Sofia Petrovna
Sofia Petrovna
Ratings1
Average rating3
We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
গুলাগের শ্রমিক শিবিরে আসা নতুন এক বন্দীর সাথে পুরনো বন্দী কথা বলছেঃ
-“তো কী অপরাধে আপনাকে ১০ বছরের সাজা দেয়া হলো?”
“কিছুই না! আমি কিছুই করিনি!”
-“কেন শুধু শুধু মিথ্যা বলছেন? এখানে সবাই জানে, “কিছুই না”'র সাজা তো মাত্র ৩ বছর!”
ইংরেজী purge শব্দটির অর্থ তো আমরা সবাই-ই জানি। অবাঞ্চিত, অপ্রয়োজনীয় বস্তু সরিয়ে ফেলার প্রেক্ষিতে এ শব্দটির নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। পেটের পীড়ায় ভোগা রোগী জোলাপ জাতীয় laxative খেয়ে কিংবা গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে পেটের ভেতরটা purge করিয়ে নেন। গবেষণাগারে কাজ করা বিজ্ঞানী ভ্যাকিউয়াম চুলার ভেতরে জমা হওয়া অবাঞ্চিত গ্যাস purge করে তাঁর sampleটিকে দূষণ থেকে বাঁচান...চাইলে এমন আরো কয়েক রকম উদাহরণই দেয়া সম্ভব; অভিধানটা হাতে নিয়ে একবার চোখ বোলালে এ শব্দটি এবং এর প্রয়োগগুলো বিনা ক্লেশেই শেখা হয়ে যায়। সোভিয়েতের জনগণ ১৯৩০-এর দশকে এ শব্দটি অবশ্য শিখেছিলো এর ব্যবহারিক প্রয়োগ থেকে, অভিধান ঘেঁটে নয়। রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ স্টালিন তখন দেশজুড়ে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে রাজনৈতিক শত্রু খুঁজে বেড়াচ্ছেন; যার ওপরই বিন্দুমাত্র সন্দেহ হচ্ছে, যাকেই বিরোধী মতের লোক বলে ঠাওর হচ্ছে, কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই তাকে জেলে পুরে দিচ্ছেন, পাঠিয়ে দিচ্ছেন নিশ্চিত মৃত্যুর পথে। এভাবে ২ বছরে প্রায় ১২ লাখ মানুষকে খুন করে purge করে কন্টকমুক্ত নিশ্চিত একটি রাজনৈতিক অবস্থান তৈরী করেন স্টালিন। ইতিহাসের পাতায় গণহত্যার এই ঘটনাটি The Great Purge নামে স্বীকৃত।
১৯২৪ সালে যখন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সর্বেসর্বা নবী ভ্লাদিমির লেনিন পটল তোলেন, তখন একটি শূণ্যতা তৈরী হয়। “পার্টির হাল এবার কে ধরবেন?”-এই প্রশ্নে বিব্রত হতে হয় দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের। ধর্মে কিংবা জিরাফে কমিউনিজমে একটি বিষয় সর্বজনীনঃ একজন পালের গোদাকে কেন্দ্র করে ধর্মের কিংবা কমিউনিজমের গোটা দুনিয়া ঘূর্ণায়মান থাকে। কেন্দ্রে থাকা এই পালের গোদা মশাইটির ভবলীলা সাঙ্গ হলেই গোটা কাঠামোটি কেঁপে ওঠে; ক্ষমতা এবার কার হাতে যাবে সে প্রশ্ন নিয়ে লেগে যায় হুটোপাটি। এই হুটোপাটিতে শেষতক কে জিতবেন সেটিরও একটি pattern রয়েছে। পালের গোদা'র ‘গোদাত্ব' জাহির করবার জন্য তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর নামে অনুসারীদের পক্ষ থেকে সচরাচর কিছু রূপকথার গল্প চাউর করা হয় (তিনি আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, কিংবা পশুপাখির সাথে কথা বলতে পারেন, কিংবা চাঁদ দু'ভাগ করে ফেলতে জানেন, কিংবা তাঁর কখনো ঘুমোবার/ বিশ্রাম নেবার প্রয়োজন পড়ে না...