চোখের জলের মতো কয়েকফোঁটা আকারের এই কবিতার বইটি চোখের জলের মতোই সরল রহস্যময়। এই কবির কাব্যমননের কেন্দ্রবিন্দুতে, অন্তত এই বইটির ক্ষেত্রে, সেই নারীটি নেই, সাধারণত যেই নারীটি থাকে পৃথিবীর আপামর কবিদের কুঠারের ধারালো কিনারে, কিংবা পালকের নরম ডগায়। অর্থাৎ কবিদের প্রেমিকারা। অথচ এই কবিতাগুলোকে ভালোবাসার কবিতা ছাড়া আর কী-বা বলা যায়? ষোলো পৃষ্ঠার পরিসরে এই বইতে ছড়িয়ে আছে মাত্র তেরোখানি নম্র কবিতা। প্রতিটি কবিতার অনুষঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কবির আম্মার প্রসঙ্গ। অন্ধকারের অন্তর্গত শিমুল যখন টুপটাপ ঝরতে থাকে সারারাত, রোগনিরাময়কারী হাওয়ায় কবির সেই আম্মা, দাঁড়িয়ে থাকেন নিজের ভেতরে, একা—
আমার বাড়ি নবদ্বীপ থেকে চাপড়া নামের জায়গাটিতে যেতে মোটরবাইকে সময় লাগে খুব বেশি হলে এক ঘন্টা। কয়েকদিন আগে পাঠকবন্ধুদের কাছে তাদের বাৎসরিক প্রিয় বইয়ের নাম জানাতে অনুরোধ করেছিলাম। গুডরিডসের অনেক পুরোনো বন্ধু (সম্ভবত সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু) রিফাত, প্রায় কুন্ঠিত হয়ে দুটো বইয়ের নাম জানায় আমাকে। তার মধ্যে এই বিশীর্ণকায় কবিতার বইটি অন্যতম। হারুনের কাছে বইটির খোঁজ নিলে স্বয়ং কবির থেকে বইটির পিডিএফ চেয়ে আনে হারুন (বন্ধুভাগ্য!)। বইটি খুলে দেখি, বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কবির এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে ভারতের নদীয়া জেলার সেই চাপড়া থেকে! ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া...!
কবি হাসান রোবায়েতের সবচেয়ে বড় শক্তি লুকিয়ে আছে অনুপম দৃশ্য ও চিত্রকল্পময় পরিবেশমাধুর্য সৃষ্টির পারদর্শিতায়। শব্দের উপমাময়, গভীর ইঙ্গিতবাহী, রহস্যময়, ছলনাময় ব্যবহারে, শীতনিশীথে গায়ে জড়িয়ে রাখা পুরাতন চাদরের মতো পাঠকের অনুভবে জড়িয়ে থাকে, জামের নিধু বনে যেসব হাঁসেদের লাল পায়ে পায়ে বাজছে সন্তুর, সেইসব হাঁসেদের বুকের উষ্ণতা। “আনোখা” শব্দটির বাংলা অর্থ হতে পারে - “অনন্য”, কিন্তু ইংরেজি প্রতিশব্দটা বললে অর্থটা আরো পরিষ্কার হবে - “unique”. আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এই অনন্য, unique নদী আর কে হতে পারে, আমাদের মা ছাড়া? মোরগ জবাই করা সন্ধ্যায় যখন কবির আম্মা গিঁট মেরে বেঁধে রাখতেন মৌসুমী হাওয়ার দিন... কিংবা, নিমগাছের অমলিন ব্যথায় কবির আম্মা লেপে দিতেন হাতের অন্ধকার... আমিও একটু আগে, কবিতাগুলো পড়ার ফাঁকে দেখে এলাম, আমার আম্মা, আমার মা, নিবিষ্ট মনে বুনছে আমার জন্যে মেরুন রঙের সোয়েটার। আমার চোখে অনর্থক জল এলো। জানিনা ক্যানো মনে পড়ে গ্যালো এই বইয়ের কয়েকটা লাইন—
সিনেমার দিনশেষে সন্ধ্যাতারার নিচেআম্মা চাল ঝাড়তে বসলেগমগমে নিস্তব্ধতার ভেতর একটা বাঁশপাতাক্রমশ পেরিয়ে যায় চিত্রার্পিত হাওয়া......একটা সাইকেলের বেল চিরকাল বেজে যাচ্ছেপত্রছিন্ন সন্ধ্যায়—
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের আত্মজীবনীর নাম রেখেছিলেন “অর্ধেক জীবন”। তাঁর জীবনের বাকি অর্ধেকটা খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর লেখা কবিতায়। আমরা যারা সুনীলের কবিতার মুগ্ধ পাঠক, সেই আমাদের জীবনেরও বেশ কিছুটা অংশ কি ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই এইসব কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে? গত প্রায় একমাস ধরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রের চারটে খণ্ড পড়ে শেষ করার পরে, বাতাসে ভাসমান একাকী তুলোর বীজের মতো আমার মনে ভাসছে প্রথমবার তাঁর কবিতা আবিষ্কার করার স্মৃতি। মফস্বল শহরের বাংলা ইশকুলের অন্ধকার লাইব্রেরির বৃদ্ধ আলমারি থেকে বের করে আনা কীটদষ্ট বইটার নাম ছিলো “জাগরণ হেমবর্ণ”। সেই বইয়ের একটি কবিতার প্রথম লাইন : “যে লেখে, সে আমি নয়/ কেন যে আমায় দোষী করো!” যে-ছেলেটা বইটা পড়ছিলো সেও তো আমি ছিলাম না! “সে কখনো আমার মতন বসে থাকে/ টেবিলে মুখ গুঁজে?”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৫৮ সালের শীতকালে। পৌষমাসে। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। বইটির নাম ছিলো “একা এবং কয়েকজন”। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছিলো “আমার প্রিয় কবিদের প্রতি”। সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু বইয়ের কবিতাগুলো মোটেও সুবিধের ছিলো না। এই বইটিকে নিয়ে সুনীল পরবর্তীকালে নিজের দ্বিধা প্রকাশ করেছিলেন। পাপস্খালনের মতো আফসোস-স্খালনের জন্যে একই নামের একটি বড়ো আকারের উপন্যাস লিখেছিলেন। কবি হিসেবে সুনীলের প্রকৃত আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে, প্রথম বই প্রকাশের আট বছর পরে। বাংলা কবিতার জগতে গুটিকয় অবিস্মরণীয় বইয়ের অন্যতম সেই বইটির নাম— “আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি”। ভাবতে অবাক লাগে, এই বইয়ের অধিকাংশ কবিতা তিনি আমেরিকায় বসে লিখেছিলেন।
বইটির ভূমিকায় তিরিশ বছর বয়েসি কবি লিপিবদ্ধ করেছেন কিছু অকপট বাক্য : “অসীম ধৈর্যের সঙ্গে ওষ্ঠাধর সঙ্কুচিত করে পড়তে হয় নিজের পুরোনো কবিতা। যেগুলি পছন্দ হয় না এবং শরীর রি-রি করে, সেগুলি মাটিতে ফেলে দিই। ক্রমে আমার ঘরময় বিবর্ণ কাগজ উড়তে থাকে, ঘরের মেঝেতে ও হাওয়ায় ব্যর্থ কবিতা ছড়িয়ে যায়। ...জানি, যে-কবিতা আমি লিখতে চাই, এখনো তার মর্ম স্পর্শ করতে পারিনি।” পরবর্তী অর্ধশতাব্দব্যাপী, ২০১২ সালে তাঁর জীবনাবসান পর্যন্ত, সুনীলের কবিতায় যেন ক্রমাগত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁর সেই অকপট স্বীকারোক্তিরই নানাবিধ সংস্করণ। নানাবিধ উচ্চারণ। কবিতা লিখে তিনি সমাজ বদলাতে চাননি। প্রতিষ্ঠা পেতে চাননি। ঠাট্টা করে একবার লিখেছিলেন বটে, কিন্তু আদৌ কখনও কবিতা লিখে রাজপ্রাসাদ বানাতে কিংবা পন্টিয়াক গাড়ি কিনতে চাননি। নিজের কবিতায় আজীবন শুধু একটাই কথা বলতে চেয়েছেন : তিনি কী রকম ভাবে বেঁচে আছেন।
আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে পঞ্চাশের দশক ছিলো মোহভঙ্গের দশক। পাটভাঙা ধপধপে পোশাক পরিহিত রাজনৈতিক নেতাদের বচনবলিষ্ঠতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নির্ভেজাল ধাপ্পাবাজিকে প্রথমবারের জন্যে চিনতে পেরেছিলো দেশের মানুষ। তিরিশের দশকের ব্যাপারে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এই দশকে “বাংলা কাব্যের” মুক্তি ঘটেছিলো। তাহলে বলতে হয় পঞ্চাশের দশক ছিলো “বাংলা কবিতার” মুক্তির দশক! এই মুক্তি এতটাই নির্মম, এতটাই “উন্মার্গগামী” যে, রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতার ব্যান্ডমাস্টার স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু স্বীকার করে নিয়েছিলেন : আধুনিক কবিতা তিনি ভালো বুঝতে পারছেন না! বন্ধ করে দিয়েছিলেন নিজের সাধের “কবিতা” পত্রিকা। সেই “দুর্বোধ্য” আধুনিকতাকে ট্যাঁকে গুঁজে বাংলা কবিতার নতুন নৌকা তৈরি হলো যার নাম “কৃত্তিবাস” পত্রিকা। সেই নৌকার অবিসংবাদিত মাঝির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
কবি সুনীল যে ভবিষ্যতে গদ্যকার সুনীল হিসেবে অধিক পরিচিত হবেন সেটা তাঁর কবিতা পড়লে আন্দাজ করা যায়। কবিতার নতুন ভাষাকে স্বীকার করে নিয়েও, প্রয়োগসর্বস্ব আঁতেলগন্ধী নিরীক্ষাপ্রবণতাকে শুরু থেকেই তাচ্ছিল্য করেছিলেন তিনি। “আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি”র ঠিক পরের কবিতার বই “বন্দী, জেগে আছো”তে লিখলেন : “কাঁচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে/ দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি.../ ...ইচ্ছে করে লণ্ডভণ্ড করি এবার পৃথিবীটাকে/ মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি/ আমার কিছু ভাল্লাগে না!” এই যে অনুভূতিময় প্রত্যক্ষ প্রকাশভঙ্গিমা, দৃশ্যের পরে দৃশ্যকে সাবলীল বুনে যাওয়া, শব্দ ও বাক্যের সহজিয়া মগ্নতা, এইসমস্ত লক্ষণ তো একজন গদ্যশিল্পীর লক্ষণ। পঞ্চাশের দশকের সবচেয়ে বড় এবং বহুপ্রজ কবির নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ঠিক কথা। কিন্তু সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী কবিতাগুলো লিখেছেন সুনীল। কবিতা সবসময়ই মুষ্টিমেয় পাঠকের জন্যে নির্দিষ্ট ছিলো। আজও আছে। কিন্তু কবিতার লাইনও যে হয়ে উঠতে পারে পপুলার কালচারের অংশ, মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে পারে কবিতার টুকরো, কবিতার এই ক্যাজুয়াল স্বর সুনীলের নিজস্ব অর্জন। এত বেশি উদ্ধৃতিযোগ্য পঙ্ক্তি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং জীবনানন্দ দাশ ছাড়া অন্য কোনো বাঙালি কবির কাব্যকৃতিতে নেই। এখানে রবীন্দ্রনাথের নাম উল্লেখ করা উচিত হবে না। উনি তো মানুষ নন, “ঠাকুর”!
“ফিরে এসো, চাকা” আমার পাঠকজীবনের একটি মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বই। প্রতিটি মানুষের চিন্তাভাবনায় কিছু স্ববিরোধ (contradiction) থাকে। পাঠক হিসেবে আমার স্ববিরোধটি হলো, গদ্যের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা, অস্পষ্টতা কিংবা উদ্দেশ্যহীন অবাস্তবতা আমার সহ্য হয়না ; অথচ আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি! গল্প-উপন্যাস পাঠের ক্ষেত্রে সুসঙ্গত প্লট এবং বক্তব্যের বোধগম্যতা আমার কাছে খুব জরুরি দুটো শর্ত। ফ্রাঞ্জ কাফকার “দ্য মেটামরফোসিস” ভালো লেগেছিলো কারণ, গল্পটির আপাত-absurdity সত্ত্বেও ওই দুটো শর্ত পূরণ হয়েছিলো। হুয়ান রুলফোর “পেড্রো পারামো” ভালো লাগেনি কারণ শর্তদুটো পূরণ হয়নি।
২৮ শে এপ্রিল ১৯৬২ সালে লিখিত নিচের এই লাইনগুলো, আজকে ভোরবেলা আমি যখন পুনরায় পাঠ করলাম, তখন আমি আরো একবার, আবারও একবার, এক রহস্যময় কিন্তু সুস্পষ্ট আচ্ছন্নতার প্রতি নিজেকে সমর্পণ করলাম।
কবে যেন একবার বিদ্ধ হ'য়ে বালুকাবেলায়সাগরের সাহচর্য পেয়েছিলো অলৌকিক পাখি।উদ্যত সংগীতে কবে ভরেছিলো হর্ম্যতল, তবুপেরেক বিফল হ'লো গহ্বরের উদ্ধার পেলো না।
যেমনটা শোনা যায়, হতে পারে এই বইটি একজন কবির ব্যর্থ প্রেমের এবং স্পর্শবঞ্চিত আকাঙ্ক্ষার, সুদীর্ঘ এপিটাফ। কিন্তু যখনই এই কবিতাগুলো পড়ি, কবির মানসিক ইতিবৃত্তান্তের কথা আমার খেয়ালে থাকে না। আমি দেখতে পাই একটা অচেতন টানেলের শেষপ্রান্তে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে একটা হলদে আলোর শিখা। শিখাটার নাম “বোধ”।
আগে এই শিখাটার নাম ছিলো “বিপন্নতা”। ২০০৯ সাল নাগাদ প্রথমবার এই কবিতাগুলো পড়ার আগে, কবিতাকে আমি জানতুম একধরণের অস্পষ্ট আবেশ হিসেবে। কবিতা পড়তে আমার ভালো লাগতো, কিন্তু তারা আমাকে বিপন্ন করতো। যা-কিছুর অর্থ আমার কাছে সম্পূর্ণ ধরা দিতো না, তা-ই আমাকে বিপন্ন করতো।
এমন বিপন্ন আমি, ব্যক্তিগত পবিত্রতাহীন।যেখানে-সেখানে মুগ্ধ মলত্যাগে অথবা অসীমেপ্রস্রাব করার কালে শিশুর গোপন কিছু নেই।ফলে পিপীলিকাশ্রেণী, কুসুমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
বিনয় মজুমদারের সান্নিধ্যে এসে আমি বুঝেছি, বিপন্নতা থেকে বোধে উত্তরণের নামই কবিতা। কবিতা মানে কেবল বিমূর্ত আবেশ নয়। সুন্দর সুন্দর শব্দ পাশাপাশি সাজিয়ে যাওয়া নয়। কিংবা, পাহাড়ি বালকের বাঁশির মতো সরল আত্মউন্মোচন নয়। ক্রোধজর্জর শ্লোগান তো নয়ই। কবি অবশ্যই নিশ্চিতভাবে কিছু একটা প্রকাশ করতে চাইছেন। হয়তো শুধু আমাকেই বলতে চাইছেন। কবি আর আমি মুখোমুখি। কিন্তু, যেহেতু কবিতার চেয়ে ব্যক্তিগত বিষয় খুব কম আছে পৃথিবীতে, নিজেকে প্রকাশ করার আগে আমার সামর্থ্য যাচাই করে নিচ্ছেন তিনি। টুকরো করে কাছি, আমি কি ডুবতে রাজি আছি?
