চোন্দিল ভড়চাজের লেখাপত্তর সেই হাপ-প্যান্টুলুন বয়েস থেকেই আমার বেশ ভালো লাগে মাইরি। ভাষা নিয়ে ক্কি সুন্দর নিজস্ব একটা হুড়ুম দুড়ুম স্টাইল বার করেছে এই ম্যানটা। পোথোম যখন লেখালিখি শুরু করেছিলেন, তখন আমি কোয়াইট ইয়াং। লেখাগুলোর পোচুর ইনার মিনিং আউটার মিনিং আমার হেডের সাড়ে-বাইশ ইঞ্চি উপর দিয়ে বেরিয়ে যেতো। কিন্তু তবুও পড়তাম নিয়মিত। আশেপাশের সবাই তখন হাঁদাভোঁদা নন্টেফন্টে আর খুব বেশি হলে ফেলুদা শঙ্কু পড়তো। আমিও ওসব পড়তাম। চোন্দিলও পড়তাম। ল্যাটিন আমেরিকার হাপবয়েল গাঁজামার্কা উপন্যাসগুলোর সুনাম করলে ইদানিং যেমন, সবার মাঝে নিজেকে বেশ ইয়ে মনে হয়। আমাদের মফস্বল শহরে চোন্দিলের লেখার সুনাম করলে তখন সেইম ফিলিং হতো, চাদ্দিক কেমন “ওয়াও” লাগতো।
একজন গেল মাঠতার মাথায় আঁতেল ছাঁটকুকুর মেকুর রামের ঢেঁকুর পেরোচ্ছে সম্রাট।
চলে যাচ্ছে দিন, ঠিক পাঁচটা তিন, প্রায় অন্ধকার।বাসস্টপে কেউ নেই কোথাও...
এই শালা গোটা সভ্যতাটা উন্নতির নাম করে স্রেফ আলসেমির দিকে ঢলছে! যত পারে শালারা মেশিন বানায়। মশলা বাটবে কে? মেশিন। মুসুম্বির রস বের করবে কে? মেশিন। জাঙিয়া কাচবে কে? মেশিন। খবর নেবে কে? টেলিফোন। ফাইল গুছিয়ে রাখবে কে? কম্পিউটার। টাকা গুনবে কে? এটিএম। মড়া পোড়াবে কে? ইলেকট্রিক চুল্লি। আর তুমি শালা ঈশ্বরের দেওয়া ননীর তনুখানি নিয়ে কী করবে? আধশোয়া হয়ে চিপস খাবে আর সিরিয়াল গিলবে।
মেয়েদের ব্যাপারটা ঠিক জানি না, ছেলেদের অন্তত, হস্তমৈথুনের চেয়ে বড় বন্ধু এ পৃথিবীতে নেই। কেউ নেই, যে নিঃশর্ত আনন্দময় এক সম্ভাবনা নিয়ে সর্বক্ষণ সঙ্গে-সঙ্গে থাকে ও তুরীয় সুখ ডেলি প্রদান করে। সান্ত্বনা ও শুশ্রূষাও কিছু কম বিলোয় না। মা-বাবার চেয়ে অনেক নিশ্চিত আশ্রয় সন্তান নিজশিশ্নের কাছে পায়। যদিও, মা-বাপ তাকে ডেকে প্রবল কড়কাবার পর এবং “এসব করলে তুমি উইক হয়ে পড়বে, কোনো কাজ করতে পারবে না, ডাক্তারকাকুও বাঁচাতে পারবে না”, কিংবা “নোংরাস্য নোংরারাই এইসব করে ছি ছি ছি আমাদের ছেলে হয়ে তুমি ছিঃ চ্ছি ছিইইহ” ধমকি শোনার পর সে প্রতিজ্ঞা করে “আর নয় জীবনে নয় কক্ষনো এই পাপ নেহি!!”
পড়লে বগা ফান্দেহাত-পা ছুঁড়ে কান্দে,আরে বৌ চাই, মৌ চাই, ম্যাও চাই, ঘৌ চাই,খ্যামটায় ঘোমটায়, ঝিংচ্যাক ছৌ চাই,Sunday হো ইয়া Monday!কিনছে পালং শাকতাতে মাছের মাথা ঢাক,আরে ঢাকঢাক, গুড়গুড়তিন তাল, সাত সুরLove scene, obsceneদিনকাল কদ্দুরআয়নায় ঠকঠকখুললেই রোদ্দুরগোবরজলে ধুই!একের পিঠে দুইকাঁদিস কেন তুই?অরুণ বরুণ কিরণমালাচৌকি চেপে শুই।এসো চৌকি চেপে শুই!এসো চৌকি চেপে শুই?
মুন্সি প্রেমচন্দ, সাদত হাসান মান্টো, কৃশন চন্দর, রাজেন্দ্র সিং বেদি, ইসমত চুগতাই। উর্দু কথাসাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব। এঁদের মধ্যে শেষ তিনজনের প্রত্যেকের পাঁচটি করে, মোট পনেরোটি গল্প নিয়ে এই সংকলনটি তৈরি করা হয়েছে। “এক গধে কি আত্মকথা” বাদ দিয়ে কৃশন চন্দরের কিছুই পড়া ছিলো না আমার। বেদি এবং চুগতাইয়ের বিশিষ্ট কয়েকটা ছোটোগল্প ইংরিজি অনুবাদে এখানে-ওখানে পড়েছিলাম। গল্পগুলো পুনরায় বাংলা অনুবাদে পড়ার ইচ্ছে ছিলো। উর্দু গল্পভাণ্ডারকে ভালো করে পড়বার একটা ব্যক্তিগত প্রকল্প শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি সম্প্রতি। এই সংকলনটা দিয়ে সেই প্রকল্পের সূচনা করেছিলাম। কিন্তু কপাল মন্দ, পড়ে শেষ করতে পারলাম না (তিরিশ পৃষ্ঠা বাকি রইলো)।
জঘন্য যাচ্ছেতাই অনুবাদ! ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এরকম উন্মাদের মতো অনুবাদকে ছাড়পত্র দিলো কীভাবে? বইটা এতগুলো মুদ্রণসৌভাগ্য (আমারটা ২০০৯ সালে প্রকাশিত। ২০০৯ সালেই সপ্তম মুদ্রণ। এখন তো আরো বেশি হওয়ার কথা!) অর্জন করলো কীভাবে? মা দুর্গা জানেন!
এবার স্থির করেছি, উর্দু লেখকদের আলাদা আলাদা গল্পসংকলন পড়বো। প্রেমচন্দের আলাদা, মান্টোর আলাদা, চুগতাইয়ের আলাদা, এরকম। ভবিষ্যতে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের বাংলা অনুবাদ পড়ার আগে ভালো করে (১০৮ বার) রামনাম জপ করে নেবো। এরকম অশৈলী অনুবাদ পড়লে মাঝরাত্তিরে হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার জোগাড় হয়!
এই বইটার কথা বাদ দেওয়া যাক। উর্দু সাহিত্যের এই বিখ্যাত গল্পগুলো অন্য কোনো বই থেকে আরেকবার পড়ার পরে, ভবিষ্যতে বিশদে আলোচনা করার ইচ্ছে রইলো।
“তমস” শব্দের অর্থ হলো নিকষ অন্ধকার। মানুষের মনের অন্ধকার। যে-সমাজে মানুষ বসবাস করে সেই সমাজের অন্ধকার।
এমনিতে বলা হয়, মানুষ নাকি সামাজিক প্রাণী। সৌভাতৃত্ব, সামাজিকতা, সহানুভূতি, সাম্য, সহযোগিতা, সম্প্রীতি— এরকম অনেক শব্দ তুলসীপাতার মতো ধুয়ে ধুয়ে রাখা হয়। কিন্তু এই শব্দগুলো এতোটাই ঠুনকো যে সামান্য অভিঘাতেই এরা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এই শব্দগুলো নিয়ে মানুষ যখন বড় বড় বাতচিত করে, আড়ালে দাঁড়িয়ে ইতিহাস মুচকি মুচকি হাসে।
উপমহাদেশের ইতিহাসে দেশভাগ শুধু যে একটা দুঃখজনক ঘটনা ছিলো তা-ই নয়, এটা ছিলো একটা হতবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা। দীর্ঘদিন-যাবৎ পাশাপাশি বসবাস করা শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশীরা যখন পরস্পরকে বুভুক্ষু শেয়াল-কুকুরের মতো আক্রমণ করে, শুধুমাত্র আরেকটা ঠুনকো শব্দের দোহাই দিয়ে, যে-শব্দটার নাম “ধর্ম”, তখন হতবাক হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না।
এমনিতে তো ধর্মের উপকারিতা, ধর্মের শক্তি, ধর্মের কল্যাণ, ধর্মের উপযোগিতার খুব একটা প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু দেশভাগের মতো ঘটনায় বেশ বুঝতে পারা গেছিলো, হ্যাঁ... হেব্বি পাওয়ারফুল জিনিস বটে ধর্ম!
ভীষ্ম সাহনির এই আইকনিক হিন্দি উপন্যাসটি খুব সোজাসাপটা ভঙ্গিতে রচিত। ঘটনাস্থল : অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশের একটি ছোটো শহর। আসন্ন দেশভাগের প্রেক্ষাপটে ঘটমান সাম্প্রদায়িক-দাঙ্গার বিভৎসতায়, মানুষের পাশবিকতায়, তিনি দার্শনিকতা কিংবা কার্যকারণসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেননি। শুধুই নির্বিকার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। এই নিস্পৃহ শৈলীই বোধহয় এই উপন্যাসটি জনপ্রিয় হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। এই উপন্যাসের আরো একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, লেখক কোনো একটি বিশেষ পক্ষ অবলম্বন করেননি।
নিকষ অন্ধকারে সব পক্ষের মুখই তমসাবৃত হয়ে যায়। যাদের নিয়ে কাহিনি রচিত হয় তাদের মুখ। যিনি সেই কাহিনি রচনা করেন তাঁর মুখ। যারা সেই কাহিনি পাঠ করেন, সেই পাঠকদের মুখও। সব্বার মুখ। দেশভাগ বিষয়ে যেকোনো ভাষায় লেখা বইয়ের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পঠিত এবং আলোচিত উপন্যাস এটি। পরিচালক গোবিন্দ নিহালানি একটি চমৎকার টেলিফিল্মও তৈরি করেছিলেন এই উপন্যাসের গল্পকে অবলম্বন করে। মূল হিন্দি থেকে উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অবশ্যপাঠ্য একটি উপন্যাসের সাবলীল অনুবাদ!
একটা বিশেষ দরকারে এই বইটা খুঁটিয়ে পড়তে হয়েছিল। সেই কাজ মিটেছে, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত জীবনে বইটার প্রয়োজন খারিজ হয়ে যায়নি। শুধু আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে নয়, বোধহয় পৃথিবীর কোনো দেশেই ইশকুলের পড়াশুনায় মনোবিদ্যা সংক্রান্ত কিছুই শেখানো হয়না। অথচ শেখানো উচিত। ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, বিজ্ঞানের মতোই বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই ছেলেমেয়েদের মনোবিদ্যার পাঠ দেওয়াটা যত দিন যাচ্ছে তত বেশি জরুরি হয়ে উঠছে। “নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না!”
মানুষের মন তো ব্রহ্মাণ্ডের মতো রহস্যময়। বিষয় হিসেবে বিজ্ঞানের অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত শাখার তুলনায় সাইকোলজি এখনও বেশ পিছিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন তত্ত্ব এবং মতামতের পারস্পরিক বাদানুবাদের এখনও মীমাংসা হয়নি। কিন্তু মনোবিদ্যা যে আসলে আজগুবি ভেল্কিবাজির চর্চা নয় (যেমনটা আজ থেকে শ'খানেক বছর আগেও মনে করা হতো), বাকি সব বিজ্ঞান-বিষয়ের মতোই এই বিষয়ের সিদ্ধান্তগুলোকে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এই ব্যাপারটা আজকের দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিষয় হিসেবে মনোবিদ্যা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। কতো কিসিমের মানুষই না আছে এই পৃথিবীতে। আর তাদের কতো কিসিমের মন। অন্য মানুষের কথা বাদ দিলাম, আমার নিজের মনের ভিতরেই কতোরকমের টানাপোড়েন, বৈসাদৃশ্য, বৈপরীত্য, পাগলামি, দুর্বোধ্যতা, দ্বিচারিতা। মাঝে মাঝে মনে হয়, অন্যকে চিনবো কীভাবে, নিজেকেই তো ভালোভাবে চিনতে পারলাম না এখনও। আমি নিজেই নিজের কাছে সবচেয়ে বেশি অচেনা। মানুষের মনের পাকদন্ডীর এই জটিল রুটম্যাপকে মনোবিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে কব্জা করার চেষ্টা করছেন। খুব সামান্যই পেরেছেন, কিন্তু যতটুকু পেরেছেন, তাতেই আশ্চর্য হতে হয়!
কেউ যদি আধুনিক মনোবিদ্যার প্রাথমিক ধারণা এবং সমকালীন অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চায়, চমৎকার প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা এই বইটা তাদের খুব কাজে লাগবে। এই বই পড়ার পরে সত্যি সত্যি আমার মনে হয়েছে, ইশ আগে যদি টের পেতাম, দরকার হলে বাড়িতে ঝগড়া করে হলেও এই বিষয়টা নিয়েই পড়াশুনা করতাম। অবশ্য ঝগড়া করেও কোনো লাভ হতো না। চিৎকার চ্যাঁচামেচি তো করেছিলাম যথেষ্ট
প্রথমেই স্বীকার্য, গত কুড়ি বছরে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্য আমি খুব বেশি পড়িনি। তাই সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের হালচাল আমি খুব ভালো জানিনা। পূজাবার্ষিকীর কল্যাণে আগে নিয়মিত সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাণী বসু কিংবা সুনীল-শীর্ষেন্দু পড়তাম। কে জানতো, এইসকল আনন্দবাজারীয় ধনুর্ধরদের পাশাপাশি, আমার মতো অনেক বে-খবর পাঠকের অগোচরে, অসামান্য সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন দু-একজন প্রতিভাবান সাহিত্যিক। এদের মধ্যে স্বপ্নময় চক্রবর্তী, খুব সম্ভবত, সৃষ্টির উৎকর্ষতার দিক দিয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন।
স্বপ্নময়কে আমি চিনতাম মূলত ছোটোগল্পের লেখক হিসেবে। একটাই উপন্যাস পড়েছিলাম, “চতুষ্পাঠী”— এবং পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সাপ্তাহিক “রোববার” পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার সময়ে “হলদে গোলাপ” উপন্যাসটি বিচ্ছিন্নভাবে পড়তে গিয়ে বুঝেছি, বৃহৎ আকারের উপন্যাস রচনাতেও স্বপ্নময়ের কব্জি যথেষ্ট চওড়া। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে “হলদে গোলাপ” একটি মাইলস্টোন। কিন্তু স্বপ্নময়ের ম্যাগনাম ওপাস যদি বলতে হয়, আমার মতে “হলদে গোলাপ” নয়, সেটা অবশ্যই “জলের উপর পানি”।
আমরা যখন কোনো মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশি, সেই মানুষটার একটা মানসিক অবয়ব তৈরি হয় আমাদের মনে। সেই মানুষটার ব্যাপারে একটা ধারণা তৈরি করি আমরা। তার সঙ্গে নিজের পছন্দ-অপছন্দ সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা করি। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়। ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনার আদানপ্রদান করার পরিসর তৈরি হয়। কিন্তু একদিন যদি হঠাৎ বুঝতে পারি, মানুষটিকে যেমনটা চিনতাম সে আদৌ সেরকম নয়। একদিন যদি মনে হয়, কে এই মানুষটা? এর সঙ্গেই কি মিশেছি এতদিন! আয়না ভেঙে গিয়ে প্রতিচ্ছবি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের চেতনার উতরাই সিঁড়িতে।
ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষরা যখন তাদের আজন্মের বাসভূমি ত্যাগ করে নতুন দেশে পদার্পণ করে, তাদের মনে অনেকটা একইরকম চিন্তার উদয় হয়। বহুদিনের পরিচিত ভূখণ্ডের যে-প্রতিচ্ছবি তারা হৃদয়ে লালন করে এসেছে জন্মাবধি, সেটা ভেঙে ছত্রখান হয়ে যায়। নিজের পুরাতন জগৎকে মনে হয় স্বপ্ন। নিজের সত্তাকে মনে হয় অচেনা। অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকা একটা সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে সে ভাবতে থাকে, যা চিনেছি যা বুঝেছি যা দেখেছি যা মেনে এসেছি এতদিন, সবই কি তবে ভ্রম? সবই কি ভুল? সাঁকোর দুলুনি ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
দেশভাগ এবং উদ্বাস্তুজীবন নিয়ে কথকতা বাংলা সাহিত্যে অসংখ্যবার করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অতি সমৃদ্ধ একটা অংশ জুড়ে রয়েছে অগণিত ছিন্নমূল মানুষের অশ্রুবাষ্প, বিষাদকুয়াশা। পঁচাত্তর বছর পূর্বের দেশভাগের ক্ষতচিহ্ন আজও রয়ে গেছে বাঙালিজাতির সম্মিলিত মননে। তাই সমাজসচেতন কথাসাহিত্যিক এতযুগ পরেও দেশভাগের বিপন্নতার মধ্যে থেকে খুঁজে নেন তাঁর উপন্যাসের রসদ, তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা। এই উপন্যাসটি লেখার জন্যে যে-বিশদ গবেষণা করেছেন স্বপ্নময়, দুই বাংলা ব্যাপী যে-বর্ণময় পটভূমির বিস্তার করেছেন, তা আমাকে বিস্মিত করেছে। “মুগ্ধ করেছে” বলতে পারতাম, কিন্তু যন্ত্রণার কোরাকাগজে মুগ্ধতার জলছাপ ফুটে ওঠেনা।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা অদৃষ্টের হস্তক্ষেপে দেশভাগ হয়নি। দেশভাগ হয়েছিলো মুষ্টিমেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সীমাহীন অপদার্থতার কারণে। দেশভাগ বিষয়ক কিছু পড়তে গেলে আমি খুব অবাক হই। ঈশ্বর নাকি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। ঈশ্বরের ক্ষমতা কি মানুষের চেয়েও বেশি? ঈশ্বর কি পারেন নিজের অহংকে তৃপ্ত করার উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে? ঈশ্বর কি পারেন ধর্মের নামে মানুষের পশুপ্রবৃত্তির বগলে সুড়সুড়ি দিতে? আমার মস্তিষ্কে দামামার মতো বাজতে থাকে— এই দেশভাগ হওয়ার কথা ছিলো না। এই দেশভাগ আটকানো সম্ভব ছিলো। খুব নিশ্চিতভাবে সম্ভব ছিলো। সত্যিই কি সম্ভব ছিলো?
হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং একাত্মবোধ নিয়ে কতো ভাবনা ছড়িয়ে আছে। মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ। স্বাধীনতাপূর্ব অবিভক্ত বাংলাদেশের আর্থসমাজব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্কের যা-কিছু বিবরণ আমি শুনেছি/ পড়েছি, তার পরে এই ধরণের ছড়াকে ছেলেভুলানো ছড়া বলে মনে হয়। যদি একই বৃন্তে দুটি কুসুম হতো, তবে মুসলমানদের খেতে দেওয়ার জন্যে আলাদা থালা-বাটি-গ্লাসের ব্যবস্থা রাখতে হতো না। আলাদা হুঁকো-তামাকের ব্যবস্থা রাখতে হতো না। একে অপরের অন্দরমহলে অবাধ প্রবেশ করার “অধিকার” থাকতো। উঠোনে দাঁড়ালে সেই মাটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ফেলে দেওয়া হতো না। এই চূড়ান্ত অপমানজনক সহাবস্থান যখন দীর্ঘদিন যাবৎ চলতে থাকে, এবং সেই সঞ্চিত অপমানরাশি যদি একদিন ভিসুভিয়াসের মতো লাভা উদগীরণ করে, তবে কাকে দায়ী করবো? মানুষকে? রাজনীতিবিশারদকে? নাকি স্বয়ং ঈশ্বরকে?
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর এই উপন্যাসের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি অনেক অপ্রিয় সত্যিকথাকে পরিত্যক্ত কুয়োর গভীর থেকে উঠিয়ে এনেছেন। দেশভাগ-বিষয়ক সাহিত্যের স্বাভাবিক রোমান্টিসিজমকে বজায় রেখেও তিনি উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বুনে দিয়েছেন তিক্ত প্রশ্নের বীজ। মানুষ মানুষের সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করেনি। মানুষই তৈরি করেছে মানুষের নিয়তি। সেই নিয়তির কুঠারের আঘাতে মানুষ হারিয়েছে নিজের প্রাণ, নিজের প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মসম্মান, মনুষ্যত্ব, মান ইজ্জত, ভিটে মাটি, পুকুর দীঘি, দীঘির জলে প্রতিবিম্বিত আকাশের চাঁদ, ভোরের পাখির কূজন, বিকেলের চন্দনচর্চিত হাওয়া, সন্ধ্যার নিবিড় কুহেলিকা, একত্রে মিশে যাওয়া শঙ্খের ধ্বনি আর আজানের আহ্বান। নির্নিমেষ স্তব্ধতা।
লাল জামা গায়ে নীল জামা গায়ে
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রঙ বদলায়
দিন বদলায় না।
বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধগুলোকে তাঁরই লেখা অন্য একটি বইয়ের নাম অনুসরণ করে বলতে ইচ্ছে করে— হঠাৎ আলোর ঝলকানি! কিংবা “অবিরাম আলোর ঝলকানি” বললেও ক্ষতি নেই। একজন কবি যখন গদ্য লেখেন, কবি-মননের স্বভাবসিদ্ধ কাব্যিক ইঙ্গিতময়তা এসে আশ্রয় নেয় সেই গদ্যে। এইরকম কাব্যগন্ধী গদ্যকে প্রায়শই আমি উপভোগ করতে পারিনা। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হয়েও বুদ্ধদেব বসু এই “দোষে” দুষ্ট নন। তাঁর গদ্য আশ্চর্যরকম সাবলীল। খাঁটি প্রত্যক্ষ গদ্য। শুধুই গদ্য।
আলোচ্য সংকলনটিতে সবমিলিয়ে আটটি প্রবন্ধ রয়েছে। আলোচনায় প্রবেশ করার আগে বলে নিই, বুদ্ধদেবের প্রবন্ধকে “হঠাৎ আলোর ঝলকানি” বললাম ক্যানো। যেকোনো ভালো প্রবন্ধে দুরকম বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। গদ্যভাষার বলিষ্ঠ রম্যময়তা, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সৈয়দ মুজতবা আলির প্রবন্ধ। আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো, বিষয়বস্তুর বিদগ্ধ উজ্জ্বল বিশ্লেষণ, যার উদাহরণ... ধরা যাক অম্লান দত্ত। (এখানে বারবার “রম্য” শব্দটা ব্যবহার করছি, কিন্তু তাই বলে, ইয়ে, সঞ্জীব চাটুজ্যেমার্কা “কৃত্রিম ছদ্মপ্রাজ্ঞ ছ্যাবলামি” অর্থে ব্যবহার করছি না। এখানে রম্য মানে ভাষা ও ভাবের অকৃত্রিম সাবলীলতা/ সর্বজনীনতা।) একইসঙ্গে রম্য ভাষার ব্যবহার করেছেন এবং উদার বিশ্লেষণ করেছেন এরকম প্রবন্ধলেখকের সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ, আমার মতে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধে অতিরিক্ত যেটা আছে সেটা হলো, ভাষাপ্রয়োগের আশ্চর্য বনেদিয়ানা। বাংলা শব্দের উৎকৃষ্টতম প্রয়োগ। এবং হঠাৎ হঠাৎ আইডিয়ার ঝিলিকে পাঠককে চমৎকৃত করবার পারদর্শিতা। হঠাৎ আলোর ঝলকানি !
প্রতিটি প্রবন্ধ নিয়েই অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করছে। সেটা তো সম্ভব নয়। অল্প কিছু বলি। মূল সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণ (কিংবা সেটির বঙ্গানুবাদ) পড়েননি বুদ্ধদেব বসু। আমি যতোটুকু পড়েছি, তিনিও ততোটুকুই পড়েছেন। অর্থাৎ, উপেন্দ্রকিশোরের শিশুতোষ রামায়ণ, কৃত্তিবাসের “বাঙালি” রামায়ণ এবং রাজশেখর বসুর সারানুবাদ। সংকলনের প্রথম প্রবন্ধে (“রামায়ণ”), আরো অনেক প্রসঙ্গের পাশাপাশি, বহুলচর্চিত একটি বিতর্ককে নিজস্ব আঙ্গিকে দেখতে চেয়েছেন বুদ্ধদেব। বিষয়টি হলো, রামায়ণের রামচন্দ্র কি আসলেই একজন আদর্শ মানবচরিত্রের উদাহরণ? “যে-রামের নাম করলে ভূত ভাগে, সেই রাম নিষ্ঠুর অন্যায় করেছেন একাধিকবার।” ক্যানো করেছেন এইসব অন্যায় কাজ? বাজে লোক ছিলেন বলে? নাকি অন্য কোনোভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে রামচন্দ্রের নিষ্ঠুরতাকে? চমৎকার এই প্রবন্ধটি পড়ে খুব খুব আনন্দ লাভ করেছি। রামায়ণ বিষয়ে এমন দারুন প্রবন্ধ বাংলায় খুব বেশি নেই।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের “কীর্তি” বিষয়ক। এই প্রবন্ধেও ঝলসে উঠেছে বুদ্ধদেবের শাণিত যুক্তির তরোয়াল। এখানেও তিনি একটি সুপ্রাচীন ধারণাকে বিকল্প আঙ্গিকে পরখ করে দেখাতে চেয়েছেন। ধারণাটি হলো, মাইকেল তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্যে রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাইয়ের চেয়েও রাবণ-মেঘনাদ দুই বাপ-ব্যাটাকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। সত্যিই কি তাঁদের প্রাধান্য দিয়েছেন? সত্যিই মাইকেল বাংলা কাব্যের জগতে বৈপ্লবিক কাজ করেছিলেন? নাকি আমরা তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছি? এই প্রবন্ধে জানতে পারি, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একবার সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, প্রাচীন বাংলা সাহিত্য সাধারণত অপাঠ্য! (এর চেয়ে সত্যি কথা জগতে আর ক'টা আছে?) বুদ্ধদেবও প্রায় একইরকম সাহসী মন্তব্য করেছেন : “মাইকেল বাংলা জানতেন না”। এইসব কী শুনছি, অ্যাঁ?
“বাংলা শিশুসাহিত্য” প্রবন্ধটি সম্ভবত বাংলা শিশুসাহিত্য বিষয়ক আমার পড়া সবচেয়ে দুর্দান্ত প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধেও রয়েছে হঠাৎ হঠাৎ ছিটকে আসা আইডিয়ার আলোর ঝলকানি। দেখতে পাচ্ছি, সে-ই ১৯৫২ সালেই তিনি লীলা মজুমদারকে বাংলাভাষার প্রতিনিধিস্থানীয় শিশুসাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন! একই সঙ্গে স্পষ্ট বুঝিয়ে বলেছেন, বাচ্চাদের জন্যে সাহিত্য রচনা করা যার-তার কাজ নয়। এমনকি রবীন্দ্রনাথও পারেননি (অথচ অবনীন্দ্রনাথ পেরেছেন)। একজায়গায় লিখেছেন : “বাংলা দেশে এত বড়ো দুর্ঘটনাও ঘটেছিলো যে ‘আবোল তাবোল' অনেক বছর ছাপা ছিলো না!” পরপর তিনবার পড়লাম বাক্যটা। খানিক বাদে আবার পৃষ্ঠা উল্টে ফিরে এসে পড়লাম। আরো অনেকবার পড়লাম। বারবার ফিরে ফিরে আসতে হলো এই বাক্যটার কাছে।
এই সেরেচে, রিভিউ তো গড়গড়িয়ে লম্বা হয়ে যাচ্চে! আচ্ছা এবার সংক্ষেপে সারছি। রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী কারা? বিশেষত কবি রবীন্দ্রনাথের? রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন, তখন তাঁর আশেপাশে বলবার মতো বাঙালি কবির নাম একটাও ছিলো না। নিজে হাতে ইট পুড়িয়ে, বালি-সিমেন্ট মেখে, মজদুরি করে তিনি দাঁড় করিয়েছেন বাংলা কবিতার ভিত্তিমূল। তারপর? “রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক” নামের প্রবন্ধে দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথ নামক একদা আকস্মিক বজ্রপাত কীভাবে আজকে বাংলা কবিতার রক্তমাংসে মিশে গেছেন। তিনি সবকিছুতেই আছেন, থেকেও আছেন, না-থেকেও আছেন। “রবীন্দ্র-জীবনী ও রবীন্দ্র-সমালোচনা” নামের আরেকটি প্রবন্ধ পড়ে বুঝতে পারলাম, আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের একটাও ভালো জীবনী লেখা সম্ভব হলোনা ক্যানো! রবীন্দ্রনাথ নাকি নিজেই এর জন্যে দায়ী!
যারা ছন্দের ব্যাকরণ বিষয়ে জানেন না, তাদের কাছে “বাংলা ছন্দ” প্রবন্ধটি বিরক্তিকর মনে হতে পারে। সংকলনের এই একটি প্রবন্ধ আমার মতো আমজনতার জন্যে নয়। খুবই টেকনিক্যাল। কিন্তু সংকলনের শেষ দুটি প্রবন্ধ শেষপাতে ক্ষীরের চমচমের মতো (আমার ক্ষীরের চমচম পছন্দ তাই এটার নাম লিখলাম, আপনারা নিজের নিজের পছন্দের নাম বসিয়ে নিতে পারেন)। “সাংবাদিকতা, ইতিহাস, সাহিত্য” নামের প্রবন্ধে বুদ্ধদেব দেখিয়েছেন, ইনফরমেশন-সর্বস্ব আজকের এই জমানায় সাহিত্যের মধ্যেও পাঠক “ইনফরমেশন” খুঁজে চলেছেন। “সংবাদ” খুঁজে চলেছেন। “অমুক রচনাটি আজও প্রাসঙ্গিক”— নিজস্ব দেশকালের সঙ্গে তাৎক্ষণিক প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে চলেছেন। অসামান্য এই প্রবন্ধটির একদম শেষদিকে চোখে পড়লো সুগভীর একটি বাক্য : “ঠিক ততটুকুই আমরা উচ্চারণের অধিকারী, যতটুকু আমাদের উপলব্ধি, আর অধিকার অতিক্রম করবার প্রলোভন ত্যাগ করতে করতেই উপলব্ধির পরিধি বাড়ে।”
বইয়ের অন্তিম প্রবন্ধ “শিল্পীর স্বাধীনতা”-তে বুদ্ধদেব বসু একটি চমৎকার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে। কোনও আদর্শ কিংবা মতবাদের ছাতার তলায় না এসেও, লাল নীল গেরুয়া কিংবা সবুজ রঙের পতাকা দিয়ে নিজের সত্তাকে মুড়ে না-ফেলেও, একজন শিল্পী নিজেকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন? সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ! — সকল পপুলার এবং ফেমাস রং ত্যাগ করে আমার যেটা রং, সেই রঙে নিজেকে রাঙাও। সংস্কৃত শ্লোকটা পড়ে প্রথমে মনে হয়, এই “আমি”টা হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাঁকে অনুসরণ করতে। ভুল কথা! এই আমিটা তো আসলে আমি নিজেই। আমার পতাকার রং হবে আমার নিজের পছন্দের। সবচেয়ে ভালো হয়, এইসব পতাকা-ফতাকার ঝামেলাই না থাকলে!
.
