বরাবরের মতোই অসাধারণ ফেলুদা, সাথে কাঠমান্ডুর প্রাকৃতিক দৃশ্যের সব বর্ননা আর শেষ মুহূর্তের টুইস্ট! সানডে সাসপেন্সের ফেলুদা'র ভূমিকায় মি. সব্যসাচী আর জটায়ুর কন্ঠ না থাকলে যে গল্পটার মজা অর্ধেক নষ্ট হয়ে যেতো, সেটা গল্পটা শেষ হওয়া মাত্রই বুঝতে পারলাম।
এডমিশন জার্নি পরবর্তী এভারেজ একটা দুপুর যে আমার কতো সুন্দরভাবে কেটে গেলো, এটার কৃতিত্ব তো সত্যজিৎ সাহেব পাবেনই।
মহিউদ্দিন আহমেদের অন্যান্য বেশকিছু বইয়ের মতোন, ক্রমানুসারে শুরু করবার জন্য জাসদ বিষয়কটার পর এটা অন্যতম সেরা বই, যা আমার ২০২২ সালে পড়া শেষ বই।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-এর বিশাল বৈচিত্রময় জার্নির সাবলীল পরিক্রমা— সংক্ষিপ্তসারে রিভিউ করতে চাইলে, এবং বই ও দল: উভয়ের বিষয়ে বলতে গেলে, বর্তমান রাজনৈতিক পর্যুদস্তবস্থায় বিএনপি বিগত যেকোনো সময়ের চাইতে এখন অধিকভাবে দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করছে সন্দেহ নেই; ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের এই সময়েও সম্ভবত ইহা উপলব্ধি করা কষ্টকর, কেননা শহুরে মধ্যবিত্ত সার্কল পূর্বেকার ন্যায় চিরাচরিত বাঙালির রোল প্লে করে
একটি গণমানুষের আন্দোলনেও অংশ নেয়নি। বিশ-পঁচিশ বছর পরেও এটা, অর্থাৎ এখনকার জনসাধারণের পালস্ অনুধাবন করাটা টাফ হবে, কেননা মেইনস্ট্রিম কোনো গণমাধ্যমই এই সময়কে ধারণ করেনা পুরোটা, মনে হয় যেন সবাই এক আশ্চর্য দ্বৈত ভূখন্ডে বাস করছি যেখানের জনমানুষ আর ঐ জনমানুষের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, শিল্পি, মিডিয়া আর রাজনীতিবিদদের মুখের বয়ান আর চোখের ভাষা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।
ঐতিহাসিকভাবেই স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙলাদেশে বিএনপি তুলনামূলক ইসলামপন্থী এবং ভারতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রধান আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করেছে; আর সাধারণভাবে পাকিস্তান বিভক্তি-উত্তর বাঙালিদের মনোজাগতিকভাবে পাকিস্তান সমর্থনকারী উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যাও (বাঙলাদেশের ন্যূনতম ২০ শতাংশ জনগণ) বিএনপির ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করেছে। অর্থাৎ বিএনপির রাজনীতি পুরোপুরি এন্টি-আওয়ামীলীগ কেন্দ্রিক নয়; যদি অদূর ভবিষ্যতে কখনো দলটির কাঠামো ভেঙ্গেও যায়, অনিবার্যভাবেই সম-আদর্শের সমমানের আরেকটি দল দাঁড়িয়ে যাবে; কেননা “এক-পাকিস্তান” আইডিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীলতা, বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদ, রাস্ট্রে ইসলাম-ধর্ম কেন্দ্রীকতা, ভারতবিরোধীতা—এই অাদর্শগুলোর বিলুপ্তি বাঙলাদেশে কখনো ঘটবে না; বরং ক্রমান্বয়ে বাড়বে এবং সম্ভবত আরোও উগ্রধর্মী নেতৃত্ব দাঁড়াবে যদিনা বর্তমান রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম বন্ধ না হয়।
অতীতের ক্ষমতাসীন দল হিসেবে বিএনপির মারাত্মক কিছু কুলষতা, প্রতিহিংসাপরায়নতা ও দুর্নীতির ফলস্বরূপ এর ইমেজের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে; সেইসাথে দেশের সংখ্যালঘু- নিরপেক্ষ জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশকে তাঁদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে সব সময়ের জন্য।
তবু বিএনপি তুলনামূলক একটি লিবারাল প্ল্যাটফর্ম; ভারতবিদ্বেষী, পাকিস্তানপন্থী হতে শুরু করে সেক্যুলার, সংস্কারপন্থী শাহবাগী সবার জায়গার সংমিশ্রণ ঘটেছে এখানে; ফলে প্রায়শই পার্টির মূলধারায় কোনো অংশের মতামতের প্রতিনিধিত্ব ঘটেনি, আবার কোনো অংশকে করেছে বিপদের সম্মুখীন। সেইসাথে আদর্শগত মিত্রদের চিনতে ভুল করার পরিনামে এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবজনিত নিদর্শনের ফলস্বরূপ দলটিকে মাশুল দিতে হয়েছে অনেক বেশি; রক্ত আর গুমের হিসেবের মধ্য দিয়ে।
