The Forgotten Uprising in Islam's Holiest Shrine and the Birth of al-Qaeda
Ratings1
Average rating4
On November 20, 1979, worldwide attention was focused on Tehran, where the Iranian hostage crisis was entering its third week. The same morning--the first of a new Muslim century--hundreds of gunmen stunned the world by seizing Islam's holiest shrine, the Grand Mosque in Mecca. Armed with rifles that they had smuggled inside coffins, these men came from more than a dozen countries, launching the first operation of global jihad in modern times. Led by a Saudi preacher named Juhayman al Uteybi, they believed that the Saudi royal family had become a craven servant of American infidels, and sought a return to the glory of uncompromising Islam. With nearly 100,000 worshippers trapped inside the holy compound, Mecca's bloody siege lasted two weeks, inflaming Muslim rage against the United States and causing hundreds of deaths.Despite U.S. assistance, the Saudi royal family proved haplessly incapable of dislodging the occupier, whose ranks included American converts to Islam. In Iran, Ayatollah Khomeini blamed the Great Satan--the United States --for defiling the shrine, prompting mobs to storm and torch American embassies in Pakistan and Libya. The desperate Saudis finally enlisted the help of French commandos led by tough-as-nails Captain Paul Barril, who prepared the final assault and supplied poison gas that knocked out the insurgents. Though most captured gunmen were quickly beheaded, the Saudi royal family responded to this unprecedented challenge by compromising with the rebels' supporters among the kingdom's most senior clerics, helping them nurture and export Juhayman's violent brand of Islam around the world. This dramatic and immensely consequential story was barely covered in the press in the pre-CNN, pre--Al Jazeera days, as Saudi Arabia imposed an information blackout and kept foreign correspondents away. Yaroslav Trofimov now penetrates this veil of silence, interviewing for the first time scores of direct participants in the siege, including former terrorists, and drawing on hundreds of documents that had been declassified on his request. Written with the pacing, detail, and suspense of a real-life thriller, The Siege of Mecca reveals how Saudi reaction to the uprising in Mecca set free the forces that produced the attacks of 9/11, and the harrowing circumstances that surround us today.
Reviews with the most likes.
কাবাঃ মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র বলে গণ্য মক্কার এ স্থাপনাটি মুসলিম মানসের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। প্রত্যেক মুসলমানই জীবনের কোন এক পর্যায়ে কাবা ঘর দর্শনের ইচ্ছে গভীরভাবে লালন করেন। এই স্থাপনাটিকে ঘিরে সত্যমিথ্যে মিলিয়ে নানানরকম গল্প প্রচলিত রয়েছে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে। মুসলমানদের ভেতর বেশ বড় একটি অংশই বিশ্বাস করেন কাবা ঘরটি পৃথিবীর কেন্দ্রে অবস্থিত (যদিও গোলক আকৃতির কোন বস্তুর পৃষ্ঠতলে ‘কেন্দ্র' বলে কোন কিছু হয় না)। এছাড়াও, ইসলামের প্রতি সম্মানের নিদর্শন হিসেবে কাবাঘরের ওপর দিয়ে কোন পাখি কখনো উড়ে যায় না-এমন একটি অবৈজ্ঞানিক, ভ্রান্ত, এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসও বহু মুসলমান অন্তরে ধারণ করেন। এই কাবা ঘরকে চতুর্পাশ থেকে ঘিরে তৈরী করা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ দ্যা গ্র্যান্ড মস্ক। ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নবী মুহম্মদের জন্মভূমি মক্কায় অবস্থিত এ মসজিদটিকে আরবীতে মসজিদ-আল-হারাম বলা হয়, কারণ পবিত্র এ নগরী এবং মসজিদ প্রাঙ্গণে বেশ কিছু কাজকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, যার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রক্তপাত; “হারাম শরীফ”-এর সীমানায় মারপিট, ঝগড়া বিবাদ, যুদ্ধ—বিগ্রহ, এসবের কিছুই চলবে না। এছাড়াও, মুসলমান নন-এমন মানুষদেরও এ সীমানায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা যেহেতু বিশ্বাস করেন ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু মূলত অমুসলিমরা, তাই তাঁদের প্রবেশ এখানে নিষিদ্ধ করে দিলেই রক্তপাতের ল্যাঠা চুকে যায়। আফটার অল, মুসলমান তো মুসলমানের সাথে ঝগড়া বিবাদ-রক্তপাতে জড়াতে পারেন না!