যে-কোনো বড়ো শহরের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সেই শহরের একাকীত্ব। শহরের একাকীত্ব মানে সেই শহরের মানুষের একাকীত্ব। যে শহরে যত বেশি মানুষ, সেই শহর তত বেশি একলা। সেইসব গণনাতীত মানুষের পরিত্যাগ করা কার্বন ডাইঅক্সাইডে ভরে ওঠে শহরের ছালওঠা ময়দান, ত্বকচর্চাহীন পিচের রাস্তা, প্লাস্টিক আলো আর আসবাবের কিউবিজমে ডুবে থাকা শহরের কাফে রেস্টুরেন্ট শুঁড়িখানা সিনেমাঘর, এবং চৌকো আয়ত ত্রিকোণ গোল লম্বা বেঁটে হাজার হাজার হাজার হাজার হাজার হাজার বাসাবাড়ি। মানুষের ফেলে দেওয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস উড়ে আসে মানুষেরই ঘরের ভিতরে।বড়ো শহরের এই চরিত্র আমি প্রথম চিনতে পেরেছিলাম কলেজজীবনে হোস্টেলে থাকার সময়। হোস্টেলও একরকম সরাইখানা বটে। পার্থক্য শুধু, সরাইখানার মতো রোজ রোজ মানুষের মুখ পাল্টে যায় না হোস্টেলে। কিন্তু সেই একইরকম চিৎকার হুজ্জতি লৌন্ডা বদনাম হুয়া লৌন্ডিয়া তেরে লিয়ে জন বন জোভি ব্রায়ান অ্যাডামস খেউড় খিস্তি আব্বে চুতিয়া বেটিচোদ হাহাহাহাহাহা হা��ির দমক সিগারেটের ধোঁয়া মৃত বিয়ারের বোতল বিকল হয়ে যাওয়া বেসিনের জলে ভেসে যাচ্ছে বারোয়ারি বাথরুমের নোংরা মেঝে ঘরের দেয়ালে টাঙানো স্বামী বিবেকানন্দ এবং ভগবান তিরুপতির পরিপাটি বাঁধানো ছবির ঠিক পাশেই পোস্টারে ঝুলে আছে প্যামেলা অ্যান্ডারসনের সাহসী পশ্চাৎদেশ।একটা বইয়ের দোকানে নিয়মিত যেতাম, সেখানেই পৃষ্ঠা উল্টে প্রথম দেখেছিলাম এডোয়ার্ড হপার-এর আঁকা ছবি (যে বইটার রিভিউ লিখছি, এটাই সেই বইটা, অনেকদিন পরে কিনেছিলাম)। মূল্যবান বইয়ের মসৃণ পৃষ্ঠাগুলো ভিজে আছে একাকীত্বের আর্দ্রতায়। বড়ো শহরের জ্যামিতিক একাকীত্ব। শিল্পী হিসেবে হপারকে “reverse-প্রথাভঙ্গকারী” বলা যেতে পারে। শিল্পীসুলভ উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন না তিনি। বোহেমিয়ান ছিলেন না। যাঁকে বিয়ে করেছিলেন তাঁর সঙ্গেই সারাজীবন কাটিয়েছেন, একটাও গুপ্ত প্রেমিকার অস্তিত্ব নেই তাঁর জীবনে। কথাবার্তায় ছিলেন অশিল্পীসুলভ মৃদুভাষী। তাঁর জীবন নিয়ে বায়োপিক তৈরি করলে সেই সিনেমা অবধারিত ফ্লপ হবে। সমকালীন সকল শিল্পতত্ত্ব, অমুক ইজম তমুক ইজম, সবরকম প্রাসঙ্গিক ইজমকে এড়িয়ে গেছেন তিনি। কোনো বিদ্রোহ নেই, কোনো তত্ত্বের প্রচার নেই, কিংবা সমাজকে তাচ্ছিল্য কিংবা আঘাত করার প্রবণতা নেই। শিল্পী ছিলেন? নাকি শিল্পীবেশী অহিংস কেরানি ছিলেন তিনি?তিরিশ/চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক দুর্দশাগ্রস্ত বিশ্বে, পিকাসো যখন আঁকছেন “গের্নিকা”, সালভাদর দালি আঁকছেন “দা পার্সিস্টেন্স অফ মেমোরি”, পল ক্লি আঁকছেন “অ্যাড পারনাসাম”, মার্ক শাগাল আঁকছেন “দা চেলিস্ট “, ফ্রিদা কাহলো আঁকছেন জাদুবাস্তবিক আত্মপ্রতিকৃতি, সেই সময় এডোয়ার্ড হপার তেলরঙের বাটিতে প্রশান্ত তুলি ডুবিয়ে নিশ্চুপে ফুটিয়ে তুলছেন একাকীত্বের বাস্তবসম্মত চিত্রভাষ্য। তাঁর ছবির ভাষায়, রঙে, রেখায়, সমসাময়িক শৈল্পিক ভাঙাগড়া, উন্মত্ততার ছিঁটেফোঁটা নেই। (বোধহয় সেই কারণেই ই. এইচ. গমব্রিচের বিখ্যাত The Story of Art বইতে একবারের জন্যেও হপারের নামের উল্লেখ নেই!) আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনের টুকরো টুকরো মুহূর্তকে, প্রতিবিম্বের মতো, নির্বিকার রিয়ালিস্ট ভঙ্গিমায় এঁকেছেন একটার পর একটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব (এবং তার পরেরও) আমেরিকান জীবনের একাকীত্বের সেই শুকনো ফুলের গন্ধ আমি আজকে ২০২৩ সালের জানুয়ারির দু-তারিখ সোমবার সকালবেলাতেও পাচ্ছি।তাঁর ছবির মেলানকলিক চরিত্ররা কেউ গাড়িতে গ্যাস ভরছে ফাঁকা গ্যাসস্টেশনে, কেউ একলা বসে আছে মোটেলের বিছানায়, অফিসে একা বসে কাজ করছে, সেলাই করছে একা, থিয়েটার দেখছে একা, রেস্টুরেন্টে কফি খাচ্ছে একা, বই পড়ছে একা। এমনকি চরিত্র যখন একাধিক, তখনও তারা চুপচাপ। নিজেদের মধ্যে একা। হপারের এই অদ্ভুত একলা বিশ্বে ছবির দর্শক হিসেবে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি নিজেদের একলা আত্মাকে। তাঁর ছবিকে নিখুঁত আয়না হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আমার খুব প্রিয় একটা ছোটোগল্পের সংকলন, [b:The Oxford Book of American Short Stories 13689875 The Oxford Book of American Short Stories Joyce Carol Oates https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1346004335l/13689875.SY75.jpg 1270467], যেটি সম্পাদনা করেছেন আরেকজন বিখ্যাত গল্পলেখক জয়েস ক্যারল ওটস, সেই বইটা যখন কিনলাম, দেখলাম প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে হপারেরই আঁকা একটা ছবি। হঠাৎ অনুভব করলাম, এডোয়ার্ড হপার তাঁর প্রত্যেক ছবিতে, ছবির দৃশ্যবস্তুর পাশাপাশি, খুব সন্তর্পণে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন নিশ্চুপ নিরিবিলি একেকটা গল্প। খুব মৃদু গলায় কথা বলছে তাঁর সেইসব গল্পের চরিত্ররা? কী কথা বলছে? কে জানে!(“সামার ইভনিং”, ১৯৪৭, ক্যানভাসে তেলরং)
হ্যাডলি চেইজ পড়িনি কখনও। এই বইটার নাম শুনেছিলাম কোথাও। রেলস্টেশনে দেখতে পেয়ে কিনলাম। কিন্তু খুব বেশি পড়ার সুযোগ পাইনি সেদিন। একটা গুরুগম্ভীর বই নিয়ে বসেছিলাম আজকে দুপুরবেলা। কিন্তু পাড়ার দুর্গাপূজার মণ্ডপ থেকে ভেসে আসা বাজনার আওয়াজে সেই বই পড়া ভন্ডুল হয়ে গ্যালো। গুরুগম্ভীর বই বন্ধ রেখে এটা পড়লাম।
প্রবল ঢাকের আওয়াজ, মাইকে লতা মঙ্গেশকরের আওয়াজ সত্ত্বেও বইটা দিব্যি শেষ করতে পারলাম। এই জন্যে একটা তারা। শেষ দশ পৃষ্ঠার আগে পর্যন্ত রীতিমত টেনে ধরে রেখেছিলো গল্পের রহস্য। সেই জন্যে আরেকটা তারা। আর কোনোদিন পড়বো হ্যাডলি চেইজ? না। এটা উপলব্ধি করানোর জন্যে বাকি তিনটে তারা কেটে নিলাম।
সবাইকে শুভ শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা!
অন্নদাশঙ্কর রায় ছিলেন ইংরেজ আমলের সিভিল সার্ভেন্ট। অবিভক্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারি প্রশাসনের দন্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে কর্মজীবন কাটিয়েছেন। কাজের সূত্রে মিশেছেন ধনী দরিদ্র সাধারণ অসাধারণ নানারকম মানুষের সঙ্গে। কিন্তু সেই মেলামেশা “সমানে সমানে” মেলামেশা নয়। উত্তমর্ণের সঙ্গে অধমর্ণের মেলামেশা। অন্নদাশঙ্কর সাহিত্যচর্চা করতেন। তাই প্রশাসনিক কর্তব্যের বাইরেও নিজের লেখালিখির জন্যে উপাদান খুঁজতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর ছোটোগল্পগুলোকে ঠিক “গল্প” বলতে পারছি না। কর্মজীবনের বিবিধ অভিজ্ঞতাকে তিনি গল্প নামে চালিয়েছেন। শুধু পাত্রপাত্রীর নামধাম পাল্টে নিয়েছেন।
গল্পগুলো আমার ভালো লাগেনি। নিজের অভিজ্ঞতাকে সরাসরি আশ্রয় করে গল্পরচনা দোষের নয়। কিন্তু গল্প শোনাবার অছিলায় নিজস্ব রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বিশ্বাস পাঠকের হৃদয়ে ট্রান্সফার করতে চাইলে বিরক্তি লাগে। গল্পের ভেতরে কিছু-একটা “বার্তা” কিংবা “দর্শন” কিংবা “শিক্ষা” ঢুকিয়ে দিলেও বিরক্তি লাগে। গল্পের প্লট আগে, নাকি “বার্তা” আগে? আমার কাছে সবসময়ই প্লট আগে। প্রতিষ্ঠিত ছোটোগল্পকার বনফুলও তাঁর নিজের ছোটোগল্পের ভেতরে “শিক্ষা” ঢুকিয়েছেন, কিন্তু সেইজন্যে প্লটকে তিনি হেলাফেলা করেন নি। অন্নদাশঙ্করের গল্পে বাঁধুনি নেই, বৈচিত্র্য নেই, কাঠামো নেই। তাছাড়া, “বাংলাদেশটাকে থালায় করে তুলে দেওয়া হলো মুসলমানদের হাতে“— একজন প্রাক্তন প্রশাসক, যিনি দীর্ঘদিন পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কাজ করেছেন, তাঁর মুখে যদি এমন কথা শুনতে হয়, তাইলে কেমন লাগে?
আধ্যাত্মিকতা, ঈশ্বরচিন্তা (কিংবা নিরীশ্বরচিন্তা), নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের বিশ্বাস ও চেতনার বিবর্তন বিষয়ক এই একটা “দার্শনিক উপন্যাস” লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।
বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্করহিত এই উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে কী যে বিরক্ত লেগেছে!
মানুষের চরিত্র এবং জীবনের পরিস্থিতি ও মূল্যবোধকে বিষয়বস্তু করে লিখিত রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলো যখন পড়ি, তাদের প্রাঞ্জল, পরিমিত এবং realistic প্রকাশশৈলীর জাদুতে মুগ্ধ হই। গল্পগুলো পড়লে বোঝা যায়, তাদের নির্মাণের পশ্চাতে লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার একটি জোরালো প্রেক্ষাপট আছে। চরিত্রগুলো জ্যান্ত।
অথচ, দু-তিনটে বাদ দিয়ে তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাস পড়তে গিয়ে ঠিক উল্টোটা ঘটে। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের পটভূমি, চরিত্র, ঘটনানির্মাণ, সবকিছুই কেমন যেন কষ্টকল্পিত, কৃত্রিম। আইডিয়ার গভীরতা আছে, কিন্তু কাহিনি এবং চরিত্রনির্মাণে লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার ছোঁয়া পাইনা। দার্শনিক আইডিয়া বিতরণ করা আর উপন্যাস রচনায় তো পার্থক্য আছে।
Verbosity'র দ্বারা জর্জরিত ন্যারেটিভ এবং মেকি কথোপকথনের মারপ্যাঁচে সাজানো এইরকম খান-চারেক “অন্য ধারার” উপন্যাস লিখেছিলেন গুরুদেব— কী যে লিখেছেন, কী যে বোঝাতে চেয়েছেন, উপন্যাসের অন্তিমে কী যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, অবাস্তব উদ্ভট এই চরিত্রদের জোগাড়ই বা করেছেন কোথা থেকে... ভগাই জানে!
এমনিতে দেড় তারা রেটিং হয়। জানলা দিয়ে ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া আর চাঁদের আলো আসছে (তাছাড়া কালকে রবিবার ছুটির দিন), এইসব ছোটোখাটো আনন্দে হাফ তারা বাড়িয়ে দিলাম।
এতো সুন্দর গদ্যশৈলী, এতো সাবলীল চরিত্রনির্মাণ, এতো ঝকঝকে বাস্তবসম্মত সংলাপ। অথচ হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ উপন্যাসের এন্ডিং এরকম ঝুপুশ করে, মাঝিকে অবাক করে দিয়ে, মাঝদরিয়ায় ডুবে যায় ক্যানো বারবার? বলি কেসটা কী ভাই??
ভগবদগীতাকে কেবলই একটা “পবিত্র ধর্মগ্রন্থ” হিসেবে গণ্য করলে আমার পক্ষে এই বই পড়া সম্ভব ছিল না। আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি, কিংবা না-করি— এইসব কথা আজকের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয়। তাছাড়া, ঈশ্বরে বিশ্বাস করা আর ধ���্মের আচার-আচরণ পালন করা, দুটো আলাদা জিনিস। আমার মূল আপত্তি আধুনিক হিন্দুধর্মের আনুষ্ঠানিক এবং নির্দেশমূলক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, এটা করলে পাপ হবে, ওটা খেলে সর্বনাশ হবে, সেটা না-করলে আমাকে এবং আমার চোদ্দোগুষ্টিকে নরকের ননস্টিক কড়াইতে ডিপ-ফ্রাই করা হবে। তারপর শূলে চড়িয়ে হাল্কা আঁচে শিককাবাব বানানো হবে।
ছোটবেলায় যা-কিছু ধর্মপালন করেছি, যা-কিছু “পাপ-পূণ্য” অর্জন করেছি, সেইসব দায় আমার বাপ-মা'র। তাঁরা যেমন বুঝিয়েছেন, তেমন চলেছি। কিন্তু এখন আমার নিজস্ব অল্পস্বল্প জ্ঞানগম্যি হয়েছে। ডিপ-ফ্রাই হওয়ার ভয়টা কেটেছে। আমার যৎসামান্য জ্ঞান দিয়ে আপাতত আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, গেরুয়া রঙের ধুতি পরে এবং সাদা পৈতা গলায় ঝুলিয়ে ব্যাটা পুরোহিত, ভগবানের ভয় (এবং পুণ্যের লোভ) দেখিয়ে, ধান দুব্বো ফুল বেলপাতা গঙ্গাজল ছুঁড়ে, অং বং চং ঘোড়াড্ডিম মন্তর আউড়ে, ঘণ্টা নাড়িয়ে— স্রেফ আমাকে মুরগি মোরগ বানাচ্ছে। ব্যাটাকে আবার দক্ষিণাও দিতে হবে। ১০১ টাকা ওম্ হরিবোলায় নমঃ!
দর্শন আমার খুব পছন্দের বিষয়। কিন্তু তৃতীয়-বিশ্বের বেশিরভাগ উজবুকের মতো আমার মগজের মাইক্রোচিপে একটা বীজমন্ত্র প্রি-ইনস্টল করা আছে— “গান হোক বা গামছা, সিনেমা হোক বা শিঙ্গাড়া, যাহা কিছু পশ্চিম-বিশ্বের তাহাই পরম উপাদেয়”। তাই প্রাচীনকালের সক্রেটিস থেকে শুরু করে আধুনিক কালের ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত পশ্চিমী বিশ্বের যত্তো বিখ্যাত দার্শনিক আছেন, তাঁদের সমস্ত সিদ্ধান্ত, অনুসিদ্ধান্ত, প্রতিপাদ্য, সম্পাদ্য, গোখাদ্য, ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে মোটামুটি কাজ-চালানোর মতো (এবং নিজেকে জাহির করার মতো) আইডিয়া জোগাড় করে ফেলিচি আমি।
কিন্তু কেউ যদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে : সাংখ্য দর্শন কাকে বলে? শূন্যবাদ কী জিনিস? কর্মযোগ বিষয়টা কী? শঙ্করাচার্য কে ছিলেন? — আমি তখন ভীষণ নাক কুঁচকে এবং প্রবল দাড়ি চুলকে জবাব দিই : “হামি টো পিওর নাস্টিক আছি, ম্যান। এই সকল রিলিজিয়াস বুলশিট হামি অট্যন্ট ঘৃণা করি। যডিও হামার গায়ের রং ব্রাউন আছে এবং হামার ফাদারের গায়ের রং আরো বেশি ব্রাউন আছে, কিন্টু মনে মনে হামি পারফেক্ট সাহেবের বাচ্চা আছি! রিয়েল সাহেবডের চেয়েও বেশি খাঁটি সাহেব, হুঁ হুঁ বাওয়া!”
