অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম-সার্ধশতবার্ষিকী চলছে। তাই স্থির করেছি এবছর তাঁর সমস্ত লেখা আবার পড়ে ফেলবো একটু একটু করে। এটা তাঁর প্রথম বই। আয়তনে সবচেয়ে ছোট বইও বটে। বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা - পনেরো মিনিট।
গল্পটা খুবই পরিচিত। মহাভারতের থেকে নেওয়া গল্প। একই গল্প নিয়ে কালিদাস নাটক লিখেছিলেন - অভিজ্ঞানশকুন্তলম্। কালিদাসের ভার্শনে প্রাপ্তবয়সোচিত উপাদান আছে প্রচুর। খোকাখুকুরা পড়বে বলে অবন ঠাকুরের বইতে সেসব নেই। গল্পটা হলো, একজন মানুষের দ্বারা আরেকজন মানুষ কিভাবে অহেতুক উপেক্ষিত হচ্ছে।
“অবন ঠাকুর ছবি লেখেন”, অর্থাৎ কেবলমাত্র শাব্দিক বর্ণনার মাধুর্যেই যেন চোখের সামনে একটা চিত্রশিল্প দেখতে পাওয়া যাচ্ছে - অবনীন্দ্রনাথের এই ট্রেডমার্ক বৈশিষ্ট্যটা তাঁর প্রথম বইতেই চিনে নেওয়া যায়। কিন্তু উপভোগ্য হয়ে ওঠেনা। কেমন যেন বিরক্ত লাগে এত এত বর্ণনার সমাহার। যদিও শুধু এই বইটার ক্ষেত্রেই এই বিরক্তির কথাটা প্রযোজ্য। তাঁর পরের বইগুলো তো দারুন দুর্দান্ত!
#অবনঠাকুর_১৫০
রোজ কত মানুষ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। হারিয়ে যায়। রেলস্টেশনের দেয়ালে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবিসহ বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। বালক, যুবক, মাঝবয়েসি, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, মহিলা, পুরুষ, মানসিক ভারসাম্যহীন। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ওয়েবসাইটের সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যান দেখলাম, ২০১৯ সালে বেপাত্তা হয়ে গেছে চার লক্ষেরও বেশি মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আজ আর জীবিত নেই। এদের মধ্যে অনেকেই এখনও নিরুদ্দেশ, কারণ তাদের খুন করে ফেলা হয়েছে।খুন করার পরে কারো দেহ পুঁতে দেওয়া হয়েছে মাটির গভীরে। শহরের ভেতর লাশ পোঁতার উপায় নেই। সেখানে তো জায়গাই নেই। তাই পোঁতা হয়েছে শহরের উপকণ্ঠে। শহরের মানুষ বাড়ছে। জায়গা কমছে। শহরের উপকণ্ঠে গড়ে উঠছে উপনগরী। উপনগরীতে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গগনচুম্বী অট্টালিকা। নতুন অট্টালিকা বানানোর জন্য ভিত খনন করা হচ্ছে। ভিত খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গ্যালো আস্ত নরকঙ্কাল। রেলস্টেশনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিজ্ঞাপনে তো মুখের ছবি দেওয়া থাকে। তবুও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। নরকঙ্কালের মুখ কই?হালফিলের পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা রহস্যকাহিনি/থ্রিলার আমি পড়ি না। পড়লে আমার একইসঙ্গে হাসি পায় এবং বিরক্ত লাগে। একমাত্র ব্যতিক্রম রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের গোয়েন্দা কানাইচরণ সিরিজ। এর আগে এই সিরিজের প্রথম বই [b:কলকাতা নুয়া 53295778 কলকাতা নুয়া Rajarshi Das Bhowmik https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1588173875l/53295778.SY75.jpg 81308087] পড়ে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-সৃষ্ট শবর দাশগুপ্ত চরিত্রটির কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে যথার্থ পুলিশ-প্রোসিজুরাল গোত্রের রহস্যকাহিনি আজপর্যন্ত একটাও লেখা হয়নি। কানাইচরণ হলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপযুক্ত পুলিশি-গোয়েন্দা। এই সিরিজের নতুন বইটি পড়ে আমার মুগ্ধতা আগের বইটিকেও ছাপিয়ে গেছে।লেখকের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, কানাইচরণ চরিত্রটিকে তিনি বাস্তবসম্মতভাবে সৃষ্টি করেছেন। সকল চরিত্রদের চলাফেরা-কথাবার্তা, কাহিনির পটভূমিকা, অপরাধ ও অপরাধীর গতিপ্রকৃতি, সাসপেক্ট, মোটিভ ও অ্যালিবাইয়ের গোলকধাঁধা, এবং সবশেষে রহস্যসমাধানের প্রক্রিয়া, প্রতিটি ক্ষেত্রে রহস্যগল্পসুলভ টিপিক্যাল অতিনাটকীয়তাকে সচেতনভাবে বর্জন করেছেন লেখক। অথচ তার ফলে কাহিনির বাঁধুনি আলগা, কিংবা রহস্যের উপভোগ্যতায় ঘাটতি হয়নি। পুলিশের প্রকৃত কর্মপদ্ধতি ও তদন্তের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো যেরকম নিখুঁত ডিটেইলে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক, তা এককথায় বিস্ময়কর!উপন্যাসটা পড়া শেষ করে আমার মনে হয়েছে, রহস্যকাহিনির ছদ্মবেশে আসলে লেখক একটি সমসাময়িক বাস্তবসম্মত সামাজিক ভাষ্য রচনা করতে চেয়েছেন। পাঠশেষের মুগ্ধতা একটু ঝিমিয়ে এলে মনে একটা প্রশ্ন জাগে। [b:পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর 54448389 পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর Paiyya Firingi Dor Rajarshi Das Bhowmik https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1594265217l/54448389.SY75.jpg 84969463]-এর মতো ব্যতিক্রমী ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন যে-লেখক, সেই একই লেখক, পাশাপাশি অবলীলায়, কানাইচরণের মতো অভিনব গোয়েন্দাচরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন কীভাবে? এমন একটি দুর্দান্ত চরিত্র উপহার দেওয়ার জন্যে লেখককে আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই! অত্যন্ত সুলিখিত এই উপন্যাসটি নিয়ে আরো বেশি আলোচনা হওয়া জরুরি।“আমি ভাবি, ভবিষ্যতে কোনোদিন, আমাদের ধ্বংসও কি আমাদের মতোই ছাপোষা হবে?”
বাংলা অ্যাকাডেমির এই লোকসংস্কৃতি সিরিজটা দারুন। আমার মাতামহ নোয়াখালীর মানুষ ছিলেন। ভারতে বসবাস শুরু করার পরেও তিনি ভারতীয় ছিলেন না ; নোয়াখালীর আলো-বাতাস-জল-মাটি পুরোপুরি ঢুকে ছিলো তাঁর বুকের ভিতর। মাথার ভিতর। এবং অবশ্যই মুখের ভাষা। এসব ছিলো আমৃত্যু। স্বাভাবিকভাবেই, আমার ভিতরেও সামান্য নোয়াখালী ঢুকে আছে।
লোকসংস্কৃতির উপাদান দুরকম হতে পারে। বস্তুগত এবং ঐতিহ্যগত। বস্তুগত উপাদানগুলো চোখে দেখা যায়। যেমন নোয়াখালীর হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি নানাবিধ লোকসামগ্রী। কিংবা সেখানকার বিশেষ খাবারদাবার। যেমন নোয়াখালীর ঘিগজ ধানের মুড়ি, যার রং হালকা গোলাপি। এছাড়া, গাছপালা-লতাপাতা। শিল্পকলা। যারা বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র। অন্যদিকে, ঐতিহ্যগত উপাদানগুলো চোখে দেখা যায়না ঠিকই, কিন্তু তাদের প্রভাব থাকে অনেক বেশি। কারণ তারা থাকে মানুষের স্মৃতিতে, সত্তায়।
ঐতিহ্যগত উপাদানের একটা বড় অংশ হলো প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা, সংগীত, ইত্যাদি। আমার বেশি উৎসাহ এইসব নিয়ে। এই বইতে খুব যত্ন নিয়ে সংগ্রহ করা হয়েছে এগুলো। যদিও আরেকটু যত্নবান হলে ভালো হতো। প্রবাদের একটা উদাহরণ দিই। “মায় কয়না পুত, মাসিয়ে কয় আঁর ভোইন হুত, আঁর ভোইন হুত!” এর অর্থ - মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। কিন্তু এই বইতে অর্থ দেওয়া আছে - অন্য আত্মীয়রা যতই আদর যত্ন দেখাক না কেন, তারা মায়ের মতো নয়। একেবারেই ভুল বোঝা হয়েছে প্রবাদটা। নোয়াখালীর ভাষা এতই দুরূহ যে অভিজ্ঞ সংগ্রাহকরাও ঘোল খেয়ে গেছেন। তবুও তাঁদের প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই খাটো করার উপায় নেই।
খুব সামান্যই বললাম। আরো অনেক কিছু রয়েছে এই বইতে। বেশ কিছু লোককবিতা কাহিনি কিসসা রূপকথা ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। “বসন্ত কাল আইছেরে, গাছে ধৈচ্ছে হুল/ হুল নয়রে হুল নয়, গাছের কানের দুল” (হুল মানে ফুল :p)। আধুনিকতার আড়ম্বরে এইসব লোকজ উপাদানগুলো ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এদের সংরক্ষণ করা ভীষণ জরুরি। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন আমার খুব প্রিয় প্রচ্ছদশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। রিভিউ শেষ করার আগে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি :
এক থাল সুয়ারি
গইনতে না হারি।
(এক থালা সুপারি, গুনতে না পারি)
কন্ চাই কিয়া?
অনেক আগের কথা। বাড়িতে “দেশ” পত্রিকা নেওয়া হতো বটে কিন্তু আমি সেটা পড়তাম না। আমি পড়তাম আনন্দমেলা আর কিশোরভারতী। মা “দেশ” পড়তো। খেয়াল করতাম পত্রিকা হাতে নিয়ে মা প্রথমেই পড়ে ফেলতো “বাগর্থকৌতুকী” নামের ছোট একটা ধারাবাহিক কলাম। পড়তে পড়তে মায়ের মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠতো। আমি আড়চোখে মা-কে দেখতাম। কলামটাও নেড়েচেড়ে দেখতাম, কিসুই বুঝতাম না। কী সব হিবিজিবি লেখাপত্তর...
চিরুনি তল্লাশি থেকে ইঁদুর দৌড়
মাল তুলতে প্রেস্টিজে গ্যামাকসিন
ইশে মানে— যে আর কী বুঝলেন না জয়গুরু
গণ্ডেরিরাম বাটপারিয়া হেশোরাম হুঁশিয়ার পাজঞ্জরিতে তিরিতঙ্ক লাগে
‘কোনও ব্যাপার না' ‘ওকে'
দেখো মগর প্যার সে
অবজ ধেচুয়া ঘোঙা
ঢাক ঢাক গুড় গুড়, গুড় গুড় ঢাক ঢাক
এত ভংগ বংগ দেশ তবু রংগে ভরা
চমকানোর কিছু নেই, এগুলো হলো বইটির কতিপয় অধ্যায়ের নাম। সেই হিবিজিবি কলামটি যে এত সুস্বাদু, এবং পড়তে পড়তে আমার মুখেও কখন যেন নিজের অজান্তে মুচকি হাসি চলে আসছে, এইসব অনেক পরের ঘটনা। “বাগর্থ” = বাক্ + অর্থ। বাক্ মানে কথা। অর্থ হচ্ছে সেই কথাটির মানে। একটা ছাড়া অন্যের অস্তিত্ব নেই। আমার নাম অরূপ। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ - রূপ নেই যার, কুৎসিৎ (অভিধানে এই মানেটাই প্রথমে উল্লেখ করা আছে)। কিন্তু সত্যিই যদি অরূপ মানে কুৎসিৎ হতো, তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ গান লিখতেন - “অরূপ তোমার বাণী, অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক সে আনি”...?