ইত্যাদি)। গোদা মশাইটি মারা যাবার পর তাঁর যে অনুসারী তাঁর নামে প্রচলিত এই গল্পগুলোকে দ্বিগুণ-চতুর্গুণ উৎসাহে জনগণের গলায় ঠেসে ঢোকাতে পারেন, তিনিই সেই ইঁদুর দৌড়ে জয়ী হন। “দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পালের গোদা”'র স্বীকৃতীস্বরূপ বরমাল্যটি তাঁর গলাতেই ওঠে। ধর্মবিশ্বাসের সাথে কমিউনিজমের এখানেই আশ্চর্য মিল। ঠিক এই ছকে পা ফেলেই লেনিনকে অতিমানব বানিয়ে স্টালিন তাঁর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ লিওন ট্রটস্কিকে হঠান। সেই সাথে ট্রটস্কির চিহ্নও মুছে ফেলতে তৎপর হয়ে ওঠেন। ট্রটস্কিকে তো মেক্সিকোতে খুন করান বটেই, সেই সাথে ট্রটস্কির অনুসারী সন্দেহে ডানে বাঁয়ে যাকে পান তাকেই নির্বাসনে পাঠান।
পালের গোদা'র আসনে বসে পড়লে তখত ধরে রাখার জন্য নিজের নামেও রূপকথা ছড়াতে হয়। স্টালিন অবশ্যই তার ব্যতিক্রম নন। স্টালিন নামটিই আসলে ভুয়া; এ নামটির অর্থ দাঁড়ায় লৌহমানব (man of steel), কিন্তু এটি মোটেই তাঁর পিতৃপ্রদত্ত কোন নাম নয়, নিজেই তিনি নিজেকে এ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। ক্ষমতায় বসবার পর স্টালিন প্রথম ৫ বছরের একটি কর্মসূচী তৈরী করেন, যার সারকথা ছিলো ব্যক্তিমালিকানাধীন কোন প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে না; কলকারখানা, অফিস-আদালত সবকিছুই সরকারের করায়ত্ত হতে হবে। মূলত এই নীতিমালার পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে মতবিরোধ থেকেই স্টালিন ও ট্রটস্কির শত্রুতার শুরু। প্রথম জীবনে ধর্মযাজকের প্রশিক্ষণ পাওয়া অর্ধশিক্ষিত স্টালিন কোন অংক না কষেই মনের খেয়ালে এ সিদ্ধান্ত নেন, যা ইউক্রেন, কাজাখস্তান, সাইবেরিয়া সহ গোটা ইউরাল অঞ্চলে ৩ বছর মেয়াদী দীর্ঘ এক দূর্ভিক্ষ ডেকে আনে। ৯০ লাখ মানুষ না খেতে পেয়ে প্রাণ হারায়। সাধারণ জনগণ যখন ক্ষোভে রাগে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, স্টালিনের নীতির সমালোচনায় অংশ নেয়, তখনি স্টালিন তাঁর লৌহদণ্ডটি বের করে আনেন। শুরু হয়ে যায় দ্যা গ্রেট পার্জ। আপনার বাড়ীতে খাবার নেই? কত খাওয়া লাগে আপনার? সব খেয়ে খেয়ে তো রাষ্ট্রকে ফতুর করে দিচ্ছেন। আপনি রাষ্ট্রীয় শত্রু। আপনার অসুস্থ সন্তান চিকিৎসা পাচ্ছে না? না-ই বা পেলো! দেশ গড়ার কাজে ডাক্তাররা ব্যাস্ত আছেন, তাঁদের বিরক্ত করে মারছেন কেন? আপনি রাষ্ট্রীয় শত্রু। আপনি ক্যাপিটালিস্টদের মতো টাই পরে ঘোরাঘুরি করেন? নির্ঘাত আপনি রাষ্ট্রীয় শ...