এসো ক্লান্তি, এসো এসো, বহু পরীক্ষায় ব্যর্থ, হাঁসপুনরায় বলে, তার ওড়ার ক্ষমতাবলি নেই,নির্মিত নীড়ের কথা মনে আনে, বিস্মিত স্মৃতিতে।অজীর্ণ, তোমাকে নিয়ে আর কতো গান গেয়ে যাবো?
বোধের এই যে স্পষ্টতা, অথচ প্রকাশের ভাষাটি যেন এই জগতের নয়। তিনি জানতেন, আমিও ধীরে ধীরে জেনেছি, আমরা দুজনেই আসলে ভিনগ্রহী। অপার্থিব মহাজাগতিক ভিনগ্রহী নয়, আমার মাথার ভেতরেই অনেকগুলো বিকল্প গ্রহ আছে। যদিও কবির সঙ্গে আমার বাক্যবিনিময় পৃথিবীর পরিচিত ভাষায় হয়না, তবু বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, নিবিড় নিশ্চিত বোধগম্যতার সিঁড়িতে দৃঢ়পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে কবিতা। কবিতা যে ভাসমান বায়বীয় কুয়াশাচ্ছন্ন কোনও হিলস্টেশন নয়, রহস্যময় মানেই যে দুরূহ অস্পষ্টতা নয়, এই জরুরি দর্পণগুলো আমাকে সরবরাহ করেছিলেন কবি বিনয় মজুমদার। কবিতা ছলনা নয়, কবিতারও আছে সুসংগত প্লট, সনির্বন্ধ বোধগম্যতা। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে জীবনানন্দ দাশ যা-খুশি হতে পারেন— একজন কমলালেবু কিংবা ভোরের শঙ্খচিল। কিন্তু তাঁর কবিতা মোটেও “বিপন্ন বিস্ময়” নয়। কোনো কবিতা যদি প্রকৃতই কবিতা হয়ে থাকে, তাহলে তা ভীষণভাবে দৃশ্যমান! অবচেতনে নয়, আমার জ্যান্ত চেতনায়! এই উপলব্ধি, “ফিরে এসো, চাকা” পড়ার আগে আমার ছিলো না।
যখন কিছু না থাকে, কিছুই নিমেষলভ্য নয়,তখনো কেবলমাত্র বিরহ সহজে পেতে পারি।তাকেই সম্বল ক'রে বুঝি এই মহাশূন্য শুধুস্বতঃস্ফূর্ত জ্যোৎস্নায় পরিপূর্ণ, মুগ্ধ হতে পারে।
ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
পূর্ণেন্দু পত্রীকে যেকোনো একটা পরিচয়ে বেঁধে ফেলা কিংবা আটকে রাখা অসম্ভব। তিনি ছিলেন কলকাতার নাগরিক-ইতিহাসের একজন উৎসাহী গবেষক। একজন মৌলিক সিনেমানির্মাতা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের “তেলেনাপোতা আবিষ্কার”কে তিনি সেলুলয়েডে ধরতে চেয়েছিলেন!! বাংলা প্রকাশনীর ইতিহাসে সম্ভবত সবচাইতে ভার্সাটাইল এবং অভিনব প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন তিনি। চমৎকার গদ্যলেখক এবং ঔপন্যাসিক। এরকম নানাবিধ কাজকর্মে পারদর্শিতা ছাড়াও তিনি এমন কিছু ঘটনার উদ্যোগী ছিলেন, যেগুলো বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। সত্যজিৎ রায় যখন পথের পাঁচালী বানিয়েছিলেন, আপামর বাঙালি দর্শকদের মধ্যে আক্ষরিক-অর্থে তিনি ছিলেন প্রথম মানুষ যিনি নবীন পরিচালকের প্রতি নিজের সমুগ্ধ প্রশস্তি অর্পণ করেছিলেন এবং তাঁকে সম্বর্ধনাজ্ঞাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই পঞ্চাশের দশকে বাংলা সিনেমার অবস্থা ছিল আজকের থেকেও বাহাত্তর-গুণ যাচ্ছেতাই। সমকালীন একজন অখ্যাত অকুলীন বাঙালি সিনেমানির্মাতার প্রতি এইরকম অকপট শ্রদ্ধার প্রকাশ আজকের দিনের ফুটোমস্তান “ফিলিম ক্রিটিক”দের দ্বারা স্বপ্নেও ভাবা যায় না!
কলকাতা শহরের সম্ভবত সবচেয়ে সুদর্শন স্থাপত্য ছিলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের “সেনেট হল”। বারোক এবং নিওক্ল্যাসিক্যাল শৈলীর যুগলবন্দিতে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন এই ভবনটিকে ১৯৬০ সালে “আধুনিকতার প্রয়োজনে” নির্মমভাবে ভেঙে ফেলা হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের মতো বেশ কয়েকজন সমসাময়িক মানুষের লেখায় দেখতে পাই, সেনেট হলের হত্যাযজ্ঞের সেই ঘটনার ছবি দিনের পর দিন নিজের স্টিল-ক্যামেরায় তুলে রাখছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। ছবি তুলছিলেন এবং অঝোরে কাঁদছিলেন। ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন শিল্পীর অসহায় যন্ত্রণা! পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার আলোচনায় এইসব অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা টেনে আনছি ক্যানো? কারণ একজন কবির প্রকৃত পরিচয় মুদ্রিত থাকে কেবল ফুল পাখি নদী চাঁদ প্রেম বিরহের রমণীয় ক্যানভাসেই নয়, তাঁর সমসাময়িক ক্ষতবিক্ষত পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেও। গভীর রাতে সাদা পৃষ্ঠায় সুচিন্তিত প্রেমের কবিতা লিখবার আগে, কবি নিজের ফুসফুসে ঢুকিয়ে নেন সারাদিনের ধুলো ধোঁয়া নাগরিক-দুর্গন্ধ বিষবাষ্প সূর্যপোড়া ছাই!
নারীরা পুরনো হয়, যুবকেরা বেঁকে যায় দুঃখে দুর্বিপাকেজননীরা তুলে নেয় মৃত্যুর সংসার কোলে-কাঁখেগভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
এখনও বিষাদ পাবে বলেপুরুষ নারীর কাছে যায়নারীরা নদীর কাছে যায়নদীরা মাটির কাছে আসেমাটি আকাশের দিকে চায়।তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাওওষ্ঠপুটে রাখি।
ফুলের কাছে নারীর কাছেবুকের বিপুল ব্যথার কাছেবেদনাবহ যে সব কথা বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম।তারাই যখন ফিরে আসেকেউ ললিতে কেউ বিভাসেস্পন্দনে তার বুঝতে পারিবুকের মধ্যে বড়ে গোলাম!
উৎকৃষ্ট মানুষ তুমি চেয়েছিলেএই যে এঁকেছি।এই তার রক্ত-নাড়ি, এই খুলি,এই তার হাড়।এই দেখ ফুসফুসের চতুর্দিকে পেরেক, আলপিনসরু কাঁটাতার।এইখানে আত্মা ছিলগোল সূর্য, ভারমিলিয়নভাঙা ফুলদানি ছিল এরই মধ্যেছিল পিকদানিপিকদানির মধ্যে ছিলপৃথিবীর কফ, থুতু, শ্লেষ্মা, শ্লেষঅপমান, হত্যা ও মরণ।উৎকৃষ্ট মানুষ তুমি খুঁজেছিলেএই যে এঁকেছি!ক্ষতচিহ্নগুলি গুণে নাও!
কথায় বলে, brevity is the soul of wit. এই ক্ষুদ্র বইটা আমি বেশ কয়েকবার পড়েছি। প্রতিবার পড়ার সময়ই এই কথাটা আমার মাথায় আসে। নাটকের মতো একটি বিচিত্রমুখী এবং যৌগিক শিল্পমাধ্যমকে একটা ছোট্ট সাইজের বইয়ের মাত্র ৫৭ পৃষ্ঠার মধ্যে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা— এটা একটা অভাবনীয় কাজ।
নাটক একটা মিশ্র-শিল্প। মানে এতে অন্য নানারকম শিল্পের মিশেল ঘটেছে। কেউ নাটক লেখে। সেই লেখাটা কেউ পড়ে। তারপর তাকে মঞ্চায়িত করার ভাবনা আসে। লোক জোগাড় করা হয়। মঞ্চ সাজানো হয়। আলো লাগানো হয়। শব্দের ব্যবস্থা করা হয়। মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রেক্ষাপট আঁকা হয়। গানবাজনার আয়োজন করা হয়। এরপর আছেন অভিনেতারা। তাঁরা কেউ কেবল সংলাপ বলেন। কেউ নৃত্য করেন। কেউ বা গান করেন। কেউ আবৃত্তি করেন। কেউ মুখে একটা কথাও বলেন না, শুধুই অভিব্যক্তির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন। যিনি নিহত সৈন্যের ভূমিকায় অভিনয় করছেন, তিনি সারাক্ষণ মঞ্চের মেঝেতে চুপচাপ মটকা মেরে শুয়ে থাকেন। অভিনেতারা কেমন পোশাক পরবেন, এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করারও লোক আছে। এরকম ছোটো বড়ো আরো অনেক কিছু। তারপর আমরা দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে নাটকটা দেখতে যাই। এই বিস্তারিত এবং বিপুল একটা আয়োজনকে তখন যেন সামগ্রিকভাবে আমাদের দিকে সজোরে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। মঞ্চের উপরের কয়েকজন মানুষের সঙ্গে মঞ্চের সামনে বসে থাকা কয়েকজন মানুষের মধ্যে এই যে একটা তাৎক্ষণিক এবং স্বতস্ফূর্ত সম্পর্ক তৈরি হয়, এটাই নাট্যশিল্পের মূল আবেদন।
এই পুরো আয়োজনটা কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে মূলত দুটো ভরকেন্দ্রকে আশ্রয় করে। একটা হলো, লিখিত নাটক। আরেকটা হলো, সেই লিখিত নাটকের অভিনয়। রচনা এবং অভিনয়। দুয়ে মিলে “নাট্যকলা”।
বাদল সরকারের “থার্ড থিয়েটার” মুভমেন্টের মতো ঘটনায় নাটকের দ্বৈত ভরকেন্দ্রের এই বিষয়টা আরো স্পষ্ট বোঝা যায়। থার্ড থিয়েটারের প্রযোজনাগুলোতে আনুষঙ্গিক আয়োজন বলতে কিচ্ছু থাকতো না। এমনকি মঞ্চও থাকতো না। সরাসরি ব্যস্ত রাস্তাঘাটের একপাশে নাটকের অভিনয় হতো। একজন লেখক নাটকটা লিখতেন, আর সেই নাটকটা কয়েকজন মিলে অভিনয় করতেন। ব্যাস, আর কিছু না। দর্শকরা যে যার ইচ্ছে মতো দাঁড়িয়ে পড়তেন। তাঁরাও অবাক হয়ে যেতেন আচমকা এই কাণ্ড দেখে। কখনও কখনও তাঁরাও নাটকের অংশ হয়ে যেতেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নাটকের মতো এই যে এত বিচিত্র এত বিবিধ একটা আয়োজন, এর স্রষ্টা হিসেবে আমরা কাকে চিহ্নিত করবো? যিনি নাটকটা লিখেছেন, তাঁকে? নাকি যিনি পরিচালনা করেছেন? নাকি যাঁরা অভিনয় করেছেন? আর যিনি আলোকসম্পাত করেছেন? যিনি শব্দ-সংযোজন করেছেন? নেপথ্যে যাঁরা বাজনা বাজিয়েছেন? যিনি পোশাক ডিজাইন করেছেন? উইংসের পিছনে অল্পবয়েসি যে-ছেলেটা দৌড়ে দৌড়ে সবাইকে সেই সকাল থেকে লাগাতার চা খাইয়ে গেলেন, তাঁর কিছু দায় নেই? পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনও শিল্পে দায়বদ্ধতার এই প্রশ্নটা এত জোরদারভাবে উঠে আসে না। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও না। চলচ্চিত্রে সত্যি করেই সিংহভাগ দায় থাকে পরিচালকের। চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নৌকার হাল এবং রশি নিজের হাতে ধরে থাকেন তিনি। নাটকের ক্ষেত্রে উল্টো। ঠিক যখন সবার সামনে নাটকটা মঞ্চস্থ হওয়ার মোক্ষম সময় এলো, তখন কোথায় নাট্যকার? কোথায় পরিচালক? তখন আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে! একবার তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে একটা সিনেমা হাজার বার দেখলেও সেটা একই জিনিস। একটা নাটক যতবার মঞ্চস্থ করা হয়, প্রতিবার সেটা বদলে বদলে যায়। বহিরঙ্গে। অন্তরঙ্গে।
শম্ভু মিত্র নিজে ছিলেন বাংলা আধুনিক নাট্যজগতের অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন। এই ক্ষুদ্র বইটা পড়লে বোঝা যায়, নাটক নামের এই শিল্পমাধ্যমটিকে নিজের ভিতরে সম্পূর্ণভাবে আত্তীকরণ করে ফেলতে না-পারলে, এতটা প্রাঞ্জলভাবে এতটা স্পষ্টভাবে তাকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। নাট্যশিল্পের গোড়ার বিষয়গুলো সহজ উপায়ে বোঝার জন্যে এই বইটার বিকল্প নেই। ক্যানো আজও, অ্যাটেনশন স্প্যানের দুর্ভিক্ষ আর চটজলদি হল্লাবাজির রমরমার এই যুগেও— যখন কোনও সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করলে ফট্ করে ল্যাপটপ খুলে ফেলা যায়, গান শুনতে হলে ফট্ করে স্পটিফাই, গুগল ইমেজ-সার্চের ভার্চুয়াল গ্যালারিতে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে পৃথিবীর বিখ্যাত চিত্রশিল্পের নমুনাগুলো, ইচ্ছে হলেই ফট্ করে দেখে নেওয়া যায় মোনালিসার স্মিত হাসি কিংবা ভ্যান গঘের আলু চাষী। তবু নাটক দেখতে হলে কষ্ট করে আমাদের যেতে হয় থিয়েটারে। আগে থেকে নিতে হয় মানসিক প্রস্তুতি। সবচেয়ে বড় কথা, ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে হয়। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন যখন সন্ধ্যা আসে— প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে থাকে শুধু অন্ধকার— তখন আলোকিত মঞ্চ থেকে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে, মুখোমুখি বসে থাকেন নাটোরের বনলতা সেন। কোন্ চিরন্তন আবেদনের জাদুতে?
সুতরাং, কাকে বলে নাট্যকলা?