আক্ষরিক অর্থকে পেরিয়ে গেলে পাওয়া যাবে শব্দটির প্রকৃত অর্থ। অভিধানেই আছে, অরূপ মানে - “নিরাকার”। নিরাকার মানে, যে জিনিসটা আছে ঠিকই, অথচ তাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না (আমাকে যদিও চোখে দেখা যায় বলেই জানি)। ঠিক তেমনি, বাংলা শব্দভাণ্ডারে এমন অসংখ্য শব্দ আছে যাদের বাক্ এবং অর্থ নিয়ে কৌতুক করা শুরু করলে কৌতুকের পাহাড় জমে যাবে। কৌতুক মানে আসলে কিন্তু ফাজলামি কিংবা নিছক ঠাট্টা নয়। কৌতুক শব্দটা এসেছে সংস্কৃত “কুতুক” শব্দ থেকে। কুতুক মানে কৌতূহল। বোঝাই যাচ্ছে, কৌতূহল না থাকলে কোনো কিছু নিয়ে আমোদ কিংবা ঠাট্টা করার অধিকার জন্মায় না।
মানুষের সৃষ্ট সবচেয়ে আশ্চর্য বস্তু হলো ভাষা। “বাগর্থ” হলো ভাষার মাথার মুকুটের সবচেয়ে মূল্যবান মণি। একটা ভাষা তৈরিই হয় শব্দ দিয়ে, আর সেই শব্দের অর্থ দিয়ে। তারপর আসে ব্যাকরণ, হ্যানা ত্যানা। জ্যোতিভূষণ চাকী ছিলেন বহুভাষাবিশারদ। বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত, হিন্দি, পালি, উর্দু, ফারসি, ইত্যাদি ভাষাতেও পারদর্শী। আমাদের বাংলা ভাষার হজমশক্তি তো নেহাত কম নয়। পৃথিবীর নানা ভাষার শব্দভান্ডার থেকে শব্দ গ্রহণ এবং আত্তিকরণ করে বসে আছে আমাদের বাংলা ভাষা। আত্তিকরণ মানে বেমালুম হজম করে ফেলা। এমনকি এই “হজম” আর “বেমালুম” শব্দদুটোও মূলত আরবি ভাষা থেকে এসেছে। তো, ঐশ্বর্যমণ্ডিত এই যে বাংলা শব্দভাণ্ডার, এতে লুকিয়ে আছে কত যে আমোদ, কত মজা, কত কৌতুক, কত মুচকি হাসি, তার কিছুটা উপলব্ধি ঘটে এই বইটা পড়লে।
রোজকার খবরের কাগজ, হরেকরকম বইপত্র, কতরকম অভিধান, দৈনন্দিন মুখের ভাষা, আরো বিবিধ উৎস থেকে লেখক শব্দ (কিংবা শব্দগুচ্ছ) সংগ্রহ করেছেন। তারপর নেড়েচেড়ে দেখেছেন সেইসব শব্দের উৎস, ব্যুৎপত্তি, প্রয়োগ। শব্দের মাঝে ঘাপটি মেরে থাকে শুধু তো সেই শব্দের অর্থ নয়। কতরকম বিপত্তি, কতরকম ত্রুটি, কতরকম ভ্ৰান্তি, কতরকম “হলদে সবুজ ওরাং ওটাং”। ভাষা কিংবা শব্দ নিয়ে এত মজাদার আলোচনা বাংলায় আমার খুব বেশি চোখে পড়েনি। একজন বহুভাষাবিদের পক্ষেই সম্ভব শব্দতত্ত্বের মতো একটা রসকষহীন বিষয়কে এমন মুচকি হাসিতে রূপান্তর করা।
খুব সামান্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন, রোজকার কথায় মুদ্রাদোষ। যেটা আমাদের সব্বার আছে। কথার মাঝে কেউ বারবার বলে, “ইয়ে”— তো যেটা বলছিলাম, ইয়ে, টাকাটা এনেছো? আমার মানে, ইয়ে, পকেট একদম, যাকে বলে, ইয়ে, গড়ের মাঠ। কিংবা বলে, “চিন্তা করুন”— আমি ওকে, চিন্তা করুন, কত বোঝালাম, কিন্তু আমার কথায়, চিন্তা করুন, কানই দিলো না, সংসারের হাল, চিন্তা করুন, ওকেই তো ধরতে হবে, চিন্তা করুন? কিংবা বলে, “তোমার”— আমি তোমার, ক্রিকেটটা তেমন ভালোবাসিনে, ক্রিকেট তোমার, বড্ডো একঘেয়ে, আর ফুটবল তোমার, উত্তেজনায় ভরা! এরকম আরো অনেক আছে। “কী বুঝলেন?”, “ঠিক কিনা?”, “বললে বিশ্বাস করবেন না”, “good”, “very good”, “হলো গিয়ে”...।
- কাল ফিরলাম।
- good
- মা-কে সঙ্গেই এনেছি।
- good
- এখন থেকে আমার সঙ্গেই থাকবেন উনি।
- good
- বাবা হঠাৎ মারা গেলেন কিনা।
- good good.
এক পিশেমশাই এতবার “ইশে” বলতেন যে তার নামই হয়ে গেছিলো ইশেমশাই!
“মাঝে মাঝে লোকজনকে বেদম গাল দেবার জন্যে ভেতরটা চিড়বিড় করে ওঠে।”
কিন্তু সরাসরি গালিগালাজ করা তো সম্ভব নয়। ভেতরটা চিড়বিড় করে উঠলেও নয়। কারণ, একটা কথা আমরা সব্বাই মেনে নিয়েছি। যে-নর্দমায় আমরা বাস করি তার পোশাকি নাম “সভ্য সমাজ”। সভ্য সমাজে বাস করে একে-অপরকে গালিগালাজ করা যায় না, স্যার। কিন্তু... একটা কাজ করা যায়। একটা আয়না খাড়া করা যায় মানুষের সামনে। মানুষ তো নিজেরাই গালিগালাজ করে চলেছে অহরহ। তাদের সামনে যদি একটা আয়না রাখা যায়, তাহলে মাছও খাওয়া হবে, গলায় কাঁটাও ফুটবে না।
Vox populi, vox Dei. (জনতার কন্ঠ মানেই ঈশ্বরের কন্ঠ)
আহা, এমন একখান খাসা কথা দিয়ে শুরু করলেন তাঁর অভিধান। এমন একটি অভিধান, যেখানে নাকি তিনি সংগ্রহ করেছেন “প্রচলিত ধ্যানধারণা”-কে। “প্রচলিত ধ্যানধারণা” মানে? মানে সেই আয়নাটা, যার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ নিজেই নিজেদের গালি দেয়। জিজ্ঞেস করলে বলে, কেমন চুপ করিয়ে দিলাম বলো আয়নাটাকে? হুঁ হুঁ বাবা, চালাকি নয়, আমার নাম “জনতা”। আমার কন্ঠ মানেই ঈশ্বরের কন্ঠ। (গর্বের হাসি)
পুরোনো জিনিস (অ্যান্টিক) - আরে, ওগুলো সব হালে তৈরি !
শিল্প - কী কাজে লাগে বলুন? আজকাল তো যন্ত্রে ‘আরো ভালো ও দ্রুত' কাজ পাওয়া যায় !
হাই - হাই তুলেই বলতে হবে : ‘ইয়ে, মাপ করবেন, এটা বিরক্তি থেকে নয়, হজমের অসুবিধে থেকে'।
দাড়ি - গায়ের জোরের বাহ্যিক প্রমাণ। যারা দাড়ি রাখে তাদের গায়ের জোর বেশি। এবং তারাই প্রকৃত পুরুষ। বাকিরা সব মেয়েছেলে।
যুদ্ধ - সর্বদাই দুজন বিজয়ী হয় : বিজয়ী ও বিজেতা।
জন্তুজানোয়ার - অনেকেই মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান !
সোনালি চুলের নারী (ব্লন্ড) - কালো চুলদের চেয়ে ‘উষ্ণ'।
কালো চুলের নারী (ব্রুনেট) - সোনালি চুলদের চেয়ে ‘উষ্ণ'।
ঝি (কাজের লোক) - ঝি মাত্রেই বজ্জাত !
বৌদ্ধধর্ম - ‘ভারতবর্ষের নকল ধর্ম'।
গ্রাম - সেখানে শৌচাগার নেই, সুতরাং কাপড় তুলে—
সারল্য - সব সময়ই ‘মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো'।
ডাক্তারির ছাত্র - মড়ার পাশে খায়, মড়ার পাশে শোয়। কেউ কেউ মড়া খায়।
দুঃস্বপ্ন - পেট থেকে উৎপত্তি।
সেলিব্রিটি - এদের সম্পর্কে ঠেস দিয়ে কথা বলতে হবে। এদের ব্যক্তিগত ছিদ্রান্বেষণ করতে হবে।
অকৃতদার - কী দুঃখের জীবন এদের !
শ্যাম্পেন - ওটা তো পান করা হয় না, ‘গেলা' হয়।
চুল - ধুর, পরচুলা !
শল্যচিকিৎসক - এদের ‘কশাই' বলে ডাকতে হবে।
ক্লাসিক - সব্বাই পড়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
অসতীর স্বামী - প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত স্বামীকে চুতিয়া বানানো।
সংকলন (compilation) - এর চেয়ে সহজ বই লেখা আর হতে পারে না।
আরাম (comfort) - অমূল্য আধুনিক আবিষ্কার।
কোষ্ঠকাঠিন্য - লেখাপড়া জানা লোকমাত্রেরই এটা থাকে।
মিলন - অশ্লীল কথা !
শরীর - আমাদের শরীরের ভেতরটা যে কীভাবে তৈরি, জানা থাকলে নড়াচড়া করতে ভয় পেতাম।
বেশ্যা - আমাদের মেয়ে-বোনেদের রক্ষা করে, যতদিন তারা অবিবাহিত।
সমালোচক - সর্বদাই ‘খ্যাতনামা'।
৭৮ পৃষ্ঠার বই। মাত্র ৩৬ পৃষ্ঠা চলছে। এভাবে চললে রিভিউ অনেক বড় হয়ে যাবে। আচ্ছা, এবার শেষের দিক থেকে কয়েকটা খুঁজে বের করি, কেমন?
ওষুধ - যখন স্বাস্থ্য ভালো থাকবে তখন এটা নিয়ে ঠাট্টা করতে হবে।
বিষণ্নতা - উচ্চ মন আর বিশিষ্ট হৃদয়ের লক্ষণ।
ভোরে ওঠা - কেউ যদি ভোর চারটায় শুয়ে সকাল আটটায় ঘুম থেকে ওঠে তবে সে কুঁড়ে। কিন্তু কেউ যদি রাত নটায় শুয়ে ভোর পাঁচটায় ওঠে, তবে সে খুব কাজের লোক।
লেবেনচুষ - কেউ জানে না কী দিয়ে তৈরি !
জঘন্য - ‘জঘন্য !'
ইঞ্জিনিয়ার - এরা সর্বজ্ঞানের অধিকারী।
গালি দেওয়া - কী মিষ্টি কথা !
সাফল্য - ঘুম ছুটিয়ে দেয়।
রোগী - রোগীর মনোবল বাড়াতে হলে তার অসুখটিকে নিয়ে হাসাহাসি করতে হবে ও তার যন্ত্রণাকে অস্বীকার করতে হবে।
অঙ্ক - হৃদয়ের রস শুষে নেয়।
নিগ্রো - ওদের থুতুর রং সাদা, এটা কী করে সম্ভব হল?!
নিসর্গচিত্র - কয়েক থালা শাকসবজি !
চিন্তা করা - কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
প্রগতি - এত দ্রুত হয়েছে যে লোকে ধরতেই পারেনি।
ভগবান - তাঁকে ছাড়া আমাদের চলবে কী করে?