১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বরঃ ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় এক দিন। ইসলামী নানাবিধ আন্দোলনের সাথে যাঁরা জড়িত, তাঁদের অনেকের কাছেই অমুসলিমীয় কায়দার ইংরেজী সাল মাসের এ তারিখটি হয়তো কোন গুরুত্ব বহন করবে না, কিন্তু আরবী তারিখটি এক নিমিষে আস্ত একটি দরজা খুলে দিতে পারে তাঁদের জন্য। এ দিনটি ছিলো হিজরী ১৪০০ সালের ১ম দিন (মুহাররম মাসের ১ তারিখ)। ইতিহাসের খাতায় এ দিনটি এত গুরুত্বপূর্ণ, এর কারণ এ দিনেই ঘটে যায় অকল্পনীয় এক ঘটনাঃ মুসলমানদের উগ্র একটি দল দখল করে নেয় মসজিদ-আল-হারাম, মসজিদ প্রাঙ্গণে ঘটে বিপুল রক্তপাত। মুসলমানের হাতেই মুসলমান খুন হয় পাইকারী হারে। কারণ? দখলকারী মুসলমানেরা ধারণা করতেন পৃথিবীব্যাপী ইসলামের ভুল একটি সংস্করণ চালু রয়েছে; সঠিক ইসলামের দিশা জানা আছে একমাত্র তাঁদেরই! বিশ্বব্যাপী ভ্রান্ত পথে থাকা কোটি মুসলমানদের সঠিক পথ দেখাবার জন্য, এবং ইসলামের জন্মভূমি সৌদী আরবের শাসকদের শায়েস্তা করবার জন্য এই ভয়ানক কাণ্ডটি ঘটান তারা। অনেকের কাছেই শুনতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রায় ৪৪ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার হাত ধরেই আধুনিক সময়ের আল কায়েদা, ও আইসিস এই দু'টি ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান।
মাত্র পাঁচ দশকেরও কম সময় আগে ইসলাম ধর্মের পবিত্রতম তীর্থভূমির দখল নিয়ে ঘটে যাওয়া এই ভীষণ অপ্রীতিকর ঘটনাটি সম্পর্কে পৃথিবীর বেশীরভাগ মুসলমানই সম্পূর্ণ অজ্ঞ। সৌদী সরকারের বিপুল প্রচেষ্টায় ধামাচাপা পড়ে গেছে ভয়াবহ এই ঘটনাটি। ইউক্রেনিয়ান-ইটালিয়ান সাংবাদিক ইয়ারোস্লাভ ট্রফিমভ তাঁর দ্যা সিজ অফ মেক্কা বইতে তুলে এনেছেন বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া সেই কাহিনী। দারুণ সত্যান্বেষী এই প্রচেষ্টায় তিনি তুলে ধরেছেন মক্কা দখলের খুঁটিনাটি সকল বিবরণী। '৭৯ সালের এ ঘটনায় বাঙলাদেশ সমেত মুসলিম বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশেই অকারণ বিক্ষোভের আয়োজন করেন মুসলমানেরা; হামলা ও ভাঙচুর চালান আমেরিকান দূতাবাসগুলোতে। এই দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তায় কোথায় কোন অফিসার প্রহরায় নিয়োজিত ছিলেন, হামলা চলাকালীন সময়ে কীভাবে তাঁদের সময় কেটেছে ইত্যাদি তথ্য থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে কী চলছিলো তখন-তার পুঙানুপুঙ্খ বয়ান উঠে এসেছে ট্রফিমভের এই বইতে।
শুরুতেই বলে নেয়া ভালো, কাবা দখলের ঘটনা ১৯৭৯ সালেই কিন্তু প্রথম ঘটেনি; বিভিন্ন শতকেই বিভিন্ন মতাদর্শের অনুসারীরা কাবায় হামলা চালিয়েছে, নিজেদের পকেটে পুরতে চেয়েছে স্থাপনাটিকে। ইসলামের ইতিহাসে কাবার ওপর চালানো সবচেয়ে বিখ্যাত হামলাটির কথা সূরা ফিল-এ এসেছে। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইয়েমেনের আবিসিনিয় খ্রিষ্টান শাসক আব্রাহা তাঁর বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে কাবায় আক্রমণ চালান; তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো কাবার স্থলে একটি গীর্জা স্থাপন করা। সূরা ফিল-এর সূত্রানুসারে আমরা জানতে পাই, আল্লাহ'র আদেশে শত শত আবাবিল পাখি মুখে ছোট ছোট নুড়ি পাথর বয়ে এনে আব্রাহার হস্তিবাহিনীর ওপর ছুঁড়ে মেরে তাদের ধ্বংস করে দেয়। আব্রাহা'র প্রায় ৬০০ বছর পর গীর্জা স্থাপনের একই উদ্দেশ্য নিয়ে ১১৮২ সালে ফরাসী ক্রুসেডার রেইনাড দে শাতিলিঁও কাবায় হামলা চালান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো কাবা'র দখল নিয়ে মদিনায় গিয়ে নবী মুহম্মদের কবরটিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে আসা। শাতিলিঁও'র এই উদ্দেশ্যও সফল হয়নি আব্রাহার মতই।