১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮-এ দুই বছরে সোভিয়েত রাশিয়ায় যখন এই দম বন্ধ করা পরিবেশ চলছে, ঠিক তখনই স্টালিনের নাকের ডগায় বসে লীদিয়া চুকোভস্কায়া তাঁর উপন্যাসিকা ‘সোফিয়া পেত্রোভনা' লেখেন। সোফিয়া পেত্রোভনা একজন সাধারণ সোভিয়েত নারী, যাঁর স্বামী গত হয়েছেন, একমাত্র ছেলে কোলিয়াকে নিয়ে তিনি বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। সোভিয়েত প্রপাগ্যান্ডা ছাপাবার এক পাবলিশিং হাউজে তিনি টাইপিস্টের চাকরী নিয়েছেন। সে অফিসে ক'দিন পর পরই কমিউনিস্ট পার্টির সভা হয়, যাতে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। একঘেয়ে, বিরক্তিকর এই সভাগুলোতে কিভাবে কমিউনিজম দিনকে দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে, এবং লেনিনের স্বপ্নের সোভিয়েত গঠিত হচ্ছে তার মুখস্ত বিবরণী থাকে। তবে সভার মূল উদ্দেশ্য স্টালিনের স্তুতি গাওয়া। উন্নতির যে গ্রাফগুলো দেখানো হয় সভাতে, আর যে সোনালী প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়, সেগুলো সহজ-সরল আধপ্রৌঢা সোফিয়ার বোধগম্য হয় না বেশী একটা। নাম লেখানো বাধ্যতামূলক, তাই কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা MOPR-এ সোফিয়াও নাম লেখান, তবে এর কার্যকলাপ কী সেসবের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা তাঁর নেই। সভা শেষ করে স্থানীয় পার্টি-প্রধান আরো একবার ক্যাপিটালিস্টদের মুণ্ডুপাত করে তাঁর (ক্যাপিটালিস্ট দেশ আমেরিকার তৈরী) ফোর্ড গাড়ীতে চড়ে বাড়ী ফেরত যান।
“পার্সোনালিটি কাল্ট” ছাড়া যে কমিউনিজম দাঁড়ায় না, তার দুর্দান্ত সব প্রমাণ চুকোভস্কায়া'র ছোট এ বইয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নাতি-নাতনী'র স্বপ্নে বিভোর সোফিয়া ভেবে রাখেন তাঁর নাতি হলে নাম রাখবেন ভ্লাদলেন, আর নাতনী হলে লিনেন। ভ্লাদিমির লেনিন-এর সংক্ষিপ্ত রূপ ভ্লাদলেন, আর Lenin-কে উল্টো করলে নিনেল। এই দু'টি নামই সে সময়ে সোভিয়েতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলো। একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য পার্টি অফিস থেকে অভিনন্দন পেয়ে গদগদ হয়ে যাওয়া সোফিয়া কোলিয়াকে কেন্দ্র করে সামনের দিনগুলোর স্বপ্ন বুনতে থাকেন। কোলিয়াও এর মাঝে কমসোমল-এ নাম লেখায় (ছাত্রদল/ ছাত্রলীগ গোছের ব্যাপার)। কিছুদিন পরেই কোলিয়া বাড়ী থেকে বেশ দূরে এক ফ্যাক্টরিতে ইঞ্জিনিয়ার-এর কাজ পায়; মাস কয়েক পর সেরা উদ্ভাবক-এর পদক পাওয়া কোলিয়ার ছবি পত্রিকাতেও আসে। যে যুবকদের হাত ধরে সোভিয়েত ক্রমশ পৃথিবীর সেরা দেশে পরিণত হচ্ছে সোফিয়া'র কোলিয়া যে তাদের সর্বাগ্রে তাতে তাঁর কোনই সন্দেহ থাকে না। কমিউনিজমের প্রতি কোলিয়ার ভালোবাসাটাও দেখবার মতই। সোফিয়া'র বান্ধবী নাতাশা বুর্জোয়া পরিবার থেকে উঠে আসায় শতচেষ্টা করেও কিছুতেই কমসোমল-এ নাম লেখাতে পারছিলো না; এ নিয়ে সোফিয়া দুঃখ নিয়ে কোলিয়াকে চিঠি লিখলে কোলিয়া জবাব দেয়, “সমাজে শ্রেণীশত্রু এখনো রয়ে গেছে, কোথায় কোন বুর্জোয়া কি ফন্দী এঁটে অন্তর্ঘাত করে বসে তা ঠিক ভাবে যাচাই না করে তো স্টালিন যাকে তাকে দলে ভেড়াবেন না! তুমি এসব নিয়ে দুঃখ না করে মন দিয়ে বেশী বেশী মার্ক্স, এঙ্গেলস, আর লেনিন পড়ো আর খাতায় নোট নাও”।
ভালোই চলছিলো দিন, এরই মাঝে হঠাৎ হঠাৎ খবর আসতে থাকে সোফিয়ার কাছে, তাঁর পরিচিত অনেকেই নাকি জেলে, রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে। একদিন সোফিয়ার বাড়ীতেও সংবাদ আসে, কোলিয়াও নাকি দেশের শত্রু, তারও ১০ বছরের জেল হয়ে গেছে। শুরু হয় সোফিয়ার এক অন্যরকম সংগ্রামের জীবন; ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জেলখানার সামনে হাজিরা দেয়া শুরু করেন প্রতিদিন, কিন্তু কোথায় কোলিয়া? কার সাথে কথা বললে ছেলের সন্ধান পাবেন সোফিয়া? এ কাউন্টার থেকে সে কাউন্টার, এ জেল থেকে সেই জেল এভাবে ঘুরে ঘুরে সোফিয়া ক্লান্ত। জনপ্রতি ১০ সেকেন্ড করে সময় দেয়া বিচারকেরও বয়েই গেছে সোফিয়ার ছেলের খোঁজ রাখতে; রুঢ় ভাষায় দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয় তাঁকে। সোফিয়া'র সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে আরো হাজার কয়েক নারী, এঁদের কেউ ছেলের জন্য, কেউ ভাইয়ের জন্য, আর কেউ স্বামীর জন্য হাজিরা দিয়ে চলেছেন দিনের পর দিন। কোলিয়ারা কোথায় যায়? কী হয় তাদের? তাদের অপরাধটাই বা কী? কেউ জানে না। স্টালিন জানেন? বছর খানেক অপেক্ষা করবার পর বাধ্য হয়ে সোফিয়া স্টালিনকে চিঠি দেন, একবার, দু'বার, তিনবার। তৃতীয়বারের চিঠি বিশেষ ডাকে পাঠান রসিদ সহ, যাতে স্টালিনের হাতে নিশ্চিতভাবেই পৌঁছায়। রসিদে পাঠের অযোগ্য অস্পষ্ট যে স্বাক্ষরটা থাকে, তা দেখে বোঝার উপায় নেই চিঠি কার হাতে গেছে, কে স্বাক্ষর করেছে। স্টালিনের খেয়ালী এক মুহুর্তের সিদ্ধান্তে সারাজীবনের জন্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া সোফিয়ারা কী করবে?