ওহ, হাঁফিয়ে গেছি। আর না।
বলতে ভুলেই যাচ্ছিলাম ! এই অভিধানটি সংকলন করেছেন মাদাম বোভারি-র লেখক গুস্তাভ ফ্লবের। আমার কাছে যেটা আছে সেটা চিন্ময় গুহ-র করা বাংলা অনুবাদ। চমৎকার অনুবাদ করেছেন। বইটা নাড়াচাড়া করতে মাঝেমাঝে কেমন যেন ইয়ে লাগে। “কিছু কিছু বাক্যের সঙ্গে নিজের বক্তব্য হুবহু মিলে যায় !” আমিও তো একজন জনতা।
বলদ - বাছুরের বাপ। ষাঁড় হল গিয়ে তার কাকা।
আমি কবিতা লিখতে পারি না। কিন্তু কবিতা পড়তে ভালোবাসি। ইশকুলজীবন থেকে কবিতা পড়ে চলেছি। আজকে বিকালেও পড়লাম।
কবিতা আসলে কী? কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে আমি কোনোদিন ভাবিনি। বরাবর জানি, কবিতা তার শব্দ, অর্থ, ছন্দ, বার্তা, ইঙ্গিত, ইশারা, সবকিছু নিয়ে পাঠকের ব্যক্তিগত বোধের রাজ্যে চুপিসাড়ে প্রবেশ করে। আমি পাঠক, তখন এক অনির্বচনীয় অনুভূতি লাভ করি। কবিতাপাঠের অনুভূতির মতোই, কবিতার সংজ্ঞাও “অনির্বচনীয়”। ভাষায় তাকে বলে বোঝানো যাবে না। কবিতা হচ্ছে, মাকড়সার জটিল নকশায় বোনা তন্তুজালিকা। যাকে এমনিতে খালি চোখে দেখা যায় না। দৈবাৎ আলোর রশ্মি এসে তার উপর পড়লে, তাকে দেখা যায়। ব্যাস এটুকুই।
বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র “প্রতিদিন”-এর সঙ্গে প্রত্যেক রবিবার “রোববার” নামক একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এখনও হয়। আগে এই ম্যাগাজিনটির সম্পাদক ছিলেন চিত্রপরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। তিনি মারা যাওয়ার পরে এখন সম্পাদনার কাজটি করেন বাংলা-ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দু-র গায়ক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। সত্যি কথা বলতে, এমন অভিনব এবং উপভোগ্য ম্যাগাজিন এই মুহূর্তে বাংলা ভাষায় একটাও নেই। এই ম্যাগাজিনেই ধারাবাহিকভাবে একদা একটি কলাম লিখতেন কবি জয় গোস্বামী। কলামটির নাম ছিল “গোঁসাইবাগান”।
বাংলা কবিতাকে বিশ্লেষণ করার কাজ এর আগে আরো অনেকেই করেছেন। রবীন্দ্রনাথ করেছেন। বুদ্ধদেব বসু করেছেন। জীবনানন্দ দাশ করেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় করেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় করেছেন। শঙ্খ ঘোষ করেছেন। এমনকি অমরেন্দ্র চক্রবর্তী (হীরু ডাকাত, শাদা ঘোড়া, আমাজনের জঙ্গলে, ইত্যাদি বইয়ের লেখক) বহুদিন আগে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন যার নাম ছিল “কবিতা-পরিচয়”। এই পত্রিকাটিতে বিভিন্ন বিখ্যাত কবিগণ অন্য কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা করতেন। যেমন সুনীল আলোচনা করেছেন শক্তির কবিতা নিয়ে। কিংবা শঙ্খ ঘোষ আলোচনা করেছেন বুদ্ধদেব বসুর কবিতা নিয়ে। বেশ সাড়া জাগিয়েছিল এই পত্রিকাটি।
ভূতপূর্ব এই সমস্ত কবিতা-আলোচনার সঙ্গে জয় গোস্বামীর গোঁসাইবাগানের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। সারা পৃথিবীজুড়েই কবিতার পাঠকসংখ্যা সীমিত। বাংলা কবিতার পাঠকসংখ্যা তো আরো সীমিত। প্রায় নগণ্যই বলা চলে। এর আগের যে কবিতা-আলোচনাগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, সেগুলো পড়লেই বোঝা যাবে যে, ওগুলো লেখা হয়েছিল কবিতাবোদ্ধাদের কথা মাথায় রেখেই। যেমন, বুদ্ধদেব বসু তাঁর “কালের পুতুল” বইতে জীবনানন্দ দাশ, সমর সেন, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কিংবা অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা নিয়ে যে-আলোচনাগুলো করেছেন, সেগুলো “সাধারণ” পাঠকদের উদ্দেশ্যে নয়। তাঁর উদ্দিষ্ট পাঠক হলো, যারা কবিতা বোঝে। জয় গোস্বামীর এই লেখাগুলো কিন্তু শুধুমাত্র “বুঝদার” পাঠকদের জন্যে নয়।
মনে রাখতে হবে, যে-ম্যাগাজিনে জয় গোস্বামী তাঁর কলামটি লিখতেন সেটি একটি পাঁচমেশালি পত্রিকা। রবিবার ছুটির দিন পরিবারের সবাই পড়ে উপভোগ করতে পারে, সেই কথা মাথায় রেখে পত্রিকাটি নির্মাণ করা হতো/এখনও হয়। এমন একটি “সর্বজনভোগ্য” পত্রিকায় কবিতার মতো একটি বিষয়, যেটি সিংহভাগ পাঠকের পছন্দের বিষয় নয়, সেই বিষয়ে নিয়মিত কলাম লেখার কাজটি তো সবিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কথা। আদপে কিন্তু এই কলামটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এবং একটানা বহুদিন প্রকাশিত হয়েছিল। এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা কীভাবে ঘটলো?
কারণ, বুদ্ধদেব বসু কিংবা শঙ্খ ঘোষের মতো শুধুমাত��র কবিতাপ্রেমী পাঠকদের কথা চিন্তা করে জয় গোস্বামী এই লেখাগুলো লেখেননি। বরং উল্টোটা। লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যাবে, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সকলের মধ্যে কবিতাপাঠের আনন্দকে ছড়িয়ে দেওয়া। যারা জীবনে কোনোদিন স্ব-ইচ্ছায় কবিতা পড়েননি, কবিতায় রস খুঁজে পাননা, কবিতার “মানে” বুঝতে পারেননা, তেমন “বেরসিক” পাঠকের কাছেও পৌঁছে দিতে চেয়েছেন কবিতার সৌন্দর্যপ্রতিমাকে। একেবারে আটপৌরে ভাষায়, পন্ডিতি বর্জন করে, পরম সহানুভূতির সঙ্গে, তিনি বিভিন্ন কবির কবিতাকে বিশ্লেষণ করেছেন। কবিতার লাইন ধরে ধরে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, কবিতা আসলে “বোঝার” বস্তু নয়, উপলব্ধির বস্তু। সাবানের বুদবুদের মতো তাকে ধরতে গেলেই সে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু শান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সেই বুদবুদে দেখা যাবে রামধনুর খেলা।
আর যারা ইতিমধ্যে কবিতা পড়তে ভালোবাসে, অর্থাৎ “অ্যাডভান্সড পাঠক”, তাদেরকেও তিনি নিরাশ করেননি। পরিচিত, সুপরিচিত কবিদের কবিতাকে যেন নতুন আঙ্গিকে চিনতে পারা যায় এই লেখাগুলো পড়লে। এবং কত যে অপরিচিত, স্বল্প-পরিচিত, বিস্মৃত কবির লেখা কবিতার উল্লেখ রয়েছে এতে! এইসব ভুলে-যাওয়া মণিমুক্তোগুলো গোঁসাইবাগানের অন্যতম বড় সম্পদ। এই মুহূর্তে বই ঘেঁটে খুঁজে বের করতে আমার ইচ্ছে করছে না। অনুপ মুখোপাধ্যায় নামের একজন অপরিচিত কবির লেখা অলংকারহীন, সোজা, সাদামাটা, চারটে লাইন খুলে আছে চোখের সামনে। এটুকুই লিখে রাখি আপাতত।
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছিকত ভোরএক ঘন্টা দশ ঘন্টা একশো বছরখুশির এমন চাপ মনে হয় জলে ডুবে আছি ...
রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, মতি নন্দী, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মতো সাহিত্যিকদের ঘরানায় লেখা উপন্যাস। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের বিপন্নতার আখ্যান। লেখার শৈলী ও গল্প বলার ধরন আমার ভালো লেগেছে। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝে, আর কিছু থাকুক বা না-থাকুক, চিরসঙ্গী হয়ে আমাদের পাশে থাকে কে? সমস্যা আর সংকট! ক্ষয়িষ্ণু আয়ু, ক্ষয়িষ্ণু আশা আর ক্ষয়িষ্ণু সমাজের এই টানটান কাহিনিটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, এরকম গল্প এখন আর কেউ লেখেন না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ (আমি নিজেও যাদের একজন), এবং তাদের যন্ত্রণা ও অসহায়তা, সবকিছুই তো এখনও দিব্যি টিকে আছে। কিন্তু এই শ্রেণিকে কেন্দ্র করে, তাদের সাদামাটা কিন্তু জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে লেখার মতো লেখকরা ক্রমশ অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন।
আজকে সকালে লছমন ফোন করেছিলো। অনেকদিন পরে। আমি তো ওকে প্রায় ভুলেই মেরে দিয়েছিলাম, কিন্তু ও আমাকে ভোলেনি। আমার নম্বরটাও হারায়নি। খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী হাল, দাজু?” (কুমায়ুনি ভাষায় দাজু মানে দাদা)। “নেহি জি আনা হ্যায় ইস বার?”
ইস বারের কথা তো এখনও কিছুই ঠিক হয়নি। কিন্তু আমার মনে পড়ে গ্যালো সেই উস বারের কথা। আমার প্রথমবার কুমায়ুন হিমালয় যাওয়ার কথা। মনে পড়ে গ্যালো হাওড়া থেকে রওনা দেওয়ার প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা পরে, ট্রেন যখন কাঠগোদাম স্টেশনে ঢুকছে, সেই সকালবেলাটার কথা। ট্রেন থেকে নেমে টের পেয়েছিলাম, আমার পিঠের ভয়ানক ভারী রুকস্যাকটা হঠাৎ অনেক হালকা মনে হচ্ছে। পিছুটানের ভার কমে গেলে, বারবার দেখেছি, এভাবেই রুকস্যাকের ওজন কমে যায়।
এই কাঠগোদাম স্টেশনে তারপর আরো অন্তত ৪/৫ বার গেছি। নৈনিতাল কিংবা আলমোড়া যেতে হলে। কর্ণপ্রয়াগ কিংবা বাগেশ্বর যেতে হলে (বাগেশ্বরের মহারানির নামেই অবনীন্দ্রনাথের “বাগীশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী”)। কিংবা আরো আরো দূরে। সুন্দরঢুঙ্গা গ্লেসিয়ার। পিন্ডারি গ্লেসিয়ার। আরো অনেক দূরে। মিলাম গ্লেসিয়ার। কুমায়ুনের বেশিরভাগ জায়গায় যেতে হলে কাঠগোদামেই (কিংবা পাশেই হলদোয়ানিতে) নামতে হবে আগে। তারপর স্টেশনের বরফশীতল জলের কলে চোখমুখ ধুতে হবে। মুখ ধুয়ে স্টেশনের দোকান থেকে খেতে হবে এককাপ গরম চা। তারপর আরেক কাপ। তারপর? তারপর আবার কি? চরৈবেতি চরৈবেতি!