তবু মাঝে মাঝে ভিতরে ভিতরে এট্টু লজ্জা লাগে। উপমহাদেশের মানুষ হয়ে উপমহাদেশীয় দর্শনের ব্যাপারে প্রায় কিসুই জানিনা। বাকি বইপত্তর বাদ দিলাম, গীতাটাও ভালো করে পড়িনি। দোষ যদিও সম্পূর্ণ আমার নয়। আবহমানকাল ধরে আমাদের দেশে দর্শনের সঙ্গে ধর্মকে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অথচ আজকের দিনে প্রচলিত হিন্দুধর্মের আচার বিচার সংস্কার বিশ্বাসের সঙ্গে বেদ-উপনিষদের দার্শনিক বিষয়বস্তুর প্রায় কোনো সম্পর্কই নেই। গোটা মহাভারতে একবারের জন্যেও মূর্তিপূজার উল্লেখ নেই। আরো কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো লিখলে কালকে সকালে আমার বাড়িতে উটকো লোকজন ঝামেলা করতে চলে আসবে এবং আমাদের বাড়ির শান্তিপ্রিয় বিড়ালগুলোকে খামোখা হ্যারাস করবে।
টো হামি গীটা ডিয়েই...
ওহ সরি! তো আমি গীতা দিয়েই প্রাচ্য-দর্শনের চর্চা শুরু করবো ঠিক করলাম। কিন্তু গীতার তো হাজার হাজার সংস্করণ বাজারে পাওয়া যায়। আমার নিজের বাড়িতেই ঠাকুরের সিংহাসনের পাশে ছোট, মেজো, সেজো, দামড়া— এইরকম বিভিন্ন সাইজের হরেক কিসিমের গীতা রাখা আছে (প্রতিটার উপর একটা করে তুলসিপাতা দেওয়া, তুলসিপাতা অ্যান্টিসেপটিক কিনা)। এর মধ্যে কোনটা পড়বো? বাড়ির গীতাগুলো একটাও পছন্দ হলো না। ওগুলো পুজো করার জন্যেই ঠিক আছে।
পড়বো যখন ভালো করেই পড়তে চাই। বঙ্গানুবাদ, বিশদ টীকা, বিশ্লেষণ সহ। বাড়ির কাছে রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে দেখলাম স্বামী রঙ্গনাথানন্দের লেখা তিনখণ্ডের গীতা বিক্রি হচ্ছে। বইটা উল্টেপাল্টে দেখে পছন্দ হলো। তিনখণ্ড একসঙ্গে কিনে ফেললাম। কিন্তু বাংলা অনুবাদটা নয়, মূল ইংরিজি সংস্করণটা। এই ঘটনা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের।
অবশেষে আজকে তিনখণ্ডের প্রায় ১৫০০ পৃষ্ঠার এই গীতাপাঠ শেষ করলাম (গীতা “পড়লাম” বলতে নেই, পাপ হয়)। যে-সময়ে এইসব প্রাচীন বইপত্র রচিত হয়েছে তখনও যেহেতু “হিন্দু” শব্দটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তাই হিন্দু-দর্শনের বদলে “প্রাচীন ভারতীয় দর্শন” বলা উচিত হবে। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের অনেকগুলো শাখা ছিল। এমনকি একাধিক নাস্তিক্য দর্শনের খোঁজও পাওয়া যায় (যেমন - “চার্বাক দর্শন”)। তবে, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মেইনস্ট্রিম ছিল বেদান্ত দর্শন।
বেদান্ত দর্শন আয়তনে বিপুল, বিশাল। বেদ, উপনিষদ— এগুলো সবই বেদান্ত দর্শনের অন্তর্গত। এই বিশাল বেদান্ত দর্শনের অনেক অনেক লিটার দুধ জ্বাল দিয়ে যদি একবাটি ক্ষীর বানানো হয়, তবে সেটা হলো ভগবদগীতা। মাত্র ৭০০টা শ্লোক আছে গীতাতে। গীতা কিন্তু মহাভারতের অন্তর্গত একটা অংশ, আলাদা করে লেখা হয়নি। মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে অর্জুন এবং শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কিছু দার্শনিক আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। সেই আলোচনার অংশটিকে আমরা আলাদা ভাবে “গীতা” নামে চিনি। কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল দুজনের মধ্যে?
অর্জুন বলেছিলেন, আমি যুদ্ধ করবো না। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো, তারা সবাই আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কেউ কেউ আমার গুরুজন। এদের আমি কীভাবে হত্যা করবো? এদের মেরে যুদ্ধে জেতার চেয়ে ভিক্ষা করে খাওয়া ভালো। ইয়ে লাফড়া আপুন সে নেহিচ হোয়েঙ্গা, বীড়ু! এই বলে তিনি হাতের অস্ত্র ফেলে দিলেন। চোখের জল মুছতে মুছতে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে মাটিতে বসে পড়লেন (তখনকার দিনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হতো। বসে পড়ার অর্থ হলো “ওয়াক-ওভার” ঘোষণা করে দেওয়া)। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু (“বীড়ু” = “বেস্ট ফ্রেন্ড”)। তিনি ছিলেন গোটা মহাভারতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষও বটে। এই শোচনীয় মানসিক অবস্থা থেকে অর্জুনকে বের করে আনতে হবে তাঁকে।
অর্জুনের মতো নিখুঁত মহাবীর, মহাভারতের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস নায়ক, আজকের দিনের pseudo-psychology'র ভাষায় - “Alpha Male”, তাঁর মতো মানুষও কিনা শোকে-দুঃখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন! নিরাশার সমুদ্রে ডুবে গেছিলেন। নিজেকে চরম অসহায় মনে করছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, এর চেয়ে তো মরে যাওয়া ভালো। নিজেকে কীভাবে সামলাবেন তার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অর্জুনের মতোই ছন্নছাড়া মানসিক অবস্থা তো আমাদেরও হয়! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ না হোক, আমাদের নিজেদের জীবনটাও একটা যুদ্ধ ছাড়া আর কী? কখনও বাস্তব পরিস্থিতি বাঁশ দ্যায়, আবার কখনও মরীচিকার মতো ভ্রান্ত মোহ এসে চাবুক মারে। আর যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমরা যন্ত্রণায় দগ্ধ হই।
স্বামী বিবেকানন্দ গীতাকে বলেছিলেন “প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত”। মানে গীতার দর্শন স্রেফ যুক্তির মারপ্যাঁচ নয়, আমাদের নিজেদের জীবনে এই দর্শনকে প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। এবং গীতার দর্শন আদ্যোপান্ত একটি পজিটিভ দর্শন। আজকের পৃথিবীতে নায়িলিজম যেন একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি বলি আমি একজন অপ্টিমিস্ট, ভবিষ্যত নিয়ে আমি আশাবাদী, তার মানে আমি যথার্থ “আধুনিক” মানুষ নই। অথবা আমি একজন সুবিধাবাদী “এলিট”।
দেশদুনিয়ার সমস্যা নিয়ে যিনি যতো বেশি ঘ্যানর-ঘ্যানর প্যানর-প্যানর করবেন, তিনি ততো বেশি “সমাজসচেতন”। দায়দায়িত্বহীন এই ঘ্যানর-ঘ্যানরের দ্বারা মূল সমস্যার কিন্তু দুই ইঞ্চিও সমাধান হয়না। নায়িলিজমগ্রস্ত এই পলায়নী-মনোবৃত্তির বিপরীতে, বিষাদাচ্ছন্ন অর্জুনের উদ্দেশ্যে শ্রীকৃষ্ণ ঠিক সেই কথাটাই বলেছিলেন যেটা একজন প্রকৃত বন্ধুর বলা উচিত : তস্মাৎ উত্তিষ্ঠ কৌন্তেয়! —হে অর্জুন, উঠে দাঁড়াও! আর যাই করো, ভগ্নহৃদয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থেকো না। ব্রো, বসা অবস্থা থেকে আগে উঠে দাঁড়াও! তারপর দেকচি কি করা যায়...
যেভাবেই হোক, অন্তত খাড়া হয়ে একটিবার উঠে দাঁড়ানোটা ক্যানো উচিত, ক্লীব হয়ে বসে থাকার মধ্যে যে কোনো গৌরব নেই, রথের চাকা (আমাদের ক্ষেত্রে কোলবালিশ) জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলে যে সমস্যার সমাধান হয়না, দুর্বলচিত্ত ভীরু দ্বিধাগ্রস্ত মানুষরা যখন ক্ষমা, করুণা, দয়া, অহিংসা, ইত্যাদি সুইট অ্যান্ড বিউটিফুল জিনিসের গুণকীর্তন করে, তখন যে সেটা কতটা হাস্যকর শোনায়, এবং সবচেয়ে বড় কথা, কখনও কখনও যে সত্যিই আমাদের কঠোর হওয়া জরুরি, ভদ্রতার পোশাকটা খুলে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখা জরুরি, “অভদ্র” হওয়া জরুরি, এই কথাগুলো অর্জুনকে বলেছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু। ইনি আমাদের পরিচিত সেই বৃন্দাবনের বংশীবাদক লেডিকিলার কেষ্টঠাকুর নন! রাইট নাউ, ড্যাম ইট, হি ইজ অন ফায়ার!
অর্জুনের এই হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে সান্ত্বনা অফার করেননি। কিংবা, Cheer up, dude! You can do it, man! Oh come on, grow some balls, will ya! এইসব ছাগলের আলাপ করেননি। তিনি বলেছিলেন : শোন ভাই, অহিংসা, ক্ষমা, দয়া— এইসব কাজ দুর্বলদের মানায় না। এগুলো শক্তিশালী মানুষের কাজ। যার নিজেরই হাত পা কাঁপছে, চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে, সে অন্যকে অহিংসা দেখাবে? হিহি! গান্ধিজির মুখেও আমরা একই কথা শুনতে পাই। নেলসন ম্যান্ডেলার মুখেও। মার্টিন লুথার কিংয়ের মুখেও। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন তথাকথিত অহিংসার পূজারী।
তারপর তিনি অর্জুনের সামনে বেদান্ত দর্শনের যাবতীয় জ্ঞানভাণ্ডারকে উন্মুক্ত করে দিলেন। বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, বোধ দিয়ে, প্র্যাকটিক্যাল চিন্তা দিয়ে, দীর্ঘদিন ধরে এই দর্শনকে গড়ে তোলা হয়েছে। তিনি বললেন, এই নাও, তোমাকে সবকিছু বললাম। এবার তুমি নিজেই বিচার করে দ্যাখো। বেদান্ত দর্শনের এটা একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। “বৃহদারণ্যক” নামের একটা বিখ্যাত উপনিষদ আছে। সেখানে একটা বৈপ্লবিক কথা বলা হয়েছে : “বেদো অবেদো ভবতি”। এর মানে হলো, আমার নিজের অনুভূতির, নিজের বিচারবুদ্ধির দাম বেদের চেয়েও বেশি। তুমি আগে তোমার অস্থির মনটা স্থির করো, তারপর সবকিছু শুনে দ্যাখো, তারপর যদি বেদান্তের বিচার পছন্দ হয়, তাহলে রাখো। নইলে ফেলে দাও। কুছ পরোয়া নেহি। আমার মনে হয়েছে, এই বিস্ময়কর ফ্লেক্সিবিলিটি বেদান্ত দর্শনের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য। এর সবচেয়ে বড়ো শক্তি। পৃথিবীর আর কোনো দর্শন নিজের ব্যাপারে এরকম নির্ভীক ঘোষণা করেছে বলে আমার জানা নেই। “বেদো অবেদো ভবতি”। আমার সিদ্ধান্তের সামনে বেদও “অবেদ” হয়ে যায়।
“রোজ সকালবেলা, ভগবদগীতার সুবিশাল এবং মহাজাগতিক দর্শনের গভীরে, আমি আমার বুদ্ধিকে অবগাহন করাই। এই গ্রন্থ পড়ার পরে, আধুনিক পৃথিবী এবং এই পৃথিবীতে রচিত সাহিত্যকে মনে হয় অতি ক্ষুদ্র, অতি নগণ্য।” এই কথা বলেছিলেন হেনরি ডেভিড থোরো, তাঁর বিখ্যাত “ওয়ালডেন” বইতে (বাংলা অনুবাদটা আমার নিজের)। আমি যদিও থোরো-র এই কথাটা মানি না, তবু একটা বিষয় বুঝতে পারি। থোরো-র মতো transcendentalist মানুষ, যিনি নিজের যুগের চিন্তাভাবনার তুলনায় এগিয়ে ছিলেন, তাঁর মননেও গীতার দর্শন এতোটা মৌলিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।
আজকে সকালে গীতা শেষ করে আমারও মনে হয়েছে, যতটুকু ভেবেছিলাম, আমার মনের উপর গীতার “পজিটিভ” দর্শনের প্রভাব তার চেয়ে অনেকটাই বেশি পড়েছে। আমারও মনে হয়েছে, মানুষের জীবনের বোধহয় সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য, যতবার বসে পড়ছি, ততবার উঠে দাঁড়ানো। যতবার, ততবার। যতবার, ততবার।
উত্তিষ্ঠত! উত্তিষ্ঠত!
(যদি কেউ নিছক ধর্মীয় অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে গীতা পড়তে চায়, আমি তাকে স্বামী রঙ্গনাথানন্দের লেখা এই সংস্করণটি পড়তে রেকমেন্ড করছি। বইটাকে “লেখা” বললে ভুল হবে। হায়দরাবাদের রামকৃষ্ণ মিশনে দীর্ঘ দুইবছর ধরে প্রতি সপ্তাহে সম্পূর্ণ গীতার বিশ্লেষণ করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। বইটি সেই বক্তৃতামালার লিখিত রূপ। মৌখিক আলোচনা হওয়ার কারণে এই বিশ্লেষণে দুর্দান্ত একটা গতিশীলতা এসেছে। তাছাড়া, স্বামী রঙ্গনাথানন্দের উদার চিন্তাভাবনা এবং উজ্জ্বল পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়েছি আমি। সবমিলিয়ে, আমার দেখা এটিই শ্রেষ্ঠ গীতা, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই!
বইটার একটা বাংলা অনুবাদ আছে। এমনিতে আমি কোনোকিছুর বাংলা অনুবাদ পাওয়া গেলে সেটা পড়াই পছন্দ করি। কিন্তু এই বইটার ক্ষেত্রে মূল ইংরিজি ভার্শনটা পড়লেই বোধহয় বেশি ভালো হবে। স্বামী রঙ্গনাথানন্দের বক্তব্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং ছন্দটা উপভোগ করা যাবে।)
.
খুব আশ্চর্যের কথা। হিন্দু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থগুলো, যেমন রামায়ণ, মহাভারত, প্রাচীনতর পুরাণ গ্রন্থ— কোথাও শ্রীরাধিকার উল্লেখ নেই। রাধার প্রথম দেখা পাওয়া যায় অনেক পরে, দ্বাদশ শতকে, মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জয়দেবের সংস্কৃত ভাষায় লেখা “গীতগোবিন্দ” কাব্যে। সুতরাং আমরা কল্পনা করে নিতেই পারি, ঐতিহাসিক না-হোক, এমনকি পৌরাণিক সূত্রেও শ্রীরাধিকার অস্তিত্ব ছিল না। তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে অনেক পরে, কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। কী উদ্দেশ্যে?
হিন্দু দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো ভক্তিবাদ। ভক্তিবাদের মতো একটি সুগভীর দর্শনকে সামান্য কয়েকটা কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বলা যায়, শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে মেনে নেওয়া সত্ত্বেও, তিনি “একাই একশো” নন। তাঁর মতো দিগ্বিজয়ী মানুষেরও একটা দ্বৈত অথচ বিপরীত সত্তা থাকতে হবে। একটা প্রবল পিছুটান থাকতে হবে। শ্রীরাধিকা হলেন কৃষ্ণের সেই পিছুটান। ভক্তিবাদের এই দারুন দুঃসাহসিক তত্ত্বটি সমগ্র ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের প্রাণ স্পর্শ করেছিল একসময়। রাধাই হলেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। “হ্লাদিনী” মানে - আনন্দের উৎস। The fountain of bliss!