কাবাঘরের সত্যিকার ক্ষতিসাধন প্রকৃতপক্ষে মুসলমানরাই করতে পারেন; ৯২৯ সালে শিয়া মতাবলম্বী কার্মাশিয়ানরা কাবাঘর লুট করে হাজরে আসওয়াদ নামক পাথরটি চুরি করে নিয়ে আসেন। হজ্বযাত্রীদের কাছে এই পাথরটির মূল্য সবিশেষ; হজ্ব পালনের যে শাস্ত্রীয় আচারগুলো রয়েছে তার মাঝে অন্যতম এই হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া। কার্মাশিয়ানদের ধারণা ছিলো নিজেদের এলাকায় (খাতিফ) হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করলে তা দেখতে তীর্থযাত্রীরা ভিড় জমাবেন, পর্যটন শিল্পের বরাতে ফুলে উঠবে তাদের পকেট, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বাধ্য হয়ে ২০ বছর পর কার্মাশিয়ানরা বেশ অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় পাথরটি মক্কায় ফেরত দিয়ে যায়। এরপর গুনে গুনে ১০৫০ বছর পর ১৯৭৯ সালেই মুসলমানেরা দ্বিতীয়বার আক্রমণ করেন কাবা; ২ সপ্তাহ কাবা অবরুদ্ধ রেখে বিপুল পরিমাণ জানমালের ক্ষতিসাধন করেন তাঁরা।
ধর্মবিশ্বাস মাত্রেই বিভাজন সৃষ্টিকারী; পৃথিবীর এমন কোন একটি ধর্ম নেই যেটির মূল বক্তব্য কী তা নিয়ে ধর্মটির অনুসারীদের নিজেদের ভেতর মতবিরোধ নেই। নিজেদের ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ দাবী করে আসা মুসলমানদের ভেতর এই বিভাজন এবং দলাদলিটি আরো প্রকট। তবে, ১৯৭৯ সালের এই মসজিদ-দখল কাণ্ড কারা এবং কেন ঘটিয়েছে তা জানতে হলে আমাদের সৌদী আরবের ইতিহাস কিছুটা জেনে আসতে হবে। সেই সাথে ইসলামের প্রচলিত নানান সংস্করণ সম্পর্কেও আমাদের একটি সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। ১৭৫০-এর দিকে আরবে মোহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নামে একজন ধর্মপ্রচারক তাঁর গোঁড়া মতবাদের জন্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে পড়েন; কট্টর ইসলামপন্থীদের কাছে তিনি আজও বড় একজন নায়ক। তাঁর প্রচারিত ইসলামের সংস্করণটিকে আমরা আজ ওয়াহাবী ইসলাম নামে জানি। এই মতটির অনুসারীরা অবশ্য নিজেদের “ওহায়াবী” বলে পরিচয় দেন না, এবং এই নামটিকে ভীষণ অপছন্দ করেন। কারণ, তাঁরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন নবী মুহম্মদ ১৪০০ বছর আগে যে ইসলাম প্রচার করে গেছেন তাঁরা ঠিক সেটিকেই সঠিকভাবে পালন করে আসছেন, তাই এটিই প্রকৃত ইসলাম (তৌহিদ), একে বর্ণনা করতে “ওয়াহাবী” বা এমন বাড়তি কোন তকমার প্রয়োজন নেই। তাঁদের মতের বাইরে বাকী সব মুসলমানকেই তাঁরা ভ্রান্ত, এবং দুর্বল গণ্য করেন যারা কী না পশ্চিমা আনুকূল্য পেতে ইসলামের সত্যিকার আচারগুলোকে পাল্টে নরম করে নিয়েছে।
