয় করে করে ক্ষমতার প্রতি নিজের লোভটিকে জায়েজ করে নিতে হয়, সেটিই তখন জাতীয়তাবাদ হয়ে দাঁড়ায়।”
-জর্জ অরওয়েল
“যে সকল জাতির জাতীয়তাবাদের অনুভূতিটি ভোঁতা হয়ে গেছে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য।”
-মুয়াম্মার গাদ্দাফি
জাতীয়তাবাদ কি ভালো? নাকি খারাপ? এক কথায় এর উত্তর কি দেয়া যায়? না বোধহয়। ২০২২ সালে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভূগোলকের দিকে তাকালে শ'দুয়েকের ওপর দেশের নাম দেখতে পাই; এই দেশগুলোর অধিবাসীরা নিজের নিজের চাহিদা আর রুচি মোতাবেক ভূপৃষ্ঠের ওপর কাটাকুটি করে নিজের নিজের এলাকা ভাগ করে নিয়েছেন। এই ভাগাভাগি করার কাজটা এঁরা করেছেন মূলত ধর্ম নইলে ভাষার ভিত্তিতে। ব্রিটিশরা ধর্মের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো, সেখান থেকে ভাষার ভিত্তিতে পরবর্তীতে বাঙলাদেশ হলো। ভাষার ভিত্তিতে নিজেদের স্বতন্ত্র দেশ গড়ার এমন নজির পৃথিবীতে খুব বেশী একটা নেই। বাঙলাদেশ তো পৃথিবীর নবীনতম দেশগুলোর একটি; যে দেশগুলো শত শত বছর ধরে পৃথিবীর মানচিত্রের শোভাবৃদ্ধি করে চলেছে, সেগুলোর প্রায় সবক'টিরই সৃষ্টি হয়েছে ধর্মকে কেন্দ্রে রেখে। প্রথমে ধর্ম, এরপর জাতীয়তাবাদের চেতনা প্রাচীন এই দেশগুলোর ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের সাথে ধর্মবিশ্বাস সবসময়ই দারুণভাবে মিশে যায় কারণ, দুটি মতবাদই নিজেকে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শেখায়।
ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারটিকে আজকের এই দিনে খুব খেলো ঠেকতে পারে অনেকের কাছেই। মনে হতে পারে, এ শুধুই দুর্বল ও বুনো অসভ্য মনের শিশুতোষ কল্পনা। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে পৃথিবীর বড় বড় পরিবর্তনগুলো ধর্মের হাত দিয়েই এসেছে। মিশর, গ্রীস কিংবা ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাঁদের নিজ নিজ ঈশ্বরের পূজার সময় নির্ধারণ করবার জন্য সেই কত হাজার হাজার বছর আগেই মহাকাশের মানচিত্র ছকে গেছেন, যার হাত ধরেই আজ জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এলো। ওদিকে বাখ, মাইকেল এঞ্জেলোরা তাঁদের ঈশ্বর-পুত্রের বন্দনায় সুর ভেঁজেছেন, দেয়ালজুড়ে বিস্ময়কর ছবি এঁকেছেন। মাইকেল এঞ্জেলো থেকে বাখ, জোয়ান অফ আর্ক থেকে ইয়াহিয়া খান-রাজনীতি, ভাষাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, শিল্প, মানচিত্রবিদ্যা...প্রদায়ক হিসেবে ধর্ম কোথায় কাজ করেনি? এঁদের প্রত্যেকের ঈশ্বর হয়তো একে অপরের চেয়ে ভিন্ন, কিন্তু বিজ্ঞান বা শিল্পের অগ্রযাত্রায় ধর্মবিশ্বাসটাই কোন না কোনভাবে জ্বালানী হিসেবে কাজ করেছে সবার বেলায়ই।
জোয়ান অফ আর্ক ফ্রান্সের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কেউ যদি বলে বসেন আধুনিক ফ্রান্সের পথ চলা শুরুই হয়েছে জোয়ানের হাত ধরে, খুব একটা অত্যুক্তি বোধহয় হয় না তাতে। খুবই অস্থির এক সময়ে জন্ম জোয়ানের, যে সময়ে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড একে অপরের সাথে জমির দখল নিয়ে ১১৬ বছর ধরে কামড়াকামড়ি করে চলেছে; ইতিহাসবিদেরা একে হান্ড্রেড ইয়ারস' ওয়ার বলে থাকেন (১৩৩৭-১৪৫৩)। ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ড-উভয় দেশকেই আমরা আজ সভ্যতার অন্যতম ধারক ও বাহক বলেই জানি, তবে এই সভ্যতার হুঁশ তাদের একদিনে আসেনি। কতটা অসভ্য হলে ১১৬ বছর ধরে মারামারি করে যাওয়া যায় তার আন্দাজ পেতে হলে আমাদের এই মারামারির ইতিহাসের দিকেও একটু চোখ ফেরাতে হবে। ইতিহাসের এই কচকচানি বাদ দিলে জোয়ানের ভূমিকা আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে না, হবে না জোয়ানকে নিয়ে লেখা বার্নার্ড শ-এর এ নাটকের এজেন্ডাটিও।
ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের শতবর্ষীয় এ যুদ্ধ শুরু হয় মুলত যখন ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড ফ্রান্সের সিংহাসন দাবী করে বসেন। ১৩২৮ সনে ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ চার্লস মারা যাবার পর ফ্রান্সের সিংহাসনের গদি গরম করবার জন্য উপযুক্ত কোন পুরুষ উত্তরাধিকার পাওয়া যাচ্ছিলো না। ৭ ছেলেমেয়ের বাবা চার্লসের একটি কন্যাসন্তান বাদে আর কেউই বেশীদিন বাঁচেনি। সেই ৯৮৭ সাল থেকেই ফ্রান্সে নিয়ম চলে আসছিলো, রাজার ছেলে রাজা হবে; রাজার পুত্রসন্তান না থাকলে নিকটতম পুরুষ আত্নীয়ের ওপর গদির ভার ন্যাস্ত হবে। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড ছিলেন এই চার্লসের বোন ইসাবেল অফ ফ্রান্স-এর ছেলে। তিনি দাবী করে বসলেন পুত্রহীন চার্লসের নিকটতম পুরুষ আত্নীয় যেহেতু তিনিই, ফ্রান্সের সিংহাসনটি এখন তাঁরই প্রাপ্য। মায়ের দিক থেকে আত্নীয়তার সূত্রে সিংহাসনের দাবীর কথা এর আগে ফ্রান্সে কেউ কোনদিন শোনেনি, শোনার প্রয়োজনও ছিলো না, কারণ আগের সব রাজারই গণ্ডায় গণ্ডায় পুত্রসন্তান ছিলো।
ফরাসী যে সংস্কৃতি, তার সাথে আরবীয় ধর্ম ইসলামের কোনই মিল নেই, বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রেই এ দুটির অবস্থান একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীতে, তবুও মধ্যযুগের ফ্রান্সের একটি নিয়মের সাথে ইসলামের একটি বিধানের আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়ঃ নারী নেতৃত্বের অস্বীকৃতি। ইসলামী বিধানে যেমন নারীর প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি এসবের কিছুই হওয়া চলে না, মধ্যযুগের ফ্রান্সও ঠিক তেমনিভাবে নারীদের এসকল রাজকার্য থেকে বঞ্চিত রাখতো; নারী নেতৃত্ব'র ব্যাপারটি মধ্যযুগের ফরাসীদের কাছে কার্যত কল্পনার অতীত ছিলো। এডওয়ার্ড যখন তাঁর মায়ের সূত্রে ফ্রান্সের শাসনভার দাবী করেন, ফ্রান্স তা প্রত্যাখ্যান করে নারী নেতৃত্বের প্রতি তাদের ঐতিহাসিক অস্বীকৃতি থেকেই। যে আইনি বিধানটি ফরাসী আইন প্রণেতারা দেখান সেটির গালভরা ল্যাটিন নাম “Nemo plus juris ad alium transfere potest quam ipse habet”-সোজা বাঙলায় এর অর্থ দাঁড়ায়, “আপনার নিজের যে সামাজিক অবস্থান, তার চেয়ে উঁচু পদের কোন অবস্থানের দায়িত্ব আপনি কাউকে দিতে পারেন না” (এ নিয়মটি কি আমাদের দেশে এখনো বলবৎ আছে? এ নিয়মটির কারণেই কি সাধারণ জনগণ, ছাত্র, শিক্ষক, মজুর, রিকশাওয়ালারা ভোট দিয়ে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করতে পারে না? প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে পদে বড় যেহেতু আর কেউই দেশে নেই, তাই তাঁর নিজেকেই নিজে নির্বাচিত করে নিতে হয়?)। ফ্রান্সের গদি না পেয়ে এডওয়ার্ড গোস্বা হয়ে ফ্রান্সকে ট্যাকশো দেয়া বন্ধ করে দেন, এতে ফ্রান্সের রাজা পাল্টা ক্ষিপ্ত হয়ে ইংল্যান্ডের কিছু জমিজমা দখল করে নেন। শুরু হয়ে যায় একশো বছরের কাজিয়া।