সোফিয়া'র অবর্ণনীয় কষ্টের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরনী চুকোভস্কায়া দিয়েছেন, তাতে পাঠকের মনে প্রশ্ন আসবেই, কী করে তিনি এত ভেতরের সব খবর জানলেন? তিনি কি নিজেই উপস্থিত ছিলেন সোফিয়ার জীবনে? লীদিয়া চুকোভস্কায়া বিয়ে করেছিলেন সোভিয়েত পদার্থবিদ মাতভেই পেত্রোভিচ ব্রনস্টেইনকে। ব্রনস্টেইন ছিলেন কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তত্ত্বের অন্যতম পথিকৃৎ। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান ১৯৬৫ সালে তাঁর যে অবদানের জন্য নোবেল পেয়েছিলেন, সেই কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রোডায়নামিক্স নিয়ে ব্রনস্টেইনের কাজ রয়েছে। সেমিকন্ডাক্টর এর কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে তিনি বহু মাথা ঘামিয়েছেন। শিশুদের জন্য বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের অসংখ্য বইও তিনি লিখে গেছেন। অসম্ভব কর্মোচ্ছল এই ব্রনস্টেইন ১৯৩৮ সালে মাত্র ৩১ বছর বয়েসে স্টালিনীয় বিচারের শিকার হয়ে লেনিনগ্রাদের এক জেলে খুন হন। তাঁর স্ত্রী, লীদিয়া চুকোভস্কায়াকে সরকার থেকে বলা হয়েছিলো ব্রনস্টেইনের ১০ বছরের জেল হয়েছে। বহুদিন পর্যন্ত চুকোভস্কায়ার কাছে স্বামীর মৃত্যুর খবর অজানা ছিলো। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তিনি ব্রনস্টেইনকে ছাড়িয়ে আনবার আশায় এক জেল থেকে আরেক জেলে ঘুরেছেন, বিচারকদের দুয়ারে মাথা খুঁড়ে মরেছেন। কাল্পনিক সোফিয়া'র সত্যিকার গল্প বলতে চুকোভস্কায়াকে মোটেই বেগ পেতে হয়নি।
স্টালিনের স্বেচ্ছাচারে রাশিয়া হারিয়েছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যাঁরা সত্যিকার অর্থে দেশটিকে ঋদ্ধ করতে পারতেন। শুধু উইকিপিডিয়া'র দ্যা গ্রেট পার্জ নিবন্ধটিতে চোখ বোলালেই হাঁ হয়ে যেতে হয়। স্টালিন কাকে খুন করতে বাকী রেখেছেন? কিছুদিন আগেই আইজ্যাক বাবেল-এর ছোট গল্পের একটি সংকলন পড়ছিলাম, যাঁকে চেখভ-পরবর্তী যুগে রাশিয়ার শ্রেষ্ঠতম ছোটগল্পকার হিসেবে ধরা হয়। বাবেলকে ১৯৪০-এর জানুয়ারীতে খুন করে মাটি চাপা দেয়া হয়, ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত সে লাশের সন্ধানই পাওয়া যায়নি। বাবেলের সূক্ষ্ম হিউমার এক মুহুর্তেই আমাকে তাঁর ভক্ত বানিয়ে দিয়েছিলো; মনে আছে, তাঁর এই করুণ পরিণতির কথা পড়ে মনের অজান্তেই হাত কেমন মুঠো পাকিয়ে ফেলেছিলাম...