আব্দুল ওয়াহাবের একনিষ্ঠ সমর্থকদের একজন ছিলেন মোহাম্মদ আল সাউদ, যিনি মূলত আরবের নেজদ অঞ্চলের একজন শেখ। ওয়াহাবের মতাদর্শে ভীষণ উজ্জিবীত আল সাউদ ১৮০২ সালে গোটা আরব অঞ্চলের তৎকালীন শাসক অটোমানদের হঠাৎ প্রচণ্ড আক্রমণ করে ইরাকের কারবালার দখল নিয়ে নেন। ওয়াহাবী দৃষ্টিতে শিয়া মতবাদটি সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য; কারবালা আক্রমণের পর শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলটির মসজিদ এবং গ্রন্থাগারগুলোকে পুড়িয়ে দেন ওয়াহাবীরা। প্রায় ৪ হাজার মানুষও প্রাণ হারান তাঁদের হাতে। বিধর্মী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওয়াহাবীদের একটি অলিখিত নিয়ম রয়েছেঃ প্রতিপক্ষ শিবিরের গর্ভবতী নারীদের পেট চিরে ভ্রুণটিকে বের করে মায়ের লাশের ওপর ছড়িয়ে রেখে আসা। এই নিয়মটি আজও এঁরা অনেকেই পালন করেন; ২০১৬ সালে ঢাকার হলি আর্টিজানের ঘটনার পর বিধর্মীদের হত্যার পক্ষে বেশ কিছু পুস্তিকার প্রচলন বাড়ে অনলাইন জগতে যেখানে এ আচারটির ওপর বিশেষ জোরারোপ করা হয়।
আল সাউদের একজন বংশধর আব্দুলআজিজ আল সাউদ ১৯০২ সালে জর্দানের হাশেমাইট সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল ছিনিয়ে নেন; একের পর এক বেদুইন গোত্র তাঁর দলে নাম লেখানো শুরু করে, বাড়তে থাকে সাউদ বংশের শাসনাধীন এলাকার সীমানা। এভাবেই ধীরে ধীরে আধুনিক সৌদি আরব গঠিত হয় সাউদদের হাতে। কড়া ওয়াহাবী ধর্মব্যবস্থার নতুন সে রাজ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়, কিন্তু মরুর বুকে বেদুইনরা যে যাযাবর জীবন কাটায়-আজ এখানে তো কাল ওখানে-তাতে দিনে ৫ বার পানি দিয়ে ওযু করা সম্ভব নয় (সৌদী আরব পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীবিহীন দেশ; ৮৩০,০০০ বর্গমাইলের দেশটিতে একটিও নদী নেই)। আল সাউদ এবং ওয়াহাবীরা মিলে তখন একটি ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং' করেন; বেদুইন গোত্রগুলোকে এক জায়গায় বসত-বাড়ী বানিয়ে থিতু হতে বাধ্য করেন তাঁরা। দলের সকলের ভেতর একটি তীব্র ভ্রাতৃত্ববোধও সৃষ্টি করেন তাঁরা যেখানে সবাই সবার ভাই বা “ইখওয়ান”। ইখওয়ানদের ভেতর এমন একটি সামাজিক কাঠামো তৈরী হয় যে তারা নিজেদের দলের বাইরের অন্য মুসলমানদের সালামেরও জবাব দিতো না (কিছুটা আমাদের দেশের ছাত্রলীগ-ছাত্রদল গোছের ব্যাপার আর কী...)
১৯২০ এর শেষের দিক নাগাদ সৌদী আরব নামের দেশটির গোড়াপত্তন হয়ে যায়, যার একচ্ছত্র অধিপতি হন আব্দুলআজিজ আল সাউদ। খনিজ তেল আবিষ্কৃত হবার দরুন বিপুল পরিমাণ পশ্চিমা অর্থও সে সাথে আসা শুরু করে দেশটিতে। রাতারাতি মরুর যাযাবর জীবন থেকে বিলাসী নতুন এক জীবনে পা ফেলেন আল সাউদ এবং তাঁর প্রিয় পাত্রমিত্ররা। যে ইখওয়ানদের কাঁধে ভর করে তিনি সৌদীর বাদশাহ হয়েছেন, তাঁরা অবশ্য অতটা খুশী নন, কারণ তাঁদের লক্ষ্য তাঁদের ওয়াহাবী মতবাদের বাইরে ইসলামের বাকী সব সংস্করণকে (বিশেষত শিয়াদের) পিষে ফেলা। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ইরাক, জর্দান, কুয়েত ইত্যাদি সবই তখন বৃটিশদের মিত্র, ফলে আব্দুলআজিজ চাইলেই ইখওয়ানদের খুশী করবার জন্য এদের সাথে যুদ্ধে জড়াতে পারছেন না (বৃটিশ রাজ্যের সূর্য তখনও অস্তগামী হয়নি)। এছাড়াও, অটোমান সুলতানের হাত হয়ে হজ্ব-বাণিজ্যের ব্যাটনটি এখন আব্দুলআজিজের হাতে, যিনি অটোমান সুলতানদের মতোই নিজেকে মুসলিম বিশ্বের মালিক, এবং মক্কা-মদিনার রক্ষক হিসেবে ঘোষণা করেছেন। হজ্ব পালনের আকাঙ্ক্ষায় আগত অ-ওয়াহাবী মুসলমানদের যদি ইখওয়ানরা অত্যাচার করা শুরু করে, তাহলে মক্কা-মদিনার রক্ষক হিসেবে তাঁর দাবীটি আর টিকবে না মুসলিম বিশ্বের কাছে, হজ্ব সংক্রান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপুল পরিমান অর্থও হাত ফস্কে যাবে। এসব বিবেচনা করে বাদশাহ ইখওয়ানদের ধর্মীয় আবেগকে সংযত করতে বলেন যা তাদের মোটেই পছন্দ হয় না। শুরু হয়ে যায় বাদশাহের সাথে ওয়াহাবী ইখওয়ানদের দ্বন্দ্ব।