“কথা ও কাহিনী” রবীন্দ্রনাথের একটি ব্যতিক্রমী কাব্যগ্রন্থ। এই বইটি লেখার ঠিক আগেই তিনি “কণিকা” নামের একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন। কণিকা-র ছোটো ছোটো কবিতাগুলোর সঙ্গে বাঙালি ইশকুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা, “ভাবসম্প্রসারণ” নামক একটি ঝামেলাবহুল কাজের সূত্রে, খুব ভালো ভাবে পরিচিত।
আম্র কহে— একদিন, হে মাকাল ভাই,আছিনু বনের মধ্যে সমান সবাই।মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি,মূল্যভেদ শুরু হল সাম্য গেল ঘুচি।
খুব সরল ভাষায় লেখা, উপদেশ কিংবা নীতিকথামূলক এই কবিতাগুলো জ্ঞানের ভারে কিংবা দার্শনিক চিন্তার গভীরতায় জর্জরিত নয়, বরং বেশ উপভোগ্য। উপদেশ দিয়েছেন বটে, কিন্তু পরিহাসের ছলে। সমাজ-সংসারের নানাবিধ বৈসাদৃশ্যকে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু কাউকে আঘাত না-দিয়ে। এই যে সহজ সরল ভাষায়, নিপুণ ছন্দে গাঁথা, গল্প শোনানোর ছলে কবিতা লেখার নবলদ্ধ স্টাইলটি উদ্ভাবন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, “কথা ও কাহিনী” কাব্যগ্রন্থে সেই ন্যারেটিভ স্টাইলটিকে আরো বিস্তারিতভাবে, আরো মনোহর ভঙ্গিতে, প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। যেসব পাঠক কবিতা উপভোগ করতে পারেন না, তারাও এই বইটি পছন্দ করে ফেলবেন। কারণ কবিতা লেখার ছলে আসলে তিনি আমাদের নির্ভেজাল গল্প শুনিয়েছেন।
বইটির দুটো ভাগ। “কথা” অংশে মোট চব্বিশটি নাতিদীর্ঘ কবিতা রয়েছে। এই কবিতাগুলোর কাহিনিবস্তু বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্র, প্রাচীন মরাঠি-পাঞ্জাবি-রাজস্থানি ইতিহাস, বৈষ্ণব সাহিত্য— এইসব সূত্র থেকে সংগ্রহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর পাঠ-পরিধি এবং উৎসাহের দিগন্ত যে কতোটা বিস্তৃত ছিল, এই বইয়ের কবিতাগুলো তার প্রমাণ। যদি বৌদ্ধ কাহিনি খুঁজতে হয়, তাহলে খুব সহজেই তিনি “জাতক” কাহিনির শরণাপন্ন হতে পারতেন। কিন্তু সহজ পথে না হেঁটে, আখ্যানের সন্ধানে “অবদানশতক” কিংবা “মহাবস্ত্ববদান”-এর মতো স্বল্পপরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থের পৃষ্ঠা উল্টিয়েছেন তিনি। কাহিনি, ছন্দ এবং বক্তব্যের ত্রিবেণীসংগমে “কথা” অংশের কবিতাগুলো ভীষণ উপভোগ্য। বারবার পড়া যায়। অনেকবার পড়া যায়। অনেককিছু উপলব্ধি করা যায়।
এই বইয়ের “কাহিনী” অংশের প্রায় প্রতিটি কবিতা বাঙালি পাঠকদের কাছে সুপরিচিত, বহুলপঠিত। যারা আবৃত্তিচর্চা করেন, তারা তো এই কবিতাগুলো নিজেদের হাতের তালুর মতো চেনেন। “কাহিনী”-তে মোট সাতটি কবিতা আছে। এগুলোকে সাধারণ কবিতা না-বলে “নাট্য-কবিতা” নামে ডাকা যেতে পারে। এই অংশের কবিতাতেও কবিতা লেখার ছলে আদপে গল্প শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ছন্দের অপরূপ অথচ বলিষ্ঠ মাধুর্যে এবং বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে, এই কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যের বিশেষ সম্পদ। “দেবতার গ্রাস” কিংবা “বিসর্জন” কিংবা “গান্ধারীর আবেদন” কিংবা “কর্ণকুন্তী-সংবাদ”— কতোবার যে পড়েছি, তবু আশ মেটেনা।
“কাহিনী” অংশের কয়েকটা কবিতার ব্যাপারে আলাদাভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন। কিন্তু এইখানে সেই আলোচনা করার পরিসর নেই। মহাভারতের মনোযোগী পাঠক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। “গান্ধারীর আবেদন” এবং “কর্ণকুন্তী-সংবাদ”— এই বিখ্যাত দুটি কবিতার প্লট তিনি মহাভারত থেকে নিয়েছেন। মহাভারতের অন্যতম অবহেলিত চরিত্রের নাম গান্ধারী। গান্ধারী কৃষ্ণের মতো সেলিব্রিটি ছিলেন না, ভীষ্মের মতো “মহান” ছিলেন না, কুন্তীর মতো তাঁর জীবন “সেনসেশনাল” ছিল না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একজন পরিপূর্ণ মানবীরূপে দেখিয়েছেন। এই কবিতায় ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনকেও একটা ভিন্ন আলোকে দেখতে পাই আমরা। পরিচিত ক্যানভাসে পরিচিত রং দিয়ে কেমন এক অপ্রত্যক্ষ ট্র্যাজেডির ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ!
“কর্ণকুন্তী-সংবাদ” পড়লে আমার মনে হয় এটা কবিতা নয়, একটা কাকচক্ষু সুগভীর দীঘি। এপিক সাহিত্যের সুপরিচিত চরিত্রদের এই যে একটা নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, এটা আমাকে মুগ্ধ করে। গোটা কবিতাটি সংলাপে গাঁথা। আর ছন্দের কী অসাধারণ বিস্তার। প্রথম স্তবকটি যতবার পড়ি, একটা আসন্ন ঝড়ের সংকেত আমার মাথায় বেজে ওঠে। সন্ধেবেলার ঝড়। বিষন্ন, বিপর্যস্ত, অন্ধকার, একাকী, সুন্দর।
পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যা-সবিতারবন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার,অধিরথ সূতপুত্র, রাধাগর্ভজাত,সেই আমি— কহ মোরে তুমি কে গো মাতঃ!
কুন্তীর বুকে কেমন ধাক্কা লেগেছিল, নিজের পুত্রের মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনে?
“কথা ও কাহিনী” তাই রবীন্দ্রনাথের একটি অপরূপ সৃষ্টি। বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন : “একদিন এল যখন আর-একটা ধারা বন্যার মতো মনের মধ্যে নামল। কিছুদিন ধরে দিল তাকে প্লাবিত করে। এর আনন্দবেগ যেন থামতে চাইল না।”
আমিও প্লাবিত হয়েছি বারবার এই ধারাস্রোতে। আমার মনের আনন্দও একই বার্তা শুনিয়েছে বারে বারে, নিজেকেই নিজে।
কথা কও, কথা কও।স্তব্ধ অতীত, হে গোপনচারী,অচেতন তুমি নও—কথা কেন নাহি কও!তব সঞ্চার শুনেছি আমারমর্মের মাঝখানে,কত দিবসের কত সঞ্চয়রেখে যাও মোর প্রাণে!হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনেকাজ করে যাও গোপনে গোপনে,মুখর দিনের চপলতা-মাঝেস্থির হয়ে তুমি রও।হে অতীত, তুমি গোপনে হৃদয়েকথা কও, কথা কও!
দেশের মাহাত্ম্যের কথা জানিনা, ধর্মের মাহাত্ম্যের কথা জানিনা। কিন্তু দেশ এবং ধর্মের নামে মানুষের উপর মানুষের অত্যাচারকে, অপমানকে, খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারি।
দেশ আর ধর্ম বায়বীয় বিষয়, কিন্তু মানুষ তৈরি হয় রক্ত-মাংস-হাড়-স্নায়ু-চেতনা দিয়ে। দেশকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিলে দেশ ভেউ ভেউ করে কাঁদতে বসে না (উপন্যাসের একটি চরিত্র নিজের দেশকে এই গালিটি দিয়েছেন)। কিন্তু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিলে মানুষের কেমন লাগে? নিজেদের পবিত্র উপাসনাস্থল ভেঙে দিলে মানুষের কেমন লাগে? জাত তুলে গালি দিলে মানুষের কেমন লাগে? নিজের মা-বোনের গণধর্ষণ হলে মানুষের কেমন লাগে?
উপমহাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য, রাজনীতি আর ক্ষমতা নিয়ে ব্যবসা করা কতিপয় হারামজাদার হাতবাক্স সেই ইংরেজ আমল থেকে সাধারণ মানুষকে দোহন করে আসছে— দেশ এবং ধর্মের সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার কোরে। “দেশভক্তি” টপিক নিয়ে নানান কিসিমের নাটক চলছে ভারতে। ভালোই বুঝি বাংলাদেশেও চলছে। একই গুয়ের গন্ধ ডানদিক থেকে শোঁকা আর বাঁ দিক থেকে শোঁকা। গু তো গু-ই।
মসজিদ ভাঙে এই দেশে, মাজা ভাঙে বাংলাদেশের হিন্দুদের। সেই মসজিদভাঙা পার্টির লোক এখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি আজকে একুশ কোটি মুসলিম জনসংখ্যার দেশের নির্বাচিত সর্বোচ্চ জনপ্রতিনিধি। কিন্তু একদা প্রকাশ্য জনসভায় মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে টিটকিরি মেরেছিলেন : “হাম পাঁচ, হামারা পচ্চিশ” (মুসলমানরা চারটে শাদি করে, তাই “আমরা পাঁচজন”, আর মুসলমানরা অনেক বাচ্চা পয়দা করে তাই “আমাদের সন্তান পঁচিশটা”)।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পরে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপরে সংঘটিত অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তসলিমা নাসরিন। সাম্প্রতিক ভারতে কোনো হিন্দু নারী-সাহিত্যিক মুসলমানদের দুঃখ কষ্ট দুর্ভাবনাকে নিয়ে উপন্যাস লেখার সাহস দেখিয়েছেন কি?
যদিও এভাবে তুলনা করা উচিত নয়। সাহস কোনো তুল্যমূল্য বিচার করার বস্তু নয়। তাছাড়া ভারতবর্ষ বোধহয় আরও অনেক জটিল দেশ। এই দেশে অন্য ধর্মের মানুষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না। উঁচু জাতির হিন্দুরাই নিচু জাতির হিন্দুদের বাঁশ দ্যায় নিয়মিত। সেই নিচু জাতির হিন্দুরা আবার তাদের চেয়ে যারা আরেকটু নিচু, তাদের দ্যায়। এইভাবে ক্রমশ নিম্নতর পর্যায়ে দেওয়াদেয়ি চলতে থাকে। জারা হাটকে, জারা বাঁচকে, ইয়ে হ্যায় ইন্ডিয়া মেরি জান!
কিন্তু আলোচ্য এই উপন্যাসটা গুছিয়ে লিখতে পারেননি তসলিমা। একটা জরুরি বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে বড্ডো বেশি মোটাদাগের অভিব্যক্তি দেখিয়ে ফেলেছেন। চরিত্রগুলো খাপছাড়া, লক্ষ্যহীন। কাহিনিটা এলোমেলো। সম্ভবত উপন্যাসটা লেখার সময় তিনি নিজেই খুব “হাইপার” হয়ে ছিলেন। পারিপার্শ্বিক উত্তপ্ত ঘটনা চাক্ষুষ করলে যেকোনো সংবেদনশীল মানুষই হাইপার হয়ে যাবেন, এটা ঠিক কথা।
কিন্তু সাহিত্যিকরা তো সাধারণ মানুষ নন। উপন্যাস লেখার সময় তারা এরকম ল্যাজেগোবরে হয়ে গেলে উপন্যাসের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়না। একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একটা নিম্নমানের উপন্যাস লিখেছেন তসলিমা নাসরিন। তবু তাঁর সাহসের কথা চিন্তা করে তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
এই দুনিয়ায় অনেক রকমের ভূতের হদিশ পাওয়া যায়। “একানড়ে” তেমনই একরকম ভূতের নাম। তালগাছের উপরে বাস করে এই ভূত। এই ভূতের একটা পা নেই। নিজের অবশিষ্ট একখানা পা ঝুলিয়ে সে বসে থাকে তালগাছের মগডালে। প্রচলিত গ্রাম্য শিশুতোষ ছড়া আছে :
যে ছেলেটা কাঁদে
তাকে ঝুলির ভেতর ভরে
গাছের উপর উঠে
তুলে আছাড় মারে।
অর্থাৎ যারা দুষ্টু ছেলেমেয়ে, এই ভূত তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দ্যায়। ছোটো ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়ানো খুব কঠিন একটা কাজ। আগেকার দিনে এইরকম ভয়ানক সব ছড়া শুনিয়ে তাদের ঘুম পাড়ানো হতো!
কিছুদিন আগেই এই লেখকের গোয়েন্দা উপন্যাস “শেষ মৃত পাখি” পড়েছিলাম। আজকে দুপুরে গুডরিডসের সূত্রেই এই উপন্যাসটার সন্ধান পেলাম। কী মনে হলো, ইন্টারনেটে খুঁজে দেখলাম এবং পেয়েও গেলাম। ছোটো সাইজের উপন্যাস, তাই পড়া শুরু করে দিলাম।
লেখকের মৌলিক গদ্যভাষার খানিকটা পরিচয় “শেষ মৃত পাখি”-তে পেয়েছিলাম। কিন্তু “একানড়ে” উপন্যাসটির অসামান্য গদ্যশৈলী ইদানিংকার বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের কারো কলম থেকে বেরিয়েছে বলে আমার জানা নেই। চিত্রকল্প এবং রূপকের অনবদ্য ব্যবহারে, শব্দচয়ন এবং বাক্যের সযত্ন নির্মাণে, কাহিনিতে যুক্ত করেছেন হিমশীতল হিংস্র অনুভূতির আলাদা একটা প্রান্তর।
এরপর আসি গল্পের কথায়। “একানড়ে” অলৌকিক গল্প হয়েও ঠিক অলৌকিক গল্প নয়, আবার বাস্তবতার গণ্ডিতেও পুরোপুরি আটকে থাকেনি এই গল্পের প্লট। রিভিউয়ের শুরুতেই “একানড়ে” নামক ভূতের যে রেফারেন্স দিলাম, সেগুলো চমৎকার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন লেখক। তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন শিশু-মনস্তত্ত্ব, অন্ধবিশ্বাস এবং ভুতুড়ে পরিবেশ-নির্মাণের মেধাবী কৌশল।
নয় বছরের একটা বাচ্চা ছেলের দৈনন্দিন চিন্তাভাবনা, তার মানসিক স্ট্রাগল, বড়োদের জগতের সঙ্গে তার নিজের জগতের টানাপোড়েন— এই সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে লেখক এমন একটা কাহিনি ফেঁদেছেন, যেটা পড়তে গিয়ে আজকে এই উল্টোরথের দিনে, বৃষ্টি থৈ থৈ বিকেলবেলাটা, সন্ধেবেলাটা, রাত্রিবেলাটা— বেশ চমৎকার কাটলো।
বড়ো হয়ে যাওয়ার পরে আমরা এখন বেমালুম ভুলে গেছি : আমরা যখন বেশ ছোটো ছিলাম, আমাদের মনের ভিতরে লুকিয়ে ছিলো একটা সম্পূর্ণ গোপন রহস্যময় জগৎ। যে-জগৎটার হদিশ কেউ জানতো না। বড়োরা না, বন্ধুরা না, ভাইবোনেরা না, কেউ না। একটা রোমাঞ্চকর নিষিদ্ধ জগৎ।
জানতাম শুধু আমরা নিজেরা। আমাদের সেই জগৎটা কিন্তু মোটেও “ছোটোদের” জগৎ ছিলো না। “নিষ্পাপ” জগৎ ছিলো না। বিস্মৃত সেই রহস্যময় জগৎটার কথা আজকে খুব ক্ষীণভাবে আবার মনে পড়ে গ্যালো।
হাবিজাবি তন্ত্র মন্ত্র পিশাচ ভুজুংভাজুং থোড়-বড়ি-খাড়া আবর্জনায় ডুবে থাকা বাংলা সাহিত্যের আজকের এই মধ্যমেধাবী লেখকদের জমানায় এরকম বুদ্ধিদীপ্ত সুলিখিত অলৌকিক একখণ্ড আনন্দ দেওয়ার জন্যে— লেখককে কুর্নিশ!