PS. বইয়ের প্রসঙ্গের বাইরে, দেশের এখনকার পরিস্থিতিতে, আমার মনেহয় বিএনপির এই দুর্দশার কারণ, প্রথমত: বিএনপির কৌশলগত অদূরদর্শীতা এবং রাজনৈতিক মিত্রদের প্রতি স্বার্থপরতা; সঙ্গে দ্বিতীয়ত: আদর্শগত শত্রু-মিত্র বিবেচনায় বিএনপি প্রকৃতপক্ষে এর রুট লেভেলের সমর্থকগোষ্ঠীকে ঔন করেনা; আসলে বিএনপির শক্তির জায়গা ইসলামপন্থী-তৃণমূল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী, শাহবাগ-কেন্দ্রীকতা নয়। বিএনপির চরিত্র শাপলা এবং জামায়াতের সদৃশ্য নয়, কিন্তু মিত্রতা বিবেচনায় বিএনপির পেছনে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে পারে কার্যত এই অংশই।
তৃতীয়ত: উপরোক্ত দুটি বিএনপির নীতিগত ভুল, এসব ভুল নিয়েও দলটির নিজস্ব সমর্থনেই আন্দোলন চালিয়ে কেয়ারটেকারের দাবি আদায় করতে পারার কথা; কিন্তু বিএনপির জন্য জার্নিটা কঠিন আর হতাশাব্যাঞ্জক। সত্যি বলতে আপনি কখনোই এমন শ্রেণীর মানুষদের সাথে ফাইট দিয়ে টিকে থাকতে পারবেন না, যারা আপনার বাজারের ব্যাগে কাঁচা মাংস দেখলেও খাবলে খেয়ে ফেলবে শুধু ক্ষুধা লাগছে বলে।
জানুয়ারি ১, ২০২৩।
স্বাধীন সামিহাকে ভালোবাসে, এবং হয়তো তাহাদের প্রেমানুভূতির জোড়ে সফল জুটি হিসেবে বিয়েও কিছু সময় পর হয়ে যাবে, বাট সমস্যার একটি হলো—সামিহাদের পরিবার অতি-ধনীটাইপের, যা মূলত ছেলেটার সাথে যায়না, বিশেষত তাঁর এক দরিদ্র ফ্যামিলি আর নিঃসঙ্গ মা ছাড়া।
তবে প্রেয়সীর পরিবার থেকে আপত্তি বাঁধে সম্পদে নয়, অন্যখানে, স্বাধীনের পিতৃপরিচয়ে।
একাত্তরে যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর জন্ম। সেজান, গুপ্তচর মজিদ, না পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের ঔরসজাত সে, তা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, স্বাধীন।
এরপর স্বাধীনতার এতোবছর পরে, একজন ছেলে, অনবদমিত কৌতুহল দমনে, তাঁর পিতার সাথে ঘটা কাহিনি শুনতে শুরু করে, যেগুলো মূলত তাঁর অনেকদিন আগেই জানবার কথা ছিলো, সেইসঙ্গে তাঁর মা তাঁকে বলে যায়—এবং, খুব সম্ভবত সবশেষে, স্বাধীনের শিহরণ ঘটে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক অন্যরকম বোধের, যাকে ঠিক যুদ্ধ হতে পিতার বেঁচে আসার আনন্দ কিংবা শহিদ হওয়ার বেদনা বোঝায় না— বরং মধ্যবর্তী অদ্ভুত কিছু অনুভূতি দেয়।
.
টিপিক্যাল বাংলা সিনেমার মতোন কাহিনি এগিয়েছে প্রথমে, নেহাত সাধারণ ও অখ্যাত একটি উপন্যাস। বেশ ছোট, সেহেতু কলেবর নেই; চিরপঠিত মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, সদ্যজাত দেশে ঘটিত হাজারো অপ্রতাশিত ঘটনার একটির শিকার একজন মানুষের কাহিনী বলা হয়েছে উপন্যাসটিতে।
যবনিকাপাত। এবং, অপ্রয়োজনীয়—
লেখিকা রাবেয়া খাতুন মারা গেলেন। তিন তারিখ, দু'হাজার একুশে। সেইসূত্রেই এই উপন্যাস পড়া হলো। এবং রিভিউ লিখছি। মোটামুটি বলা যায়, প্রিয়ান্তর স্মৃতিরক্ষা প্রকল্পের অংশ হিসেবে—ইহা বছরের প্রথম পড়া বলে কথা!
এই উপন্যাস নিয়ে মুভি হয়েছে, মেইবি এডওয়ার্ডও পাইসে অইটা, যাহোক, সিনেমাবান্ধব গল্প, এইটার প্রধানতম মিউজিকটা:
( ভালোবাসি সকালে, ভালোবাসি বিকেলে, মেঘলা কালো খোপার ও চুল ভালোবাসি! স্বর্ণলতার কানের ও দূল ভালোবাসি!) আমার বেশ পছন্দসই এবং কিউট লাগসিলো, যেইটা অফটপিক হিসেবে দেওয়া গেলো না;- যেহেতু মিউজিক টেস্ট বাজে, এবং লিরিকঃ আপাত পড়তে অতি-সাধারণ, তবু সুরটা সুন্দর।
নাস্তিক আর কাফের বলো তোমরা লয়ে আমার নাম,
কুৎসা গ্লানির পঙ্কিল স্রোত বহাও হেথা অবিশ্রাম।
অস্বীকার তা করব না যা ভুল করে যাই, কিন্তু ভাই,
কুৎসিত এই গালি দিয়েই তোমরা যাবে স্বর্গধাম?