ইখওয়ানরা এক পর্যায়ে বাদশাহের হুকুম অমান্য করেই ব্রিটিশ-শাসিত ইরাক এবং কুয়েতে হামলা চালায়। রাজনৈতিক স্বার্থ ধরে রাখার নিমিত্তে বাধ্য হয়ে বাদশাহকে ইখওয়ানদের বিরুদ্ধে এবার যুদ্ধে নামতে হয়। ১৯২৯-এর মার্চের এ যুদ্ধে বাদশাহ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেন। ইখওয়ানরা যুদ্ধে হেরে যায়, কিন্তু খোদ বাদশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার এ সাহসিকতা তাদের মনোভাবকে আরো কঠোর করে তোলে। এ যুদ্ধে ইখওয়ানদের নেতা ছিলেন দুই বিখ্যাত বেদুইন গোত্রপতি ফায়সাল আল দুয়াইশ, এবং সুলতান আল বিজাদ। আল বিজাদের দলে একজন সৈনিক ছিলেন উতায়বি গোত্রের মোহাম্মেদ বিন সাইফ, যিনি আজীবন তাঁর সেনাপতি আল বিজাদকে চূড়ান্ত সম্মানের আসনে বসিয়ে গেছেন। সৌদী বাদশাহের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধের ৭ বছর পর বিন সাইফের একটি পুত্রসন্তান হয়। জন্মের পর থেকেই এই শিশুটির চোখেমুখে ভীষণ ক্রোধের একটি অভিব্যাক্তি দেখা যায়। সন্তানের ভীতিকর নাম রাখবার বেদুইন নিয়ম মেনে বিন সাইফ তাঁর পুত্রের নাম দেন জুহাইমান-“রাগী চেহারা”।
৪৩ বছর পর রাগী চেহারার এই বালকটিই সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে কাবা'র দখল নিয়ে নেবে; গোটা ২ সপ্তাহের জন্য সৌদী বাদশাহ মসজিদ-আল-হারামের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব হারাবেন। সুন্নী মতাবলম্বী সৌদী রাজপরিবারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে বদ্ধপরিকর ইরানী শিয়ারা সৌদী বাদশাহ আব্দুলআজিজকে এমন কোণঠাসা অবস্থায় পেয়ে মরণ কামড় দিতে তোড়জোড় শুরু করে দেবে। শুরু হয়ে যাবে বিশ্বব্যাপী এক নোংরা এবং ভীষণ বিষাক্ত রাজনীতির দাবা খেলা...
ছবিঃ জুহাইমান আল উতায়বি।
১৯৩০-এর দশকে সৌদী আরবে তেল আবিষ্কৃত হবার পর দেশটি আমেরিকার সহায়তায় গঠন করে রাষ্ট্রীয় তেল উত্তোলন প্রতিষ্ঠান “আরব-আমেরিকান অয়েল কম্পানি” (আরামকো) যার বরাতে প্রতি মাসেই বিপুল পরিমাণ পশ্চিমা বিদেশীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বিদেশী এই অতিথিদের আপ্যায়নে সৌদী সরকার চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখে না, ফলে ওয়াহাবী মতের কট্টর ইসলামপন্থী দেশটিতে মদ, নাইটক্লাব ইত্যাদির প্রচলন শুরু হয়ে যায়। ইখওয়ানদের ভাবগুরু আব্দুলআজিজ বিন বাজ পশ্চিমা সংস্কৃতির এই আগ্রাসনকে আক্রমণ করে একের পর এক আগুনে ফতোয়া জারি করতে থাকেনঃ আরামকো'র সকল বিধর্মী এবং নারী কর্মকর্তাদের বহিষ্কার করতে হবে, ইসলাম ধর্মের জন্মস্থানে একজনও বিধর্মী থাকা যাবেনা, নারীদের ঘর থেকে বেরোতে দেয়া যাবেনা...ইত্যাদি। ভীষণ প্রভাবশালী অন্ধ এই ধর্মগুরুকে বাদশাহ আব্দুলআজিজ কারাগারে পাঠান বাধ্য হয়ে। সাউদ বংশের সাথে ধর্মবাদীদের দূরত্ব আরো বেড়ে চলে।