লছমনের সঙ্গে কথা শেষ হলে আমি দৌড়ে নিচের ঘরে গিয়ে বের করলাম এই বইটা। প্রতিবার আমাকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে গেছেন ইনি। কবেকার কথা? গতজন্মের? আরেহ ন্না! এই জন্মেরই কথা! আমি যে কেমন ভাগ্যবান সেটা আমার মাঝে মাঝে মনেই থাকেনা। চম্পাবতে বসে জিম করবেটের “ম্যানইটার্স অভ কুমায়ুন” আর ক'জন পড়েছে? (চম্পাবতেই শেষবার ধরা পড়েছিলেন সেই হতভাগ্য শার্দুল শিরোমণি)। কিংবা মাইনাস তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গ্লেসিয়ার পার হতে গিয়ে পা পিছলে আলুর দম হয়েছে ক'জন? কিংবা ফিকে কমলারঙের বিকেলবেলায়, থোকা থোকা নীল রঙের ফল ফুটে থাকা একটা জুনিপার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, পিথোরাগড় শহর থেকে পঞ্চচুল্লির পর্বতশিখরে সূর্যকে দাউ দাউ আগুন ঢালতে দেখেছে ক'জন? ঘটনাগুলো ঘটবার অনেক আগে, যখন বাড়িতে বসে বেরিয়ে পড়ার চিন্তাভাবনার পালা চলছিল, তখন এই বইটা আমাকে তথ্য জুগিয়েছে, ভরসা দিয়েছে, সাবধান করেছে, মন্ত্রণা দিয়েছে। এই বইটার কাছে আমার অনেক ঋণ।
আবার কবে যাবো এখনও জানিনা। লছমন আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে। বলা হয়নি, লছমনের পুরো নাম লছমনপ্রসাদ কান্ডারি। বারতিনেক আমাদের গাইড ছিলো সে। বাংলায় কান্ডারি মানে নৌকার মাঝি। কেমন সার্থকনামা মানুষ! On the road and hanging by a song! না, কানে হেডফোন গুঁজে শোনা গৃহবন্দী গান নয়। ঘামে ভেজা ক্ষুধার্ত শরীর যখন আর একটা পদক্ষেপ নিতেও আপত্তি জানায়, বোতলের জল যখন তলানিতে এসে ঠেকে, বাঁপাশের গহীন জঙ্গলের ভেতর থেকে তখন যদি হঠাৎ ভেসে আসে অশ্রুতপূর্ব কোনো পাখির অদ্ভুত অপার্থিব সুরেলা ডাক। সেই অবস্থায়, সেই মুহূর্তে, পৃথিবীর আর কোনো গান এত মধুর মনে হয়না। এত শক্তি জোগায় না। আবার কবে শুনবো সেই গান? আবার কবে বলবো, বারবার উচ্চারণ করলেও যে-কথাটা কখনও পুরোনো হবার নয় :
THE MOUNTAINS ARE CALLING. AND I MUST GO!
সামান্য কয়েকপৃষ্ঠার এই বইটা পড়ে (বই না বলে পুস্তিকা বলাই ভালো), কত যে ভাবনা আসছে মাথায়!
শ্রীজাত তাঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেন,
“শঙ্খ ঘোষের ‘কবির বর্ম' গায়ে চাপিয়ে ঘুরে মরছি কলকাতায়...“
শঙ্খবাবু নিজেও অন্যত্র লিখেছেন,
“এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন
শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে !”
কাকে বলে “কবির বর্ম”?
“অনেকে ভুল বুঝবে, অনেকে ঠিক বুঝেই তাদের ভিন্ন রুচিগত কারণে আমাকে এড়িয়ে যাবে, অনেকে তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে মারবে আমার মুখের ওপরে, সমূহ অকৃতজ্ঞতার ঝলক তুলেও চলে যাবে অনেকে...।”
তবুও, “থাকবে না কি এইটুকু বিনয় যে অন্যদের বলতে দাও তাদের নিজের মতো কথা, আমি বলবো শুধু আমারটা, যেটুকু আমি পারি?”
“দেখো, এই হচ্ছি আমি। এইটুকুই, এর চেয়ে বেশি নয়, কমও নয় এর চেয়ে। আর তারপর কে আমার কী বিচার দিল, সে শুধু তার দায়।”
এই বিনীত আত্মপ্রত্যয়কেই “কবির বর্ম” বলে, যা আমরা মাঝেমাঝে গায়ে চাপাতে বিস্মৃত হই।
এই বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধটি পড়ে আরো একবার উপলব্ধি করলাম— তিনি “নির্জনতম কবি” হওয়া সত্ত্বেও, “নিরালম্ব শূন্যতা”কে, শিশিরপতনের মতো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে, জীবনযাপনের ক্লান্তিকে, নিজের কবিতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে বারবার তুলে ধরলেও, ক্যানো জীবনানন্দ দাশের “অনেক নিঃশব্দের মধ্যে গোপনে গোপনে জড়ো হয়ে আছে বহুতর আর্ত শব্দের উৎক্ষেপ”। এবং ক্যানো, শুধু গলাবাজি করে বিপ্লব বিপ্লব বলে চেঁচামেচি করলেই, গরম গরম ভাষণের আঘাতে চেয়ার-টেবিল-চায়ের গেলাস-বিস্কুটের বয়ম ভেঙে ফেললেই “বিপ্লবী” হওয়া যায় না।
তৃতীয় প্রবন্ধে রাইনার মারিয়া রিলকের “লেটারস টু এ ইয়ং পোয়েট” বইয়ের বক্তব্যের অনুষঙ্গে দেখিয়েছেন, কাউকে কিছু “উপদেশ” দেওয়ার কাজটা আসলে কতটা অবান্তর, অপ্রয়োজনীয়, যান্ত্রিক। কারণ,
“আমার যদি ইচ্ছে হয় প্রেমেরই কথা বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় প্রকৃতিতে যাই ; আমার যদি ইচ্ছে হয় সহজ কথা বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় দুরূহতায় যাই ; আমার যদি ইচ্ছে হয় অলংকারে বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় নিরাভরণ হই ; আমার যদি ইচ্ছে হয় ছন্দ দিয়ে বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় ছন্দ ছেড়ে যাই ; আমার জন্য নির্ধারিত পথ রাখেনি কেউ, আমারও পথে চাই না আমি কাউকে।”
প্রাণিত সুষমাময় গদ্যে এমন স্পষ্ট কথা শঙ্খ ঘোষ ছাড়া আর কে বলতে পারেন?
ইবসেনের লেখা নাটকগুলোর মধ্যে তুলনায় কম আলোচিত নাটক এটি। যদিও বিষয়বস্তুর বিচারে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত। ঘৃণিতও বলা চলে। নাটকের কাহিনি-অংশটি আমার কাছে বেশ দুর্বল মনে হয়েছে। একটা চরিত্রও মনে দাগ কাটতে পারেনি। তবে, নাটকের নামকরণের কারণটা উপলব্ধি করে সামান্য চিন্তার পরিসর তৈরি হয়েছিলো, এটুকুই যা প্রাপ্তি।
কখনও বা কবির পাল্কি থামিয়ে একজন মুসলমান প্রজা কবিকে দুটো টাকা নজর দিলেন। কবি নিতে আপত্তি করলে তিনি বললেন, আমরা না দিলে তোরা খাবি কি করে?
একদম সত্যি কথা! রবীন্দ্রনাথ আশি বছর বেঁচেছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনের চতুর্থ দশকটি সৃষ্টির প্রাচুর্যে, বৈচিত্র্যে এবং স্থায়িত্বের দাবীতে বিশেষভাবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এই দশকে তিনি লিখেছিলেন সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালির মতো কবিতার বই, বিদায় অভিশাপ ও কর্ণ-কুন্তী-সংবাদের মতো কাহিনিকাব্য, অসংখ্য ছোটগল্প, এবং সর্বোপরি— ছিন্নপত্রাবলী! এক হিসেবে দেখতে গেলে, জীবনের চতুর্থ দশক থেকেই রবীন্দ্রপ্রতিভার প্রকৃত স্ফূরণ শুরু হয়েছিল। এবং তাঁর এই বিস্ময়কর আত্মবিকাশের প্রেক্ষাপটরূপে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছে পূর্ববঙ্গের পল্লীঅঞ্চল। নদ-নদী-খালবিল। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত। মাঠ-প্রান্তর-রাস্তা-কৃষিক্ষেত্র। শুধু পেটের খাদ্য নয়, রবীন্দ্রনাথকে মনের খাদ্য জুগিয়েছিল এই অঞ্চলের প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ। রবীন্দ্রজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল হিসেবে প্রমথনাথ বিশী এই শিলাইদহ-পর্বটিকেই চিহ্নিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলতেন, তাঁর পেশা জমিদারি আর নেশা আশমানদারি। কলকাতার ঘিঞ্জি নাগরিক পরিবেশ থেকে যে তিনি এই আশমানদারি ক��ার প্ররোচনা পাননি, এইকথা তো বলাই বাহুল্য। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমথনাথ বিশী শুধু বিষয়টিকে বিশ্লেষণই করেননি, আমাদের জানিয়েছেন অনেক জানা-অজানা-অর্ধজানা তথ্য। যেমন, “শিলাইদহ” নামটির উৎস হচ্ছে সেই অঞ্চলের জনৈক নীলকর সাহেব, যার নামের পদবি ছিলো “শেলী”। শেলী থেকে শিলাই। আমি জানতে পেরে আশ্চর্য হয়েছি, স্বাধীনতার আগে শিলাইদহ গ্রামটি ছিল নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত। আমার বাড়ি এই নদীয়া জেলাতেই, যদিও শিলাইদহ আজ চলে গেছে কাঁটাতারের ওপারে। বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুকে নিজের লেখা ছোটগল্প শোনাবার লোভ দেখিয়ে শিলাইদহ আসার আমন্ত্রণ জানাতেন রবীন্দ্রনাথ। কুষ্টিয়ার মানুষরা জেনে খুশি হবেন, কুষ্টিয়াতে প্রথম আলুচাষের প্রবর্তন করেন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তার আগে ওই অঞ্চলের মানুষ আলু খেতে জানতেন না। আমি নিজেও জেনে খুশি হয়েছি যে, রবীন্দ্রনাথ এবং আমি, আমরা দুজনেই মীনরাশির জাতক। হাহা!
রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য রচনায় প্রবিষ্ট হয়ে আছে পূর্ববাংলার চিহ্ন। সমাপ্তি গল্পের মৃন্ময়ী, ছুটি গল্পের ফটিক, অতিথি গল্পের তারাপদ, পুরাতন ভৃত্য ও দুই বিঘা জমি কবিতার কেষ্টা ও উপেন, কিংবা ময়নাপাড়ার মাঠের কালো-হরিণ চোখের সেই বিখ্যাত মেয়েটি, এরা কেউই পুরোপুরি কাল্পনিক নয়। ঠিক যেমন কাল্পনিক নয় “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা” গানটির বিষাদবিলীন কথা ও সুর। কাল্পনিক নয় আরো অনেক কিছু। চলনবিলে সূর্যাস্তের সময় ঝপাঝপ দাঁড় ফেলতে ফেলতে দাঁড়ের তালে তালে ছোকরা মাঝিদের গেয়ে ওঠা গান—
যোবতী ক্যান্ বা করো মন ভারি? পাবনা থাক্যে আন্যে দেব ট্যাকা দামের মোটরি...
হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি,ছুটি নে কাহারো পিছুতে,মন নাহি মোর কিছুতেই, নাই কিছুতে।নির্ভয়ে ধাই সুযোগ-কুযোগ বিছুরি,খেয়াল খবর রাখি নে তো কোনো-কিছুরই।উপরে চড়িতে যদি নাই পাই সুবিধাসুখে পড়ি থাকি নিচুতেই, থাকি নিচুতে...
সুব্রত : ইংরেজিতে একটা কথা আছে... A woman's place... is in the home.আরতি : কথাটা তুমি বিশ্বাস করো?সুব্রত : হুঁউ! আমি ভয়ানক কনজার্ভেটিভ... বাবার মতো। ঘরের বউ... should stay in her ঘর! And not... বিচরণ!
গতকাল বিশ্ব শ্রমদিবস উপলক্ষ্যে বেশ কয়েকজন আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মেসেজ পাঠালো। মেসেজগুলো দেখার পর, কলকারখানা-কৃষিক্ষেত্র কিংবা কাস্তে-হাতুড়ির মতো অমোঘ দৃশ্যের বদলে আমার মনে এসে উদয় হলো সত্যজিৎ রায়ের “মহানগর” সিনেমাটির কথা। দুপুরবেলা ইউটিউবে সিনেমাটা দেখলাম আরেকবার। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা মূল গল্প “অবতরণিকা”ও পড়লাম আরেকবার। আজকে সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন। সুতরাং, সিনেমা আর গল্প, দুটো মিলিয়েমিশিয়ে একটা রিভিউ লেখার চেষ্টা করা যাক!