প্রথমে বঙ্গবন্ধু নিয়ে তিনটে লেখা, স্মরণ-স্মৃতিমূলক তিনটে, আর পারিবারিক বিষয়ে তিনটি আর্টিকেলসমেত লেখা বই। কয়েকটি স্টোরি আলাদা করে পড়া হলো—আসলে বেশিরভাগই চিরপরিচিত আদিম কথামালার সমষ্টি, যেগুলো তিনি বলেন স্পিচে, রাজনৈতিক মঞ্চে আর সাক্ষাৎকারে; তারপরও কিছু বিষয়ে নষ্টালজিক ফ্লেভার আর দুঃখময় লাগবে হয়তো অনেকের। (বিশেষত: “স্মৃতি বড়ো মধুর, স্মৃতি বড়ো বেদনার” লেখাটা খুব পছন্দসই হয়েছে।)
দুঃখজনকভাবে উনার রাইটিং স্কিল নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, এরচাইতে পার্থ ঘোষের প্রস্তাবনা পার্টটা বেশি উপভোগ্য। খুবই সরলটাইপ লেখা এবং আকর্ষণহীন টেনে টেনে অনেকটা।
( প্রচ্ছদ আর পেইজ কোয়ালিটি নিসন্দেহে ভালো।)
ঢাকার হিস্টরিকাল নবাব পরিবার—এবং তাঁদের পিরিয়ডে সমসাময়িক দীর্ঘকাল ধরে চলমান পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী মূলত বইটিতে বিবৃত হয়েছে। নবাব পরিবারের সদস্যদের ডায়রির লেখনীতে নবাব পরিবারের অভ্যন্তরীন নৈমিত্তিক জীবনযাপন, অন্দরমহলের বিভিন্ন কাহিনি, খাদ্যাভাস, রুচিবোধ, রাজনীতি, ঢাকার তৎকালীন শহুরে পরিবেশ ফুটে উঠেছে চিত্তাকর্ষকভাবে (যদিও তা ধারাবাহিক সময়ক্রমানুযায়ী বর্ণিত হয়নি)। পাশাপাশি আহসান মঞ্জিল সংলগ্ন তখনকার ঢাকার শহরতলী এবং তৎকালীন সিভিল সোসাইটির ম্যানশন পাওয়া যায় বইটিতে, টপিক বিবেচনায় বইটির বিষয়বস্তু নিঃসন্দেহে ইউনিক এবং পড়ার আগ্রহ জন্মায়।
ভিন্ন ফ্লেভারের আশায় এবং আপনি যদি হিস্ট্রিবাফ হয়ে থাকেন, তবে পড়াটা বোরিং হবেনা, আই গেইস।
(সম্ভবত অপ্রতুলতার কারণে বইটি খুব কম মানুষের নজরেই আসছে, নতুবা বই হিসেবে ইন্ট্রেস্টিং। এবং এর সুবাদে ইহা আমার এড করা দ্বিতীয় বই, গুডরিডসে।)
যদিও শব্দ শুনে পড়া হলো পুড়োটা, সানডে সাসপেন্সে। বইটার নাম, কাভার, অলংকরণ আর লেখক যখন সত্যজিৎ রায়—তখন বোঝাই যায় এতে ক্লাস বলে একটা ব্যাপার রয়েছে। সেই ক্লাসিক ফেলুদা, তোপসে এন্ড জটায়ু। এই সিরিজের রহস্যময়তার বিচারে, সেরাদের একটা ছিলো বলতে হবে।
আর সানডে সাসপেন্স?