এডওয়ার্ডের দেখানো পথে তাঁর বংশধরেরা এই কাজিয়া চালিয়ে যায়। অবশেষে মারামারি শুরু হবার ৮৩ বছর পর ১৪২০ সালে ইংরেজরা ফরাসীদের একটি চুক্তির প্রস্তাব দেয়। চুক্তিমতে ইংরেজরা (ফরাসী) ষষ্ঠ চার্লসকে ফ্রান্সের রাজা হিসেবে মেনে নেয়, কিন্তু শর্ত জুড়ে দেয় চার্লসের মেয়ে-জামাই ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম হেনরি হবে চার্লসের উত্তরাধিকারী। এই চুক্তির মাধ্যমে মূলতঃ চার্লসের পুত্র চার্লস জুনিয়রকে (যিনি পরবর্তীতে সপ্তম চার্লস হবেন) বঞ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়, এবং ফরাসী সিংহাসনটি যেন ইংরেজদের দখলেই যায় তা নিশ্চিত করা হয়। চুক্তিটি করবার অল্প কিছু পরেই চুক্তির কেন্দ্রে থাকা দুই চরিত্র ষষ্ঠ চার্লস এবং পঞ্চম হেনরি দুজনই ধরাধাম ত্যাগ করেন। ফ্রান্সের তখতে এবার এসে বসেন পঞ্চম হেনরির ৯ মাস বয়েসী পুত্র ষষ্ঠ হেনরি। এখানে বলে রাখা ভালো, এই ষষ্ঠ হেনরিই একমাত্র ইংরেজ রাজা যিনি দস্তুর মেনে ফ্রান্সেরও রাজা হন। এর আগে এবং পরে অনেক ইংরেজ রাজাই নিজেকে ফ্রান্সের রাজা ঘোষণা করেছেন, কিন্তু সেটা নিতান্তই গায়ের জোরে। ষষ্ঠ হেনরি একমাত্র ‘ডি ফ্যাক্টো' ইংরেজ রাজা যিনি যুগপৎভাবে ফ্রান্সেরও রাজা হয়েছেন।
জোয়ান অফ আর্কের যখন জন্ম হয়, সেই ১৪১২ সালে ফ্রান্সের রাজা ছিলেন ষষ্ঠ চার্লস, যার সাথে ইংরেজরা ঐ হঠকারী চুক্তিটি করে। ষষ্ঠ চার্লস মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ ছিলেন, রাজকার্য চালানো প্রায়ই তাঁর জন্য অসম্ভব হয়ে পড়তো। তাঁর দুর্বল শাসনের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার দখল নিয়ে লড়াইয়ে নামে তাঁর ভাই লুইস (ডিউক অফ অরল্যান্ডো), এবং তাঁদের নিকট আত্নীয় জন দ্যা ফিয়ারলেস (ডিউক অফ বার্গার্ন্ডি)। জন আততায়ী লাগিয়ে লুইসকে খুন করান, যার ফলে ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ্বের এক আবহাওয়া তৈরী হয়। ফ্রান্সে দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক মত গড়ে ওঠে, যার একপাশে থাকে ডিউক অফ বার্গান্ডি জন দ্যা ফিয়ারলেস, এবং অপরপাশে খুন হওয়া লুইসের দল, যাঁরা নিজেদের আরম্যানিয়াক (Armagnacs) বলে পরিচয় দেয়া শুরু করে।
এতদিন পর্দার আড়ালে থাকা চার্লস জুনিয়র (যাঁকে সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করে ইংরেজরা তাঁর পিতা ষষ্ঠ চার্লসের সাথে চুক্তি করে) এবার আরম্যানিয়াকদের সাথে হাত মেলান এবং রাজনীতিতে জোরেসোরে পা ফেলেন। এর মাঝে অতি-উৎসুক আরম্যানিয়াকদের একটি দল জন দ্যা ফিয়ারলেসকে খুন করে বসে, যার দায় ষষ্ঠ চার্লস আপন-পুত্র চার্লস জুনিয়রের ওপর চাপান। আগেই ইংরেজদের সাথে চুক্তি করে ষষ্ঠ চার্লস তাঁর পুত্রকে বঞ্চিত করেছিলেন, এবার খুনের দায়ও তাঁর ওপর চাপানোর ফলে দেশে গুজব রটে গেলো চার্লস জুনিয়র আদৌ ষষ্ঠ চার্লসের পুত্র নয়, বরং ষষ্ঠ চার্লসের স্ত্রী ইসাবিউ এবং খুন হওয়া