বৈষ্ণব পদাবলীতে, যেখানে শ্রীরাধিকার প্রাসঙ্গিকতা এমনকি কৃষ্ণেরও উপরে, সেই পদাবলী সাহিত্য পড়লে বোঝা যায়, পুরুষ হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ হতে পারেন সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু তাঁর অস্তিত্বের মূলটি গাঁথা রয়েছে রাধার হৃদয়ে। কানু বিনা যেমন রাই নেই, রাই বিনা তেমনি কানুও অসম্পূর্ণ হয়ে আছেন। তাঁরা দুজন সারাজীবন কাছে থাকতে পারেন নি। তাঁদের প্রেম সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। তবু বৈষ্ণব সাহিত্যে এই প্রেমকেই সবচেয়ে উঁচুতে জায়গা দেওয়া হয়েছে।
অভিমান, বিরহ, বিষাদ এবং দিগন্ত প্রসারিত প্রতীক্ষারই আরেক নাম দেওয়া হয়েছে “প্রেম”। এই যে বুকফাটা অসহায় তৃষ্ণা, এই শূন্যতার অনুভূতিকেই যুগ যুগ ধরে ব্যক্ত করার চেষ্টা করে এসেছে মানুষ। প্রেমিক মানুষ। ভিখারি মানুষ। রাধাকে বলেছিলেন কৃষ্ণ, আলিঙ্গনও যদি না করো, একবার আমার দিকে না-ও যদি তাকাও, একবার স্পর্শ না করো, তোমার ওই খণ্ডিত চন্দ্রকলার মতো পায়ের নখে অন্তত একবার চুম্বন করতে দিও? ভগবানকে এভাবে ভিখারি বানাতে পারা কম সাহসের কথা নয়!
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।এ ভরা বাদর মাহ ভাদরশূন্য মন্দির মোর।
মহাভারতের সফিস্টিকেটেড কৃষ্ণের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীর এই প্রেমিক কৃষ্ণের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আসামের কামরূপী আঙ্গিকের একটা লোকসংগীত আছে। “ও রে কলঙ্কিনী রাধা, কদম ডালে বসিয়া আছে কানু হারামজাদা, মাঈ তুই জলে না যাইও”। যাঁকে দেবতা বলে স্তুতি করা হয়, সেই দেবতাকেই “হারামজাদা” নামে সম্বোধন করা হয়েছে! দেবতার সঙ্গে এই যে বন্ধুর মতো আচরণ, সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যের এটাই essence! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এই উপন্যাসে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের এই লৌকিক এবং ক্যাজুয়াল বৈশিষ্ট্যকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
পুরোপুরি সফল হননি তিনি। আবহমানকাল ধরে চলে আসা রাধাকৃষ্ণের কাহিনিকে তাঁর স্বকীয় পাকা হাতে effortlessly প্রকাশ করতে পারেননি তিনি। তবু দুইজন নরনারীর পারস্পরিক প্রণয়ের সর্বগ্রাসী আকুতিকে বেশ খানিকটা দেখাতে পেরেছেন। রাধা আর কৃষ্ণের ব্যতিক্রমী প্রেমের গল্পটা জানার জন্যেও খুব সম্ভবত এই বইটির চেয়ে ভালো উপায় আর নেই। অন্তত বাংলায় বোধহয় নেই। আজকে দোল পূর্ণিমার দিন বিকেলবেলা বইটা পড়া শেষ করে, রাধা আর কৃষ্ণের চিরন্তন বেদনাকে উপলব্ধি করতে করতে মাথায় ঘুরছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখা একটা গানের কয়েকটা লাইন।
ধীরে ধীরে পহুঁছত যমুনা কে তীরসুনসান পনঘট মৃদুল সমীরক্ষণ ক্ষণ মাধব বিরহ মদিরউসে কাহে ভুল না পাও ?মথুরা নগরপতী কাহে তুম গোকুল যাও ?
প্রায় একই কথা ভানুসিংহ ঠাকুরও লিখে গেছেন।
বজাও রে মোহন বাঁশিসারা দিবসক বিরহদহনদুখমরমক তিয়াষ নাশি।রিঝ-মন-ভেদন বাঁশরিবাদনকঁহা শিখলি রে কান ?
তিনি কোথায় শিখেছেন এই বাঁশি বাজানোর কায়দা, তা আমি জানিনা। তবু বাঁশির আওয়াজ যে আজও শোনা যায় এই কথাটা কে অস্বীকার করতে পারে? আগুনের শিখার মতো বিরহের এই গল্পটা এভাবেই চলতে থাকবে যুগ যুগ ব্যাপী। যতদিন মানুষ প্রেমিক থাকবে। যতদিন মানুষ প্রতীক্ষারত থাকবে। যতদিন মানুষ ভিখারি থাকবে।
আর কি কখনো কবে এমন সন্ধ্যা হবে ?জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। প্রায় গোটা পৃথিবী মেতে আছে অভূতপূর্ব ধ্বংসলীলায়। অমর্ত্য সেন সেই সময় মাত্র বছর-দশেকের একজন বালক। পুরোনো ঢাকায় নিজের পৈতৃক বাড়ি এবং ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের সেইন্ট গ্রিগোরি স্কুল ত্যাগ করে (মূলত যুদ্ধের কারণেই) শান্তিনিকেতনের স্কুলে এসে ভর্তি হয়েছেন। বসবাস করছিলেন তাঁর দাদু-দিদিমার সঙ্গে (দাদু ছিলেন প্রবাদপ্রতিম পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সরাসরি কোনো প্রভাব তখনও শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছায়নি।
১৯৪৩ সালের বসন্তকালে, বছরের যে-সময়টাতে সাধারণত শান্তিনিকেতনে উৎসবের মরশুম চলে, হঠাৎ একদিন সেখানে একজন পাগলের উদয় হলো। অপ্রকৃতিস্থ উন্মাদ একজন মানুষ। ছেলেছোকরাদের যেমন কাজ, তারা সেই পাগলকে উত্যক্ত করতে শুরু করলো। খোঁজখবর নিয়ে জানা গ্যালো, মানুষটা আদপে পাগল নন। একমাসেরও বেশি সময় তিনি অভুক্ত অবস্থায় রয়েছেন। দীর্ঘদিন আহারের অভাবে সাময়িক মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে তাঁর। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সঙ্গে এভাবেই প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেছিলো অমর্ত্য সেনের।
এই একটি ঘটনা অমর্ত্যের ভবিষ্যত জীবন এবং চিন্তাভাবনার মূল লক্ষ্যটি নির্ধারণ করে দিয়েছিলো। অমর্ত্য সেনের এই আত্মজীবনী আর-পাঁচটা আত্মজীবনীর চেয়ে অনেকটাই আলাদা। অনেক পাঠক হয়তো একে আত্মজীবনী বলেই মানতে চাইবেন না (কিংবা পড়ার পরে হতাশ হবেন)। এই বইতে, পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের “গোপন” বৃত্তান্ত, অথবা স্বীকারোক্তিমূলক সাহসী আত্মউন্মোচন করার কাজ থেকে বিরত থেকেছেন তিনি। নিজের পরম ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যক্তিগতই রেখেছেন। কোনও চমকপ্রদ এবং উত্তেজক তথ্যই যদি না-পাওয়া গ্যালো তাহলে এই আত্মজীবনী পাঠ করে আমাদের লাভ কী?
১৭৭৬ সালে অ্যাডাম স্মিথের লেখা সুবিখ্যাত “Wealth of Nations” বইটি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে, তাত্ত্বিকভাবে “ক্লাসিকাল অর্থনীতি”র ভিত্তি স্থাপন করা হয়। আবহমানকাল ধরে চলে আসতে থাকা রাজতান্ত্রিক এবং জমিদারতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়ে ইয়োরোপের মানুষ তখন বাজারতান্ত্রিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি বা market capitalism-কে সাদরে বরণ করে নিয়েছিল।
এই নতুন ধরণের অর্থনীতির প্রাণভোমরা ছিলো “পুঁজি”, অর্থাৎ ক্যাপিটাল। এই অর্থনীতির উদ্দেশ্য ছিলো বাজারের চাহিদা (demand) এবং যোগান (supply)— এই দুই অবস্থার মধ্যে সহাবস্থান বজায় রাখা। মোদ্দা হিসেবে একেই বলে “ক্লাসিকাল অর্থনীতি”। কিন্তু বিংশ শতকের শুরুতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়াবহ একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতির আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়।
আমরা সবাই জানি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯১৯ সালে, “ভার্সাই চুক্তি” নামের একটা বালখিল্য ব্যবস্থার দ্বারা যুদ্ধের সমস্ত দায়ভার জার্মানির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই অপমানজনক চুক্তির পরিণতি ছিলো সুদূরপ্রসারী এবং এই চুক্তি ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে বিধ্বংসী সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হলো, তখন দেখা গ্যালো, অর্থনৈতিক জগৎ দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।
একটা ভাগে ক্যাপিটালিস্ট বাজারনির্ভর অর্থনীতির মূল তত্ত্বগুলোকে সামান্য পরিবর্তন করে নিয়ে নাম দেওয়া হলো নিও-ক্লাসিকাল বা নব্য-ক্লাসিকাল অর্থনীতি। আরেক ভাগে বলা হলো, “পয়সার জোর যার, বাজার তার”— ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতির এই অবধারিত নিয়মটা সমাজে মারাত্মক অসাম্য তৈরি করেছে। বড়লোক মালিক আর গরীব কর্মচারীর মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে সমাজতান্ত্রিক (সোশ্যালিস্ট) অর্থনীতিকে মান্যতা দেওয়া হলো।
এই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির নিয়মকানুনের মুখ্য প্রণেতা যে ছিলেন কার্ল হেইনরিখ মার্ক্স নামের একজন লন্ডনপ্রবাসী জার্মান ভদ্রলোক, এই কথাটা আলাদা করে না বললেও চলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, গত শতকের একটা বড়ো সময়জুড়ে বাজারতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি— এই দুই নীতির তাত্ত্বিকরা পরস্পরের মধ্যে হাতাহাতি করে কাটিয়েছেন। হাতাহাতিতে কারও জয়লাভ হয়নি বটে, কিন্তু একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বোঝা গেছে।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হলো, এই দুই অর্থনীতির কোনোটাই সাধারণ মানুষকে গুরুত্ব দ্যায় না। সাধারণ মানুষ মানে আপনি, আমি, এবং আমাদের মতো গুরুত্বহীন মানুষশাবকের দল। ক্যাপিটালিজম চায় বড়লোকরা আরো বড়লোক হোক। বাজারের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাক। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চায় গভর্নমেন্টের হস্তক্ষেপে দেশের সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়ন হোক (“উন্নয়ন” শব্দটা শুনলে আমার আজকাল ভয় লাগে)। ধনী-গরীব ভেদাভেদ ঘুচে যাক। কিন্তু সোশ্যালিস্ট অর্থনীতিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিশেষ মূল্য নেই! এখানেই প্রশ্ন ওঠে, আমি কী চাই? দেশের উন্নতি হলে আমার কী ঘোড়ার ডিম হবে?
এইখানে অনেকে বলবেন, এটা একটা কথা হলো? দেশের উন্নতি হলে তো সেই দেশের মানুষেরও উন্নতি হবে। আচ্ছা সত্যিই কি তাই? উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ভারতের সামগ্রিক GDP বৃদ্ধি পেলে কিংবা সরকারি হিসেব অনুযায়ী মানুষের গড় আয় বৃদ্ধি পেলেই কি ধরে নিতে হবে যে দেশের সকল মানুষের মধ্যে সম্পদের সমান-সমান বণ্টন হয়েছে? দেশের সব মানুষ একইরকম সুবিধে ভোগ করছে? এই বিষয়টা নিয়ে নতুন করে তর্ক করার প্রয়োজন নেই, কারণ রাষ্ট্রের GDP'র হিসেব আর রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের জীবনযাপনের অবস্থার মধ্যে যে অনেক ফারাক আছে, সেটা এখন একটা শিশুও বুঝে গেছে।
এই দুইরকম প্রচলিত অর্থব্যবস্থার পাশাপাশি, ধীরে ধীরে উঠে এসেছে তৃতীয় একটি বিকল্প। অমর্ত্য সেন যখন অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনা করার জন্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে এই তৃতীয় বিকল্পটি নিয়ে তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদরা চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন। গত শতকের তিরিশের দশকে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে, জন মেইনার্ড কেইন্স নামের একজন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এই তৃতীয় বিকল্পটির বীজ বপন করেছিলেন।
বিলেত যাওয়ার আগে, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা করার সময় থেকেই অমর্ত্য সেন এই বিকল্প তত্ত্বটির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছিলেন, বইপত্র পড়েছিলেন। আত্মজীবনীতে তিনি নিজেই মন্তব্য করেছেন, কলকাতায় ছাত্রাবস্থায় তাঁর চিন্তাজগতের নায়ক ছিলেন ইতালীয় অর্থনীতিবিদ পিয়েরো স্রাফা (Piero Sraffa)। এই স্রাফা ছিলেন জন মেইনার্ড কেইন্সের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কেমব্রিজে পড়াশুনা করতে গিয়ে অমর্ত্য সেন পিয়েরো স্রাফাকেই নিজের অ্যাকাডেমিক তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পেলেন। কেমন সৌভাগ্যের কথা!
নিজের এই সৌভাগ্যকে অমর্ত্য সেন পুরোদস্তুর কাজে লাগিয়েছিলেন। আমি এর আগেও অমর্ত্য সেনের বিভিন্ন লেখাতে পড়েছি, তিনি বাঙালির আড্ডা-আলোচনা-তর্ক-বিতর্কের জাতিগত স্বভাবটিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে থাকেন। তর্কবিতর্ক বা argument হলো ভারতের চিরাচরিত দার্শনিক বিচার ও শিক্ষাপদ্ধতির একটি সুপ্রাচীন প্রকরণ। বইতে অসংখ্যবার তিনি উল্লেখ করেছেন, জীবনের শুরুতে শান্তিনিকেতনে এবং তারপর কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউস এবং অন্যান্য আড্ডার আসরগুলো তাঁর নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং চিন্তাক্ষমতার বিকাশে কতটা অবদান রেখেছিল।
কেমব্রিজে পড়াশুনা করতে গিয়েও তিনি সমগোত্রীয় একটি সুস্থ বিতর্কের পরিবেশ লাভ করেছিলেন। যেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত মতবাদের মানুষরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মগ্ন হন— শুধুই তর্কে জয়লাভ করার উদ্দেশ্যে নয়— বরং তাঁদের নিজস্ব ধারণাকে আরো প্রখর করে তোলার উদ্দেশ্যে। নতুন কিছু শেখার উদ্দেশ্যে। এই আড্ডা-আলোচনার প্রসঙ্গেই অমর্ত্য সেন শুনিয়েছেন তাঁর শিক্ষা এবং কর্মজীবনের অগণিত শিক্ষক, বন্ধু, সহপাঠী এবং ছাত্রদের বৃত্তান্ত। তাঁদের বিচিত্র চিন্তাভাবনার কথা। এটাই অমর্ত্য সেনের এই আত্মজীবনীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
বইটি পড়তে পড়তে আমার বারবার মনে হয়েছে, মুক্ত, উদার এবং গঠনমূলক আলোচনার সেই লোভনীয় জগৎটা আজ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। বদলে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় troll, meme, status, tweet, post-ভিত্তিক একটা অসুস্থ, অগভীর এবং চটকদার চিন্তাব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় যে যতো বেশি তাৎক্ষণিক চটক বিতরণ করতে পারে, যে যতো বেশি মানুষকে আঘাত দিতে পারে, বাঁকা কথা বলতে পারে, সে তত like কিংবা ফলোয়ার লাভ করে (এবং এতেই তাদের মোক্ষলাভ ঘটে)। আমরা এখন চিন্তার “আদান-প্রদান” করিনা, শুধুই “প্রদান” করি। এবং আমাদের নিজের মতামতের সঙ্গে যাদের মতের মিল হয়না, তৎক্ষণাৎ তাদের গর্দান নিয়ে নিই। I am so cool and the rest is fool. সবকিছুই অবশ্য কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনের পিছনে মুখ লুকিয়ে করা হয়।
যাই হোক, এই বইটির আরেকটা বড়ো প্রাপ্তি হলো, অর্থনীতির সেই তৃতীয় বিকল্পটি যখন ধীরে ধীরে মূলস্রোতে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করছে, সেই সময়টার এবং সেই পরিবেশটার প্রত্যক্ষ বিবরণ দিয়েছেন অমর্ত্য সেন। তিনি নিজেও সেই তৃতীয় বিকল্পটির সঙ্গে নিজের চিন্তা এবং কর্মজীবনকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন। তৃতীয় বিকল্পটির নাম : “কল্যাণমূলক অর্থনীতি” (welfare economics)। এই অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হলো, এতে পুঁজি, বাজার, উন্নয়ন, রাষ্ট্র, মুনাফা, এইসবকিছুর বাইরেও আরেকটা বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তার নাম - মানুষ। মানুষ মানে শুধুই গোটা মানবসমাজ নয়, একজন একক ব্যক্তিমানুষকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। “A stupid common man!”