“অবতরণিকা” শব্দের একটা অর্থ— বইয়ের ভূমিকা অথবা মুখবন্ধ। আরেকটা অর্থ— সিঁড়ি। তবে উপরে ওঠবার নয়, নিচে নামার সিঁড়ি। গল্পটি লেখা হয়েছিল স্বাধীনতার বছর তিনেক পরে (শ্রাবণ ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ)। একটা দেশ যখন নতুনভাবে নিজেকে গড়ে তুলছে। কিন্তু একইসঙ্গে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ইউটোপিয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা আপামর দেশবাসীর স্বপ্নভঙ্গেরও সময় ছিলো সেটা। ভারতের অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় কলকাতা শহরে স্বপ্নভঙ্গের রূপটা ছিল আরো বেশি মর্মান্তিক। কারণ শহর জুড়ে উপচে পড়েছিলো অসহায় উদ্বাস্তুদের ঢল। কাজের বাজারে ক্রমশ ঘুচে যাচ্ছিলো নারী-পুরুষের বিভেদ। ইতিহাসে প্রথমবার, ঘরের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন গৃহস্থ বাঙালি মেয়েরা। শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে।
রিভিউর শুরুতে উল্লেখ করা কথোপকথনের অংশটা সত্যজিতের “মহানগর” সিনেমার শুরুর দিকের একটা চিত্রমুহূর্ত থেকে নেওয়া। আরতির স্বামী সুব্রত কথাগুলো বলেছিলো নেহাৎ ঠাট্টাচ্ছলে। কিছুটা সাংসারিক অভাবের কারণে, কিছুটা নিজের উদারতা প্রমাণ করতে, সুব্রত নিজেই “অনুমতি” দিয়েছিলো আরতিকে, একটা চাকরি খুঁজে নেওয়ার জন্য। এই ঠাট্টা যদিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আমেরিকার বিখ্যাত চিত্রসমালোচক রজার এবার্ট ১৯৬৮ সালে শিকাগো শহরে বসে “মহানগর” দেখার পরে তাঁর রিভিউতে চারের মধ্যে চারতারা রেটিং দিয়েছিলেন। এবং উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছিলেন :
সত্যজিতের সিনেমাকে যদি আমি “বিদেশি” (foreign) সিনেমা হিসেবে গণ্য করে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে আমি মুশকিলে পড়ে যাই। তাঁর সিনেমাগুলোকে কীভাবে “বিদেশি” বলবো আমি? এটা ঠিক কথা যে উনি একজন ভারতীয়, আমি ভারতীয় নই। কিন্তু তাঁর তৈরি সিনেমাগুলোর বিষয়বস্তু এবং চরিত্রদের কথা চিন্তা করলে আমাদের হলিউডের সিনেমাগুলোকে অধিক “বিদেশি” বলে মনে হয় আমার কাছে।
I love to see a young girl go out and grab the world by the lapels. Life's a bitch. You've got to go out and kick ass. (Maya Angelou)
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের কতটুকু মিথ, আর কতটুকু সত্যি, কতটুকু কুয়াশা, আর কতটুকু দ্বিপ্রহরের প্রখর সূর্যালোক— এইসব জটিল ধাঁধার কিছুটা সমাধান হয়েছে, কিছুটা আজও হয়নি, কিছুটা হয়তো কোনোদিন হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একটা ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর মতো বৈচিত্র্যময় এবং ঘটনাবহুল জীবনের উদাহরণ আর একটিও নেই।
সুভাষচন্দ্র ছিলেন আজন্ম-বিপ্লবী। পারিবারিক স্বচ্ছলতা এবং নিজস্ব প্রতিভার স্পর্ধায় তিনি অতি অনায়াসে একটি আরামের জীবন বেছে নিতে পারতেন। ইংরেজ রাজত্বের সবচেয়ে উঁচুপদের চাকরি পাওয়ার জন্যে যে ICS পরীক্ষা দিতে হতো, সেই পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন। অতি দুর্লভ এবং আপাত-লোভনীয় সেই চাকরিতে তিনি যোগদান করেননি, পরাধীন দেশের প্রতি কর্তব্যের আহ্বান তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে অন্য ভবিতব্যের দিকে।
কর্মজীবনের শুরুই হয়েছে যাঁর এরকম অবিশ্বাস্য ত্যাগের মধ্যে দিয়ে, সেই মানুষটার বাকি জীবনের রূপরেখা আমরা সহজেই আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে দুরন্ত কল্পনাও তাঁর জীবনের বাস্তব কাহিনিকে স্পর্শ করতে পারেনা। অতিমানবিক অকল্পনীয় এক নাটকীয় জীবন কাটিয়েছেন তিনি।
যখন মূলধারার রাজনীতি করেছেন, তখন স্বয়ং গান্ধীজির নির্দেশ অমান্য করেছেন বারবার। কংগ্রেসের রাজনৈতিক দর্শন যখন ডুবে আছে অহিংসার কোমল নরম এঁটেল মাটির কাদার গভীরে, সেই সময় তিনি বারবার বলেছেন, হাত পেতে ভিক্ষা চাইলে স্বাধীনতা লাভ করা যাবেনা। প্রয়োজন সার্বিক সংগ্রামের। তাঁর নিজের কথায় : “No real change in history has ever been achieved by discussions.”
এই বিকল্প “উগ্র” মনোভাবের কারণে প্রায় প্রত্যেক প্রথমসারির কংগ্রেস নেতার বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। শুধু ব্রিটিশরাই তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেনি, নিজের দলেও তাঁকে ব্রাত্য করে রাখার, তাঁকে মাথা তুলতে না-দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিলো। ব্রাত্য হয়েছেন তিনি মৃত্যুর পরেও। রিচার্ড অ্যাটেনবরো পরিচালিত বিশ্ববিখ্যাত “গান্ধী” ছবির একটা ফ্রেমেও সুভাষচন্দ্রকে দেখা যায়নি। গান্ধীর জীবনে সুভাষচন্দ্র নেই, ভাবা যায়!
অজস্র বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও একটা অবিশ্বাস্য জীবন যাপন করেছিলেন তিনি, সেই জীবনের তুলনা সমগ্র পৃথিবীর মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাঁর জীবনের ভরকেন্দ্র ছিল নিজের দেশমাতৃকার প্রতি অকপট শ্রদ্ধা। আর কিচ্ছু না! আর কোনোকিছু কিংবা কোনো মানুষের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন না। কাউকে পরোয়া করেননি। কোনো বাধাবন্ধন সহ্য করেননি। ভেতো, ভীরু, ক্ষমতার-পদলেহনকারী বাঙালির ঘরে তাঁর মতো সিংহের জন্মগ্রহণ একটা অকল্পনীয় ঘটনা!
বাঙালি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে, মাথায় তুলে নেচেছে। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কাউকে বাঙালি এতটা উঁচু বেদীতে প্রতিষ্ঠা করেনি। কিন্তু তাঁর জীবন নিয়ে আজ পর্যন্ত একটাও পরিপূর্ণ উপন্যাস লেখা হয়নি বাংলাভাষায় (রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়েও নয়)। এই উপন্যাসটা মারাঠি ভাষায় রচিত। আমি পড়েছি বাংলা অনুবাদে। যেরকম নিষ্ঠার সঙ্গে, গবেষণার পরিশ্রমে, সাবলীল সজীব গদ্যে, এই উপন্যাসটা লেখা হয়েছে, তার জন্যে লেখকের প্রতি শুধু আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানানো যায়! বইয়ের শেষে “তথ্যসূত্র” ও “গ্রন্থপঞ্জী” অংশদুটিতে চোখ বোলালে তাজ্জব হতে হয়।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে কেউ কেউ উল্কার সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু তিনি উল্কা ছিলেন না মোটেও। একটি প্রজ্জ্বলন্ত মশাল ছিলেন। পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে মশালটা আজীবন দাউ দাউ করে জ্বলেছে। কেউ তাঁকে নেভাতে পারেনি! তাঁর জীবনের কথা জানতে পেরে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ হয়। আবার পাশাপাশি এটাও মনে হয় যে, সেই মশালের একটা ছোট্ট স্ফুলিঙ্গের অস্তিত্বও কি আজকের বৃহত্তর বাঙালি সমাজে খুঁজে পাওয়া যাবে?
এমনটা তো আকছার ঘটছে। সরকারের দুর্নীতিতে শামিল হচ্ছে জনগণ। কিংবা, জনগণের সেন্টিমেন্টকে তুষ্ট রাখতে, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকার। সরকার এবং জনগণ, ঠিক যেন চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।
মনোবিজ্ঞানে “সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্স থিওরি” নামের একটা তত্ত্ব আছে যেখানে দেখানো হয়েছে, একজন মানুষ তার আশেপাশের মানুষের চিন্তাভাবনা এবং কাজকর্মের দ্বারা নিজের অজ্ঞাতেই প্রভাবিত হয়ে যায়। চলতি হাওয়াকে অগ্রাহ্য করার কাজটা মানুষের সহজাত নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দাঙ্গার সময় মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী, যার সঙ্গে কোনোদিন কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিলোনা, তাকেও আক্রমণ করে। আবার সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ, যাকে সে চেনেই না, তাকেও আক্রমণ করে।
ইবসেনের এই নাটকে একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ (“মেজরিটি”) যদি সরকারের একটা অন্যায় কিংবা ক্ষতিকর কিংবা ভুল নীতিকে সমর্থন করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিবাদ করা সম্ভব?
এমনিতে তো সম্ভব নয়। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে, ভারতের ৫০০ ও ১০০০ টাকার কাগজের মুদ্রা বাতিল করার হঠকারী, অপরিকল্পিত এবং হাস্যকর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সেই সময় যারা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের বলা হয়েছিলো “দেশের শত্রু”।
ঠিক যেমন ইবসেনের এই নাটকেও, একজন চিকিৎসক যখন তাঁর শহরের সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্যে প্রতিবাদ করতে উদ্যত হন, তখন সেই সাধারণ মানুষই তাঁকে “an enemy of the people” আখ্যা দ্যায়। তাঁর জীবন বিপর্যস্ত করে তোলে।
মানুষের দুটো রূপ। একটা রূপ— মানুষ যখন একলা। আরেকটা রূপ— মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধ। একলা মানুষ অনেক অন্যায় কাজ করতে পারেনা যেটা গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ একত্র হয়ে করতে পারে। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের বিচারবিবেচনাবোধ থাকেনা।
রাজনৈতিক নেতারা এই বিষয়টা কাজে লাগায়। তারা প্রোপাগান্ডা তৈরি করে, শ্লোগান তৈরি করে, ছলে-বলে-কৌশলে “মেজরিটি”কে নিজের আয়ত্বে আনার চেষ্টা করে। একবার যদি সেই চেষ্টা সফল হয়, ব্যাস, তাহলেই বাজিমাত!
তখন, কোনো একক মানুষ যদি ন্যায্য কথা বলে, যদি চোখে আঙুল দিয়ে বলে - “তোমরা ভুল করছো”, কিংবা “ তোমাদের ভুল বোঝানো হয়েছে”, মেজরিটি তাঁর জামার কলার চেপে ধমক দিয়ে বলে : “তুই ব্যাটা চুপ করে থাক! তুই দেশের শত্রু!” রাজনৈতিক নেতারা তখন আড়ালে বসে মিটিমিটি হাসে।
“The majority is never right. Never, I tell you! That's one of these lies in society that no free and intelligent man can help rebelling against. Who are the people that make up the biggest proportion of the population — the intelligent ones or the fools?”