১৯৬০-এর দশকে বাদশাহ আব্দুলআজিজ-এর পুত্র ফায়সাল সিংহাসনে বসেন, এবং বেশ কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন সৌদী সমাজে। তিনি নারীশিক্ষা চালু করেন, দাসপ্রথা উঠিয়ে দেন, এবং সৌদী টেলিভিশন স্থাপন করেন (যা পরবর্তীতে তাঁর মৃত্যু ডেকে আনে)। ফায়সাল পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে তেল বিক্রির নিষেধাজ্ঞা জারী করলে সৌদী আরবের অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে ওঠে, হুহু করে বাড়তে থাকে তেলের দাম। ১৯৭০-এর শুরুর দিকে যেখানে সৌদী আরবের তেল বিক্রয় থেকে আয় ছিলো বছরে ১.২ বিলিয়ন ডলার, নিষেধাজ্ঞার কারণে দশক শেষে এই আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলারে। এই একই সময়টাতে মিশরের শাসক গামাল আব্দেল নাসের একটি ধর্মনিরপেক্ষ সর্ব-আরব জাতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন, যেখানে দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি, ইত্যাদি সবকিছু ছাপিয়ে সবার একটি পরিচয়ই থাকবেঃ আরব। সৌদী বাদশাহ ফায়সাল এই প্যান-অ্যারাবিক ধারণাটির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান; নাসেরের সর্ব-আরব আন্দোলনের বিপক্ষে দাঁড় করান তাঁর প্যান-ইসলামিক বা সর্ব-ইসলামীয় আন্দোলন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সবাই আরবী বললেও সবাই তো আর মুসলমান নয়; সেখানে খ্রিষ্টান, দ্রুজ, ইহুদী এমন বহু ধর্মের লোকই আছে, তাদের সবার সাথে বন্ধুত্ব চলে না। শুধু আরব মুসলমানদের মাঝেই সখ্যতা চলবে-ফায়সাল সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন।
তেল উত্তোলন সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত কাজে যেহেতু দক্ষ, এবং শিক্ষিত সৌদী জনবলের অভাব খুব প্রকট ছিলো, তাই বাধ্য হয়ে ফায়সালকে বিদেশী ইঞ্জিনিয়ার এবং কর্মকর্তাদের ওপরই ভরসা করতে হতো। দেশের অর্থনীতির শক্ত একটি ভিত্তি দাঁড় করালেও বিপুল পরিমাণ বিধর্মী বিদেশীদের সৌদীর পবিত্র ভূমিতে আসতে দেয়ায় কট্টর ধর্মবাদী ইখওয়ানদের চোখে তিনি খলনায়কই থেকে যান; ১৯৭৫-এর মার্চে তাঁরই এক নিকটাত্নীয় মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাঁকে হত্যা করেন। সৌদী রাজাদের নিরাপত্তায় যে বিশেষ প্রহরীরা নিয়োজিত থাকতো ৭০-এর দশকের সে সময়টায়, তাদের কার্যত বিশেষ কোন কাজ ছিলো না। কালেভদ্রে হঠাৎ কুচকাওয়াজ, শরীরচর্চা ইত্যাদির আয়োজন করা হতো, যাতে কারোই তেমন একটা অংশগ্রহণ ছিলো না। একরকম বিনে খাটুনিতেই মাসের পর মাস এই প্রহরীরা বেতনের টাকা পকেটে ভরে যেতো। আমাদের রাগী চেহারার সেই জুহাইমান আল উতাইবি ১৯ বছর বয়েসে এই প্রহরী দলে নাম লেখান।
১৮ বছরের চাকরীজীবনে জুহাইমান সবচেয়ে দায়িত্বশীল যে কাজটি করেছেন সেটি হলো পানিবাহী একটি ট্রাক চালানো; সেনাবাহিনীর সবচেয়ে নিচের দিকের কর্পোরাল পদেরও ওপরে কখনো উঠতে পারেননি তিনি। প্রহরীর আরামের চাকরীটিতে যেহেতু দায়িত্ব বিশেষ ছিলো না, জুহাইমানের সময় কাটতো বিভিন্ন ইসলামিক বক্তার ওয়াজ মাহফিলে ফতোয়া শুনে। এই সমাবেশগুলোতে সবচেয়ে বেশী প্রচারিত হতো সেই অন্ধ ধর্মগুরু আব্দুল্আজিজ বিন বাজের ফতোয়া, যাঁকে বাদশাহ আব্দুলআজিজ জেলে পুরেছিলেন। বিন বাজের বজ্রকঠোর কন্ঠে ঘোষিত হতে থাকে একের পর এক দাবীঃ দাঁড়ি-চুল কাটা যাবে না, নরসুন্দর পেশাটি উঠিয়ে দিতে হবে, ছেলেদের বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া যাবে না, টিভিতে নারীরা খবর পড়তে পারবে না, পৃথিবী গোল-এই ‘মিথ্যে তথ্য' শিক্ষার্থীদের শেখানো যাবে না...সৌদী বাদশাহেরা যে রাষ্ট্রীয় অর্থেই আমেরিকা সুইটজারল্যান্ডে মদ্যপান করে বেড়াচ্ছেন, বেশ্যা নিয়ে ফূর্তি করছেন, তা নিয়ে এই উলেমা সমাজ কোন নিন্দেমন্দ করেনি, কারণ, “দেশের শাসকের বিরুদ্ধাচারণ করা গুরুতর একটি গুনাহের কাজ”!