আমার প্রিয় গদ্যশিল্পীদের তালিকায় ট্রুম্যান কাপোটি'র নাম উপরের দিকে থাকবে। এমন ঝকঝকে গদ্য লেখার হাত তাঁর, পড়লে মনে হয় বৃষ্টিঝরা বিকেলে বারান্দায় বসে গরম চায়ে রাস্ক বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছি। তাঁর “ইন কোল্ড ব্লাড” বইটা পড়ার অভিজ্ঞতার কথা এখনও বেশ মনে আছে। ক্রাইম জার্নালিজমকে সাহিত্যের পর্যায়ে তুলে ফেলেছিলেন সেই বইতে। তারপর “ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফ্যানিজ” সহ দু-তিনটে ছোটগল্প পড়েছিলাম। গল্প যেমনই লাগুক, তাঁর গদ্য পড়লে একটা আলাদা আরাম পাওয়া যায়। “মিউজিক ফর ক্যামিলিয়ন্স” বইটা বোধহয় স্টাইলিশ এবং উদ্ভাবনী গদ্যকার হিসেবে কাপোটি'র সবচেয়ে আকর্ষণীয় কাজ (যদিও তাঁর সব ছোটগল্প এখনও পড়িনি আমি)।
তিনটে আলাদা অংশে বইটাকে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে কয়েকটা ছোটগল্প রয়েছে। নাহ, ছোটগল্প বললে বোধহয় ভুল হবে। ওগুলোকে “ক্যারেকটার-স্কেচ” বলা উচিত। কাপোটির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা নিয়ে তো আলাদা করে কিছু আর বলার নেই। তাঁর চমৎকার সেন্স-অফ-হিউমর নিয়েও কিছু বলার নেই। এই বইয়ের মুখবন্ধে লেখক নতুন একটা সাহিত্য-ফর্মের উল্লেখ করেছেন : “নন-ফিকশন নভেল” (আশা করি নামটা শুনেই আমরা খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি ব্যাপারটা আসলে কী জিনিস)। তো, সেই হিসেবে এই গল্পগুলোকেও “নন-ফিকশন শর্টস্টোরিজ” বলা যেতে পারে।
তার পরের অংশটা, মানে বইয়ের দ্বিতীয় অংশটাকেই আসলে তিনি “নন-ফিকশন নভেল” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমেরিকার মিডওয়েস্ট অঞ্চলের (সম্ভবত ক্যানসাস স্টেটের) একটা স্মলটাউনে ঘটে যাওয়া সিরিয়াল কিলিংয়ের সত্যি ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা কাহিনিটা পড়ে ভীষণ আনন্দ পেয়েছি। আনন্দ পাওয়ার কথাটা স্বীকার করতে একটু লজ্জা লাগছে যদিও। একটার পর একটা মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে (তাও আবার হতভম্বকর উপায়ে), আর আমি ভাবছি : আহা, এভাবেও লেখা যায়! কেয়া বাত, কেয়া বাত!
তৃতীয় অংশটা বইয়ের সবচেয়ে দুর্দান্ত অংশ। অংশটার নাম : “কনভার্সেশনাল পোর্ট্রেটস্”। মানে, পারস্পরিক কথোপকথনের মাধ্যমে মানুষের চারিত্রিক রূপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সাতজন আলাদা আলাদা মানুষকে নিয়ে লিখেছেন। সাতজনের সামাজিক স্ট্যাটাস সাতরকম। কেউ লোকের বাড়িতে ঘরদোর পরিষ্কার করার কাজ করেন। কেউ ওয়াল স্ট্রিটের নামজাদা (কিন্তু ঘনঘন মদ্যপায়ী) ব্যক্তিত্ব। কেউ আবার কুখ্যাত সাইকোপ্যাথ চার্লস ম্যানসনের ঘনিষ্ঠ সহকারী (ইদানিং যিনি, বলাই বাহুল্য, শ্রীঘরে বিরাজ করছেন)। সাতজন মানুষের মধ্যে অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো-ও আছেন (যিনি নাট্যকার আর্থার মিলার-এর প্রেমে পড়েছেন সদ্য)। সাতজনের শেষ ব্যক্তিটি হলেন লেখক নিজেই। তিনি নিজেই নিজের ইন্টারভিউ নিয়েছেন। প্রত্যেকটা লেখাই উপভোগ্য এবং চিন্তার খোরাক জোগানদায়ী। কাপোটি'র রসবোধের ব্যাপারটা বারবার বলতে ইচ্ছে করে। মোটাদাগের নয়, খুব সূক্ষ্ম এবং তৃপ্তিদায়ক। কেবল রসবোধ আর স্টাইল নয়, প্রতিটা লেখার মধ্যে লেখকের একটা গভীর মানবিক সত্ত্বা টের পাওয়া যায়। একটা ছায়াচ্ছন্ন “হিউম্যান” দিক। নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথনের যে-লেখাটা, সেখান থেকে ছোটো একটা টুকরো তুলে এনে এই রিভিউটা সমাপ্ত করা যাক।
Q : If you could be granted one wish, what would it be?A : To wake up one morning and feel that I was at last a grown-up person, emptied of resentment, vengeful thoughts, and other wasteful, childish emotions. To find myself, in other words, an adult.
এমন একটা সকালের কথা আমিও প্রায়শই চিন্তা করি। কিন্তু হে মা জগদম্বা, এখনও সেই সকালটার দেখা পেলাম না।
পল গগ্যাঁ-র জীবন যেন একটা ধূমকেতু। উনিশ শতকের প্যারিস-কেন্দ্রিক ইম্প্রেশনিস্ট/ পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের,— রেনোয়া, দেগা, মানে, সেজান, কামিল পিসাহো, মোনে, তুলুঝ লোত্রেক, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ— প্রায় প্রত্যেকের জীবন ছিলো ছন্নছাড়া, এলোমেলো, হিবিজিবি। এই ছন্নছাড়াদের দলের মধ্যমণি ছিলেন গগ্যাঁ। আবার এই ছন্নছাড়াদের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্রও ছিলেন তিনি। জন্ম থেকেই শুধু ছুটছেন। এদিক থেকে সেদিক, এধার থেকে ওধার। সারাজীবন ফরাসি শৌখিনতার ধার ধারেননি। পরিশীলিত ফরাসি বিলাসিতার মুখে ঝাঁটা মেরেছেন। নিশ্চিন্ত স্বচ্ছল গৃহস্থ জীবন ত্যাগ করেছেন। কী যে একটা কাণ্ড করেছেন— স্রেফ ছবি আঁকবেন বলে! শুনলে মনে হয় রূপকথা শুনছি।
এই বইয়ের লেখক অহিভূষণ মালিক (মল্লিক নয়) নিজেই ছিলেন একজন স্বনামধন্য ইলাস্ট্রেটর। মূলত ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। লীলা মজুমদারের “পদীপিসির বর্মীবাক্স” উপন্যাসের অবিস্মরণীয় ইলাস্ট্রেশনগুলো তাঁরই আঁকা। “রূপদর্শীর নকশা” নামে গৌরকিশোর ঘোষের লেখা বিখ্যাত সংবাদ-ফিচারের সঙ্গে দীর্ঘকাল শিল্পসঙ্গত করেছিলেন তিনি (“দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত হতো)। তুলির মতো তাঁর কলমও যে কতোটা চমৎকার, এই বইটা না-পড়লে পেত্যয় হবে না! মাত্র ৯৮ পৃষ্ঠার মধ্যে গগ্যাঁ-র মতো ফুটন্ত আগ্নেয়গিরিকে দিব্যি আঁটিয়ে ফেলেছেন। ছোটো ছোটো অধ্যায়ে, সরস সাবলীল গদ্যে লেখা, পল গগ্যাঁ-র এই জীবনীটি পড়লে বড্ডো আফসোস হয়। হায়, অন্য শিল্পীদের নিয়েও ক্যানো যে লিখলেন না!
পড়ছিলাম সমারসেট মম্-এর উপন্যাস “দা মুন অ্যান্ড সিক্সপেন্স”। শুনেছিলাম এই উপন্যাসটা নাকি গগ্যাঁ-র জীবনকাহিনি অবলম্বনে রচিত। পড়তে পড়তে মনে হলো : আরেহ, ডাল মে তো কুছ কালা হ্যায়! গগ্যাঁ-র জীবনের খুব সামান্য একটা আভাস আছে ঠিকই, কিন্তু সবমিলিয়ে শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়ে ফেলেছেন লেখক। মনের মধ্যে ভেসে উঠলো অনেকদিন আগে পড়া অহিভূষণ মালিকের লেখা পল গগ্যাঁ নামক বজ্রবিদ্যুৎসহ এক অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের বৃত্তান্ত। শেলফ থেকে খুঁজে বের করে আরেকবার বইটা পড়া ছাড়া তখন আর কোনো উপায় রইলো না!
Life is hardly more than a fraction of a second. Such a little time to prepare oneself for eternity! (পল গগ্যাঁ)
পেশায় সাংবাদিক ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। সংবাদ-প্রতিবেদনে বাড়তি কথা ফেনিয়ে লেখার সুযোগ থাকেনা সাংবাদিকদের। পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে খুব তাড়াতাড়ি এবং স্পষ্টভাবে মূল বক্তব্যকে প্রকাশ করার তাগিদ থাকে। গৌরকিশোর ঘোষের উপন্যাসে সাংবাদিকসুলভ এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রত্যক্ষভাবে খুঁজে পেয়েছি। যদিও দৈনিক-পত্রিকায় খবর ছাপানোর তাড়াহুড়ো এবং সেইসব মুদ্রিত খবরের তাৎক্ষণিক সমসাময়িকতার বাইরে বেরিয়ে এই উপন্যাসগুলো হয়ে উঠেছে প্রকৃত অর্থে “সাহিত্য”। উঁচুদরের সাহিত্য। পাঠককে ভাবিয়ে তোলার মতো সাহিত্য। একবার পড়া হয়ে গেলে ঝালমুড়ির ঠোঙা তৈরি করা যাবেনা এই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো দিয়ে।
মোট ছয়টি উপন্যাস রয়েছে এই সংগ্রহে। সবকটাই সীমিত দৈর্ঘ্যের এবং প্রতিটির বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গি চমকপ্রদ। দুটো বিশেষ লক্ষণ গৌরকিশোরের উপন্যাসে দেখতে পেয়েছি। এক, তাঁর প্রধান চরিত্ররা প্রখরভাবে রাজনীতি এবং সময়-সচেতন। দুই, তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ছক ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্যে উদগ্রীব। গৌরকিশোরের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের ব্যাপারে খোঁজখবর করলে বোঝা যায়, এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিল। তাঁর উপন্যাসের চরিত্ররা সবাই অস্তিত্বের সংকটে ভুক্তভোগী। সমাজের সার্কাসে অদক্ষ জোকারের মতো তারা বিপজ্জনকভাবে ট্র্যাপিজের দড়ি ধরে ঝুলছে। কিন্তু প্রত্যেকেই নিজের অবস্থার ব্যাপারে তলিয়ে ভাবছে। বিশ্লেষণ করছে। শুধুই দিনগত পাপক্ষয় করতে শশব্যস্ত নয় তারা।
সবকটা উপন্যাস ধরে ধরে আলোচনা করার সুযোগ নেই। দরকারও নেই। গৌরকিশোর ঘোষের গদ্যভাষা তাঁর বক্তব্যের মতোই টানটান, ন্যাকামিবর্জিত, বলিষ্ঠ। যদিও তাঁর উপন্যাসের ন্যারেটিভ-গঠন গতানুগতিক নয়, বরং ভাষা এবং সংলাপ নিয়ে ক্রমাগত নিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। এবং প্রায় প্রতিটি নিরীক্ষাই আমার কাছে মৌলিক ও সার্থক বলে মনে হয়েছে। উপন্যাসগুলো ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে লেখা। আমরা সবাই জানি, এই সময়কালে বাংলা সাহিত্যে জাঁকিয়ে বসেছিলো আরো বেশকিছু বিকল্প সাহিত্যস্বর। কিন্তু গৌরকিশোরের মতো ভানহীন, ভন্ডামিহীন, কৃত্রিমতাহীন উৎকর্ষ আমি আর কারো মধ্যে দেখতে পাইনি। আর সেই জন্যেই, পাঠক হিসেবে আমি বারবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি।
সামাজিক অব্যবস্থাগুলো নিয়ে, মানুষের মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে, এরকম অদ্ভুত আতসকাচের ব্যবহার আমি আর কখনও দেখিনি যে! একবারের জন্যেও গৌরকিশোর সরাসরি আঙুল তুলে, মুখ থেকে থুতু ছিটিয়ে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশে ছুঁড়ে, কিংবা বাঁকা হেসে, সবজান্তা ভাব দেখিয়ে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গালিগালাজ করেননি (যেমন করাটাই “প্রতিবাদ” করার প্রতিষ্ঠিত রীতি— তখনও, এখনও)। তাঁর সমালোচনা করার পদ্ধতিটা নিস্পৃহ, মোহশূন্য, কিন্তু সত্যনিষ্ঠ। হাসপাতালের লাশকাটা ঘরের দরজা খুললে যেমন একইসঙ্গে ভেসে আসে হিমশীতল বাতাসের ঝাপটা এবং মৃতদেহের পচা দুর্গন্ধ (ডিসিনফেকট্যান্টের আপাতসুগন্ধ ছাপিয়ে)। গৌরকিশোর ঘোষের প্রতিটি উপন্যাস আমাকে উপলব্ধির সেই মৃতকল্প করিডোরে একলা ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। সেই করিডোরে দাঁড়িয়ে, আমাদের সমাজব্যবস্থার হাস্যকর অথচ নিদারুণ পরিস্থিতির নিখুঁত ভাষ্য হিসেবে আমি ফিরে ফিরে শুনতে পেয়েছি গৌরকিশোরের উপন্যাসের একটা সংলাপ :
ওরে, লাশটার পকেটগুলো ভালো করে দ্যাখ। যা পাস নিয়ে আয় এখানে। লিস্টি করে রেখে দিই। তারপর ওটাকে নিয়ে যা। গাদায় রেখে দে।
এই লাশটা কে? আমাদের জীবন্মৃত সমাজ? নাকি সমাজের সদস্য হিসেবে আলাদাভাবে আমরা সবাই?