(এই নাটকের কাহিনি অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় নির্মিত সিনেমার পোস্টার)
প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলো যেদিন, ভারতবর্ষ সেদিন দ্বিধাবিভক্ত। দীর্ঘদিনের অমানুষিক সংগ্রাম শেষ হওয়ার পরে দেখা গ্যালো, সারা দেশে আনন্দের আতশবাজি নয়, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার আগুন জ্বলছে। দেশমায়ের কর্তিত শরীর থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত��ব মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্মৃতিচারণামূলক বইটির একদম অন্তিম বাক্যটি হলো : History alone will decide whether we had acted wisely and correctly.
তারপর পঁচাত্তর বছর কেটে গেছে। ইতিহাসের রায় এখন কী বলছে? গান্ধীজির নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সবচেয়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন যাঁরা, কতটা সঠিক ছিলো তাঁদের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত? কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন তাঁরা? অকল্পনীয় অত্যাচার ও অপমানের বদলে “স্বাধীনতা” নামের যে-বস্তুটি লাভ করেছিলো দেশের সাধারণ মানুষ, তারা আস্থা রেখেছিলো এই নেতাদের উপর। আস্থার কতটুকু দাম দিতে পেরেছিলেন সেই নেতৃবৃন্দ?
মৌলানা আজাদের বইটি পড়ে মালুম হয়, দূরদৃষ্টি থাকা তো অনেক দূরের কথা, সমসাময়িক দেয়াললিখনটাও তাঁরা ভালোভাবে পড়তে পারেননি। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতির যেটা সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, আমজনতাকে “মুরগি” বানানো, সাধারণ মানুষের জীবন ও ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলার প্রবণতা, এই ট্র্যাডিশনের সূত্রপাত অনেক আগেই ঘটিয়ে ফেলেছিলেন মহান জননায়করা। খুব খুব স্পষ্ট ভাষায় সেই বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন মৌলানা আজাদ। বইটির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এখানেই।
কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি মৌলানা। গান্ধীজি, পণ্ডিত নেহরু, সর্দার পটেল এবং তাঁদের আরো যত কংগ্রেসী সাঙ্গপাঙ্গ, সক্কলের বিচ্যুতিকে, ব্যর্থতাকে, অপদার্থতাকে, সোজাসুজি আঙুল তুলে দেখিয়েছেন। দেশভাগ কিংবা পাকিস্তান-সৃষ্টির ট্র্যাজেডি, যেটা আজকের দিনেও কুরে কুরে খাচ্ছে উপমহাদেশের মানুষকে, তার জন্যে এককভাবে দায়ী করা হয় জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগকে। কিন্তু আরো কয়েকজন মানুষ এর জন্যে দায়ী ছিলেন। পাইকারি হারে স্তব-স্তুতির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে সেই নামগুলো। এই বই খোঁজ দিয়েছে তাদের।
বইটির তিনটি ত্রুটি চোখে পড়েছে আমার। এক, স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানকে খুব হাস্যকরভাবে এড়িয়ে গেছেন লেখক। দুই, সকলের দোষত্রুটি দেখিয়েছেন, কিন্তু নিজের ব্যাপারে কেবল ভালো ভালো কথা বলেছেন— “সব্বাই ভুল, শুধু আমি ঠিক”। তিন, বইটি আদপে মৌলানা নিজে লেখেননি। মৌলানার সঙ্গে বিস্তারিত কথাবার্তা-সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরে বইটি লিখেছিলেন হুমায়ুন কবীর। হুমায়ুনের লেখার ভাষা আমার কাছে বেশ নিরস ও বিরক্তিকর ঠেকেছে। বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ছিলো, তাই পড়ে শেষ করতে পেরেছি। কিন্তু এই ত্রুটিগুলো থাকা সত্ত্বেও বইটির সামগ্রিক মূল্য অপরিসীম।
কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র সর্দার বল্লভভাই পটেলকে কেজি কেজি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার মোড়কে ক্যানো ঢেকে দিচ্ছে নরেন্দ্র মোদি অ্যান্ড কোম্পানি, বিপুল টাকা খরচ করে পটেলের বৃহদাকার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হলো ক্যানো (পৃথিবীর উচ্চতম স্ট্যাচু), এইসব জটিল প্রশ্নের সহজ উত্তরও পেয়েছি বইটা থেকে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ বারোটা বছরকে একটা নির্লজ্জ রাজনৈতিক প্রহসন বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না!
ঔপন্যাসিক সুবোধ ঘোষ এবং ছোটোগল্পকার সুবোধ ঘোষ দুজন ভিন্ন ব্যক্তি, এটা আমি আগেও টের পেয়েছি। তবুও তিলাঞ্জলি পড়া শুরু করেছিলাম কারণ, পঞ্চাশের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে বলতে গেলে প্রায় কিছুই লেখা হয়নি। বাংলা তেরোশো-পঞ্চাশ (ইংরিজি ১৯৪৩) সালের দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিলেন প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ। প্রকৃত মৃত্যুসংখ্যা আরো অনেক বেশি ছিল, কারণ এটা সরকারি হিসেব। পঞ্চাশের মন্বন্তরকে শুধু “দুর্ভিক্ষ” বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। ঠান্ডা মাথায় ও সুপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত গণহত্যা বললে ঠিক বলা হবে। অথচ এই মর্মান্তিক ঘটনাটিকে নিয়ে বাংলাভাষার সাহিত্যিকরা আশ্চর্যরকম নিশ্চুপ। বিভূতিভূষণের “অশনি-সংকেত” ছাড়া বলার মতো কোনো উপন্যাস নেই। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কয়েকটা ছোটগল্প ছাড়া বলার মতো ছোটগল্প নেই। বিজন ভট্টাচার্যের “নবান্ন” ছাড়া নাটক নেই। সুকান্ত ভট্টাচার্য ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা একমুঠো কবিতা ছাড়া কবিতা নেই।
এই উপন্যাসটা পড়ে খুব অবাক হলাম। পঞ্চাশের মন্বন্তরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলো এই যুক্তিতে যে, “মহান” সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ইংরেজরা ফ্যাসিস্টবিরোধী গাঁটছড়া বেঁধেছে। ফলে এমনিতে যারা “দুনিয়ার মজদুর এক হও”, “সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক”, “সাম্রাজ্যবাদীর কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও” এইসব হ্যানাত্যানা বুলি কপচায়, তারা লজ্জার মাথা খেয়ে বাংলার অগণিত সাধারণ মানুষের অভুক্ত থাকার বিষয়টা অগ্রাহ্য করেছিলো। ফ্যাসিস্টবিরোধিতাই ছিলো তাদের মূল অ্যাজেন্ডা। পঞ্চাশের মন্বন্তর এমন একটা ঘটনা, যেখানে খেতে-না-পাওয়া মানুষদের পাশে কেউ ছিলো না। ইংরেজ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তাদের ভারত ছাড়ো আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। কমিউনিস্ট পার্টি তাদের রাশিয়ান ভেঁপু বাজাতে ব্যস্ত ছিলো। বাংলার প্রাদেশিক সরকার কালোবাজারিদের পায়ে তেলমালিশ করতে ব্যস্ত ছিলো। ব্যবসায়ীরা নিজেদের গুদামে চাল মজুত করতে ব্যস্ত ছিলো। বাংলার স্বচ্ছল মানুষরা কালোবাজার থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে সেই চাল কিনতে ব্যস্ত ছিলো।
দুটো ভাতের জন্যে দলে দলে মানুষ গ্রাম-গঞ্জ-মফস্বল থেকে শহরে চলে এসেছিলো। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের গল্পে এইসব ঘটনার কথা আমরা কিছু কিছু পড়েছি। কলকাতার রাস্তায় পোকামাকড়ের মতো বসবাস করছিলো মানুষ। পোকামাকড়ের মতো বেঘোরে মারা যাচ্ছিলো। যদিও তাদের কোনোভাবেই মানুষ বলা যায় না। চেহারায়, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, মানসিকতায়, সেই লক্ষ লক্ষ হাভাতের দল সমবেতভাবে নিজেদের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিলো। নাগরিক সমাজ বড় বিব্রত ছিলো এই পোকামাকড়দের নিয়ে। তাদের কর্কশ “ফ্যান দাও ফ্যান দাও” চিৎকারে আকাশবাতাস ভারী হয়ে থাকতো রাত্রিদিন। হ্যাঁ, এটা সত্যি কথা যে, তথাকথিত “সর্বহারাদের পার্টি” মোক্ষম সময়ে সর্বহারাদের পাশে দাঁড়ায়নি। কিন্তু এই উপন্যাসের লেখক কমিউনিস্টদের বিপরীতে জাতীয় কংগ্রেসকে প্রায় ভগবানের আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। উপন্যাসটা লেখা হয়েছিলো ১৯৪৪ সালে, অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের কয়েকমাস পরেই। জাতীয় কংগ্রেসের ঢালাও গুণগান পড়তে পড়তে মনে মনে হাসছিলাম আর ভাবছিলাম, আর তিন/চার বছর অপেক্ষা করলেই লেখকমশাই জাতীয় কংগ্রেসের আসল খেল দেখতে পেতেন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার লাইন মনে পড়ে যাচ্ছিলো বারবার।
আমি কি চেয়েছি এতো রক্তের দামে
এতো কষ্টের, এত মৃত্যুর, এতো জখমের দামে
বিভ্রান্তির অপচয়ে ভরা এই ভাঙা ঘরখানি?
আমি কি চেয়েছি কুমির তাড়ায়ে বাঘের কবলে যেতে?
খেতে ভালোবাসতেন সুকুমার রায়। খেতে যারা ভালোবাসে তারা খাওয়াতেও ভালোবাসে। প্রতি সোমবার সুকুমারের গড়পারের বাড়িতে গুণীজনের সাহিত্য-আড্ডা বসতো। আড্ডার নাম ছিল “Monday Club”, যেহেতু সোমবারের আড্ডা। কিন্তু আড্ডার পাশাপাশি খাওয়াদাওয়ার বহর এতোই প্রবল হয়ে ওঠে যে সেই ক্লাবের নাম পাল্টে হয়ে যায় “মন্ডা ক্লাব”। সেই সুকুমার যে একদিন “খাই খাই” লিখবেন তাতে আর আশ্চর্যি কিসের?
যারা সুকুমারকে শুধুই “ননসেন্স” পদ্যের লেখক হিসেবে গণ্য করেন, এই বইটা পড়লে তাদের ভুল ভাঙবে। এই বইয়ের ছড়াগুলোতে ননসেন্স নয়, বরং সেন্সের ছড়াছড়ি রয়েছে (আরে! শিবরামের মতো কথা বলে ফেললাম যে!)। প্রথম যে ছড়াটি, “খাই খাই”, এটি বাংলা ভাষার ব্যবহারযোগ্যতার অনবদ্য পরিচয় দেয়। কিভাবে? শুধুমাত্র “খাওয়া”— এই ক্রিয়াপদটা ব্যবহার করে আটান্ন লাইনের একটা আস্ত ছড়া লিখেছেন সুকুমার। খাওয়া মানে কি শুধুই ভোজন? আরো কত কি যে খায় মানুষ। মহাজন সুদ খায়। দারোগা ঘুষ খায়। পালোয়ান ডিগবাজি খায়। তেলে জলে মিশ খায়। “ভয় খেয়ে খাবি খায় পাঠশালে ছেলেরা”। কেউ বেত খায়, কেউ গালি খায়। খোকা কাঁদলে মা চুমু খায়। আরো কত কত কত খাওয়ার ফিরিস্তি আছে এই পদ্যে। কিন্তু সুকুমারের ম্যাজিক শুধু ফিরিস্তি দিয়েই থেমে যায়নি। তাঁর অসম্ভব উচ্চমার্গীয় কল্পনাশক্তি এবং ছন্দসৃষ্টির পারদর্শিতা একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। দুনিয়ার সকল মহার্ঘ্য বস্তুর মতো এই ছড়াটার মর্মও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু কখনও অবকাশমতো তলিয়ে ভাবলে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কত শক্তিশালী আমাদের এই বাংলাভাষা, কত শক্তিশালী এই ভাষার কারিগররা। কত ভাগ্যবান আমরা।
আরো অনেকগুলো ছড়া আছে এই বইতে। প্রতিটা ছড়াই সরস মাধুর্যে টলমল করছে। আর, ছন্দের সে কি বাহার! জলের মতো সহজ কিন্তু সন্দেশের মতো উপাদেয়। অথচ গভীরতায় অনন্য। অনেকেই বলেন সুকুমার শুধুই ছেলেভোলানো হাসির ছড়া লিখেছেন (সেদিন একজায়গায় দেখলাম অক্ষয় মালবেরির লেখক মণীন্দ্র গুপ্তও এই কথা বলছেন। অন্য কেউ হলে ব্যাটা আহাম্মক বলে গালি দিতাম। শুধু অক্ষয় মালবেরি লিখেছেন বলে গুপ্তমশাইকে ছাড় দিলাম)। যারা এমন কথা বলেন, তারা কি “জীবনের হিসাব” (যেখানে বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই এবং নিরক্ষর বৃদ্ধ মাঝির কথোপকথন রয়েছে), কিংবা “নিঃস্বার্থ” (যেখানে মানবচরিত্রের নির্লজ্জ হিপোক্রিসির বিষয়টি হাস্যরসের মোড়কে পরিবেশন করা হয়েছে), কিংবা “হিংসুটিদের গান” (সুকুমারের লেখা শ্রেষ্ঠ ছড়াগুলোর অন্যতম, ছড়ার বিষয়বস্তুটি ছড়ার নামকরণেই প্রকাশিত)— এই ছড়াগুলো কি তারা পড়েন নি?