গোটা সমাজ কী চাইছে, ক্যানো চাইছে, কীভাবে আচরণ করছে— তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ একজন একক মানুষ কী চাইছে, ক্যানো চাইছে, কীভাবে আচরণ করছে। কারণ আমাদের প্রত্যেকের অনেকগুলো আলাদা আলাদা পরিচয় আছে। এবং প্রতিটা পরিচয়ের স্বতন্ত্র মূল্য আছে। আপনি একইসঙ্গে একজন বাঙালি, হিন্দু, মেয়ে, গ্র্যাজুয়েট, বেকার, কবি, অমুকের প্রেমিকা, অমুকের ভগিনী, তমুকের কন্যা, সমকামী, ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং আর্জেন্টিনা ফুটবল টিমের সমর্থক হতে পারেন (পরিচয়ের সংখ্যা আরো অনেক বাড়তে পারে)। অন্য কেউ না-বুঝুক, আপনি জানেন, আপনার কাছে এই প্রতিটি পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সমগ্র জীবন, আপনার কাজকর্ম, আপনার সিদ্ধান্ত, আপনার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতকে চালনা করছে আপনার এই পরিচয়গুলো। এগুলো একটাও বাদ দেওয়া যাবে না।
অর্থনীতির উপর মানুষের এই স্বতন্ত্র ব্যক্তিপরিচিতি এবং ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ কীভাবে প্রভাব ফ্যালে? খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে, এটাই ছিল অমর্ত্য সেনের মৌলিক গবেষণার বিষয়। যেখানে একটা দেশের মানুষের সামগ্রিক পছন্দ-অপছন্দের হিসেবনিকেশ করাই একটা মুশকিলের ব্যাপার, সেখানে মাত্র একজন মানুষকে ক্যানো গুরুত্ব দেওয়া হবে? কারণ, গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এটাই কল্যাণমূলক অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য।
মানুষের এই ভিন্ন-ভিন্ন পরিচয়গুলোকে যখন আলাদা-আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়না, তখনই আমরা কাউকে “সে একজন মুসলমান” কিংবা “সে একজন ভারতীয়” কিংবা “সে একজন নাস্তিক” কিংবা “সে একজন নিরামিষাশী” কিংবা “সে একজন ব্রাজিল ফুটবল দলের সমর্থক”— এইরকম ভাঙাচোরা পরিচয়ে ডাকতে শুরু করি। ডাকলেও অসুবিধে নেই, অসুবিধে হলো, তাদের ভাঙাচোরাভাবে বিচার করতে শুরু করি। তখনই শুরু হয় ঝামেলা। তখনই আমরা আক্রমণাত্মক হয়ে যাই। তখনই আমরা ক্ষুদ্র হয়ে যাই। তখনই আমরা “holier than thou” হয়ে যাই। তখনই আমরা বলি : লোকটা নামাজ পড়ছে, তার মানেই ব্যাটা মুসলমান। আর মুসলমান মানেই... সে শুধুই মুসলমান। তার আর কোনও পরিচয় নেই! আর কোনো সত্তা নেই! কিচ্ছু নেই! গোটা মানুষটার বাকি সব পরিচয় তখন উবে গেছে। রয়ে গেছে শুধু একটা শব্দ। “মুসলমান”।
এই বিচ্ছিরিরকমের বড়ো একটা রিভিউ লিখেও, অত্যন্ত সুলিখিত এই বইটির সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে পারলাম না। ব্যক্তিগতভাবে এই বইটি পড়ার পরে আমি ভীষণরকম সমৃদ্ধ হয়েছি। আমার চিন্তা মার্জিত হয়েছে। অর্থনীতি আমার অন্যতম একটি আগ্রহের বিষয়। অমর্ত্য সেনের চিন্তা এবং কাজকেও আমি অনেকদিন যাবৎ জানার চেষ্টা করে আসছি। একটা হারিয়ে যাওয়া সময়, একটা হারিয়ে যাওয়া জগৎ, কয়েকজন হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বল মানুষ এবং তাঁদের চিন্তাভাবনা এবং আজকের এই জটিল উদ্ভট সময়ের মধ্যে একটা মিসিং লিঙ্ক হয়ে থাকবেন অমর্ত্য সেনের মতো ব্যক্তিত্বরা। যাঁদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। চারশো পৃষ্ঠার বইতে কারোর প্রতি অসূয়া কিংবা বিদ্বেষ প্রকাশ করেননি তিনি। একবারের জন্যেও “নোবেল পুরস্কার” শব্দটি উচ্চারণ করেননি। পুরো বই জুড়ে ছড়িয়ে ছিলো একটা রসিকতাময় বিদগ্ধ বিনম্র আলো। বইটা শেষ করে খেয়াল হলো, “বিনয়”— এই শব্দটা শুধু বিদ্বান ব্যক্তিদের মানায়। আজকের এই ট্রল, স্ট্যাটাস, রিল, মিম-সংস্কৃতিতে এই গভীর ব্যঞ্জনাময় শব্দটির কোনও জায়গা নেই! জায়গা থাকার কথাও নয়!
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশিবিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,পৌরুষেরে করে নি শতধা; নিত্য যেথাতুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা—নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।
১৯১৬ সাল, জাহাজের নাম তোসামারু, গন্তব্য জাপান, যাত্রীর নাম রবীন্দ্রনাথ। জাহাজে বসে চিঠি লিখছেন তিনি। সেই চিঠিগুলোই সংকলিত হয়েছে এই বইতে, ভ্রমণসাহিত্যের ছদ্মবেশে। সচেতন গদ্য নয়, আসলে তো চিঠি, তাই ভাবের প্রকাশে রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি সাবলীল এখানে। লৌকিকতামুক্ত। পথে যেতে যেতে কী কী দৃশ্য দেখেছেন তার বর্ণনার চেয়েও বেশি লিখেছেন, কী কী ভাবনা ভেবেছেন। ভেবেছেন অনেকরকম কথা। তোলপাড় করা সামুদ্রিক ঝড়ের কথা। শান্ত বৈকালিক আকাশে সূর্য অস্ত যাওয়ার কথা। প্রকৃতির অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করে মানুষের যান্ত্রিক-দানবিক হয়ে উঠবার কথা। জাপানিদের অনুপম সৌন্দর্যবোধের কথা। জাপানিদের সঙ্গে বাঙালিদের মিল ও অমিলের কথা। রাতদুপুরে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অঝোর বৃষ্টিপাতের তালে তাল-মিলিয়ে গেয়ে ওঠা গানের কথা : “শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে”।
হঠাৎ মনে হয়, এ একেবারে অসহ্য। কিন্তু, মানুষের মধ্যে শরীর-মন-প্রাণের চেয়েও বড় একটা সত্তা আছে। ঝড়ের আকাশের উপরেও যেমন শান্ত আকাশ, তুফানের সমুদ্রের নীচে যেমন শান্ত সমুদ্র, সেই আকাশ সেই সমুদ্রই যেমন বড়ো, মানুষের অন্তরের গভীরে এবং সমুচ্চে সেইরকম একটি বিরাট শান্ত পুরুষ আছে— বিপদ এবং দুঃখের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখলে তাকে পাওয়া যায়— দুঃখ তার পায়ের তলায়, মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারে না।সন্ধ্যার সময় ঝড় থেমে গেল।
চমৎকার একটা উপন্যাস। আমার পড়া হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম সেরা উপন্যাস। ইদানিং তাঁর যেসব লেখাপত্র পড়ছিলাম, বেশিরভাগই ভালো লাগছিলো না। খুব বেশি আশা না-নিয়েই এই উপন্যাসটা শুরু করেছিলাম। একদম ছোটো উপন্যাস। এটা কিন্তু খুব ভালো লেগে গ্যালো।
এই উপন্যাসে হুমায়ূনীয় অনেক কিছুই নেই। “অসম্ভব রূপবতী” এবং “প্রচণ্ড বুদ্ধিমতী” কোনো মেয়ে নেই। সেই বুদ্ধিমতী-রূপবতীকে দূর থেকে ভালোবাসে এমন কোনো নিঃস্বার্থ আলাভোলা প্রেমিক নেই। উপরে ভীষণ কঠিন কিন্তু ভেতরে তুলতুলে নরম হৃদয়ের বাবা নেই। আধপাগল মামা কাকা জ্যাঠা পিসেমশাই মেসোমশাই নেই। অলৌকিক আজগুবি কান্ডকারখানা নেই।
আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার। “যার রাগ বেশি সে নীরবে অনেক ভালোবাসতে জানে, যে নীরবে ভালোবাসতে জানে তার ভালোবাসার গভীরতা অনেক বেশি”, কিংবা “মেয়েদের স্বভাবই হচ্ছে হালকা জিনিস নিয়ে মাতামাতি করা”, কিংবা “যদি আপনি অন্তর থেকে কাউকে চান, জেনে রাখুন সেই মানুষটিও আপনাকে ভেবেই ঘুমাতে যায়”— এই ধরণের হুমায়ূন-সুলভ “উক্তি” এই বইতে একটাও নেই। বিষয়টা আমাকে খুবই অবাক করেছে। উক্তিবিহীন বই তিনি কীভাবে লিখলেন?!
বাবার সঙ্গে মেয়ের, মেয়ের সঙ্গে মায়ের, বোনের সঙ্গে ভাইয়ের, স্ত্রীর সঙ্গে তার প্রাক্তন স্বামীর, ইত্যাদি যে-সম্পর্কগুলো আমাদের চারপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে, আমরা নিজেরাও যে-সম্পর্কগুলোতে প্রায়শ অংশগ্রহণ করি, মধ্যবিত্ত জীবনের তেমন কিছু সম্পর্ককে দারুন পারদর্শিতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই কাহিনিতে।
পড়তে পড়তে রমাপদ চৌধুরী কিংবা মতি নন্দী কিংবা গৌরকিশোর ঘোষ কিংবা বিমল করের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। হুমায়ূন আহমেদের রচনার এই বাস্তবসম্মত রূপ আমি খুব বেশি দেখিনি। শুধু একটাই আফসোস। হুমায়ূন তাঁর গল্পে মানসিকভাবে শক্তিশালী নারীদের এতো কষ্ট দেন ক্যানো? এই নারীরা নিজেদের শক্তি প্রয়োগ করে যদি জিতে যেত জীবনে, তাহলে আরো ভালো লাগতো আমার।
কবিতার পরেই ছোটগল্প আমার প্রিয় সাহিত্য-আঙ্গিক।
প্রখ্যাত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় পাঁচটা আলাদা খণ্ডে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লেখা ছোটগল্প, পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। এই সংকলনটিকে বাংলা অনুবাদ-সাহিত্যের একটি মাইলস্টোন হিসেবে গণ্য করা হয়। মানবেন্দ্রবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নবনীতা দেবসেনের লেখা একটি প্রবন্ধ থেকে আমি এই সংকলনটির খোঁজ পেয়েছিলাম। আপাতত প্রথম খণ্ডটা পড়লাম। এবং পড়ে তৃপ্ত হলাম।
প্রথম খণ্ডে মোট এগারোটা গল্প আছে। যার মধ্যে দুটো বিখ্যাত বাংলা গল্প ঠাঁই পেয়েছে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের “দেবী” এবং শিবরাম চক্রবর্তীর “দেবতার জন্ম”। এছাড়াও রয়েছে :
প্রেমচন্দের “সদগতি” (হিন্দি)
ভগবতীচরণ পাণিগ্রাহী'র “শিকার” (উড়িয়া)
ভৈকম মুহাম্মদ বশিরের “প্রেমপত্র” (মালায়ালম)
ইসমাত চুঘতাইয়ের “গুডডির নানি” (উর্দু)
পান্নালাল প্যাটেলের “জায়গিরদার আর তাঁর কুকুর” (গুজরাতি)
কৃষণ চন্দরের “পেশোয়ার এক্সপ্রেস” (উর্দু)
ফণীশ্বরনাথ রেণু'র “তিসরি কসম” (হিন্দি)
গোপীনাথ মোহান্তি'র “পিঁপড়ে” (উড়িয়া)
ইউ আর অনন্তমূর্তি'র “ঘটশ্রাদ্ধ” (কন্নড়)
গল্পগুলো পড়ার পরে দুটো বিষয় গভীরভাবে অনুভূত হলো। এক : প্রকরণ হিসেবে ছোটগল্পকে ক্যানো এতো শক্তিশালী বলে মনে করা হয়। দুই : ভাষা, জীবন এবং সংস্কৃতিগত এতো বৈচিত্র্য সত্ত্বেও ভারতবর্ষের অন্তরালে বয়ে যাচ্ছে একটি সার্বজনীন সুরের ফল্গুধারা। বিভেদের হাজারটা কারণ খুঁজে বের করলেও, জাতধর্ম নির্বিশেষে ভারতবর্ষের সব মানুষের দুঃখ, আনন্দ, ভালোবাসা, যন্ত্রণা, অভিশাপ এবং অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রাম— সর্বত্র একই রকম। গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে একটাই ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ।
অনুবাদের মান খুবই চমৎকার, বলাই বাহুল্য।
এবার দ্বিতীয় খণ্ডের দিকে এগোনো যাক।
দামু বেজায় বোকা মানুষ। কেমন বোকা? একবার কে যেন তাকে বলেছিল— দেখে এলাম, আমড়াতলায় তোর ডান কানটা পড়ে আছে। তাই শুনে, নিজের কান পরখ না করেই আমড়াতলায় কান খুঁজতে ছুটেছিল সে।
দামুর চেহারাটাও দেখবার মতো। অন্ধকারে তার দিকে তাকালে মানুষের বুকের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। ভূতের ভয়ে তারা রামনাম জপ করতে শুরু করে। কিন্তু আদপে সে বড্ডো ভালমানুষ। সরল সাধাসিধে মনের দামুকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। কেউই তাকে মূল্য দ্যায় না।
একটা বিশেষ কারণে দামুর একটা হাতির প্রয়োজন হয়। হাতি দিয়ে দামু কী করবে? সেটা তো বলা যাবে না, কিন্তু হাতি একটা দামুর চাই-ই চাই! হাতি না পেলে সে সন্ন্যাসী হয়ে যেতেও রাজি। কিন্তু হাতি জোগাড় করা কি এতই সোজা? হাতি তো আর গরু-ছাগল নয়।
সন্ধ্যেবেলা আমার বোনের বাড়িতে এসেছি লুচি-মাংসের নিমন্ত্রণ খেতে। ঘন্টাদুয়েক সময় ছিল হাতে। বোনের বইয়ের আলমারি থেকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের “সমগ্র কিশোর সাহিত্য” বের করে পড়ে ফেললাম চমৎকার এই হাতি-সন্ধান কাহিনি।
হাতি জোগাড় করা কি দামুর দ্বারা সম্ভব হবে? অবশ্যই হবে! চিরাচরিত ইচ্ছেপূরণের এই গল্পের ভিতরে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন তাঁর অনবদ্য মনভোলানো ম্যাজিক। ছোট্ট উপন্যাসটা শেষ করে মনে পড়ে গ্যালো— আরে! এই গল্পটা নিয়েই তো পরিচালক রাজা সেন একটা সিনেমা বানিয়েছিলেন। খুব সুন্দর সেই সিনেমার নাম “দামু”। উপন্যাসের নামটাও “দামুর হাতি” হলেই যথার্থ হতো। যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার আমি যাই, লুচি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!
.
“আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি— পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি।”
রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ বক্তৃতা, আশি বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রদত্ত। চল্লিশের দশকের শুরুর সেই সময়ে বাতাসে ভাসছে হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় সংঘাতের বিষবাষ্প, দিগন্তে দেখা দিচ্ছে বিশ্বযুদ্ধ এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত। তবুও তিনি আস্থা রেখেছেন মানুষের শুভবুদ্ধির উপর। “অপরাজিত” মানুষের উপর।
অদ্ভুত সুন্দর উপন্যাস লিখেছেন বিমল কর। শেষ হওয়ার পরেও অনুভূতির রেশ এতটাই রয়ে গেছে, খুঁটিয়ে বিশেষ কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। তবু সামান্য কিছু লিখে রাখা দরকার।
বিমল করের গদ্যভাষা, বরাবরের মতোই, ব্যতিক্রমী। অনুপম। মানুষের মন যদি একটা জটিল বিষয় হয়ে থাকে, তবে তো এই উপন্যাসের বিষয়বস্তুকে জটিল বলতে হয়। পূর্ণতার সন্ধানে মানুষ তার জীবন অতিবাহিত করে। জীবনকে সম্পূর্ণরূপে পেতে চায়। উপভোগ করতে চায়। কিন্তু হিসেব মেলাতে বসলে দেখা যায়, অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি আর রিক্ততায় ভরে থাকে মানুষের জীবন। অপূর্ণতায় ভরে থাকে।
নিরাসক্ত, আত্মগত ভঙ্গিতে এই কাহিনি আমাদের শুনিয়েছেন বিমল কর। গভীর এবং শান্ত তাঁর পর্যবেক্ষণ। প্রকৃতির বর্ণনা এত সুন্দর, যেন হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যায়। উপন্যাসটির পটভূমি - বিহারের হাজারিবাগ অঞ্চল। এই অঞ্চলে যারা গিয়েছেন, তারা আরো ভালো বুঝবেন এই ব্যাপারটা। যদিও এই গল্প প্রকৃতির নয়। মানুষের। তিনজন নরনারীর প্রেম এবং প্রেমহীনতার গল্প। প্রেমের মধ্যে দিয়েও তো আমরা সেই পূর্ণতাকেই অন্বেষণ করি, তাইনা?
Though nothing can bring back the hour
Of splendour in the grass, of glory in the flower,
We will grieve not, rather find
Strength in what remains behind.
(Wordsworth)
“গোলকধাম রহস্য” গল্পের শুরুতে মহাভারত প্রসঙ্গে তপেশরঞ্জন মিত্তির বলেছিলো, “এ হলো একধার থেকে ননস্টপ ভূরিভোজ। গল্পের পর গল্পের পর গল্প।” তপেশরঞ্জন ওরফে তোপসের এই কথা শুনে তার কাজিন-ব্রাদার ফেলু মিত্তির উল্লসিত হয়ে এই বইকে “আনপুটডাউনেবল” আখ্যা দিয়েছিলেন। “যে বই একবার পড়ব বলে পিকআপ করলে আর পুট-ডাউন করবার জো নেই!” যদিও তিনি যেটা পড়ছিলেন, সেটা ছিলো থানইঁট সাইজের কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত। কালীসিঙ্গির মহাভারত আমি একবার ট্রাই করেছিলাম। সামলাতে তো পারিই নি, উল্টে ল্যাজে-গোবরে হয়ে গেসলুম।
কালীপ্রসন্ন সিংহের দুই-খণ্ডের মহাভারত এমনিতেই সেই ঊনবিংশ-শতক স্টাইলের তৎসমবহুল পুরোনো বাংলায় লেখা। রেলগাড়ির মতো ইয়া লম্বা লম্বা বাক্য। তার উপর মহাভারতের কিসসার তো কোনো অন্ত নেই। একই কাহিনি চোদ্দোবার বলা হয়েছে। বেশিরভাগ কাহিনির সঙ্গে মূল গল্পের কোনো সংস্পর্শ নেই। সংস্পর্শ থাকলেও সেই সংস্পর্শের বিষয়টা আবিষ্কৃত হয়েছে চারশো-বত্তিরিশ পৃষ্ঠা পরে গিয়ে। চরিত্রদের সংখ্যারও কোনো গোনাগুন্তি নেই। গল্প ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে। দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি, কূটনীতি, রাজনৈতিক তত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, আরো গুচ্ছের সব কঠিন কঠিন ব্যাপার-স্যাপার। প্রথমখণ্ডের ২৬.৩২% এগিয়েই মুন্ডু খামচে বসে থাকার মতো অবস্থা। সেল্ফ-কনফিডেন্সের সোয়া-বারোটা বেজে গেছিলো।
সেই কবে ছোটোবেলায় উপেন্দ্রকিশোরের মহাভারত পড়েছিলাম। রামায়ণ আর মহাভারত যদিও আলাদা করে পড়তে হয়না ভারতীয়দের। বিশেষ করে রামায়ণ। প্রি-ইনস্টলড সফটওয়ারের মতো, জন্মের সময় থেকেই এই গল্প আমাদের মগজের মাদারবোর্ডে চিপকানো থাকে। পৌনে-দুই বছরের পুঁচকে নাকেশিকনি ছোঁড়াকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, রামচন্দ্রের শত্তুর কে? সেও আধো উচ্চারণে ঠিক ঠিক জবাব দেবে : রাবণ। রামচন্দ্রের বউ? - হিহি, সীতা।
কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর তো অল্পবয়েসিদের কথা চিন্তা করে মহাভারত লিখেছিলেন। খোকাখুকুদের মন যাতে দূষিত না-হয় সেকথা ভেবে সমস্ত “অ্যাডাল” প্রসঙ্গ বাদ দিয়েছেন। অনেক গুরুগম্ভীর বিষয় ছেঁটে দিয়েছেন। শরশয্যায় শুয়ে পিতামহ ভীষ্ম কাকে কাকে কী কী পরামর্শ দিয়েছেন সেই জটিল কথাবার্তা শুনলে শিশুরা তো মনে মনে বলবে, অ্যাম্মা ক্বী বোরিং গল্প মাইরি ধুস্ আমি খেলতে গেলাম ঝন্টু তোর ব্যাট বের কর। তাই ওই বইতে ওইসব কিছুই নেই। কিন্তু আমি তো এখন বড় হয়ে গেছি! কালীপ্রসন্নও মুখ বাঁকাচ্ছেন আমার বুদ্ধিশুদ্ধির অভাব দেখে। তাইলে কি মহাভারতটা ভালো করে পড়াই হবে না আমার?
ঠিক এমনি সময়ে, এন্টার দ্য রাজশেখর দ্য বসু! এর আগে তাঁর হাসির গপ্পো পড়ে আঁকুপাঁকু হেসেছি অনেক। হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ হাসতে হাসতে হঠাৎ চোখে পড়লো : আরে! ভদ্রলোক তো বিখ্যাত অভিধানও সংকলন করেছেন। “চলন্তিকা”। অলরাউন্ডার নাকি? তারও পরে একদা হাতে এলো তাঁর লেখা মহাভারত। আমার সব ছ্যাবলামি ফুলস্টপ হয়ে গ্যালো। আমি মহাভারত পড়লাম। কালীপ্রসন্নের দুইখণ্ডের দুটো থানইঁটকে উনি ওস্তাদের মতো পালিশ করে একখণ্ডের সুদৃশ্য শিল্পবস্তুতে পরিণত করেছেন। আমি তখনও বুদ্ধদেব বসু পড়িনি। মুজতবা আলি পড়িনি। শঙ্খ ঘোষ পড়িনি। বাংলা গদ্যের বলিষ্ঠ সৌকর্যে আমার প্রাণ যেন ভরে গ্যালো। প্রথমবারের জন্যে।
মহাভারতকে বলা হয় পৃথিবীর দীর্ঘতম মহাকাব্য। পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থগুলোর অন্যতমও বটে। হিন্দুধর্মের একটা প্রধান আকরগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হলেও আমি মহাভারতকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করিনা। একটা কথা সত্যি, মহাভারতের ভেতরেই আছে “শ্রীমদ্ভগবতগীতা”, যে-বইটি হিন্দু বেদান্ত-দর্শনের সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎস হিসেবে মান্যতা পেয়ে এসেছে বরাবর। কিন্তু মহাভারতের বিশালতাকে শুধুমাত্র একটি ধর্মের চৌহদ্দিতে আটকে রাখার চেষ্টা করা উচিত হবে না, চেষ্টা করে লাভও হবে না। মহাভারতের আবেদন সর্বজনীন। কোনো বিশেষ ধর্ম নয়, একটি বৃহৎ অঞ্চলের সম্মিলিত সংস্কৃতি ও সভ্যতার দীর্ঘকালীন লৌকিক ইতিহাস এটি। অধুনা-প্রচলিত আনুষ্ঠানিক পৌত্তলিক ধর্মের সংগঠন হয়েছে আরো অনেক পরে।
মূল মহাভারতের বিস্তারিত আলোচনা করার পরিসর এটা নয়। (আমার পক্ষে সম্ভবও নয়!) আমি বরং রাজশেখর বসুর ভার্শনটার ব্যাপারে আর মাত্তর চাট্টি কথা বলে আজকের বক্তিমে শেষ করবো আজ্ঞে। রাজশেখর বসুর মহাভারতের সবচেয়ে বড় প্লাসপয়েন্ট হলো, মূল মহাভারতের একটা উপাখ্যানও উনি বাদ দেননি। একটা প্রসঙ্গও হাপিস করেননি। এমনকি প্রচলিত দার্শনিক অংশগুলোও দিব্যি রেখে দিয়েছেন (যেমন “গীতা”)। উনি শুধু মূল সংস্কৃত মহাভারতের অতিরিক্ত কোলেস্টরল এবং ফ্যাটকে ট্রেডমিল-দ্বারা বর্জন করিয়ে সিক্স-প্যাক সারবস্তুটুকু পরিবেশন করেছেন। যাতে আমার মতো ধৈর্যহীন, বুদ্ধিশুদ্ধিহীন ব্যক্তিরাও মহাভারত-পাঠের অভিজ্ঞতা এবং আনন্দ লাভ করতে পারে।
ভাগ্যিস রাজশেখর বসু ছিলেন। তাই আমিও এখন গুরুগম্ভীর আলোচনায়, বিজ্ঞবাগীশ কলার তুলে, স্লো-মোশনে জামার হাতা গোটাতে গোটাতে উদাস কিন্তু হেব্বিজ্ঞানী নয়ন মেলে বলতে পারি : তো ইয়ে যেটা বলছিলাম আরকি... গরুড় যদিও সেই বিশাল গাছটার মগডালে বসে আরাম করে গজকচ্ছপ ভোজন করছিলো, কিন্তু গাছের ডাল তো গ্যালো ভেঙে... শেষ পর্যন্ত গন্ধমাদন পর্বতের শৃঙ্গে বসেই ভোজন করতে হলো তাকে, আর কোনো উপায়ও তো ছিলো না বেচারার, তাইনা?
আপন���রা যারা রাজশেখর পড়েননি তারা তো আমার কথা কিসুই বুঝবেন না। শুধু বলবেন, হেঁ হেঁ তা তো বটেই, তা তো বটেই...
লীলা মজুমদারের জন্মদিন আজকে। সেই কথা ভেবে রচনাসমগ্র বের করে মাকু'র গল্পটা পড়লাম।
মাকু একজন কলের পুতুল, অর্থাৎ রোবট। সে প্রায় সবকিছুই করতে পারে। কথা বলা, গান গাওয়া, নাচা, অঙ্ক কষা, হাতুড়ি পেটানো, দড়ির জট খোলা, পেরেক ঠোকা, ইস্ত্রি করা, রান্না করা, কাপড় কাচা, সেলাই কল চালানো... সবকিছুই করতে পারে। শুধু দুটো কাজ পারেনা।
হাসতে পারেনা আর কাঁদতে পারেনা।
এই দুটো ভীষণ জরুরি কাজ মাকুকে শেখাতে ভুলে গেছে তার মালিক। সোনা আর টিয়া দুই বোন, ঘটনাচক্রে তারা মাকু'র জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তারপর ঘটতে থাকে নানাবিধ অশৈলী কার্যকলাপ।
অল্পবয়েসি পাঠকদের জন্যে গল্প লিখেছেন, তবু তাঁর গল্পে জীবনের জটিল বিষয়গুলো বাদ দিতেন না লীলা মজুমদার। শিশুরা আসলে সবকিছুই বোঝে। মাঝে মাঝে বড়োদের চেয়েও বেশি বোঝে। এই কারণেই, পাঠকের বয়স বেড়ে গেলেও এইসব গল্পের মজা ফুরোয় না।
এই গল্পটা যদিও বেশ ভালোই লাগলো, কিন্তু কেমন যেন খাপছাড়া এলোমেলো মনে হলো। চরিত্রের সংখ্যা আরেকটু কম হলে ভালো হতো। তবু একটা কথা স্বীকার করতেই হয়, লীলা মজুমদারের মাঝারি মানের লেখাতেও ভালোলাগার অনেক রসদ খুঁজে পাওয়া যায়।
শুভ জন্মদিন, লীলাপিসি!
ও হ্যাঁ বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, এই বইয়ের প্রচ্ছদ আর ভিতরের অলংকরণ করেছেন সত্যজিৎ রায়। প্রচ্ছদটা আমার খুব প্রিয়। বাংলা অক্ষর দিয়ে কেমন সুন্দর মুখের অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যজিৎ। একেবারে লা-জবাব!
“যোগাযোগ” পড়া শেষ হলে মনের ভিতর প্রথম যে অনুভূতিটা জেগে উঠেছিল সেটা হলো অতৃপ্তি এবং হতাশা। কাহিনির পরিণতি কেমন হবে তার উপর পাঠকের হাত নেই। পাঠক হলো লেখকের হাতের পুতুল। কিন্তু লেখক নিজেও কি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের জীবন এবং মনের অন্দরমহলে?
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে (প্রথমবার পড়েছিলাম একেবারে কাঁচা বয়সে) বারবার অনুভব করেছি, সাহিত্যের যে-আঙ্গিকটাতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাপ্রদীপ সবচেয়ে কম উজ্জ্বল তা হলো উপন্যাস।
এই দ্বিতীয় দফায় তাঁর সবকটা উপন্যাস এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি, তবে অন্তত নৌকাডুবি, শেষের কবিতা এবং চতুরঙ্গ পড়ার পরে মনে মনে নিজেকে নিজে বলেছিলাম : রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস লিখতে পারতেন না। আজকে “যোগাযোগ” শেষ করে, তৃপ্ত হয়েছি বলবো না, তবে চিন্তার খোরাক পেয়েছি অনেক। আমার সব চিন্তাভাবনার কথা এখানে লেখার উপায় নেই। একটা-দুটো লিখি।
তৃতীয় বিশ্বের (বিশেষ করে, ধর্মকণ্টকিত আমাদের এই উপমহাদেশে) মেয়েদের জীবনযন্ত্রণা যে অনেকরকম, এই কথাটা নতুন করে বলার আর কিছু নেই। “যোগাযোগ” উপন্যাসের যিনি নায়িকা, কুমুদিনী (ডাকনাম কুমু)— রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছে করলেই তাঁকে দরিদ্র কিংবা নিদেনপক্ষে মধ্যবিত্ত ঘরের “সাধারণ মেয়ে” হিসেবে দেখাতে পারতেন।
সেরকম দেখালেই বরং কুমুর জীবনের প্রতিকূল অবস্থার বর্ণনা দেওয়া সহজ হতো। তাঁর প্রতি ঘটে যাওয়া অবমাননাগুলো “স্বাভাবিক” বলে মনে হতো। গরীব ঘরের মেয়ের আবার মান-অপমান কী? গত শতকের প্রথম দিকে সাধারণ বাঙালি পরিবারের মেয়ে হয়ে জন্মানো ছিলো যেন গতজন্মের মহাপাপের ফল। কিন্তু যোগাযোগের কুমুদিনী “সাধারণ ঘরের সাধারণ মেয়ে” ছিলেন না।
তিনি স্বচ্ছল বনেদি জমিদার পরিবারের (যদিও বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু) ইংরিজি-শিক্ষিত “refined” মানসিকতার মেয়ে। তিনি এসরাজ বাজিয়ে ক্লাসিকাল গান গাইতে পারেন। তিনি ছবি তুলতে পারেন। এমনকি বন্দুক চালাতে পারেন। কুমুর দাদা বিপ্রদাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জমানার ব্রাহ্মসমাজসুলভ সফিস্টিকেশনের আদর্শ উদাহরণ।
বিপ্রদাস অতীব সুদর্শন এবং অতীব ঈশ্বরবিদ্বেষী। তিনি নারীস্বাধীনতার সমর্থক। তিনি মুক্তচিন্তার অধিকারী। এমন enlightened দাদার আদরের বোন ছিলেন কুমু। কিন্তু সময়ের তুলনায় এতটা প্রাগ্রসর হয়ে থাকা সত্ত্বেও, বাঙালি নারী হয়ে জন্মানোর আবশ্যিক পরিণামগুলো এড়িয়ে যেতে পারেননি তিনি। এই একটা বিশেষ ব্যাপারে, এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ একটা দারুন চালাকি করেছেন!