বাংলা সাহিত্যভুক্ত বুকিশদের জন্য ইহা নিসন্দেহে একটি আশীর্বাদমূলক পণ্য।
এটার চরিত্রগুলির মুখ থেকে হরহামেশাই বিভিন্ন জনরার দার্শনিকদের কৌট পাওয়া যায়—আদতে উপন্যাসটা দার্শনিকরূপী সন্দেহভাজন কিছু মানুষদের নিয়েই; যাদের নামই “গ্যাডফ্লাই”, ডাশঁপোকা; এরা সক্রেটিসের গ্যাডফ্লাই উপাধির অনুকরণ করে বর্তমানেও চলমান বিব্রত সত্যগুলোকে উপস্থাপন করতে চায়; হয়তো এটা তাদের ফিলোসোফি অথবা তারা হতে পারে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ, যারা দর্শনকে শুধুমাত্র ইউজ করে, প্রকাশ্যে।
নোট-১: উপন্যাসটা তো বড়ো কলেবরের করা যাইতো, প্রথমদিকে কাহিনি সেভাবে এগুলেও সমস্ত জটগুলো শেষে খুবই তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে দিয়েছেন লেখক; অনেকটা শুধু একটি চাপ্টারেই।
নোট-২: উপন্যাসে দেওয়া বেশ অজানা কিছু ইনফরমেশন, আর সুন্দর একটা কভার।
নোট-৩: এডামস ফ্যামিলির অনুরূপ কাহিনির একটা ক্ষুদ্র পার্ট ছিলো, এটায়। যেইটা নিয়ে আমার ইন্টারেস্ট অতিমাত্রায় সেজন্যই আরো পছন্দ হয়েছে ‘প্রথম চ্যাপ্টার' থেকে টানা অংশটা। দিল্লির বুরারি ডেথ আর এইটা নিয়ে জানতে হবে আরও।
নোট-৪: লেখক, আমার পড়া “গ্যাডফ্লাই” এবং “কাফকা ক্লাব” দুটো উপন্যাসেই প্রচুর তথ্য দিয়েছেন, সরাসরি আর্টিকেলের লেখবার মতোন। এটা একইসাথে ফিকশন পড়াকালীন: বিরক্তিকর, একঘেয়েমিপূর্ণ এবং উপকারী।
ভূতের গল্পের যে কতো রকমফের হতে পারে, এই বইটা না পড়লে অনেকখানি অজানা থেকে যেতো; গল্পগুলোতে ভূতের ভয় কম, রোমাঞ্চ যেন বেশি; তাতে ভয় লাগবার পরিমাণটা কমে না। এরকম বিভিন্ন স্বাদের বারোটি গল্প (সাথে চমৎকার সব হেডপিস আর ছবি জুড়ে দেয়া) এরকম বই দেখলেই যেন মন ভরে যায়—বিট্রিশ আমলের বাংলো—সাসপেন্স—ভৌতিকতা মেশানো দারুণ এডভেঞ্চার, আর অল্প একটু আসল ভূত!
আমার ভালো লেগেছে “ব্রাউন সাহেবের বাড়ি”, “তারিণীখুড়ো ও লখ্নৌর ডুয়েল” আর “নীল আতঙ্ক”।
এইটা রিভ্যুলুশন ২৪ পরবর্তী পঠিত প্রথম বই; সেই হিসেবে ৫৩ বছর আগের এই মাটির আরেক রিভ্যুলুশনের নায়কদের গতি-প্রকৃতি, উথান আর অন্তিম যাত্রা অবলোকন করে রোমাঞ্চকর একটা রিড উপহার দিতে লেখক ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
মুজিবের সৃষ্ট নিপীড়ক রাষ্ট্রকাঠামো বর্ননায় এটা সত্যি অনবদ্য, গত ষোল বছরে যেই ফ্যাসিজমের বিষমিশ্রিত বাতাস আমাদের গেলানো হতো, সেটার পালে হাওয়া লাগাতো মুজিবের এই ওভার-গ্লোরিফিকেশন, আশা করি এটার ন্যারেটিভ কিছুটা হলেও ওর দেবত্ব নামাতে, আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে যাওয়া ফ্যাসিজমের আইকনরূপী পুঁজের শাসনামলের ভয়াবহতা বুঝতে কাজে দেবে—এটাই প্রধান অবদান বলে মনে করি। এরপর জিয়ার পিরিয়ডে চলমান অটোক্রেটিক টেন্ডেন্সি আর জুডিশিয়াল কিলিংয়ের সমালোচনাও ভারসাম্যপূর্ণ লেগেছে (যদিও এখানে আরো আলোচনার সুযোগ ছিলো)
বইটি নিয়ে ক্রিটিকেরও অন্ত নেই; অনেক বর্ননায় কোনোরকম সোর্সের বালাই নেই, মুজিবের বিরোধিতাকারীদের ক্লিনশিট দিয়ে তাঁদের বয়ানেই সুর মেলানোর চেষ্টা, মুজিবের অপোনেন্টদের (ইনক্লুডিং সর্বহারা, জাসদ) ত্রাস নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য বর্ননা নেই, কিন্তু তাদের দমনের কাহিনি আছে কঠোরভাবে। মুজিব হত্যা নিয়ে লেখকের অতিরঞ্জিত বর্ণনা প্রসঙ্গে (আন্ধা হাফিজ কনটেক্সট) তার কিলারগণই সমালোচনা করেছে; একই কথা জিয়া হত্যা নিয়েও, এরশাদ সংশ্লিষ্টতার জোড়ালো বর্ণনা থাকলেও তার বইয়ে অনুপস্থিত। (এতে অনেকেই মনে করতে পারেন: এরশাদ পিরিয়ডের জাস্টিফিকেশান উৎপাদনে মুজিব-জিয়া ব্যাশিংই তার লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য, প্রধান দুই দলের আইকনদ্বয়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ মনোভাব বাড়ানোর ইন্টেনশন তার কাজ করে থাকতে পারে।)