গ্রেট পার্জের মূল নকশাকার স্টালিন, কিন্তু ধরপাকড় আর খুন করাবার নোংরা কাজগুলো তিনি করাতেন তাঁর গোপন পুলিশ বাহিনী এনকেভিডি (NKVD)কে দিয়ে। এই এনকেভিডি'র প্রধান নিকোলাই ইয়েজভ ছিলেন স্টালিনের ডান হাত। স্টালিন ইশারা দেবার সাথে সাথে প্রভুভক্ত কুকুরের মতোই ইয়েজভ বিপুল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়তেন ‘রাষ্ট্রীয় শত্রু'দের ওপর। বাবেল সহ বহু বহু লেখক-বুদ্ধিজীবিই ইয়েজভের শিকার। ইয়েজভ তাঁর কাজে এতই পারদর্শী ছিলেন যে রাশানরা '৩৬-'৩৮ এর সেই দুই বছরকে গ্রেট পার্জ না বলে ইয়েজভস্কিনা (ইয়াজভের সময়) বলতো। গ্রেট পার্জ নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক সমালোচনার সম্মুখীন হন স্টালিন, নিজের ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় দিয়ে এনকেভিডিকে তিনি আচ্ছা করে কড়কে দেন; একসময়ের জিগরী দোস্ত নিকোলাই ইয়েজভকে সেই একই কায়দায় খুন করান। ইয়াজভ আর স্টালিনের একসাথে তোলা যতো ছবি ছিলো খুঁজে খুঁজে বের করে সেগুলো থেকে ইয়াজভকে মুছে ফেলার এক মহাযজ্ঞ শুরু হয়। আগাগোড়া পুরোটাই ইস্পাতের তৈরী না হলে এতটা নির্লজ্জ বোধহয় হওয়া যায় না। সে অর্থে স্টালিন সত্যি সত্যিই লৌহমানব ছিলেন।
সূত্রঃ রেয়ার হিস্টোরিক্যাল ফটোস
যে লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবিদের স্টালিন নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের মাঝে হাতেগোনা অল্প ক'জনই প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। ১০ বছর কারাভোগের পর আলেকজান্ডার সোলঝিনিৎসেন যখন ওয়ান ডে ইন দ্যা লাইফ অফ ইভান দেনিসোভিচ লেখেন, গোটা বিশ্ব নড়েচড়ে বসে। আজ অব্দি গ্রেট পার্জের সবচেয়ে বিখ্যাত দলিল সোলঝিনিৎসেনের বইগুলো। লীদিয়া চুকোভস্কায়া তাঁর উপন্যাসিকাটি লিখেছেন সোলঝিনিৎসেনেরও কয়েক দশক আগে, অথচ ভাগ্যের একটু এদিক ওদিক হলেই এ বই কখনোই প্রকাশিত নাও হতে পারতো। একাধিকবার চুকোভস্কায়ার বাড়ীতে এনকেভিডি হানা দিয়েছে, তন্নতন্ন ক���ে খুঁজেছে তাঁর বাড়ী, কিন্তু ‘সোফিয়া পেত্রোভনা'র পাণ্ডুলিপি তিনি তদ্দিনে তাঁর এক বন্ধুর কাছে পাচার করে দিয়েছেন। ৫ বছর যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখবার পর মৃত্যুশয্যায় সেই বন্ধুটি তাঁর বোনকে পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে বলেছিলেন “যদি তুমি আর লীদিয়া দু'জনই বেঁচে থাকো, আর ওর সাথে তোমার দেখা হয়, তাহলে এই বইটা ওকে ফেরত দিও”। গায়ে কাঁটা দেবার মতো ঘটনা, তাই না?
স্টালিন যে তাঁর দেশের বুদ্ধিজীবিদের পাইকারী হারে খুন করা শুরু করেছিলেন, সে ঘটনা প্রায় ৯০ বছর আগের বাসী হয়ে গেছে। কারো কি কুমীর চাষী মুশতাক আহমেদের কথা মনে আছে? তাঁকে জেলে নেবার পর তাঁর স্ত্রী লিপা আহমেদ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ও ভরণপোষণের দায়িত্বে থাকা মুশতাকের পরিবারের কী হবে তা নিয়ে ভেবে সরকার সময় অপচয় করেনি। মুশতাক আহমেদের অপরাধ ছিলো কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে বাঙলাদেশ সরকারের দূর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি একটি ফেইসবুক পোস্ট দিয়েছিলেন।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ কে ছিলেন মুশতাক আহমেদ?