অনেকদিন পরে আর. কে. নারায়ণের উপন্যাস পড়লাম। এই উপন্যাসটা প্রথম পড়েছিলাম আজ থেকে প্রায়... পনেরো বছর আগে!! তখন কেমন লেগেছিলো সেসব আর কিছুই মনে নেই এখন। নারায়ণের সবকটা উপন্যাস সেইসময় একটানা পড়ে শেষ করেছিলাম। এবারও তাঁর সবকটা উপন্যাস একটানা পড়ে ফেলবো ঠিক করেছি। দেখা যাক কদ্দুর এগোনো যায়।
“স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস”কে যদি কিশোর-উপন্যাস হিসেবে গণ্য করি, তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক বিষয় নিয়ে এটিই নারায়ণের প্রথম উপন্যাস। গত শতকের তিরিশের দশকে দক্ষিণ ভারতের একটি ছোটো মফস্বল শহরের গল্প (কাল্পনিক এই শহরের নামটি আমরা সবাই জানি— “মালগুড়ি”)। সেই শহরের চন্দ্রন নামের একজন যুবকের গল্প। একটি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যাওয়া সময় এবং পরিবেশের গল্প। উপন্যাসটিতে লেখকের আত্মজৈবনিক কিছু উপাদান আছে।
কাহিনির চরিত্রদের কিছু কিছু চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণ, আজকের দিনে আমাদের কাছে আপত্তিকর বলে মনে হবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, লেখক যদি উপন্যাসের চরিত্রদের “আদর্শ চরিত্র” হিসেবে দেখাতেন, তাহলে তখনকার মানুষের চিন্তাভাবনার ব্যাপারে আমরা কীভাবে জানতে পারতাম? সাহিত্যের থেকে আমরা কী প্রত্যাশা করি? বাস্তবধর্মিতা? নাকি স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা— “সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা”— একটি কাল্পনিক আদর্শ জগত? কথাসাহিত্য পড়ার সময় আমি সময়ের থেকে এগিয়ে থাকতে চাইনা। সময়টাকে চিনতে চাই।
নারায়ণের গদ্যশৈলী আমার ভীষণ প্রিয়। কী সুন্দর ফুরফুরে লেখা। কোনো চালাকি নেই। বাচালতা নেই। বাক্যগঠনে এবং শব্দচয়নে জটিলতা নেই। উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা নেই। “দার্শনিক বার্তা” দেওয়ার চেষ্টা নেই। পরিমিত ছিমছাম কয়েকটি রেখার টানে ফুটিয়ে তুলেছেন একটি অল্পবয়েসি ছেলের জীবনে প্রথমবার প্রেমে পড়ার ইতিবৃত্ত। প্রথমবার কষ্ট পাওয়ার ইতিবৃত্ত। কষ্টের মাঝেও কয়েক টুকরো মুচকি হাসি গুঁজে রাখতে ভুলে যাননি নারায়ণ। জীবন তো এরকমই...
মহাভারতের অতিপরিচিত কাহিনিগুলো যতবার পড়ি, নব রূপে, নব আঙ্গিকে, ততবার নিত্যনতুন উপলব্ধি জেগে ওঠে মনের মধ্যে। গল্পের আদি-অন্ত জানা থাকলেও মলিন হয়না তাদের আকর্ষণ। পাণ্ডবদের পিতা পাণ্ডু ছিলেন একজন প্রবল প্রতিভাশালী ব্যক্তি। পৌরুষ এবং পাণ্ডিত্যে, শস্ত্র এবং শাস্ত্রে— তাঁর ছিল সমান অধিকার। এত যে পরাক্রমী একজন মানুষ, এত রূপবান এত গুণবান, তবু জন্মগত বিশেষ ত্রুটির কারণে তিনি সন্তানপ্রজননে অক্ষম ছিলেন। কুন্তী এবং মাদ্রী, এই দুই সহানুভূতিশীল স্ত্রীকে পাশে পেয়েও তিনি কাটিয়েছিলেন একটি বিষন্ন এবং বিপন্ন জীবন। এমনিতেই মহাভারতের কাহিনিতে জটিলতার শেষ নেই। পাণ্ডু'র এই শারীরিক ব্যাধি এবং সেই ব্যাধির পরিণাম— মহাভারতের অভিনব এবং ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এবং সবচেয়ে রহস্যময়। বলা যেতে পারে, এই বিশেষ ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়েই সমগ্র মহাভারতের সুদূরপ্রসারী ঘূর্ণাবর্তের সূচনা হয়েছিল।
সন্তান উৎপাদনে অক্ষম ছিলেন পাণ্ডু, তবু কীভাবে জন্ম হয়েছিল পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়ের?
তমাল বন্দোপাধ্যায় মহাভারতের এই কৌতূহলকর অধ্যায়টিকে বেশ সুন্দরভাবে পুনরুজ্জীবিত করেছেন তাঁর কলমে। লেখকের গদ্যভাষা মনোরম, বর্ণনা স্বচ্ছ এবং পরিমিত। পৃথিবীর যেকোনো প্রাচীন মহাকাব্যের বহিরঙ্গের অলৌকিক/অতিলৌকিক খোলসটি অতিক্রম করলে আবিষ্কার করা যায় মানুষের চরিত্র এবং সমাজের চিরকালীন বৈশিষ্ট্যগুলোকে। মহাকালের মন্দিরা সেই একই ছন্দে বেজে যাচ্ছে আজও। আজও মানুষ কায়মনোবাক্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় ; কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিংবা স্বার্থের তাড়নায়, পরিত্যাগ করে সেই সুচিন্তিত প্রতিজ্ঞা। আজও মানুষ, সভ্যতার দ্বারা অর্জিত শোভন পরিচ্ছদ এবং মার্জিত আচরণের নিচে লুকিয়ে রাখে তার basic instinct-গুলোকে। আসমুদ্রহিমাচল পৃথিবীকে পদানত করার আস্ফালন দেখায় ; কিন্তু মানুষ আজও পোষ মানাতে পারেনি, এমনকি তার নিজের মনকেও!
এই বইটিকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী বলা যাবে না। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে হিন্দুধর্মের অবস্থা কেমন ছিল? ব্রাহ্মণরা ভাবতো তারা জাতপাতের অবস্থানগত পিরামিডের একদম চূড়ায় বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে (যদিও, পিরামিডের একদম উপরের ছুঁচলো অংশটিতে বসে থাকা শারীরিকভাবে একটু অস্বস্তিকর)। আর সমাজের অন্ত্যজ মানুষরা, যারা বেদ বেদান্ত শাস্ত্র ফাস্ত্র এইসব বুঝতেন না, তারা নিজেদের সুবিধে মতো ধর্মপালনের উপায় খুঁজে বের করে নিয়েছিলেন।
হিন্দু ধর্মের মূল শাস্ত্রগ্রন্থগুলো পৌত্তলিকতাকে সমর্থন করে না। “অদ্বৈতবাদ” নামের একটি দার্শনিক চিন্তার লাইন ধরে সুদীর্ঘকাল মেইনস্ট্রিম হিন্দু দর্শনের বিশ্লেষণ এবং চর্চা হয়ে আসছিল। মোটামুটিভাবে “অদ্বৈতবাদ” = ঈশ্বর কোনও মানুষের মতো দেখতে থ্রি-ডাইমেনশনাল জিনিস নয়। রক্তমাংসের মনুষ্যের দ্বারা তাঁকে বোঝা, কল্পনা করা, অনুভব করা, বিশ্লেষণ করা, স্পর্শ করা, দর্শন করা— এইসব পার্থিব কোনোকিছুই করা সম্ভব নয়। তিনি “অবাঙ্মনসগোচর”। সাধারণ বোধবুদ্ধি দিয়ে তাঁকে বোঝা যায় না।
ঈশ্বরের এই যে দুর্বোধ্য অদ্বৈত রূপটির ধারণা, একজন সাধারণ অশিক্ষিত দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের মাথার দুই কিলোমিটার উপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। রুজি রোজগারের ধান্দায় সারাদিন পরিশ্রম করার পরে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এইসব ভজকট চিন্তাভাবনা করতে কার ভালো লাগে? ক্লাসের হিংসুটে ফার্স্ট বয় (কিংবা গার্লরা) যেমন নিজেদের “স্পেশ্যাল নোটস” অন্যদের থেকে লুকিয়ে রাখে, শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরাও তেমনি এইসব টেকনিক্যাল দার্শনিক ব্যাপার সাধারণ মানুষের থেকে লুকিয়ে রাখতো। সাধারণ মানুষ তখন ধুরশ্লা বলে নিজেরাই নিজেদের মতো ঈশ্বরের রূপ কল্পনা করে নিতে বাধ্য হলো।
কিন্তু এত সহজে সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ ঈশ্বরকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে, ঈশ্বরের মূর্তি তৈরি করে, পূজা করতে লাগলো। আর ওই হিংসুটে ফার্স্ট বয়রা (এই ক্ষেত্রে শুধু বয়, কারণ গার্লদের ক্ষেত্রে শাস্ত্রপাঠ নিষিদ্ধ ছিল) বললো, মাটি কিংবা ধাতু কিংবা পাথর দিয়ে তৈরি মূর্তি নিয়ে তোমরা যতোই লাফালাফি করো, ধর্মের আচার বিচার সংস্কার নিয়ম কানুনের ব্যাপারে জানতে হলে আমাদের কাছেই আসতে হবে। ঈশ্বরকে নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এই টানাপোড়েন বহু যুগ ধরেই চলছিল। ঠিক এই পরিস্থিতিতে চৈতন্যদেব এমন একটি উপায় বললেন, যাতে এক ঝটকায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে গ্যালো।
তিনি বললেন, ধর্মপালন করার জন্যে আচার বিচার নিয়ম নিষ্ঠা মন্ত্র তন্ত্র হাবিজাবি কিচ্ছু দরকার নেই। প্রাণের আনন্দে ভক্তিসহকারে উচ্চকণ্ঠে স্রেফ হরিনাম সংকীর্তন করলেই ঈশ্বরকে ডাকা হবে, ঈশ্বরকে পাওয়া হবে। সঙ্গে যদি খোল কর্তাল শঙ্খ মাদল জোগাড় করতে পারো তাহলে তো কথাই নেই। এইসব বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গলা ছেড়ে (ইচ্ছে হলে দুই হাত তুলে একটু নেচেও নিতে পারো, নো প্রবলেম) হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করলে আর কিছুর প্রয়োজন নেই। ব্যাস, মহাপ্রভুর এই আশ্বাস পেয়ে সাধারণ মানুষ উল্লাসে একেবারে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো। প্রথমে নবদ্বীপ শহর, তারপর গোটা গৌড়বঙ্গ, তারপর ভারতের আরও নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো ঈশ্বর ভজনার এই অভিনব সহজিয়া পন্থা। প্রতিষ্ঠিত হলো “গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন”। (এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানানো যেতে পারে। হরিনাম সংকীর্তনের বার্তাটি চৈতন্যদেব সর্বপ্রথম, নবদ্বীপেরও আগে, প্রচার করেছিলেন পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টে— বর্তমান সিলেট)।
আজকের দিনের বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করলে এই পুরো বৃত্তান্তকে “আরো একটি নতুন কিসিমের কুসংস্কারগ্রস্ত ধর্মীয় পাগলামি” বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চিরাচরিত সামাজিক কাঠামোর সীমা লঙ্ঘন না করেও, তৎকালীন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে, ধর্মকে সংস্কার করার এই সাহস দেখাতে চৈতন্যদেবের আগেও কেউ পারেননি, পরেও কেউ পারেননি। এমনকি আজকের দিনের মুক্তচিন্তার ফুরফুরে মলয় বাতাসেও ধর্মকে নিয়ে বেশি খোঁচাখুঁচি করার পরিণাম কেমন হতে পারে তা আমরা সবাই জানি।
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তাঁর নিজস্ব বিশ্লেষণের আলোকে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক চিন্তার জগৎকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই বিষয়ে অনেক নতুন কিছু জানতে পেরেছি বইটা পড়ে, অনেক অন্ধকার দূর হয়েছে। রিভিউর সীমিত পরিসরে মহাপ্রভু প্রবর্তিত বৈষ্ণব দর্শনের ব্যাপারে প্রায় কোনোকিছুই আমি লিখতে পারলাম না। তাঁর মতো যুগন্ধর মানুষকে “ঈশ্বরের অবতার” হিসেবে গণ্য করা হবে, এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু আদপে তো তিনি ছিলেন আপনার আমার মতোই রক্তমাংসের মানুষ। কেউ বলে তিনি শ্রীকৃষ্ণের অবতার, কেউ বলে তিনি প্রথম বাঙালি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী (তথা “প্রলেতারিয়েতদের মসিহা”), কেউ বলে তিনি হিন্দুধর্মের একজন সংস্কারক, কেউ বলে তিনি কিসুই না, স্রেফ একজন বায়ুরোগগ্রস্ত প্রায়োন্মাদ।
কিন্তু সব মসিহার যেরকম অবস্থা হয় মহাপ্রভুরও একই অবস্থা হয়েছে। যিনি কিনা মানুষের উচ্চনিচ ভেদাভেদ দূর করে সবাইকে একই পঙ্ক্তিতে দাঁড় করাবার জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করলেন, তাঁর নিজের শহর নবদ্বীপে গেলে আজকে দেখা যাবে, তাঁর নামাঙ্কিত “মহাপ্রভু মন্দিরে” অব্রাহ্মণদের প্রবেশ করতে হলে কাঠের বাক্সের ভিতরে ভেট গুঁজে দিয়ে তবে ঢুকতে হয় (ভেট = entry fee)। তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পার্ষদ, মুসলমান ধর্মাবলম্বী হরিদাসকে মিছিলের মধ্যিখানে রেখে যিনি অত্যাচারী কাজির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেই মহাপ্রভুর ভক্তরা তাদের মন্দিরে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যাপারে আপত্তি না জানালেও নজরুলগীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যিনি সবাইকে হতে বলেছেন “তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা” (তৃণের মতো সামান্য, বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু), তাঁরই নামে কপালে তিলক কেটে ISKCON-এর ছোকরা সন্ন্যাসীমহারাজ ইউটিউবের ভিডিওতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দকে বাঁদরের মতো মুখ ভ্যাংচায়। চেষ্টাচরিত্র করে দেখলে কুকুরের ল্যাজ সোজা হলেও হতে পারে, কিন্তু মানুষের ল্যাজ সোজা করা মহাপ্রভুরও কম্মো নয়।
সিনেমাটা অনেকেই দেখেছেন। আমি এখনও দেখিনি, বইটাও পড়া ছিল না। মাত্র ১৭১ পৃষ্ঠার একটি নভেলা। বিষয়বস্তু : প্রেম।
প্রেমের উপন্যাস পড়তে কেমন যেন লাগে। গুরুত্বপূর্ণ কতো উপন্যাস পড়া বাকি এখনও, যেসব উপন্যাসে সামাজিক কিংবা মানবিক জটিলতাকে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে। সেইসব “দরকারি” লেখা ছেড়ে প্রেমের উপন্যাস পড়ে সময় নষ্ট করবো?
তবু পড়লাম। পড়ে কিন্তু ভালো লাগলো। গল্পের প্রধান চরিত্ররা অল্পবয়েসি প্রেমিক-প্রেমিকা নয়। সংসারী এবং মধ্যবয়স্ক। প্রেমের মাঝে বিপত্তি তাই বেশি। দ্বন্দ্ব বেশি। গভীরতাও বেশি।
কাহিনির সারবস্তু দুই পৃষ্ঠাতেই লিখে ফেলা যেত। কিন্তু লেখকের রচনাশৈলী বেশ উপভোগ্য। তিনি ধীরে সুস্থে গল্পটা বলেছেন আমাদের। প্রেমের মতো জরুরি এবং অনিবার্য বিষয়ও আজকের দিনে “বাবু, খাইছো?” ঠাট্টায় পরিণত হয়েছে। ইট-চাপা ঘাসের মতো তবুও কয়েকদিন সূর্যালোকের স্পর্শ পেলেই, প্রেম এখনও, এত ঠাট্টা সত্ত্বেও, গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে।
বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একাদৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখাহয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলেআজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলেকিন্তু তুমি নেই বাহিরে, অন্তরে মেঘ করেভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!
(শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
কলেজ স্কয়ারের “ধ্যানবিন্দু” দোকানে আমি যাই কবিতার বইয়ের খোঁজ করতে আর লিটিল ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা উল্টে দেখতে। সেখানেই পেয়ে গেলাম সালভাদোর দালি-র এই চমৎকার জীবনীটি। বিংশ শতাব্দীর চিত্রশিল্পীদের মধ্যে পাবলো পিকাসো এবং সালভাদোর দালি— এই দুজনের মধ্যে কে বেশি কিংবদন্তি ছিলেন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয় (দুজনেই স্প্যানিশ)। যদি চারিত্রিক বৈপরীত্যের তত্ত্বতালাশ করতে হয়, তাহলে দালি-র তুলনা শুধু চিত্রশিল্প জগতে নয়, পৃথিবীর যেকোনো সাংস্কৃতিক মাধ্যমেই পাওয়া দুষ্কর। অনতিদীর্ঘ এই বইটিতে একজন অবিস্মরণীয় শিল্পীর জীবন এবং কাজের খতিয়ান তুলে ধরা হয়েছে, যা আমার মতো সীমিত শিল্পবোধসম্পন্ন পাঠকের কাছে এক পরম পাওনা।
আমার দৃষ্টির ধার এত বেশি, এবং একাগ্রতা এত তীব্র, আর আমার সৃষ্টি প্রমাণ করছে যে এই শতাব্দীতে আমার চেয়ে বীরোচিত এবং বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব আর কেউ নেই। নিচাহ্ (Nietzsche) ছিলেন, কিন্তু উন্মাদ হয়ে জীবন শেষ করেছিলেন। আমি উন্মাদ নই আমি বিদূষকও নই। বাকি উন্মাদদের সঙ্গে আমার একটাই তফাৎ আছে— আমি উন্মাদ নই।
নিজের আত্মজীবনীতে এইভাবে নিজেই নিজের তারিফ করেছেন দালি। একবার দুবার নয়। সারাটা জীবন অক্লান্তভাবে নিজের গুণগান করে গেছেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, নিজের ঢাক নিজে পিটিয়েছেন। নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন, তিনি একজন “নার্সিসিস্ট”। নিজের মুখেই ঘোষণা করেছেন, দিনের মধ্যে দুই ঘণ্টা যদি ছবি আঁকার কাজে ব্যস্ত থাকেন, বাকি বাইশ ঘণ্টা বরাদ্দ থাকে স্বপ্ন দেখার কাজে। “সুররিয়ালিজম” ধারাটিকে প্রায় তর্কাতীতভাবে গণ্য করা হয় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে অভিনব এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে। এবং এই আন্দোলনের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাটি সালভাদোর দালির হাতেই ধরা ছিল, এই ব্যাপারে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। অথচ সেই দালি-ই দম্ভ ভরে ঘোষণা করেছেন :
বাদবাকি সুররিয়ালিস্ট শিল��পীদের সঙ্গে আমার পার্থক্য হলো, আমিই হলাম একমাত্র সুররিয়ালিস্ট।
এমন বলেছেন ক্যানো? শুধুই দম্ভ? না বোধহয়। ঠিক যেমন কবিদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে কিছু ধারণা থাকে : কবিদের বড় বড় চুল হয়, সেই চুল তারা আঁচড়ায় না, জামার বোতাম ছেঁড়া থাকে, পকেট থাকে গড়ের মাঠ। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীদের নিয়েও পূর্বধৃত কিছু ধারণা পোষণ করে থাকি আমরা। একটা মস্ত বড় ভুল তো আমরা প্রায় সবাই করি, সুররিয়ালিজম এবং অ্যাবস্ট্র্যাকশনিজম (বিমূর্ত শিল্পধারা)-কে অভিন্নরূপে গণ্য করি। “সালভাদোর” শব্দের অর্থ হলো Saviour বা ত্রাণকর্তা। নিজের নামের প্রসঙ্গ টেনে দালি নিজেই বলেছেন :
কিউবিজম, ডাডাইজম, অ্যাবস্ট্র্যাকশনিজম, ফভিজম, বাজারে ছেয়ে থাকা এইরকম গন্ডা গন্ডা “ইজম” থেকে চিত্রশিল্পকে বাঁচানোর জন্যেই আমার আবির্ভাব ঘটেছে।
কী দোষ করলো এইসব ইজম? দালি-র মতে, এইসব শিল্পীদের প্রায় কেউই ঠিকঠাক ড্রয়িং করতে পারেনা। মানবশরীর কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যকে দক্ষভাবে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা নেই এদের। এরা রঙের ব্যবহার জানেনা। পার্সপেক্টিভের জ্ঞান নেই এদের। আর নিজেদের অক্ষমতাকে ঢাকতেই এরা এইসব আজগুবি ইজমের ছাতার তলায় এসে জড়ো হয়েছে। দালি-র নিজের দৈনন্দিন জীবন ছিল অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নিজের কাজের ব্যাপারে ছিলেন প্রচণ্ড পরিশ্রমী (এই দিক দিয়ে পিকাসোর সঙ্গে মিল আছে তাঁর)। শিল্পে সিম্বলিজম বা প্রতীকের ব্যবহারকেও অশ্রদ্ধার চোখে দেখতেন তিনি। তাঁর মতে, যারা নিজেদের মনোভাবকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম, তারাই প্রতীকের উপর নির্ভরশীল হয়। যেকোনো শিল্প হলো প্রকৃতির সরাসরি উন্মোচন। প্রকৃতিতে “প্রতীক” বলে কিছু নেই, অ্যাবস্ট্রাক্ট বলে কিছু নেই, যা আছে সবকিছুই সরাসরি অর্থবোধক। ঠিক এই কারণেই “Art for art's sake” তত্ত্বকেও দুচ্ছাই করেছেন।
তাহলে কেমন ছিল সালভাদোর দালি-র নিজস্ব শৈল্পিক মনোজগৎ? গুগল থেকে দালি-র যেকোনো বিখ্যাত ছবি খুঁটিয়ে দেখলেই একটা ব্যাপার বোঝা যায় (এই বইয়ের ভেতরেও রয়েছে অসংখ্য সুমুদ্রিত ছবি)— একনজরে এই ছবিগুলোকে বিমূর্ত এবং আজগুবি বলে মনে হলেও আসলে তা শিল্পীর অবচেতন মন এবং অবিশ্বাস্য কল্পনাশক্তির মূর্ত প্রকাশ। এর মধ্যে প্রতীকী কিছু নেই, অকল্পনীয় কিছু নেই, উদ্ভট কিছু নেই (তাঁর নিজের ছবির মধ্যে প্রতীক খুঁজতে নিষেধ করেছেন)। দালি ছিলেন অস্ট্রিয়ান মনস্তত্ত্ববিদ সিগমান্ড ফ্রয়েডের ভক্ত। দালি-র ছবির এই আপাত উদ্ভটজগৎ আসলে ফ্রয়েডীয় অবচেতন মন এবং স্বপ্নসন্ধানের প্রতিফলন। ঘুমের মধ্যে আমাদের দেখা স্বপ্নগুলো যেমন অবাস্তব হয়েও বাস্তব, দালি-র ছবিও তেমনি। একইসঙ্গে দালি একে বলেছেন তাঁর অতীন্দ্রিয়সত্তার বহিঃপ্রকাশ। ভাবতে খুবই আশ্চর্য লাগে, সুররিয়ালিজম-এর সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন গভীরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী (এবং বামপন্থার বিরোধী)। আধুনিক চিত্রশিল্পের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বটি মধ্যযুগের রেনেসাঁস খ্রিস্টান ভক্তিবাদী চিত্রকলা থেকে নিজের বেশিরভাগ আইডিয়া আহরণ করেছিলেন!
একে যদি চারিত্রিক বৈপরীত্য না বলা হয় তাহলে আর কাকে বলা হবে? দালি-র অভিনব ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে আরও অনেক কিছু বলে ফেলা যায়। স্বঘোষিত নার্সিসিজমের ব্যাপারে তো আগেই বলেছি। তিরিশের দশকের স্পেনের মানুষ হয়ে (স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ) এবং চল্লিশের দশকের ইয়োরোপের মানুষ হয়ে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ), তিনি ছিলেন ঘোরতরভাবে অরাজনৈতিক। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় পালিয়েছিলেন রোমে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকাতে। কিন্তু এই ব্যাপারে কোনও লুকোছাপা ছিল না তাঁর। সরাসরি বলেছেন :
আমি ইতিহাসপ্রবণ মানুষ নই, আমি যেমন অরাজনৈতিক, তেমনি আমার ইতিহাস প্রবণতাও কম। হয়তো আমি আমার সময় থেকে এগিয়ে রয়েছি অনেক গুণ, কিংবা সময় থেকে পিছিয়ে আছি অনেকটা। কিন্তু তাই বলে সমসাময়িক এই পিংপং খেলায় আমি নেই!
আত্মপ্রচারে ছিলেন দ্বিধাহীন। পয়সা রোজগারের ব্যাপারে ছিলেন নির্লজ্জ (“টাকাপয়সা ভীষণ ভালোবাসি আমি”)। বিখ্যাত ফরাসি কবি পল এলুয়ার-এর স্ত্রী, দালি-র চেয়ে দশ বছরের বড় গালা-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল শিল্পের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পৃথিবীতে আর কোনও শিল্পী নিজের প্রেরণাদাত্রী (muse)-কে নিয়ে এত বেশি মাতামাতি করেননি। নিজের অসংখ্য ছবিতে গালা-কে এঁকেছেন। মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন, গালা-র সঙ্গে জীবন না কাটালে তিনি দালি হয়ে উঠতে পারতেন না।
বিয়ে করেছিলেন এই নারীকে এবং পাঁচ দশকব্যাপী ঝড়ের মতো উদগ্র দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন। একদিকে গালা ছিলেন তাঁর বিবিধ এবং উন্মত্ত যৌননিরীক্ষার সঙ্গী, আরেকদিকে দালি-র টাকাপয়সা ও বিপুল সম্পদের হিসেবরক্ষক। একটা সময় নিজে অমর হতে চেয়েছিলেন (তাত্ত্বিকভাবে অমর নয়, আক্ষরিক “অমর”)। মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পেতেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়েসে জীবনসঙ্গিনীর মৃত্যুর পরে ঠিক করেন নিজেও মৃত্যুবরণ করবেন। জল খাওয়া ত্যাগ করেন। পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। চুরাশি বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে একবার ফিসফিস করে বললেন, “যবনিকা পতন”, তারপর বললেন :
আমার ঘড়িটা কোথায়?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে শিশু এবং কিশোরদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে উপন্যাসটি। একইসঙ্গে একজন পিতার সঙ্গে তাঁর সন্তানের স্নেহার্দ্র সম্পর্কের কথাও ফুটে উঠেছে। গল্পের ঘটনাক্রম আমাদের প্রায় সবারই কমবেশি পরিচিত। তাই গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু—
ওখানে একটা বড়ো বটগাছ ছিলো। এখন গাছটা নেই। মিলিটারিরা কেটে ফেলেছে। কেটে ফেলেছে গাছটা। এখানে একটা মন্দির ছিলো। মন্দির। ওখানে পুজো করতো হিন্দুরা। মিলিটারিরা তাদের মেরে ফেলেছে। মন্দিরটা ভেঙে ফেলেছে। এখানে বস্তি ছিলো। এখন নেই। গরিব মানুষরা এখানে থাকতো। মানুষগুলোকে মেরে ফেলেছে মিলিটারিরা। বস্তি নেই। মানুষ নেই। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে।...
গোটা উপন্যাসটা লেখা হয়েছে এরকম অদ্ভুত আধো আধো বাক্যে। একই কথা বারবার বারবার পুনরাবৃত্তি করে করে বড়ো বাক্যকে এরকম ছোটো ছোটো বাক্যাংশে ভেঙে ভেঙে লেখা হয়েছে। আমার কাছে চূড়ান্ত বিরক্তিকর লেগেছে হুমায়ুন আজাদের এই গদ্যশৈলী। তাই বিষয়বস্তু পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও লেখার ভঙ্গির কারণে উপন্যাসটি পড়ার সময় সবমিলিয়ে খুব একটা সুখ অনুভব করিনি।
ব্যাস, পরপর দুটো বই হিট করেছে, এবার শুরু হয়ে গেছে আলতুফালতু লেখা।
ভাবলাম, অনেক দিন পরে নতুন একজন ভালো গোয়েন্দা চরিত্রের আগমন ঘটেছে বাংলা সাহিত্যে। ও বাবা, এই বইতে দেখি কাহিনিটাও পুরোপুরি গুছিয়ে শেষ করবার গরজ দেখাননি লেখকমশাই, রহস্যের অর্ধেক সমাধান করেই বই খতম! এরকম কাণ্ড জীবনে এই প্রথমবার দেখছি।
আশাহত!
(আরও কিছু কথা। “নোয়াপাতি ভুঁড়ি” কথাটা বেশ কয়েকবার ব্যবহার করা হয়েছে। নোয়াপাতি নয়, “নেয়াপাতি”। হোটেলের রেজিস্টার খাতাকে একাধিকবার লেখা হয়েছে “রেজিস্ট্রার খাতা”। একই ভুল বারবার হলে সেগুলো স্রেফ “ছাপার ভুল” বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং আয়ান রশীদ অনূদিত “গালিবের কবিতা” বইটির অনুবাদ করা হচ্ছে ১৯৮৩ সালে— এমনটা দেখানো হয়েছে। ১৯৮৯ সালের কলকাতার স্টোনম্যান হত্যার ঘটনাও চলে এসেছে ১৯৮৩ সালে। যদিও ক্রিকেটার কপিল দেব-এর নাম যথাযথ সময়েই উল্লেখ করা হয়েছে। সাল তারিখ সংক্রান্ত এই বিচ্যুতিগুলো কি সব “অ্যানাক্রনিজম”-এর কাঁধে চাপিয়ে দেবো?
কাহিনি নির্মাণ, ভাষার ব্যবহার, ডিটেইলিং— সবদিক দিয়েই অযত্নের ছাপ। কবীর সুমনের গানের লাইন আছে : “সাহিত্য মরে পুজো সংখ্যার চাপে”। এই উপন্যাস তো পুজো সংখ্যায় বেরোয়নি, তাহলে কীসের চাপে মরলো? প্রকাশকের চাপে? নাকি “ব্যাধ”-এর চাপে?)
বাংলা গদ্যের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ উদাহরণগুলোর মধ্যে একটা।
এই বই বারবার পড়া যায়।
ফিরে ফিরে পড়া যায়।
অনেকবার পড়লেও এই গদ্যের অমোঘ মায়া অনুক্ষণ অনুসরণ করতে থাকে আমার কংক্রিটে ঢাকা পাঠকসত্তাকে।
দুর্দান্ত!!
ভালো সাহিত্যের একটি লক্ষণ হলো, তা একই সঙ্গে সমকালীন এবং চিরন্তন। ১৯৫২ সালে লেখা এই বিখ্যাত হিন্দি উপন্যাসটির দেশকাল এবং প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আজকের দিনদুনিয়ার ভিনগ্রহসম পার্থক্য। তবু মানুষ যেহেতু আজও মানুষ রয়ে গেছে, তাই উপন্যাসের মূল বার্তাটি আজকের দিনেও আমার কাছে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থায়, একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে তার নিজের পরিবারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। ছোট থেকে আমরা বড় হই আমাদের পরিবারের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে। বড় হওয়ার পরে সেই পরিবারের প্রতি ঋণ শোধ করি আমরা। ধর্ম ত্যাগ করলেও করা যেতে পারে, কিন্তু পরিবারকে ত্যাগ করা (কিংবা দূরত্ব তৈরি করা) তো মহাপাতকের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়!