বইয়ের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সরলীকরণ ছিলো দৃষ্টিকটু, নিজ পছন্দসই কয়েকটা ঘটনাক্রম বর্ননা করেই কনক্লুশনে পৌছে গেছেন অথবা জাস্টিফিকেশানের চেষ্টা করেছেন। তিনি চাইলে ক্রসচেক এবং ব্যালেন্সড/নিরপেক্ষ জায়গা থেকে লেখার প্রয়াস বাড়াতে পারতেন, যেই এডভান্টেজের তিনি সদ্ব্যবহার করেন নি।
সবশেষে, সবাইকে পড়তে বলার ক্ষেত্র হিসেবে, দুটো বিষয়ে এটাকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জনরায় ক্লাসিক পিস হিসেবে ধরে রাখবে বলে ধারণা করতে পারি, প্রথমত: লিখনশৈলী—দারুণ দুরন্ত, একদম ফিকশন পড়ার মতো (জেন-জি যাদের ইতিহাস বিষয়ক বই মাত্রই বোরিং, তাদের জন্য সুবিধাজনক বটে)
দ্বিতীয়ত, লেখকের অবস্থানগত প্রিভিলেজ: তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন জার্নালিজম চর্চার প্রেক্ষাপটে সবচে প্রমিনেন্ট ছিলেন, আর পরবর্তীতে মুজিব-ফারুক/রশিদ-জিয়া-এরশাদ সকল ক্যারেক্টারের সাথেই তার সরাসরি পরিচিতি ছিলো, এটা বায়াসনেসের প্রসঙ্গে যেমন ভয়ংকর দিক, আবার বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রেও সবচে সুবিধাজনক দিক; আই গেস লেখক তার সুবিধাজনক দিককেই কাজে লাগিয়ে সত্য বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন; অন্তত কোনোটা নিয়ে কনক্রিট সাংঘর্ষিক আর্গুমেন্ট পাবার আগ-অব্দি এরকম ধারণা পোষন করতে পারি।
অগাস্ট ২১, ২০২৪
ঊনলৌকিক দেখা আর বানিয়ালুলু পড়ার পর এই ব্যক্তির মস্তিষ্ক আর লেখার হাত—দুটোই যে সমপরিমাণ ইন্ট্রেস্টিং এটা বুঝতে বাকি থাকে না। এই লোকের মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরায় কল্পনারা কিভাবে ঘুরে বেড়ায় সেটার কৌতূহল দমানো, যারপরনাই দুঃসাধ্য। এইখানা নিয়েও অবসেশন না ফুরাইবার নয়, অদ্ভুত সব গল্পের গ্যালারি (না অ্যালবাম?)
কয়েক গল্প বিষাদমাখা, আবার গুটিকয়েক সুখী অনুভূতির সমাহার। খানিক থামতে হয় প্রত্যেক গল্পের শেষেই।
সুরাইয়া নিয়ে যতটুকুন এক্সপেক্টেশন ছিলো, পড়া শেষে তা বানিয়ালুলুকে ছাড়ায়নি কিন্তু স্টিল একটি আনন্দদায়ক রিডিংয়ের জন্য ওর্থি। গল্পগুলো পড়তে যেনো লাগে অন্যরকম; অদ্ভুত ম্যাজিক রিয়েলিজমের ফ্লেভারসমেত, একমলাটে কিম্ভূতকিমাকার সব গল্পের উপস্থিতি।
আমার সবচে প্রিয়:
সুরাইয়া: নামগল্প যেটায় কাকতালীয়ভাবে একরকমের ভাষা শিখে দুজনের আধা রোম্যান্টিক স্টোরি শুরু হয় (কিংবা শেষ হয়)
চেইন ক্যাফে: যেখানে চক্রবৃদ্ধি হারে প্রেমঘটিত বিষাদ উৎপন্ন হতে থাকে।
আর মরিবার হলো তার স্বাদ, সর্বশেষ গল্প।
বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, পাফার ফিশের মৃত্যুকামী রেসিপি এবং মধ্যরাতে একটা দোতলা বাসের সিটে থ্যাঁতলানো, রক্তাক্ত অবস্থায় মারা যাওয়ার মতোন রোমাঞ্চকর এবং সুস্বাদু ঘটনার বিবরণ।
৪.৫/৫
গল্পগুলো ফ্যান্টাসি অথবা সাইন্স ফিকশনের মাঝামাঝি—যেটাই হোক, জানিনা আমি, ভাল্লাগসে আমার, গল্পের প্লট আর কাহিনির ক্রম কিংবা ধাঁচ: দুটোই—অপরিচিত লাগবারই মতো, এবং ওটা নিয়ে দীর্ঘকালীন মুগ্ধতা কাজ করবে আমার বলে মনে হয়, আর আছে লেখকের লিখনশৈলীর স্বকীয়তা; বাঙলা ভাষায়, উক্ত জনরার বইগুলোয়, আপনি এমন কম্বিনেশন প্যাকেজের গল্পগ্রন্থ কমই পাবেন।
সেপ্টেম্বর ৮, ২০২১।
আশা করছি “সেভেন রুমস” গল্পটা অনেকদিন মনে থাকবে। “সো-ফার” এবং “কাজারি এ্যান্ড ইয়াকো” গল্প দুইটাও অনেকক্ষণ থামিয়ে রেখেছিল। “গথ” আর এইটা একসাথে পড়া হচ্ছে, এবং ইহা আগে শেষ হয়ে গেলো। রাইটারের মস্তিষ্ক আর তাঁর স্টোরিটেলিংয়ের প্রতি রীতিমতো আমার ঈর্ষা হচ্ছে।
এতো অদ্ভুত সুন্দর ব্যাপার এই শর্ট স্টোরির বইটায়—এবং মানসিক চাপ সমেত; ভীষণ অন্যরকম সব গল্প। আসলে এইটা শেষ হয়ে যাওয়াটাই একটা বিশাল দুঃখজনক ব্যাপার, যার পরিমাণ মাত্র ১১টা গল্প।
(সাইকোলজিকাল হরর অথবা ডার্ক ফ্যান্টাসিতে ঢুকানো যায় এগুলোকে, আর লেখকের টেস্ট সম্ভবত খারাপ লাগবেনা, বিশেষত যারা grotesque fantasy পছন্দ করে। হ্যাপি রিডিং!)