যাই হোক, অনেক কথাই তো বলে ফেললাম। আবোল তাবোল কিংবা হযবরল-র পাশাপাশি এই বইটা নিয়েও আরো বেশি বেশি আলোচনা হওয়া উচিত। আমার মতো জানলা খুলে বাইরে তাকিয়ে পাড়াপ্রতিবেশীর সুখশান্তিকে নিছক অগ্রাহ্য করে সন্ধেবেলা গলা ছেড়ে আবৃত্তি করা উচিত :
ভাবলে গাধা—এই তো মনিব জল হয়েছেন হেসে এইবারে যাই আদর নিতে কোলের কাছে ঘেঁষে। এই না ভেবে এক্কেবারে আহ্লাদেতে ক্ষেপে চড়ল সে তার হাঁটুর উপর দুই পা তুলে চেপে। সাহেব ডাকেন ‘ত্রাহি ত্রাহি' গাধাও ডাকে ‘ঘ্যাঁকো' (অর্থাৎ কিনা ‘কোলে চড়েছি, এখন আমায় দ্যাখো!')
তারপর? তারপর কী হলো?
দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাস করেছেন এমন কোনো বাঙালি লেখক, নিজের প্রবাসজীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লিখেছেন, এরকম কোনো উদাহরণ আমার জানা ছিলো না। ভাগ্যের পরিহাসই হবে হয়তো, এমন উপন্যাস সত্যিই একটি আছে, কিন্তু সাধারণ বাঙালি পাঠকের খোঁজখবরের প্রায় বাইরে। ক্যানো যে এই উপন্যাসটির নাম শুনিনি কোনোদিন, কোনো আলোচনা পড়িনি, দেখিনি কোথাও কোনো উল্লেখ, চোখে পড়েনি মুদ্রিত কোনো সংস্করণ, এই ব্যাপারটাকে একটা রহস্যই বলা যায়। ইলেকট্রনিক ভার্শনে বই পড়তে আমি স্বচ্ছন্দ নই। তবু চারশো পৃষ্ঠার উপন্যাসটা মোবাইলের স্ক্রিনে পড়ে ফেলতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। মোবাইলে পড়া ছাড়া আর উপায়ও ছিলো না।
অসুবিধে না-হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ উপন্যাসটির নির্মেদ লিখনশৈলী। কাহিনিবিন্যাস, চরিত্রনির্মাণ কিংবা পটভূমি বর্ণনা— সবদিক দিয়েই লেখক মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। বিশ্বাসই হয়না এটি লেখকের প্রথম এবং একমাত্র উপন্যাস। ইন্টারনেট ও বিশ্বায়নের দৌলতে আমেরিকান জীবন আমাদের কাছে এখন খুবই পরিচিত। কিন্তু ১৯৬৫ সালে, উপন্যাসটা যখন লেখা হয়েছিলো, আমেরিকা তখন ছিলো রূপকথার দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর “বেবি বুম” জমানার, কোল্ড-ওয়ার জমানার, ঘটনাবহুল সেই ষাটের দশক। বিত্ত, বৈভব, ঐশ্বর্য্য এবং রাজনৈতিক মহিমায় এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ঘোড়ার মতো দৌড়চ্ছে আমেরিকা। ভারতের মতো একটি দরিদ্র দেশের কোনো মানুষের কপালে যদি সেই সময়ে আমেরিকায় বাস করার শিকে ছেঁড়ে, কেমন হবে তার জীবন? তার চিন্তাধারা? তার স্ট্রাগল?
ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, মানুষ যখন ছিন্নমূল হয়, তখন সে যেন একটা দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে যায়। মানসিক অস্তিত্বের দিক দিয়ে এমনিতেই প্রত্যেকটি মানুষ একাকী। তার উপর যখন তাকে ছেড়ে যেতে হয় নিজের শহর কিংবা গ্রাম, নিজের দেশ, তখন যেন তার শেকড় উপড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। নতুন দেশের মাটিতে নতুন একটা স্বপ্নকে ধাওয়া করে মানুষ। বেশ কিছুদিন আবিষ্ট থাকে সেই স্বপ্নের কুহকে। কিন্তু একটা সময় সে বুঝতে পারে, আজন্মের পরিচিত ভাষা, মানুষ, দৃশ্য, শব্দ, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ, সবকিছুই তার হাতের নাগাল থেকে বহুদূরে সরে গেছে। তাকে যেন নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। নির্বাসিত, দ্বীপান্তরিত, সেই মানুষদের জীবনের একটা সার্থক পরিচয় পেয়েছি, খুব সহমর্মিতার সঙ্গে লিখিত এই উপন্যাসটা পড়ে।
প্রায় ষাট বছর আগে লেখা চমৎকার এই বইয়ের গল্পটা আজকের দিনেও একটুও পুরোনো হয়ে যায়নি, প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। শেকড়শুদ্ধু উৎপাটন করে ভিনদেশে পুঁতে দিলেই আমগাছে কমলালেবু ফলতে শুরু করেনা। তৃতীয় বিশ্বের মধ্যবিত্ত জীবনের ভয়, আশঙ্কা, লজ্জা, দ্বিধা, অস্থিরতা, পূর্বজীবনের স্মৃতি— সেই ছিন্নমূল মানুষদের পিছু ধাওয়া করে যায় আজীবন। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে, নতুন দেশের নতুন ছাঁচে নিজেকে গড়ে তুলতে। কিছু কিছু অতিনাটকীয়তা রয়েছে এই উপন্যাসে। গল্পের গতি এবং উপভোগ্যতা সবজায়গায় সমান ছিলো না। তবু বাংলা সাহিত্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। একটি বিশিষ্ট উপন্যাস। এই উপন্যাসটিকে নিয়ে আরো অনেক বেশি আলোচনা হওয়া উচিত। আশ্চর্য! কীভাবে হারিয়ে যায় এমন দারুন একটা লেখা?
মাত্র একুশটি গল্প লিখে যেতে পেরেছিলেন জহির রায়হান।
একুশটি বিবেকস্পর্শী, সাহসী গল্প।
বিপন্ন এক সময়ের, বিপদগ্রস্ত এক দেশের, হতভাগ্য একজন মানুষ ছিলেন তিনি। সাহসী মানুষ।
আরো কিছু যদি লিখে যেতে পারতেন!
কিছু না হোক, অন্তত আরো একুশটি গল্প।
আজ বাইশে শ্রাবণ। দুঃখের দিন। রবীন্দ্ররচনাবলী ঢুঁড়ে বিমর্ষ টাইপের কিছু পড়ার দরকার ছিলো। কিছু না হোক, রবীন্দ্রবিরচিত গুটিকয় “স্যাড সং” শুনলেও চলতো। আমি বরং উল্টো কাজটাই করলাম। রবিবার দুপুরে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন ভক্ষণ করার পরে, কিছুতেই মনে দুঃখের আমদানি করতে পারলাম না (ভোজনরসিক হওয়ার উপকারিতা #১৭)। তাই দুঃখের ঘাড়ে রদ্দা মেরে “চিরকুমার সভা” পড়লাম।
চিরকুমার সভাকে নাটক না-বলে প্রহসন বলাই ঠিক হবে (প্রহসন যদিও নাটকেরই একটা সাব-জন্রা)। প্রহসনের মূল উপাদান হলো ছ্যাবলামি এবং অতিরঞ্জন। রবীন্দ্রনাথের দাড়িগোঁফের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফিচেল হাসিটাকে চট্ করে আন্দাজ করা যায় না। তাঁর কবিতা গান গল্প উপন্যাস নাটক প্রবন্ধের বেশিরভাগই সিরিয়াস গোছের। তবু মাঝে মাঝে গুম্ফ-আচ্ছাদিত সেই ফিচেল হাসিটা আলগোছে টের পাওয়া যায়। চিরকুমার সভাতে তিনি, যাকে বলে, হাত খুলে ব্যাটিং করেছেন।
নাটকটা পাঠ করে বেশ নির্মল আনন্দ লাভ করেছি। পাশাপাশি এটা ভেবে আফসোস হয়েছে যে, এর অভিনয়রূপ দেখতে পেলে আরো উপভোগ্য হতো। নাটকের কাহিনিসূত্রটা একেবারেই জটিল নয়। ছেলেমানুষি কাজকর্মে ভরপুর। কিন্তু সংলাপের সরস চাতুর্যে, ঘটনার অভিনবত্বে, ফাঁকে-ফাঁকে টুকরো-টুকরো কাব্যের সংযোজনে, নাটকটার অভিনয় একটা জমজমাট ব্যাপার হবে। বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এর মধ্যে গাম্ভীর্য একেবারেই নেই। কাহিনির পরিণতির দিক দিয়েও মধুরেণ সমাপয়েৎ ঘটেছে। এরকমই কিছু একটা পড়তে চাইছিলাম আজকে। এবারের বাইশে শ্রাবণের দিন সিরিয়াস কিছু পড়লাম না বলে আশা করি কিছু মনে করেননি ঠাকুরমশাই।
(নিজের মৃত্যুদিবস উপলক্ষ্যে জনসাধারণের ন্যাকামি এবং আদিখ্যেতা দেখে তিতিবিরক্ত হয়ে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ)
আঠারো কিলোমিটার লম্বা বি টি রোড (“ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড”— ব্যারাকপুর থেকে কলকাতা যাতায়াতের রাস্তা) ছিলো বাংলার শিল্পউদ্যোগের প্রাণকেন্দ্র। একটা সময়, এই মহাসড়কটির দুধারে ছিলো অজস্র বড় বড় কলকারখানা। কারখানার অদূরেই থাকতো শ্রমিকদের বসবাসের বস্তি। পশুরাও সেইসব অস্বাস্থ্যকর বস্তির চেয়ে উত্তম জায়গায় বাস করে। এমনই একটি শ্রীহীন বস্তি এবং সেই বস্তিবাসী ততোধিক শ্রীহীন মানুষদের ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি।
সমরেশ বসুর লেখকজীবনের শুরুর দিকের রচনা এটি। সম্ভবত এই উপন্যাসটির মাধ্যমেই প্রথম পাঠকপরিচিতি পেয়েছিলেন লেখক। কিন্তু আমার একদম ভালো লাগলো না। সম্ভাবনা ছিলো অনেক। বিষয়বস্তুর ব্যাপারে লেখকের অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট, বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু অতিনাটকীয়তার উপদ্রবে খুব বিরক্ত হয়েছি পড়ার সময়। চরিত্র, ঘটনা, সংলাপ— সবকিছুই চড়াসুরে বাঁধা, যেন সস্তার যাত্রাপালা চলছে। শ্রমিকদের জীবন এবং সংগ্রাম নিয়ে পরবর্তীকালে এর চেয়ে ঢের ভালো উপন্যাস লিখেছেন সমরেশ।