উপন্যাসের স্থান এবং কাল : স্বাধীনতার ঠিক পরের ভারতবর্ষের একটি মফস্বল শহর (সম্ভবত আগ্রা)। মুখ্য চরিত্র অপ্রাপ্তবয়স্ক একটি দম্পতি। মনের দিক দিয়ে পরিণত হয়ে ওঠার আগেই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, কারণ তাদের পরিবার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পৃথিবীটা ভালো করে চিনে ওঠার আগেই জীবনের অন্যতম গুরুতর দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের উপর। এর ফলাফল হয়েছে মর্মান্তিক।
নিজের আজন্মপরিচিত পরিবেশ ছেড়ে একজন নারী যখন সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হয় (বিয়ের পরে), তখন তার মনের আদল কেমন থাকে? আর যদি নতুন পরিবেশটি হয় সেই নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ? এমনকি যার ভরসায় মেয়েটি নিজের আত্মপরিচয় পাল্টে ফেলেছে, সেই স্বামীটিও যদি পছন্দ না করে তাকে? কিংবা স্বামীটি যদি হয় অস্থিরমতি, দুর্বলচিত্ত, অমানবিক?
নারী পুরুষের সম্পর্কের রসায়ন, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সমাজে পরিবারের সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের সম্পর্ক, সমাজের দ্বারা অন্ধভাবে চাপিয়ে দেওয়া প্রথার পরিণতি, আধুনিকতার সঙ্গে গতানুগতিকতার দ্বন্দ্ব— এরকম বেশ কিছু গুরুতর বিষয়কে খুব মুনশিয়ানার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন রাজেন্দ্র যাদব। ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লেখা এরকম কতো মণিমুক্তোর সঙ্গে আচমকা দেখা হয়ে যায়! উৎকৃষ্টতম ভারতীয় সাহিত্য আসলে লেখা হয়েছে আঞ্চলিক ভাষাতেই।
যদি প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিই (অন্যকে না হলেও, অন্তত নিজেকে); প্রচলিত সমস্ত রীতি-রেওয়াজকে যদি চোখ বন্ধ করে মেনে নিই; বেশিরভাগ মানুষ যা বিশ্বাস করে, তাকেই যদি অভ্রান্ত ভেবে নিই; নিজের বিচারবুদ্ধিকে যদি সংস্কারের পায়ে সমর্পণ করি; যদি সোজা পায়ে না হেঁটে পিছন দিকে হাঁটতে থাকি, তাহলে কি আমি জীবিত মানুষ? ভূতের পা পিছন দিকে ঘোরানো থাকে।
পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত একদম সাধারণ মানুষের প্রাণের গান হয়ে উঠতে পারেনি। পপ রক জ্যাজ ব্লুজ র্যাপ কান্ট্রি মেটাল (এবং আরো অনেককিছু) সমন্বিত পাশ্চাত্য সংগীতের যে আধুনিক ধারাটি এখন বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, খুব টেনেটুনেও তার ইতিহাস দেড়শো বছরের বেশি পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এবং খাঁটি পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের সঙ্গে এইসব আধুনিক সংগীতধারাগুলির আত্মীয়তা খুঁজতে হলে খুব সরু স্রোত হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু সেই অন্বেষণ হবে খড়ের গাদায় আলপিন খোঁজার শামিল। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত আজও তার স্বকীয় বনেদিয়ানা ধরে রাখতে পেরেছে। হাওয়াই চপ্পল, হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট পরে কেউ যদি বেঠোভেনের পিয়ানো কনচার্টোর অনুষ্ঠান শুনতে যায়, আজকের দিনেও তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে।
ভারতীয় উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী সংগ���ত কিন্তু এই বনেদিয়ানার তোয়াক্কা করেনি। উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী সংগীতবিশ্বের সমৃদ্ধির পিছনে সমাজের “এলিট” সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতার ভূমিকা আছে ঠিকই, কিন্তু তবুও আমাদের ধ্রুপদী সংগীতকারেরা কেবল এলিট শ্রোতাদের গান শুনিয়েই পরিতৃপ্ত হননি। রাগ সংগীতের কাঠামোকে আশ্রয় করেই তাঁরা নিজেদের সংগীতকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের গৃহ এবং মনের অন্দরমহলে। তাঁরা বাইজিনাচের সঙ্গে ঠুমরি গেয়েছেন, ফসলের ক্ষেতে কাজ করতে করতে কাজরি গেয়েছেন, আড্ডার বৈঠকে টপ্পা গেয়েছেন, ঘরোয়া আসরে গজল গেয়েছেন কিংবা ধর্মীয় জলসায় কাওয়ালি গেয়েছেন। একটা উদাহরণ দেখা যাক।
রাগসংগীতের “খামাজ” (বা খাম্বাজ) নামক একটি ঠাটের (ঠাট মানে প্রকরণ) কাঠামোতে তৈরি বিখ্যাত ঠুমরি গেয়েছেন বেগম আখতার (“অ্যায় মহব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া”)। সেই একই ঠাটের তিলক কামোদ রাগে বিখ্যাত ভজন গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর (“বৈষ্ণব জন তো”— মহাত্মা গান্ধীর প্রিয় গান))। খামাজের একতালে গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ (“আমি চিনি গো চিনি তোমারে”)। একই রাগকে আশ্রয় করে অসামান্য কাওয়ালি লিখেছেন নবাব সাদিক জং বাহাদুর (“কানহাইয়া, ইয়াদ হ্যায় কুছ ভি হামারি?”— ধর্মীয় সম্প্রীতির চমৎকার একটি উদাহরণ এই গানটি কেউ না শুনে থাকলে প্লিজ শুনুন!)। “অভিমান” সিনেমায় শচীন দেব বর্মনের সুরে ডুয়েট গেয়েছেন লতা-কিশোর (“তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না”)। আবার এই তিলক কামোদ রাগেই উস্তাদ রশিদ খাঁ “জব উই মেট” সিনেমায় গান গেয়েছেন (“আওগে জব তুম মেরে সাজনা”)। স্মরণাতীত কাল আগে সৃষ্টি হওয়া একটি ধ্রুপদী রাগের প্রত্যক্ষ ব্যবহার, জনপ্রিয় সংগীত মাধ্যমে আজও হয়ে চলেছে অবিরাম! তলিয়ে ভেবে দেখতে গেলে এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটি অহরহ ঘটে চলেছে হিন্দি সিনেমায়। হিন্দি চলচ্চিত্র নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবত গবেষণাধর্মী কাজ করে চলেছেন নাসরিন মুন্নি কবির। এই বইটি কবি, গীতিকার এবং চিত্রনাট্য লেখক জাভেদ আখতারের সঙ্গে মুন্নি কবিরের সুদীর্ঘ কথোপকথনের মুদ্রিত রূপ। হিন্দি সিনেমা এবং ফিল্মি গানের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য নিয়ে দুজনের এই আলোচনাটি পড়ে অত্যন্ত ঋদ্ধ হলাম। উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী ও লোকজ নাট্যকলা এবং সংগীতের উত্তরাধিকারের সর্বশেষ নমুনা হলো হিন্দি সিনেমা। জাভেদ আখতার বলেছেন, হিন্দি সিনেমার সত্তাটি “সর্বভারতীয়”, অথচ সমগ্র ভারতের কোনো অংশের সঙ্গে এর মিল নেই। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মতো “হিন্দি সিনেমা” হলো একটি আলাদা রাজ্য। জাভেদ আখতার খুব চমৎকার কথা বলতে পারেন। আমি হিন্দি সিনেমা খুব বেশি দেখিনা, কিন্তু হিন্দি ফিল্মের গানের ভীষণ বড় ভক্ত। আমার কাছে এই বইটি একটা আনন্দময় উপহারের মতো উপভোগ্য মনে হয়েছে।
জাভেদ আখতারের বাগ্মীতার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন নাসরিন মুন্নি কবির। সত্তরের দশকে মেইনস্ট্রিম হিন্দি সিনেমাজগতে একটা বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন সেলিম খান (সালমান খানের বাবা) এবং জাভেদ আখতার চিত্রনাট্যকার জুটি (“সেলিম-জাভেদ” নামে পরিচিত)। দুজনের লেখা চিত্রনাট্য থেকে তৈরি হয়েছে একের পর এক ছাঁচভাঙা সিনেমা (জঞ্জির, দিওয়ার, শোলে, ত্রিশূল, ডন, ইত্যাদি)। সুতরাং হিন্দি সিনেমা জগতের “ইউনিক” বৈশিষ্ট্য এবং হিন্দি সিনেমার উপযোগী চিত্রনাট্য লেখার কায়দা— এই দুই বিষয়েই কথা বলার উপযুক্ত মানুষ হলেন জাভেদ আখতার। পরবর্তীকালে চিত্রনাট্য লেখার কাজে ইস্তফা দিয়ে তিনি পুরোপুরি গান লেখার কাজ শুরু করেন। আমার ব্যক্তিগত মতে, হিন্দি ফিল্মের উর্দুভাষা-আশ্রিত গানের লিরিক লেখার মুনশিয়ানা এবং সত্তর দশক পরবর্তী আধুনিকতা— দুটো বিষয়কে সবচেয়ে সফলভাবে যদি কেউ মিশিয়ে দিতে পেরেছেন, তিনি হলেন জাভেদ আখতার।
বইতে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি হিন্দি ফিল্মের গান নিয়ে তাঁর কথাবার্তা। কথায় কথায় তিনি বিশ্লেষণ করেছেন শাহির লুধিয়ানভি, শৈলেন্দ্র, শাকিল বদাউঁনি, মজরুহ সুলতানপুরি, কৈফি আজমির মতো নিজের পূর্বসূরিদের লেখা গান নিয়ে। একই সঙ্গে এমন কিছু কথা বলেছেন যা কিনা আমারও মনের কথা। যেমন, হিন্দি ফিল্মের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড সংগীত রচয়িতার নাম আনন্দ বকশি। কিংবা, ‘Cool' isn't the opposite of poetic. Somehow people have come to believe that one can either be modern or literary. ভিতরে ভিতরে জাভেদ আখতার আসলে একজন কবি। তবু তিনি বলেছেন, যে-কথা কোনোভাবে বলা যায় না, এমনকি কবিতাতেও বলা যায়না, সেই কথা গানের মাধ্যমে বলে ফেলা যায়। উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী রাগসংগীত এবং উর্দু ভাষার সাংস্কৃতিক বনেদিয়ানা— এই দুটো উৎকৃষ্ট জিনিসকে আমি একত্রে খুঁজে পাই হিন্দি ফিল্মের গানে। জাভেদ আখতারের প্রাণবন্ত আলাপচারিতায় ফিল্মের গানের প্রতি আমার চিরকালীন ভালোবাসা আরো একটু বেড়ে গেলো।
আমি প্রথম শার্লক হোমস পড়েছিলাম চুরি করা টাকায়, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়। কার পকেট মেরেছিলাম, কীভাবে মেরেছিলাম, এইসব বৃত্তান্ত আপাতত “ক্লাসিফায়েড” থাকুক। কিন্তু একটা বিষয় অনুধাবন করতে পেরেছিলাম— বই কেনার জন্যে হাতসাফাই খুবই তৃপ্তিদায়ক একটি কাজ। চুরির টাকায় কেনা বইটিতে শার্লকের ছোটগল্প এবং উপন্যাস সমস্তকিছু একটা খণ্ডেই আঁটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনুবাদক ছিলেন নচিকেতা ঘোষ (কামিনী প্রকাশনী)। অনুবাদটা ভালো ছিল না।
তারপর পড়েছিলাম “তুলি-কলম” থেকে প্রকাশিত শার্লকের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা অনুবাদ। অনুবাদকের নাম মণীন্দ্র দত্ত। অনুবাদের মান আগেরটার চাইতে ভালো ছিল। ততদিনে শার্লক হোমসের মহিমা আমি বেশ ভালোমতোই ধরে ফেলতে পেরেছি। একই কাহিনি একাধিকবার পড়লেও আশ মিটছে না। দ্য হাউন্ড অভ দা বাস্কারভিলস উপন্যাসটা সারাজীবনে আমি বোধহয় দশবার পড়েছি।
মূল ইংরিজি লেখাগুলো পড়েছিলাম কলেজে পড়ার সময়। প্রায় সবক'টা গল্পই আগে থেকে পরিচিত থাকায় ইংরিজি রচনাশৈলী উপভোগ করতে আরেকটু বেশি সুবিধে হয়েছিল। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সেই প্রথম আমি বুঝতে পারি, বাঙালি অনুবাদকরা তাঁদের অনুবাদে বেশ খানিকটা জল মিশিয়ে রেখেছেন। কোনো লাইনকে আক্ষরিকভাবে বঙ্গায়িত করার প্রচেষ্টায়, কিংবা আপন মনের মাধুরী মেশানোর চক্করে, শার্লক হোমসের প্রকৃত চেহারা পুরোপুরি সফলভাবে ফুটে ওঠেনি। অনুবাদে অনুবাদ-অনুবাদ গন্ধ রয়ে গেছে।
শার্লকের যে-বাংলা অনুবাদটা পড়ে প্রথম পুরোপুরি তৃপ্তি পেয়েছিলাম সেটা হলো মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা “বাস্কারভিলস”-এর অনুবাদ। তারপরে পড়লাম মানবেন্দ্রবাবুরই “দ্য সাইন অভ ফোর”-এর অনুবাদ। দুঃখের বিষয় তিনি শার্লকের আর কোনো অনুবাদ করেননি। বাঙালি শার্লকপ্রেমীদের জন্যে সেই অভাব পূরণ করে দিয়েছেন দ্য গ্রেট অদ্রীশ বর্ধন মশাই।
বেঙ্গল পাবলিশার্স নামে অধুনা-বিলুপ্ত একটি প্রকাশন সংস্থা ছিল। অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদে শার্লকের সমস্ত রচনা পাঁচটা আলাদা খণ্ডে পাওয়া যেত। আমার কাছে প্রথম চারটে ছিল। সে-ই পুরোনো লেটারপ্রেসে ছাপা বই। কিন্তু পঞ্চম খণ্ডটা বহু খুঁজেও জোগাড় করতে পারিনি। অসম্পূর্ণ সেই সেটটা আলমারিতে মাঝে মাঝে দেখতাম আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়তাম। আমার বোন আমার এই ফোঁস ফোঁস শব্দে হতাশ দীর্ঘশ্বাসের কারণটা জানতো।
বছর সাতেক আগে এক ভাইফোঁটায় আমার বোন কাগজে মোড়ানো বেশ ভারী একটা উপহার দিলো আমাকে। হাতে নিয়েই বুঝেছিলাম বই, কিন্তু মোড়ক খুলে আমার খাদের ধারে দাঁড়ানো প্রফেসর মরিয়ার্টির মতো হতভম্ব অবস্থা। লালমাটি প্রকাশন থেকে সদ্য প্রকাশিত খুব চমৎকার দুই খণ্ডে অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদ করা শার্লক হোমস সমগ্র! ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান, খাওয়া দাওয়া, সবকিছু মাথায় উঠলো।
অদ্রীশ বর্ধনের কাজটাই আমার পড়া শার্লকের সবচে ভালো বাংলা অনুবাদ। বাংলা রহস্য এবং সায়েন্স ফিকশন সাহিত্যের জগতে অদ্রীশবাবু নিজেই এক একক প্রতিষ্ঠান। শার্লক ছাড়াও তিনি জুল ভার্নের সব রচনা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এডগার অ্যালান পো-র সমস্ত কাহিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। ফাদার ব্রাউনের গল্পের অনুকরণে তৈরি করেছেন ফাদার ঘনশ্যাম নামের একটি চরিত্র। বিশাল আয়তনের “কথাসরিৎসাগর” বইয়ের পুরোটা অনুবাদ করেছেন (তাঁর এই কাজটি খুব বেশি পরিচিতি পায়নি)। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায় হোমসের অনুবাদই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এই দুর্দান্ত কাজটিকে লালমাটি প্রকাশন যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে প্রকাশ করেছে।
প্রত্যেক শার্লকপ্রেমীই সিডনি প্যাজেট-এর অলংকরণের কথা জানেন। এছাড়া বিলিতি দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। লালমাটি প্রকাশনের এই বইটিতে পুরোনো সেইসব অলংকরণ এবং আনুষঙ্গিক আরো অনেক কিছু পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। ফলে বইটির নান্দনিক মূল্য এক লাফে অনেকটা বেড়ে গেছে। এছাড়া নতুন এই সংস্করণের আরো একটি আকর্ষণ আছে।
এমনিতে কোনো বইতে খুব বেশি টীকাটিপ্পনী আমার ভালো লাগেনা। শার্লক এবং অদ্রীশ বর্ধন যুগলবন্দীর এই নতুন সংকলনে প্রচুর প্রচুর প্রচুর টীকা সংযোজিত হয়েছে। টীকাগুলো আমার খুব কাজে লেগেছে। শার্লক-সমকালীন পুরোনো ইংল্যান্ডকে জানতে (ইতিহাস এবং ভূগোল— দুই দিক দিয়েই) ; তৎকালীন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, যেগুলোর সঙ্গে গল্পের যোগসাজশ রয়েছে ; কিংবা একটি গল্পকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে সাহায্য করা, ইত্যাদি সবকিছু বিবেচনা করলে এই টীকাগুলো খুবই উপাদেয় বস্তু। প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত এবং সৌম্যেন পাল প্রশংসনীয় এবং পরিশ্রমী কাজ করেছেন।
যদি কেউ বাংলা ভাষায় তৃপ্তিসহকারে শার্লক হোমসের গল্প-উপন্যাস উপভোগ করতে চান, চোখ বন্ধ করে এই সংস্করণটি বেছে নিতে পারেন। অনুবাদের মুনশিয়ানা, অলংকরণের প্রাচুর্য, দৃষ্টিনন্দন গ্রন্থনির্মাণ— সব দিক দিয়ে এই সংস্করণটি দুর্দান্ত। সবার শার্লক-পাঠ আনন্দময় হোক!