~March 10, 2022
যখন আপনাকে আগেই বলে দেয়া হয় কে খুনি, এবং তার খোঁজকারী কারা—এরকম মার্ডার মিস্ট্রি পড়ার অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি বিধায় অন্যরকম চাপা উত্তেজনা কাজ করছিলো (এবং আমি হত্যাকারীর পক্ষে থাকায় টেনশন আরো কাজ করছিলো, এটা আশা করতে যাতে সে না ধরা পড়ে!)
এটাকে সময় কাটানোর জন্য গড়পড়তার উপরেই ফেলা যায়, অর্থাৎ পড়ার জন্য যুতসই। কিন্তু আবারো এটা মাথায় রাখতে হবে এটার রোমাঞ্চ খুনি কে সেটা বের করায় নয় বরং খুনি-আর পুলিশের দৌড়ঝাঁপে কে শেষ পর্যন্ত হাসে সেটা আবিষ্কার করায়; সে হিসেবে বলা চলে থ্রিলার হিসেবে যথেষ্ট সাসপেন্সে ভরপুর (এবং একাধিক টুইস্ট বিদ্যমান)
জীবনানন্দের দু-দন্ড শান্তির মতোন কাব্যিক ফ্লেভার না হলেও অনেককাল পর হুমায়ূন আহমেদ, তাও বছরের শেষে সেমিস্টার ব্রেকে—প্রাগৈতিহাসিক সূখানুভব হইলো। সবচে এভারেজ বইগুলোর একটা ধরা যায় ইহা, তবে অধিকাংশ গল্প ( না কাহিনি?) ইন্ট্রেস্টিং বহুত।
১। হোটেল আহমেদিয়া দিয়ে শুরু করি, মেইনস্ট্রিম মুক্তিযুদ্ধের বয়ানের বাইরেও আমরা দেখতে পাই অনেক প্রো-পাকিস্তানিও এরকম ওয়ার-ক্রাইমের শিকার হয়েছিলেন (মুক্তিযোদ্ধা দল কর্তৃক হুমায়ূন আহমেদের নানার হত্যা) এবং লেখা হতে প্রাপ্ত অনুসিদ্ধান্ত: উক্ত সময়ে পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজনটা গ্রে এরিয়ার।
২। সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে ঘাঁটছিলাম এমন সময়েই “ইংলিশম্যান” লেখাটা পড়া হইলো, এবং সেজন্য পাগলদের সমন্ধে রহস্যযুক্ত কৌতূহল বৃদ্ধি পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়, তবে অনেক নাটকীয় করে লিখসেন লেখক, যেটার মেইন চরিত্রের সত্যতা নিয়ে একটু কনফিউজড।
৩। যেটার সত্যতা নিয়ে কনফিউজড নই, ইনি হলেন “সমুদ্রদর্শন” গল্পের ক্যারেক্টার, মোখলেসুর রহমান, ব্যক্তিটি বাস্তবে এক্সিস্ট করেন এবং কাহিনিটি বড়ই চমকপ্রদ।
বাকি স্টোরিস প্রায়শই “বিলো এভারেজ-হুমায়ূন আহমেদ টাইপ” চলে যেটা ম্যানশন না করলেও যুতসই, সেজন্য স্যাডনেস মিশ্রিত তিন-তারা।
ডিসেম্বর ২৬, ২০২৩।
জাসদ যেই পটভূমিতে জন্ম নিয়েছিলো, আর বাহাত্তর থেকে পচাত্তর অব্দি যেইসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তাতে দলটির জার্নি কে নিসন্দেহে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বলা যায়। দলটির উথান, বিস্তার আর পতন—সবটুকুন পিরিয়ডই বেশ বিতর্কিত আর হতাশামাখা।
.
লেখকের লেখার হাত বেশ ভালো, তেমন কোনো জটিল শব্দাবলীর সমাবেশ ছাড়াই, ঘটনাগুলোর পরম্পরা ক্রমানুসারে বর্ণনা করে গিয়েছেন, নিরপেক্ষ ভাইব রাখার চেষ্টা ছিলো যথাসাধ্য, সেটাও ধারণা করি। আমার মনেহয়, হাতেখড়ি হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে নলেজ গেদারিংয়ে, এই রাইটারের বইগুলোর কম্বিনেশন একটা গুড রেকমেন্ডেশন।
.