অরল্যান্ডোর ডিউক লুইসের অবৈধ সন্তান। ষষ্ঠ চার্লস ও পঞ্চম হেনরি যখন ২ মাসের ব্যবধানে পটল তোলেন, ৯ মাস বয়েসী ষষ্ঠ হেনরির বিরুদ্ধে সিংহাসনের দাবী নিয়ে এবার সরাসরি সামনে আসেন চার্লস জুনিয়র। তিনি নিজেকে দ্যোফাঁ (Dauphin) বা সিংহাসনের যোগ্য ও প্রকৃত উত্তরসূরী হিসেবে ঘোষণা করেন। এতদিকের নানা অভ্যন্তরীণ সংঘাত, ও কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধে চরম দুর্দশাগ্রস্ত ফ্রান্স তখন ধুঁকছে। ইংরেজদের করাল থাবায় ফ্রান্স প্রতিদিন একটু একটু করে নিজেদের হারাচ্ছে। ঠিক এই সময়েই ফ্রান্সের রক্ষাদূত হয়ে পটে হাজির হন ১৭ বছরের কিশোরী জোয়ান অফ আর্ক।
খুব সাধারণ এক কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা জোয়ান তাঁর গ্রামে প্রচার করা শুরু করেন তিনি স্বপ্নে আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন, “দ্যোফাঁ” চার্লস জুনিয়রকে রেইমস ক্যাথিড্রালে মুকুট পরিয়ে তাঁকে রাজা সপ্তম চার্লস হিসেবে অভিষিক্ত করাতে হবে; স্বপ্নাদেশের মাধ্যমে জোয়ানকে এ গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন ফেরেশতা মাইকেল (মুসলমানেরা যাঁকে মিখাইল নামে জানেন), সেইন্ট মার্গারেট এবং সেইন্ট ক্যাথেরিন। সেইন্ট মার্গারেট এবং সেইন্ট ক্যাথেরিন উভয়ই ১৫-১৬ বছর বয়েসে রোমানদের হাতে খুন হন, তাঁদের খ্রীষ্টীয় বিশ্বাসে অনড় থাকবার জন্য। জোয়ান রেইমস ক্যাথিড্রালে চার্লসকে অভিষিক্ত করার ব্যাপারে জোরেসোরে জনমত তৈরী করতে শুরু করেন; সুদূর অতীত থেকেই রেইমস ক্যাথিড্রাল ফরাসী রাজাদের অভিষেকস্থল হিসেবে পালিত হয়ে আসছিলো। জোয়ানের এই স্বপ্নে সওয়ার হয়ে ফরাসী বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরুতে বেশ কিছু সাফল্য পায়, জোয়ান যে সত্যিই ঈশ্বরের আদেশপ্রাপ্ত হয়ে ফরাসীদের মুক্তির জন্য সংগ্রামে নেমেছেন-এ ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত হয়ে পড়ে। জোয়ান রেইমসের ক্যাথিড্রালে চার্লসের অভিষেক ঘটান, দীর্ঘ অন্ধকার এক সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় ফ্রান্সের স্বাধীনতার একটু ছটা যেন দেখতে পাওয়া যায়...জোয়ানের জয়রথ থামাবার জন্য ইংরেজ এবং ইংরেজ-মিত্র বার্গান্ডিদের (যারা মূলত ফরাসী) শিবিরে শুরু হয়ে যায় ষড়যন্ত্রের এক নীল নকশা।
জোয়ানের ভাগ্য বেশীদিন সুপ্রসন্ন থাকে না। কিছুদিন পরেই তিনি বার্গান্ডিদের হাতে ধরা পড়েন। ইংরেজ চার্চ-এর অধীনে জোয়ানের বিচার শুরু হয়। জোয়ানের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগটি গুরুতরঃ ধর্ম অবমাননা! জোয়ান পুরুষের মতোন কাপড় চোপড় পরে ঈশ্বরের বিধানকে অস্বীকার করেছে, জোয়ান নিজেকে চার্চের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, জোয়ানের স্বপ্নে অলৌকিক দর্শন থাকে-শয়তানের উপাসনা ছাড়া এ কি করে সম্ভব? জোয়ানের এ বিচারকার্যের পুরো খরচ বহন করে ইংরেজরা; যে ১৩১ জন ধর্মীয় পুরোহিতকে জোয়ানের ধর্ম অবমাননার এ অভিযোগটি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেয়া হয়, তাদের ৮ জন বাদে বাকী সবাই ফরাসী ছিলো বটে, কিন্তু এরা সবাই-ই ছিলো ইংরেজ কিংবা বার্গান্ডিদের অনুগত। সাজানো বিচারের দেশের আমাদের বুঝে নিতে মোটেই বেগ পেতে হয় না এ বিচারের ফলাফল কী হয়েছিলো। জোয়ানকে জ্ব্যান্ত পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত এ বিচারকাজ শুরুর বহু আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো।