ইচ্ছা করেই তিনি কুমু চরিত্রটি “অনন্যসাধারণ” রূপে গড়ে তুলেছেন। এই সত্যটা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যে, সমসাময়িক সমাজ এবং আবহমান সংস্কারের কুদৃষ্টি তোমার উপর পড়বেই (কিছু কিছু সংস্কার তো তুমি নিজেই সযত্নে পুষে রেখেছো)। তুমি ফর্সা হও বা কালো (পলিটিক্যাল কারেক্টনেস বজায় রাখার জন্যে যাদের “শ্যামলা”, “চাপা গায়ের রং”, “মাজা গায়ের রং”, “শ্যামবর্ণা”, “উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা” এইসব কাব্যিক নামে ডাকা হয়), তোমার পরিবার ধনী হোক বা হতদরিদ্র, তুমি শিক্ষিত হও বা নিরক্ষর, কুরূপা কিংবা সুরূপা, ছলনাময়ী কিংবা সরলসোজা, বুদ্ধিমতী কিংবা গর্ধব— তুমি যে-ই হও, মেয়ে হয়ে পৃথিবীতে এসেছো মানেই কিছু কিছু আবশ্যিক অপমান এবং অত্যাচার তোমাকে সহ্য করে নিতেই হবে। পালাবার পথ নেই।
কুমুও পালাতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছে করলেই, পাঠককে খুশি করার জন্যে, তাঁকে পালাতে দিতে পারতেন। “নারীশক্তির জয়”, “নারীচেতনার উদ্বোধন”— এইসব প্রমাণ করে হাততালি কুড়োতে পারতেন। উপন্যাসটা শেষ করে এই কারণেই আমি নিদারুণ হতাশ (এবং কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ) হয়েছিলাম। কিন্তু খানিকক্ষণ চিন্তা করে দেখলাম, পরিবার, পরিবেশ, সময় এবং সমাজের দ্বারা টেনে দেওয়া গণ্ডিকে মেয়েরা আদৌ প্রত্যাখ্যান করতে পারে? কোনোদিন পেরেছে কি?
তখনকার কথা বাদ দিলাম, আজকের দিনেও কি পারে? কেউ কেউ পারে (গণনায় যারা যৎসামান্য), কিন্তু অধিকাংশ মেয়েরা পারে? আজও কি সবাই সাহসী হতে পারে? সবাই কি নিজের ভিতর জাগ্রত করতে পারে তথাকথিত নারীবাদসম্মত মুক্তিচেতনা? রুখে দাঁড়াতে পারে? হতে পারে নির্ভীক? হতে পারে “ব্যতিক্রমী”? হতে পারে “বেপরোয়া বেহায়া অসভ্য নির্লজ্জ মেয়েছেলে”? দৃঢ় কন্ঠে বলতে পারে, “পরোয়া করিনা!”
নাহ, পারে না। যারা পারে, তারা কয়জন? আপনি বলুন দেখি কয়জন? কয়জন “ব্যতিক্রমী” মেয়েকে চেনেন আপনি?
বেশ কিছু গঠনগত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও “যোগাযোগ” একটি জরুরি উপন্যাস। অনেক বিখ্যাত নারীবাদী উপন্যাসের চেয়ে বেশি বাস্তবসম্মত। কুমুদিনীর অপমান আমার বুকে এসে বেজেছে। সেই অপমানের নিষ্পত্তি করে কুমুদিনী মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেননি, এটা দেখে আমার মাথা নিচু হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কুমুদিনীকে জিতিয়ে দেননি, কারণ কুমুদিনীরা তখনকার দিনেও পরাজিত হতো, আজও পরাজিত হয়। আর পাঠক হিসেবে আমরা অতৃপ্ত কণ্ঠে আফসোস করি : ধুর, গল্পের এন্ডিংটা মনের মতো হলো না!
ছোট হয়ে নেমে পড়ুন মশাইসরু হয়ে নেমে পড়ুন মশাইচোখ নেই ? চোখে দেখতে পান না ?সরু হয়ে যান, ছোট হয়ে যান !আরো কত ছোট হব ঈশ্বর ?ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে !আমি কি নিত্য আমারও সমানসদরে, বাজারে, আড়ালে ?
যদি জিজ্ঞেস করা হয় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আইকনিক নারী কে ছিলেন? তাহলে প্রায় নির্দ্বিধায় উত্তর দেওয়া যায় : মারি কুরি। ক্যানো? রেডিয়াম এবং পোলোনিয়াম মৌল আবিষ্কার করেছিলেন বলে? রেডিওঅ্যাক্টিভিটি নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণা করেছিলেন বলে? দু'বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বলে?
মারি কুরি'র মেয়ে ইভ কুরি'র লেখা এই অসামান্য জীবনীগ্রন্থটা পড়ার আগে আমিও নিশ্চয়ই এইসব মামুলি উত্তর দিতাম। কিন্তু বইটা পড়ার পরে আমি বিলকুল হতভম্ব হয়ে গেছি। পরাধীন পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এই নারী, সেই সময় যাঁর নিজের দেশের কোনো ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের অ্যাডমিশন দেওয়া নিষিদ্ধ ছিলো ; পয়সার অভাবে যাঁকে লোকের বাড়িতে গভর্নেসের কাজ করতে হয়েছে দীর্ঘদিন ; প্যারিসের প্রচণ্ড শীতে যাঁর পরিধানের জন্যে না ছিলো ঠিকঠাক শীতবস্ত্র, খাওয়ার জন্যে না ছিলো যথেষ্ট খাদ্য, বসবাসের জন্যে না ছিলো একটা ভদ্রস্থ ঘর ; তবুও যখন বইয়ের শেষের দিকে জানতে পারি : “মাদাম কুরি, বৈজ্ঞানিক, ফ্রান্স”— এইটুকু ঠিকানা লিখে পাঠালেই তাঁর কাছে চিঠি পৌঁছে যেত, তখন মনে হয়, একটা কিংবা দুটো কিংবা তিনটে কিংবা চারটে কিংবা দশটা কিংবা কুড়িটা পয়েন্টের একটা লম্বাচওড়া লিস্ট বানিয়ে মারি কুরি'র সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়।
এত বিচিত্র, বহুমুখী এবং অকল্পনীয় পথে তাঁর চরিত্র এবং জীবন ধাবিত হয়েছিল যে, এই রিভিউটা লিখতে বসে আমি কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবো, কীভাবে অল্প কয়েকটা কথায় এই মানবীর পরিচয় দেবো বুঝতে পারছি না। Superwoman. শুধুমাত্র এই একটা শব্দ লিখেই তাঁর পরিচয় দেবার কাজটা সেরে ফেলা যেত, কিন্তু তিনি তো মোটেও Superwoman ছিলেন না। তাঁর মধ্যে আদপেই তো কোনো সুপারপাওয়ার ছিলো না। কর্তব্যের প্রতি অপরিসীম নিষ্ঠা, কাজ করার প্রচণ্ড স্পৃহা, অদম্য জেদ, অদম্য আত্মসম্মানবোধ— এই গুণগুলোকে তো আর “সুপারপাওয়ার” বলা যায়না, তাইনা? যদি বলা হয়, সাধারণ মানুষের চেয়ে তাঁর বুদ্ধি এবং প্রতিভা ছিলো অনেক বেশি, এই কারণেই তিনি এরকম অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তাহলে যুক্তিটা অনেকটা সেরকম হবে, যদি মাউন্ট এভারেস্টের শিখরে ওঠার পরে কাউকে বলা হয় : ওহ, আপনার তো দুটো পা আছে, সেই কারণেই আপনি শিখরে উঠতে পারলেন!
আমি বোঝাতে পারছি কিনা জানিনা, “বিশেষ” কোনো মহাজাগতিক গুণের অধিকারী ছিলেন না মারি কুরি, তবুও তিনি বিজ্ঞানজগতের শিখরে উঠতে পেরেছিলেন, এই বিষয়টা বুঝতে পেরেই আমার এই হতভম্ব অবস্থা। তাহলে ম্যাজিকটা লুকিয়ে আছে কোথায়? কিছু তো একটা ব্যাপার আছে যে-কারণে তিনি একজন অসামান্য মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আচ্ছা বেশ, কারণগুলো আরেকবার বলি তাহলে? কর্তব্যের প্রতি অপরিসীম নিষ্ঠা, কাজ করার প্রচণ্ড স্পৃহা, অদম্য জেদ, অদম্য আত্মসম্মানবোধ। সত্যি বলছি, তাঁর জীবনী পড়ে অনেক খুঁজেও, অনেক ভেবেও, আমি অন্য কোনও স্পেশাল কারণ আবিষ্কার করতে পারিনি!
আমার মধ্যে যা আছে, আমার মাথায় যতটুকু বুদ্ধি আছে, যতটুকু সুযোগ আমি পেয়েছি, কেবল এইগুলো কাজে লাগিয়েই আমি অনেক কিছু করতে পারি। দরকার নেই প্রচণ্ড বুদ্ধিমান হওয়ার। দরকার নেই প্রভূত সুযোগ পাওয়ার। এই উপলব্ধিটাই মারি কুরি'র জীবন থেকে আমার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। এই কারণেই তিনি শুধু বিংশ শতাব্দীর নয়, গোটা ইতিহাসের সবচেয়ে আইকনিক নারীদের মধ্যে... না না, ভুল বললাম! জীবনে কখনও, কোনোদিন, নারী হওয়ার জন্যে আফসোস কিংবা উদযাপন করেননি তিনি, তাই তাঁকে শুধু “আইকনিক নারী” বললে তাঁর জীবনদর্শনের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। তিনি ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আইকনিক মানুষদের মধ্যে একজন।
নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্রটার সন্ধানও দিয়েছেন তিনি। মারি কুরি'র সেই অস্ত্রটা তাঁর জীবনের মতোই সাদামাটা, গ্ল্যামারহীন, কিন্তু কার্যকরী। অস্ত্রটার নাম : কাজ (তাঁর ক্ষেত্রে গবেষণার কাজ)। তাঁর যোগ্য সহকর্মী এবং জীবনসঙ্গী, অকালপ্রয়াত পিয়ের কুরি'র একটা কথা তিনি আজীবন মনে রেখেছেন : “যদি প্রাণটাও চলে যাওয়ার উপক্রম হয়, তবুও কাজ বন্ধ করা যাবে না।” শুধু পুরুষতন্ত্র নয়, সামাজিক বাধাবিপত্তি কিংবা অনিবার্য দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধেও মারি কুরি শুধু একটাই অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। কাজ করে যাওয়া। কাজ করে যাওয়া। আর কাজ করে যাওয়া।
আরো একটা অসাধারণ চারিত্রিক গুণ ছিলো তাঁর, যেটার কথা আলাদা করে বলা দরকার। আমি বরং বই থেকে একটা ঘটনার কথা হুবহু লিখে দিই, তাহলে ভালো বোঝা যাবে। রেডিয়াম একটি মহামূল্যবান মৌলপদার্থ। ১৯২০ সালে এক গ্রাম রেডিয়ামের দাম ছিলো এক লক্ষ ডলার। একজন আমেরিকান সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন :
- আপনার কাছে কতোটুকু রেডিয়াম আছে?
- আমার ল্যাবরেটরিতে এক গ্রামের বেশি নেই।
- আপনার কাছে মাত্র এক গ্রাম আছে?
- আমার? ওঃ, আমার তো কিছু নেই। আমার ল্যাবরেটরির জিনিস ওটা।
- আমি স্বত্বাধিকার অনুযায়ী প্রাপ্য অর্থের কথা বললাম। আপনি তো প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতেন।
শান্ত স্বরে তিনি জবাব দিলেন : কারুর ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করা রেডিয়ামের কাজ নয়। রেডিয়াম একটা মৌলিক পদার্থ মাত্র। তার উপর সবার সমান অধিকার।
আরো আগে, আরো অনেক আগে এই বইটা পড়লে হয়তো আরেকটু অন্যরকম হতো জীবনটা!
কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসটিকে কাছ থেকে অবলোকন করলে ঝাপসা দেখাবে। দূর থেকে অবলোকন করলে খাপছাড়া দেখাবে। উপন্যাসটি পড়ে খুব ভালো লেগেছে, এই কথা জানানোর পরে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, উপন্যাসের বিষয়বস্তু কী? কাহিনি কী? কোনো বই পড়ার পরে এমনিতে আমি ভালোলাগা মন্দলাগার কারণগুলো গুছিয়ে বলার চেষ্টা করি। কিন্তু এইক্ষেত্রে, ক্যানো জানি মনে হচ্ছে, ম্যাজিকের রহস্য জানিয়ে দিলে যেমন ম্যাজিকের মজা কমে যায়, কাঁদো নদী কাঁদোকে নিয়ে বেশি বিশ্লেষণ করলে পড়ার আনন্দও কমে যাবে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “বড় সাহিত্যের একটা গুণ হচ্ছে অপূর্বতা— অরিজিন্যালিটি।” এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে এই উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সচেতনভাবে অরিজিন্যাল কিছু সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন। “স্ট্রিম অফ কনসাসনেস”, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছিলেন “সচেতন মনের অবিরাম বকবক”, এই বিষয়টা ওয়ালীউল্লাহর অনেক আগে থেকেই সাহিত্যে বিদ্যমান। ম্যাজিক রিয়েলিজমের ব্যবহারও এই উপন্যাসের মৌলিকতা নয়। তাহলে? আমার মনে হয়েছে, এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় অরিজিন্যালিটি হলো এর বর্ণনাকৌশল। মানুষের শরীরের বর্ণনা হোক কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যের, অলৌকিকতার বর্ণনা হোক কিংবা প্রখর বাস্তবের, কী যে এক রহস্যময় বাঙ্ময়তা ছড়িয়ে আছে উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়— মুখর হয়েও স্তব্ধ। চঞ্চল হয়েও নিবাতনিষ্কম্প। বাংলা সাহিত্যে এমন জিনিস আমার চোখে পড়েনি কস্মিনকালে। বিশ্বসাহিত্যের কথা জানিনা। কতোটুকুই বা আর পড়েছি!
মানুষের মনকে, মানুষের মনের সিঁড়িভাঙা জটিল অঙ্ককে যেন হাতের মুঠোয় ধরে ফেলেছেন ওয়ালীউল্লাহ। কাহিনির একদম শুরু থেকেই, নিদ্রারসে সিঞ্চিত এক দ্বিপ্রহরে, স্টিমারের একজন যাত্রীর দেহভঙ্গিমা এবং স্বভাবচরিত্রের বর্ণনার মধ্যে দিয়ে পাঠকের চেতনাকে আবিষ্ট করতে শুরু করেন লেখক। সেই বিশেষ যাত্রীটি তাঁর ফেলে আসা জীবনের একটি বিশেষ ঘটনার কথা স্টিমারের সহযাত্রীদের কাছে বলবার উপক্রম করেন। মূল উপন্যাসের যিনি কথক, ঘটনাটি তিনি আগে থেকেই জানতেন। শুরু হয় গল্পের যাত্রা। এইভাবেই ধূপের অদৃশ্য সুগন্ধের মতো, কাহিনির প্লটহীন মন্থর আমেজ আমাকে ঘিরে ফ্যালে। ভাষার অমোঘ অথচ অনায়াস প্রয়োগে, বর্ণনার সূক্ষ্ম কারুকাজে, চিত্রকল্পের মগ্নতায়, আমি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করি, “অরিজিন্যালিটি” শব্দটির দ্বারা রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন।
I am moved by fancies that are curledAround these images, and cling :The notion of some infinitely gentleInfinitely suffering thing.
(টি এস এলিয়ট)