যতটুকুন আশার পারদ নিয়ে জাসদের জন্ম আর স্বপ্নমাখা বিপ্লবের কথা তারা জানাতো, সময়ের ধারাবাহিকতায় তাঁদের এরূপ অবস্থায় পৌছানোর পেছনে দায়ী কি বা কারা ছিলো—প্রশ্নটা অনেক বড়ো। বড়ো এই কোশ্চেনটির এ্যান্সারে, একটা নোট হিসেবে কাজ করবে বইটি।
~অগাস্ট ১, ২০২২।
" আসলে ভেবে কিংবা না ভেবে নেওয়া ছোট ছোট সিদ্ধান্তগুলোই আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে বেশি, যদিও আমরা আমাদের অল্পকালের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কি করবো-কি হবো, এসব ভেবেই পার করে দিই। "
সম্ভবত একুশ সালে পড়া আমার শেষ বই, তাও হুমায়ূন দিয়ে; স্টোরির শুরু হয়েছিলো বিষন্ন যাত্রাপথের কাহিনি দিয়ে, রূপা নামক একজন রহম্যময়ী নারী, আর উপন্যাস কথক, রঞ্জুর অদ্ভুত ফ্যামিলির নানা অভ্যন্তরীণ ঘটনার মিশেলে কাহিনি এগিয়ে যায়। আর যার শেষ হয়, রাত্রিকালিন বিষন্ন আরেকটি ভ্রমনের মধ্য দিয়ে।
বি.দ্র-১ঃ উপন্যাসের কথকের মুখস্থশক্তি অবশ্যি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, সে হৈমন্তী গল্প, আর তার বন্ধু সফিকের লেখা উপন্যাসের প্রথম পনেরো পাতা পুরোটা বলতে পারে।
বি.দ্র-২ঃ রঞ্জুর পুরো উপন্যাসে, ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠা জুড়ে, সুপ্ত আকাঙ্খা ছিলো একটা ক্লিন ফুলফিল মার্ডার করা, তার স্ত্রীকে; এবং উপন্যাসের শেষের দিকে রূপা অদ্ভুতভাবে উধাও হয়ে যায়; কেউ কিছু জানতে পারে না, কারো জীবনে কিছু প্রভাব পড়ে না। কারণ রন্জুর মার্ডারটা ছিলো...
বই পড়ার পরের এই সময়টুকুন আমার অনেক বিষন্নের, এমন বইটি শেষ হয়ে যাবার দুঃখে। বইয়ের কাহিনির আঙ্গিকে গেইস করা যায়, দুঃখ আপাতত প্রশমনের সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ।
ব্রেইনে এতো ওয়ার্ডসও আসতেসে না যে কিছু লিখা যাবে (রিভিউ বলবার মতোন), পুরো বইটিতেই একটু স্যাডনেস ছাড়ানো, আর মায়াময়টাইপ আবহ ক্যামন যেন; হয়তো সংলাপগুলোর কল্যাণে, কিংবা স্টোরির টেলিংয়ে। এটা অবশ্যি কিছুক্ষেত্রে সমস্যাজনক, কজ আপনাকে উপন্যাস পড়াকালীন পুরোটা সময়ই দুঃখসমেত মুড নিয়ে থাকতে হয়, সমস্যাটা আরো প্রকট হয়, তখন;— যখন আপনি উপলব্ধি করেন, বইটি আপনার সম্পূর্ণ পড়া শেষ, এবং এই কাহিনি আপনার কাছে পুনরায় আর অপরিচিত ঠেকবে না।
সুন্দর একটা স্টোরির সংখ্যা কমে যাওয়াটা নিশ্চয়ই দুঃখজনক, নাহ?
.
পুনশ্চঃ নন্দিত নরকের নাম আর প্রচ্ছদ, দুটোই গল্পের মতোনই অসাধারণ।
~July 31, 2022.