ভেবে দেখলে একটা কথা সত্যি। যে-লেখাগুলোর জন্যে সত্যজিৎ পরবর্তীকালে লেখক হিসেবে খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তালাভ করেছিলেন, ফেলুদা কিংবা প্রোফেসর শঙ্কু কিংবা তাঁর ছোটোগল্পগুলো, এই সবকিছুই তিনি লিখেছিলেন প্রয়োজনের খাতিরে। পারিবারিক পত্রিকা “সন্দেশ” যখন পুনরায় বের হওয়া শুরু হয়, সেই পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরাবার উদ্দেশ্যে রায়পরিবারের অনেক সদস্যকেই দুহাত খুলে লিখতে হয়েছিলো। প্রধান-সম্পাদক সত্যজিৎকে একটু বেশিই লিখতে হয়েছিলো। আরো পরে, তাঁর স্ত্রীর আত্মজীবনী “আমাদের কথা”-তে দেখতে পাই সত্যজিতের অকপট স্বীকারোক্তি : সিনেমা থেকে উপার্জন নয়, তাঁদের সংসার চলতো সত্যজিতের লেখা বইগুলোর রয়ালটির টাকায়। ভেবে দেখলে, তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলো কিন্তু পুরোপুরি এই গোত্রের নয়। অর্থাৎ গল্প-উপন্যাসের মতো ফরমায়েশি নয়। সিনেমা (এবং পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত) ছিলো সত্যজিতের সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়। অথচ সিনেমা বিষয়ে খুব বেশি লেখার সুযোগ তিনি পাননি। সিনেমা নির্মাণ করতেন সৃজনশীল সৃষ্টির উদ্দীপনায়। গল্প লিখতেন কিছুটা কর্তব্যের ডাকে, কিছুটা জীবিকার প্রয়োজনে। গুরুগম্ভীর সিরিয়াস প্রবন্ধ লেখার সময় কই? কিন্তু সত্যজিতের সৃষ্টিভাণ্ডারের দিকে চোখ বোলালে আমরা টের পাবো, খুব সামান্য কোনো কাজে হাত দিলেও তিনি সেই কাজটা দায়সারাভাবে করতেন না। “দায়সারা” শব্দটা তাঁর অভিধানে ছিলোই না। উদাহরণস্বরূপ, অনামা অখ্যাত “শারদীয় সোভিয়েত বিপ্লব পরিচয়” নামের পত্রিকাতে তিনি যখন “সোভিয়েত চলচ্চিত্র” নামের প্রবন্ধটি লিখেছেন, নিজের অভিজ্ঞানের পুরোটা ঢেলে দিয়েছেন। অথচ এই প্রবন্ধটি তাঁকে পরিচিতি দ্যায়নি, পয়সা দ্যায়নি, কিছুই দ্যায়নি।ঠিক এই কারণেই সত্যজিতের প্রবন্ধগুলো আমার কাছে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। অল্পবয়েসে “বিষয় চলচ্চিত্র” পড়েছিলাম। সিনেমার তখন কিছুই বুঝতাম না (এখনও বুঝিনা যদিও)। কিন্তু জটিল বিষয় নিয়ে যিনি ইচ্ছে করলেই পাণ্ডিত্য ফলাতে পারতেন, লম্বা লম্বা তত্ত্বকথা লিখতে পারতেন সহজেই, সেই মানুষটা সযত্নে পরিহার করেছেন পণ্ডিতি করার লোভ। সারাজীবন। আজীবন। তাই “চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে” নামক মাত্র দুইপৃষ্ঠার রচনাতে তিনি আমার মতো গণ্ডমূর্খকে এমন অনেককিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন যেটা হয়তো এই বিষয়ের একটা গোটা বই পড়লেও আমি বুঝতে পারতাম না। “সংলাপ যদি স্বাভাবিক না হয় তাহলে অভিনয় স্বাভাবিক হওয়া মুশকিল”— হঠাৎ শুনতে খুব সামান্য মনে হলেও, সিনেমার নির্মাণগত দিকটা নিয়ে যারা বিন্দুমাত্রও আগ্রহী, তারা এই কথাটার মূল্য বুঝতে পারবেন! এরকম মূল্যবান উদাহরণ আমি ভুরি ভুরি দিয়ে যেতে পারি।অথচ মানুষটা একটু সময় নিয়ে, একটু যত্ন নিয়ে, একটু আরাম করে, প্রবন্ধ লেখার সুযোগ পেলেন না। এটা একটা বড় আফসোস। তাঁর প্রবন্ধগুলো পড়লেই বোঝা যায়, হাজাররকম কাজের ফাঁকে চটজলদি সময় বের করে নিয়ে লেখা হয়েছে সেগুলো। তাই সিংহভাগ প্রবন্ধই দৈর্ঘ্যে যৎসামান্য। প্রবন্ধের ভাষাতে যদিও সত্যজিতের ট্রেডমার্ক সহজতা এবং মিতবাচনের চিহ্ন আছে। প্রতিটা রচনাতেই কিছু-না-কিছু নতুন অন্তর্দৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়। এমনকি তাঁর নিজের তৈরি সিনেমাগুলো নিয়ে ছোটো ছোটো যে লেখাগুলো লিখেছেন, সেখানেও তিনি পাঠকের সময় ফালতু নষ্ট করেননি। নতুন কোনো আঙ্গিকে চিনিয়েছেন তাঁর চিরচেনা ছবিকে। “অপুর সংসার” তৈরির সময় অপু চরিত্র এবং অপু-অপর্ণার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে দেড়পৃষ্ঠার একটা নোট লিখে দিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। এই নোটটি যেন সত্যজিতের পুরো জীবনকে, পুরো প্রতিভাকে, পুরো মানুষটাকে, এক লহমায় চিনিয়ে দ্যায়। সহজ, মিতবাক, স্পষ্ট, প্রাঞ্জল, কিন্তু চিন্তার গভীরতায় ও বক্তব্যের বিশ্লেষণে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত। অনন্য!তাঁর প্রবন্ধ নিয়ে আরো অনেক কথা বলে ফেলা যায়। আমার বিশেষভাবে ভালোলাগা প্রবন্ধগুলো নিয়ে আরো কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে। তাঁকে নিয়ে আমার কথার শেষ নেই। চারশোর কিছু বেশি পৃষ্ঠার এই বইটিতে তাঁর লেখা শুধু বাংলা প্রবন্ধগুলোই স্থান পেয়েছে। তাঁর ইংরিজি মৌলিক প্রবন্ধগুলো, যা আপাতত দুটো আলাদা আলাদা বইতে সংকলিত হয়েছে, [b:Our Films, Their Films 670580 Our Films, Their Films Satyajit Ray https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1363702482l/670580.SY75.jpg 656613] এবং [b:Deep Focus 13385130 Deep Focus Reflections On Cinema Satyajit Ray https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1337760534l/13385130.SX50.jpg 18615535]— সেগুলোও অসামান্য, অসাধারণ— বলাই বাহুল্য! ইংরিজি এবং বাংলা এই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে দিয়ে সত্যজিতের একটা ভিন্ন, অপরিচিত রূপ আমাদের সামনে প্রকাশিত হয়। একজন চিন্তাশীল সত্যজিৎ। ভাবুক সত্যজিৎ। যে-বিষয়টা আমরা সবচেয়ে ভালোবাসি, আমাদের প্রাণের সবচেয়ে কাছাকাছি, সেই বিষয়ে কথা বললেই তো সবচেয়ে ভালো চিনতে পারা যায় আমাদের, তাইনা?একেক সময় মনে হয় যদি সময় পাই, অবকাশ আসে, তখন শুধু বাখ মোৎজার্ট বেটোফেন শুনবো!
সাড়ে-তিন তারা।
এই উপন্যাসটা দিয়েই এবছরের “পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা” পড়া শুরু করলাম। অনেকদিন পরে স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর লেখা পড়লাম। বেশ ভালো লাগলো।
সময় ষোড়শ শতক। পর্তুগিজ জলদস্যুরা দক্ষিণবঙ্গের ভাটি অঞ্চলের ত্রাস ছিলো তখন। বিখ্যাত বারো-ভুঁইয়াদের অন্যতম, রাজা প্রতাপাদিত্য ছিলেন যশোরের তৎকালীন শাসক। তাঁর রাজ্য দখল করতে ক্রমশ এগিয়ে আসছেন বাদশাহ আকবরের সেনাপতি মানসিংহ। ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা গল্পটা শুরু থেকেই টানটানভাবে জমে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা, জলদস্যুদের নৃশংসতা, বাহুবলের বিরুদ্ধে মস্তিষ্কের লড়াই, সবশেষে অশুভের পরাজয়। বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবে এবং দ্রুতগতিতে পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে কাহিনি। ক্লাইম্যাক্সটাও বেশ জমজমাট। সবমিলিয়ে উপভোগ করেছি স্মরণজিতের এই কিশোর-উপন্যাসটি।
এরপর কোনটা পড়া যায়?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে?
আর. কে. নারায়ণের লেখা গল্প-উপন্যাস নয়, তাঁর এই আত্মজীবনীটাই প্রথম পড়েছিলাম আমি। চেন্নাই, আগে যে-শহরের নাম ছিলো মাদ্রাজ, যে-শহরে তাঁর ছোটোবেলার অনেকটা অংশ কেটেছিলো, সেই শহরে বসেই পড়েছিলাম বইটা। এমন কাণ্ড ক্যানো করেছিলাম জানিনা। অন্য সব লেখা বাদ দিয়ে সবার আগে লেখকের আত্মজীবনী কে পড়ে?
এইজন্যে যদিও আফসোস হয়নি কখনও। তাঁর উপন্যাস কিংবা গল্প পড়ার সময় মিলিয়ে মিলিয়ে দেখেছি, অনেক উপাদানই নিজের জীবন থেকে নিয়েছেন তিনি। মনে হয়েছে, একজন লেখকের মূল অস্ত্র কল্পনাশক্তি নয়, তাঁর অভিজ্ঞতা। নারায়ণ নিজের জীবনের কাহিনিও শুনিয়েছেন স্বকীয় উপন্যাসের আদলেই। নিচু তারে বাঁধা সরস স্বর। চমক দেওয়ার প্রবণতা নেই একটুও। জীবনের অবশ্যম্ভাবী বিষাদ-বেদনা সেই স্বরের তাল কাটতে পারেনি পুরোপুরি।
প্রিয় মানুষদের আত্মজীবনী পড়তে ভালো লাগে। তাঁদের মতো হতে হবে, তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে, এইসব আদর্শ-ফাদর্শগত কারণে নয়। এমনিই। কেমন ছিলো সময়টা। কেমন ছিলো পারিপার্শ্বিক সমাজ। মানুষ। বন্ধুবান্ধব। আলো জল বাতাস। বই পড়তে ভালোবাসতেন? কী কী বই তাঁর জীবন পাল্টে দিয়েছে? অন্তর্মুখী ছিলেন? নারায়ণের সহোদর আর. কে. লক্ষ্মণ আমার খুব প্রিয় কার্টুনিস্ট। দুই ভাইই নিজ নিজ সৃষ্টিক্ষেত্রে একইরকম খ্যাতি অর্জন করেছেন। কীভাবে গড়ে উঠেছিলো তাঁর সাহিত্যচেতনা? সাহিত্যসৃষ্টির উদ্দীপনা? কীভাবে তৈরি হয় একটা উপন্যাস? কীভাবে সামলেছেন খ্যাতিকে? স্ত্রীর মৃত্যুর পরে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা থেকে মাথা তুলে কীভাবে আবার শুরু করেছিলেন লেখালিখি?
এত গভীর অনুভূতিসম্পন্ন উপন্যাস হুমায়ূন আহমেদ খুব বেশি লেখেননি।
আমার পড়া তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
খুব চমৎকার!