বার্নার্ড শ দাবী করেছেন তাঁর সেইন্ট জোয়ান নাটকে তিনি কোন ভিলেন রাখেননি; জোয়ানের বিচার যাঁরা করেছেন, বা শাস্তির সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাঁরা কেউই খারাপ ঠিক নন। ইংরেজরা তাদের দেশপ্রেম থেকেই ফ্রান্সের স্বাধীনতা আটকে রেখেছিলো, তাদের ফরাসী মিত্র বার্গান্ডিরা-ফরাসীদের চোখে যারা রাজাকার-তারাও ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছে ঐ দেশপ্রেমের জন্যই, এখানে কাউকেই নাকি মোটাদাগে সাদা-কালো ছোপে ছাপানো যায় না। মধ্যযুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপের প্রেক্ষিতে হয়তো অনেকটাই সত্যিও এ দাবীটি। জোয়ানের সময় থেকে ৬-৭০০ বছর পরে দাঁড়িয়ে আমাদের সময়ের ভালো-খারাপের মাপকাঠি দিয়ে হয়তো সে সময়টাকে মাপতে যাওয়া উচিৎ নয়। কিন্তু তবুও শ-এর নাটকে প্রহসনের সে বিচারের দৃশ্যে আমরা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর যাকে যেমন দেখতে চাই, তেমন ভাবেই দেখতে পাই। যে নিরাবেগ স্বরের কথা শ দাবী করেন, সেটির তেমন সন্ধান মেলে না, ‘খারাপ লোকগুলো' তাদের কাজ এবং সংলাপের মাধ্যমে ‘খারাপ' হিসেবেই উঠে আসে।
শ নাটক শেষ করেছেন নাটকীয় একটি দৃশ্য দিয়েই; মৃত্যুলোক থেকে অশরীরী জোয়ান পৃথিবীতে কিছু সময়ের জন্য ফিরে আসেন, তখন তিনি জানতে পান নাটকটি লেখার সময়কালে, ১৯২০ সালে, ক্যাথলিক চার্চ জোয়ানকে সন্ত উপাধিতে ভূষিত করেছে। জোয়ান তখন অনুরোধ জানান, তিনি আবারো মানুষরূপে মর্ত্যে ফিরে যেতে চান; তাঁর এ অনুরোধের জবাব কেউ দেয় না, কারণ মর্ত্যের পৃথিবী তার মহাপুরুষদের (বিশেষত ‘মহানারীদের') বরণ করে নিতে আজও প্রস্তুত নয়। জোয়ানের মৃত্যুর ৭০০ বছর পরে আজও প্রশ্ন উঠবে কেন তার পোষাক নারীসুলভ নয়, কেন সে পুরুষদের মতো যুদ্ধে লড়াই করে, কেন সে ঘরের কোণে মাথায় কাপড় দিয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকে না?
পৃথিবীর বড় বড় চিন্তাবিদেরা প্রায় সবাই-ই জাতীয়তাবাদকে ঘৃণা করেছেন, ঘৃণা করতে শিখিয়েছেন। কিন্তু জোয়ান যে জাতীয়তাবাদের বীজ বুনে দিয়েছিলেন ফরাসী জনগণের মনে, সেটি না করলে হয়তো ফ্রান্স দেশটির ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো, হয়তো এ নামে কোন দেশ থাকতো না। জাতীয়তাবাদের এই দিকটি না থাকলে বাঙলাদেশ নামক দেশটির অস্তিত্বও হয়তো আজ থাকতো না। এ লেখা শুরু করেছিলাম খুব বিখ্যাত তিনজন মানুষের উক্তি দিয়ে, যার একটির বক্তব্য বাকী দুজনের বক্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টোরথী। আলবার্ট আইনস্টাইন কিংবা জর্জ অরওয়েলের মতো মহান চিন্তার মানুষেরা জাতীয়তাবাদকে কষে গালাগাল করেছেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফি জাতীয়তাবাদকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। ভুলটা তাহলে কোথায়? অরওয়েল বা আইনস্টাইনরা কি তাহলে অতোটা মহান আদৌ নন?
পৃথিবীতে আসলে সবাই-ই কমবেশী গাদ্দাফি। অরওয়েল বা আইনস্টাইনরা কোটিতে মাত্র একজন।