2020-2021 সালের ELEVEN-এ বাঙলা বিষয়ের সিলেবাসভূক্ত আছে, এই উপন্যাস—সেজন্যই পড়া। শখের নয়, বাধ্য হয়ে। প্রথমে খানিকটা বিরক্তি লাগলেও পরে কাহিনিতে ঢুকে গেলে মোটামুটি লাগবে। প্রথম পড়াটাই মজা। উপন্যাস টাইপ লাগছিলো, পরে যেহেতু কিউরোসিটি নাই, এমসিকিউ মার্ক করতে পড়া। অসম্ভব বোরিং ছিলো, তখন।
বাংলাদেশের গ্রামান্চল, এবং তা হতে উদ্বুদ্ধ জনগণের মানসিকতা, উইকনেস, সাইকোলজি হালকা ধরতে পারবেন। সেইসাথে টিপিক্যাল পির কালচারের একটা নমুনা আপনার সামনে লেখক দেখিয়েছেন। ভাষা খুবই সাবলীল, বাক্যগুলোও। কাহিনী ও পটভূমি পুরোটাই জুড়ে এক গ্রাম, একজন পির, একটা ধর্ম আর গ্রামের কিছু অতিসাধারণ বোকা জনগন, যারা প্রতিনিয়ত নানাজন কতৃক ম্যানুপুলেট হচ্ছে, যা তারা বুঝে না। আরেকটা ব্যপার, নানারকম খারাপের মাঝেও সবশেষে শুভবোধ জাগ্রত হওয়ার ব্যপারটাও বেশ ভালো।
১. ১৯৭১এ স্বাধীনতাকামী মজলুম বাঙালিদের উল্লেখ আমরা সর্বত্র পাই, স্কুলে পড়ানো বিশ্বপরিচয় বই হতে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া, সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত কনটেন্ট পর্যন্ত তাঁদের প্রতি হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ আর নির্যাতনের কথা ছড়িয়ে আছে; কিন্তু ওইসময় যারা আওয়ামীলীগের অপজিশন পার্টি করতেন, বিশেষত চীনপন্থী বাম আর ইসলামপন্থীরা; একাত্তর পূ্র্ব তেইশ বছরে যেসব অগনিত বিহারি আর মাগরেবে পাকিস্তানির আগমন ঘটেছিলো এই অঞ্চলে—বিভিন্নভাবে, অথবা নেহায়ত এখানে অবস্থানরত সিভিলিয়ান অবাঙালিগণ—এই নয়মাসে তাদের অবস্থা কেমন ছিলো? আমাদের সূর্যসন্তানেরা কি তাহাদের প্রতি যুদ্ধাপরাধের বদলা নিতে পাল্টা যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছিলো? নাকি পৌরানিক কাহিনির নিষ্পাপ দেবতাদের ন্যায় রোল প্লে করেছিলো?
গৃহযুদ্ধের মার্চের প্রথম আর শেষ ডিসেম্বরের কিছু ঘটনা, কিছু মাস কিলিং; যা আমাদের টেক্সটগুলোতে অবধারিতভাবে উহ্য থাকে, সেসব আমাদের জন্য কি খুব বেশি বিব্রতকর?
২. লেখিকার পলিটিক্যাল অবস্থান স্বভাবতই পাকিস্তানপন্থী; শর্মিলা বসু আমেরিকা হতে পাকিস্তানে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিক্রয়ের সমর্থকদের একজন ছিলেন। এই প্রজেক্টের ক্ষেত্রেও কিছু প্রশংসার পাশাপাশি ভারতীয়, বাংলাদেশি এবং একাত্তরে পূর্ব-পাকিস্তানে অবস্থানরত কতিপয় বিদেশি সাংবাদিকের সমালোচনা কুড়িয়েছেন তিনি।
বইয়ের বিবৃতিগুলোয় পাকিস্তানি মেজরদের বিবরনগুলোকে অধিকতর সত্যি এবং, কিছুক্ষেত্রে বাঙালি সাক্ষ্য/দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অনাস্থা প্রকাশের প্রবনতা ছিলো। বইতে বিশেষত উনি ফোকাস করেছেন কয়েকটি পয়েন্টে:
ক. মুক্তিযুদ্ধের সহিংসতা মূলত দুইপক্ষ থেকেই হয়েছিলো, পাকিস্তানিদের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারাও প্রো-পাকিস্তানি এবং নিরস্ত্র সিভিলিয়ানদের রক্তে রঞ্জিত।
খ. পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক ধ্বংসযজ্ঞ ও নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক কম, যার ভারতীয় ও বাংলাদেশি মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত প্রচারণা ঘটেছে (দেশদ্বয়ের রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য)
গ. লেখিকা পাকিস্তানের তৎকালীন পলিসি মেকারদের একটা জাষ্টিফিকেশন তৈরি করতে চেয়েছেন, বিশেষত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আর জেনারেল নিয়াজীর প্রতি।
ঘ. উগ্র জাতীয়তাবাদী মব, মুজিব-ভুট্টোর অসহিষ্ণুতা, এবং পঁচিশে মার্চ পরবর্তী সামরিক হস্তক্ষেপ : পাকিস্তান ভাঙনের মূল নিয়ামক।
৩. ইতিহাস মূলত অতীতে যা ঘটে সেটার বর্ণনা নয়, কজ সেটা আসলভাবে বর্ণনা করা সম্ভবও না, বরং কোনো ঘটনার একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিকে আপনি যেভাবে, যত প্রভাবশালীভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রচার করতে পারছেন, সেটাই হবে মেইনস্ট্রিম ইতিহাস; একাত্তরের স্মৃতি আমাদের কাছে যেরকম আবেগমাখা, অামাদের চারপাশে যারা গনবিরোধী ভূমিকা নিয়েছিলো একসময়, তাঁদের স্টোরিগুলো ভিন্নরকম, হয়তো পুরো বিপরীত তাদের যুক্তির জায়গাগুলোও; সেগুলো কতোটুকুন সত্যি-মিথ্যা তা তো আরও পড়াশোনা আর আপনার ক্রমবর্ধমান রুচি আর চাহিদা মাফিক কৌতূহলের ওপর নির্ভরশীল, তবু চিরায়ত স্টোরির বাইরে শুরু করার জন্যে এটা মন্দের ভালো বই।
-ডিসেম্বর ১৫, ২০২২।