কোমল পানীয়, জিনস-টিশার্ট, টিভি ইত্যাদি পশ্চিমা ‘অপসংস্কৃতি' থেকে আরব তরুণ-যুবাদের বাঁচাবার জন্য বিন বাজ এবং তাঁর সহচরেরা একটি বিশেষ কর্মসূচী চালু করেন, যাতে অংশগ্রহনকারী অল্পবয়েসী কিশোর-যুবাদের মরুভূমিতে নিয়ে যাওয়া হতো সপ্তাহান্তে। গোটা দু'দিন তাদের কাটতো প্রার্থনা এবং কোরান তিলাওয়াত করে। এই সময়টাতে তাদের একমাত্র খাবার ছিলো ভিনেগারের স্বাদযুক্ত শুকনো রুটি। বারবার করে তাদের মনে করিয়ে দেয়া হতো তিলাওয়াতে পূর্ণ মনোযোগ দিতে, তাহলেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ অলৌকিক এক উপহার দেবেন। দু'দিনের প্রার্থনা শেষে দেখা যেতো সত্যিই এক অলৌকিক কাণ্ড ঘটে গেছে! মরুভূমির মাঝেই জাফরানি চালের শাহী পোলাও, গরম ধোঁয়া ওড়া ভেড়ার মাংস, কাবাব, কালিয়া, এবং বরফজুড়ানো ঠাণ্ডা পেপসিকোলা চলে এসেছে তাদের ভোগে (কোকাকোলা যেহেতু ইজরায়েলে ব্যবসা করছিলো, তাই বেশীরভাগ আরব দেশগুলোতেই শুধু পেপসি পাওয়া যেতো। প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে যে ‘সর্বশক্তিমান' এই খাবার মিলিয়ে দিতেন, পেপসি-কোকাকোলার এই সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বিষয়টিও তিনি আমলে নিতেন স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে!)।
আব্রাহামিক ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা হলো ‘মসীয়াহ'; কেয়ামতের আগে পৃথিবীর মানুষ যখন সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে যাবে, শয়তানের অবাধ বিচরণ চলবে, ঠিক তখনি মানবজাতির উদ্ধারে সর্বশক্তিমান এই মসীয়াহ বা উদ্ধারকর্তাকে পাঠাবেন। খ্রীষ্টানরা যীশুকে মসীয়াহ মনে করেন; মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন এই মসীয়াহ-এর সাথে আরো একজন সহকারী আসবেন, যাঁকে তাঁরা ইমাম মাহদী বলে জানেন। আহমাদিয়া মুসলমানেরা মনে করেন মসীয়াহ এবং মাহদী একই ব্যক্তি এবং তিনি ইতোমধ্যে চলে এসেছেন (হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, তিনি এই ধর্মমতটির স্থপতি মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানী নিজেই)। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় প্রতি দশকেই আসলে কেউ না কেউ নিজেকে ইমাম মাহদী বা মসীয়াহ দাবী করে আসছেন। গোলাম আহমদ সাহেব যখন নিজেকে মসীয়াহ দাবী করেন, ঠিক একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়ে জন আলেকজাণ্ডার ডাওয়ি নাম্নী আরেকজন ভদ্রলোকও একই দাবী করেন। কয়েক হাজার মাইল দূরত্বের ব্যবধানে দু'জন ভিন্ন ব্যক্তি একই সময়ে একই ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের আফিমটি বেশ কার্যকর; গল্পের গরুকে গাছে ওঠাতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
কী করে ঈমাম মাহদীকে চেনা যাবে, তাঁর হুলিয়ার বর্ণনা দিয়ে বেশ কিছু হাদিস রয়েছে, যার সূত্রমতে মাহদীর কপাল চওড়া হবে, গালে দাগ থাকবে, ইসলামের নবীর মতোই তাঁর নামও হবে মুহাম্মদ, এবং পিতার নাম হবে আব্দুল্লাহ (নবী মুহম্মদের পিতার নাম)। ‘রাগী অভিব্যক্তির' জুহাইমান অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন তাঁর প্রিয়তম কবি বন্ধু মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ-এর সাথে এই সবগুলো লক্ষণই মিলে যায়! পরিসংখ্যানের কোন জ্ঞান না থাকা কার্যত অশিক্ষিত জুহাইমানের মনে কখনো এই ভাবনাটির উদয় হয়নি যে পৃথিবীতে ইতোমধ্যে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মুহম্মদ নামটি ধারণ করেন, যাঁদের অনেকেরই পিতার নাম আব্দুল্লাহ। ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্ব্বপূর্ণ এই নাম দু'টি ইসলামিক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় দু'টি নামও বটে। ধর্মাবেগের আতিশয্যে দুইয়ে দুইয়ে বাইশ মিলিয়ে প্রিয় বন্ধুকে (এবং সম্বন্ধীও বটে; জুহাইমান তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তাঁর এই ‘মাহদী' বন্ধুটির বোনকে বিয়ে করেন) ইমাম মাহদী সাজিয়ে মসজিদ-আল-হারাম দখল করে নেন জুহাইমান। ২ সপ্তাহের এ নাটকে অনর্থক প্রাণ হারায় হাজারের ওপর মানুষ।
মুসলমান বিশ্বে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভীষণ জনপ্রিয় যা কার্যত একটি বড় অংশের মুসলমানেরাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, বিধর্মী কাফেররা ইসলামকে কলুষিত করবার জন্য দিনরাত ২৪ ঘন্টা নীলনকশা কষে যাচ্ছে। জুহাইমানদের কাবা দখল করে নেবার ঘটনা সম্পর্কে যখন মুসলিম বিশ্বের বাকী দেশগুলো অবগত হয়, তারা কোন প্রমাণ ছাড়াই অন্ধভাবে প্রচার করতে থাকে এই কাজটি আসলে আমেরিকা এবং ইজরায়েল-এর খ্রীষ্টান ও ইহুদীরা একত্র হয়ে ঘটিয়েছে, মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন ��রে দেবার জন্য! এর প্রতিবাদে পাকিস্তানের কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ক্লাসরুম ছেড়ে পড়ালেখা ফেলে পাকিস্তানের আমেরিকান দূতাবাসে হামলা চালায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ছোটখাটো একটি দাঙ্গা ঘটে যায়; মুসলমানেরা বাস গাড়ী এবং দোকানে আগুন দেন, বিদেশীদের ওপর হামলা চালান। কেরালায় সে সময়ে কোন বিদেশী ছিলো না, তাই সেখানে মুসলমানেরা চড়াও হন হিন্দুদের ওপর। হায়দ্রাবাদে হিন্দুদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়, কয়েক দিন ব্যাপী চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ঢাকায় হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিশাল জটলা পাকান, জনজীবনকে করে তোলেন দুর্বিষহ।
কাবার দখলের পর জুহাইমানদের দমন করতে গিয়ে সৌদী সরকার বারবার ভুল করেছে, হাস্যকর সব পদক্ষেপে নিজেদের বিপর্যস্ত করে তুলেছে, তাতে প্রাণক্ষয়ই শুধু বেড়েছে। দখলকৃত মসজিদের ভেতর একদিকে জুহাইমান তাঁর অনুগত চরদের বলছেন ভণ্ড সৌদী সরকারের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে কেউ মারা গেলে বেহেশত সুনিশ্চিত, অপরদিকে মসজিদের বাইরে যে সৌদী সেনাবাহিনী জুহাইমানদের বিরুদ্ধে গুলি ছুঁড়ছে, তারাও ওপর মহল থেকে আশ্বাসবাণী কানে নিয়ে এসেছেঃ ভ্রান্ত মুসলমান ‘খারেজী' এই জুহাইমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মারা পড়লে বেহেশত সুনি...
বেহেশত-দোযখ ঠিক করবার মালিক যিনি, তিনি কার পক্ষে রায় দেবেন শেষতক? এর উত্তরে আমার কোন আগ্রহ নেই। আমার শুধু প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ি যখন শিক্ষাহীনদের নিম্নরুচির ফ্যান্টাসি গল্প বাস্তবায়নের বলি হতে হয় নিরীহ মানুষকে। বুড়োদের রূপকথার এই নির্বোধ নিরেট দেয়ালে আমার সমস্ত অসহায় আক্রোশ সজোরে আছড়ে পড়ে। তারপর আমি চারপাশে শুধুই অন্ধকার দেখি।