(“শার্লক হোমসের মৃত্যু”, সিডনি প্যাজেটের অলংকরণ)
গুলজার আগে কবি, পরে গীতিকার। উপমা এবং রূপকের যে নিবিড় সৌকর্য তাঁর লেখা গানে পাওয়া যায়, তা শুধু একজন কবির পক্ষেই সম্ভব। আমাদের সবার জীবনের সঙ্গে খুব সম্পৃক্ত কোনো ঘটনাকে, যেমন ধরা যাক প্রেমে বিচ্ছেদ, তাকেও তিনি বাকি সব বিচ্ছেদের গানের চেয়ে অভিনব পঙক্তিতে লিখে ফেলতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে সবার আগে মাথায় আসে আমার ভীষণ প্রিয় একটা গান : “মেরা কুছ সামান তুমহারে পাস পড়া হ্যায়”। আর ডি বর্মন-এর সুরে এবং আশা ভোঁসলের গাওয়া এই গানটির শুধু লিরিক পড়লে মনে হবে যেন লয়হীন সাদামাটা একটা বিবৃতি পড়ছি। কোনো ছন্দমিল নেই, বিচ্ছেদের গানসুলভ কোনো তীব্র আবেগ নেই। অথচ গানটি যখন আমরা শুনি, মনে হয় এই কথাগুলি আমার নিজের কথা, গুলজার জানলেন কীভাবে? হিন্দি সিনেমার গানে আধুনিক গদ্যকবিতা ব্যবহারের এরকম উৎকৃষ্ট উদাহরণ বিরল।
গুলজারের গানের আরেকটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গানের মধ্যে একটি লক্ষণীয় ক্যাচলাইন বা ক্যাচফ্রেজ ব্যবহার করা, যেটি গোটা গানজুড়ে ধুয়োর মতো ঘুরেফিরে আসে এবং এই লাইনটি দিয়েই শ্রোতা গানটিকে চিহ্নিত করেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উদাহরণ : ছাঁইয়া ছাঁইয়া, বিড়ি জ্বালাই লে, কাজরা রে, ধান তে নান (“কামিনে” সিনেমার গান), ইত্যাদি। যদিও যে-গানটি লেখার জন্যে তাঁকে অস্কার দেওয়া হয়েছে (“স্লামডগ মিলিয়নেয়ার” সিনেমার “জয় হো”), সেটা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। গুলজারের এই ক্যাচলাইন বৈশিষ্ট্যটি যদিও তাঁর আগেকার গানে দেখা যায় না, এটি তাঁর নতুন উদ্ভাবন। যে বইটি নিয়ে আলোচনা করছি সেটা গুলজার এবং প্রখ্যাত হিন্দি সিনেমা অনুরাগী নাসরিন মুন্নি কবির-এর পারস্পরিক আলাপচারিতার লিখিত রূপ। আলাপের বিষয়বস্তু : গুলজারের লেখা গান এবং তাঁর কয়েকটি গানকে ইংরিজি ভাষায় রূপান্তরের প্রয়াস।
বইটি যতটা আশা নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম তা পুরোপুরি মেটেনি। মূলত তিনটে কারণে। প্রথম কারণটি নিতান্ত ব্যক্তিগত। আমি যেহেতু হিন্দি এবং উর্দু ভাষা বেশ ভালো বুঝতে পারি, তাই গানগুলোর ভাষান্তরিত রূপ আমার বিশেষ কাজে লাগেনি। মূল ভাষাতেই আমি গানগুলোর রসগ্রহণে সক্ষম। তাই এই ভাষান্তরের প্রক্রিয়াটি আমার কাছে প্রচণ্ড বিরক্তিকর লেগেছে। দ্বিতীয় কারণ, আলোচনা করার জন্যে গুলজারের অনেক মাঝারি এবং নিচুমানের গান বেছে নেওয়া হয়েছে (বিশেষ করে বইয়ের শেষ অর্ধে)। বেশ কয়েকটা গানের আমি নামই জানতাম না, শুনেও একেবারে পছন্দ হয়নি (যেমন রূপকুমার রাঠোরের গাওয়া “রোজ-এ-আওভল” নামের একটা গান। কী বুঝে এটাকে নেওয়া হয়েছে কে জানে। এরকম হাবিজাবি আরো আছে)। এগুলোর চেয়ে গুলজারের আলোচনাযোগ্য গানের সংখ্যা প্রচুর, সেগুলোকে বাদ দিয়ে অহেতুক এই পচা গানগুলো নিয়ে অনেক পৃষ্ঠা বরবাদ করা হলো ক্যানো বুঝলাম না।
তৃতীয় কারণটি হলো গুলজারের আদর্শবাদী কথাবার্তা। গুলজারকে আমি মুখ্যত কবি হিসেবেই মান্য করি, এবং কবিদের মুখে দেশদুনিয়ার ভালোমন্দ, দোষত্রুটি, কোনটা উচিত কাজ, কোনটা অনুচিত কাজ, এইসব নিয়ে ঘ্যানঘ্যান শুনলে ভালো লাগেনা। খবরের কাগজ খুললেও তো এই একই কথা পড়ি, হোয়াটসঅ্যাপের ফরোয়ার্ডেড মেসেজেও একই বক্তব্য, টিভির আলোচনাসভাতেও একই বকবক। গুলজারের মুখেও সেই ভাষণবাজি ভালো লাগেনি আমার। আমার কাছে কবিরা এসবের ঊর্ধ্বে। কবিরা কিছু বলতে চাইলেও আকারে-ইঙ্গিতে বলবেন, সরাসরি নয়। যেকোনো ভাষার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পরিবেশক হলেন কবিরা। এক জায়গায় দেখলাম গুলজার রীতিমত রেগে ফায়ার হয়ে গেছেন কারণ, ইন্টারনেটে প্রচুর নকল কবিতা তাঁর নাম লাগিয়ে সার্কুলেট করা হয় নিয়মিত। আমার মতো হরিদাস পাল যদি এইসব ফালতু বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতো তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু গুলজার?
বইটার ভালো দিকই বেশি যদিও। পুরোনো দিনের হিন্দি গানের জগৎ নিয়ে প্রচুর প্রচুর কৌতূহলকর তথ্য জানতে পেরেছি। সংগীতরচনার কলাকৌশলের খুঁটিনাটি স্বয়ং অশ্বের গুলজারের মুখ থেকে শুনতে পারা তো কম সৌভাগ্যের কথা নয়! তাঁর মতো একজন সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ এখনও গান লিখে চলেছেন, এটা আমাদের প্রজন্মের জন্যে একটা আশীর্বাদ। আরো একটি কারণে গুলজারকে আমি পছন্দ করি। আমিও তাঁর মতো উর্দু ভাষাটিকে খুব ভালোবাসি। “দিল সে” সিনেমার “দিল সে রে” গানটিতে একটা লাইন আছে : উও ইয়ার হ্যায় জো খুশবু কি তারাহ্ উও জিসকি জুবাঁ উর্দু কি তারাহ্ (সেই বন্ধু আমার, যেন এক সুগন্ধের মতো যার উপস্থিতি, যেন উর্দু ভাষার মতো সুন্দর যার কথা বলার ভঙ্গি...)। আহা কী উপমা! তিনি আরো অনেক বছর এরকম গান লিখুন, এটাই কামনা! রিভিউয়ের শেষে আমার প্রিয় দশটা গুলজারি গানের একটা তালিকা দিলে কি খুব বেমানান লাগবে? :p :p
- আপ কি আঁখো মে কুছ (সিনেমার নাম “ঘর”)
- দিল ঢুন্ডতা হ্যায় (ধীর লয়ের ভার্শনটা, সিনেমার নাম “মৌসম”)
- না জিয়া লাগে না (“আনন্দ”)
- সিলি হাওয়া ছু গয়ি (“লিবাস”)
- এক আকেলা ইস শহর মে (“ঘরাওন্দা”)
- তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোয়ি (“আঁধি”)
- শাম সে আঁখ মে নমি সি হ্যায় (জগজিৎ সিংয়ের গাওয়া গজল, অ্যালবামের নাম “মারাসিম”)
- চুপকে সে (“সাথিয়া”)
- দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি (“ইশকিয়া”)
- পেহলি বার মহব্বত (“কামিনে”)
কবিতা বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের সত্যিকারের গর্ব করার মতো জিনিস যদি কিছু থাকে তা হল ছোটগল্প। সেই রবীন্দ্রনাথ আর প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু। তারপর বিভূতিভূষণ পরশুরাম সতীনাথ তারাশঙ্কর মানিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র প্রেমেন্দ্র মিত্র জগদীশ গুপ্ত গৌরকিশোর ঘোষ মতি নন্দী কমলকুমার হাসান আজিজুল হক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আশাপূর্ণা মহাশ্বেতা সত্যজিৎ রায় রমাপদ চৌধুরী বিমল কর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হুমায়ূন আহমেদ শ্যামল গাঙ্গুলি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ইত্যাদি দিকপালদের (দিকপাল আরো অনেক আছেন অবশ্যই, এখানে শুধু আমার প্রিয়দের নামোল্লেখ করলাম) সৃষ্ট অজস্র মণিমুক্তো পেরিয়ে এসে আজকে বেশ জোরগলাতেই বলা যায় : ছোটগল্পের মতো এরকম বহুমুখী সমৃদ্ধ শাখা কি বাংলা সাহিত্যে আর কিছু আছে?
কিন্তু গত শতকের নব্বই দশকের পরে কী যে হলো, যেমনটা বোধহয় হলো বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই, বাংলার আঞ্চলিক নিজস্বতা এবং স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে আন্তর্জাতিকতার গড্ডলিকা-স্রোতে ভেসে গেলেন বেশিরভাগ সাহিত্যিক (“গড্ডল” শব্দের অর্থ ভেড়া। ভেড়ারা তাদের দলের একজন যেদিকে যায়, পিছে পিছে বাকি সবাই সেদিকেই যায়)। শীর্ষেন্দু সুচিত্রা দেবেশ স্বপ্নময়দের মতো কয়েকজন টিমটিম করে জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন খাঁটি বাংলা ছোটগল্পের চিরাচরিত ধারাটি ; কিন্তু নতুন শতাব্দীতে প্রবেশ করে “চিরাচরিত” কিংবা “ধ্রুপদী” শব্দগুলো গালিগালাজে পরিণত হল। আরো আরো আরো বেশি আধুনিকতার খোঁজে নেমে পড়লাম আমরা সবাই। লেখক পাঠক প্রকাশক সম্পাদক সমালোচক— সব্বাই! সরলরৈখিক ছাপোষা প্লটের দিন ফুরাইলো। বাংলা ভাষার দিশি আম্রবৃক্ষশাখে ঝুলতে লাগলো লাতিন আমেরিকার “পোস্ট-মডার্ন” ফল কিংবা পূর্ব ইয়োরোপের বিপ্লবী সুগন্ধে ভরপুর exotic ফল কিংবা জাপানি “বিজার” ফল কিংবা...
বিপদে পড়লো আমার মতো নির্বোধ নিপাট নিরীহ পাঠকরা। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত গল্পে আমরা নিরিবিলি প্লট খুঁজতে লাগলাম। একটা সোজাসাপটা এবং সাদামাটা (এই শব্দ দুটোও বর্তমানে গালিগালাজে পরিণত হয়েছে) গল্প খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু চারিদিকে দেখি শুধু ফর্মের নতুন নতুন কায়দা নিয়ে কচলাকচলি। ভাষার প্রচলিত আদবকে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে নতুন রূপের সন্ধান চলছে। হৃদয় নয়, লেখকরা চাইলেন পাঠকের মস্তিষ্ককে উজ্জীবিত করতে। যে লেখা সহজেই পড়ে ফেলা যায়, যে লেখা পড়তে হলে মগজের কোষকে যোগব্যায়াম করতে হয়না, সেগুলো এলেবেলে সাহিত্য। হুমায়ূন আহমেদ কিংবা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মতো সাবলীল (এটাও গালিগালাজ) গদ্যকাররা “বাজারি লেখক” খেতাব অর্জন করলেন।
এরই মধ্যে দেখতে দেখতে চোখের সামনে উপস্থিত হলো নতুন উপদ্রব। বাংলা সাহিত্যের দুকূল ছাপিয়ে বইতে লাগলো ভূত-প্রেত তন্ত্র-মন্ত্র সাই-ফাই স্পেকুলেটিভ-ডিস্টোপিয়ান— আরো কীসব অত নামও জানিনা ছাই! অগত্যা, আমি “আধুনিক” লেখাপত্তর পড়া বন্ধ করলাম। ফিরে গেলাম আমার চিরপরিচিত আটপৌরে (গালিগালাজ) বাংলা সাহিত্যের পুরোনো জগতে। যেখানে চরিত্ররা সবাই মানুষ, প্রেক্ষাপট আমাদের পরিচিত বাস্তব (গালিগালাজ) পৃথিবী, বিষয়বস্তু প্রাসঙ্গিক। চারিপাশে সবাই যখন আধুনিক (এবং আন্তর্জাতিক) হয়ে উঠতে লাগলো, আমি একটা আশাপূর্ণা দেবীর ঘরোয়া (গালিগালাজ) গল্প, কিংবা একটা গজেন্দ্র মিত্রের গ্রাম্য (গালিগালাজ) গল্প, কিংবা বিমল করের নাগরিক (এই শব্দটা এখনও গালিগালাজ হয়নি) গল্প পড়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে লাগলাম। অনেক চেষ্টা করেও বন্ধুরা আমাকে “আজকালকার সাহিত্য” পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে পারলো না। কেউ ভাবলো আমার নাক উঁচু, কেউ ভাবলো পাঠক হিসেবে আমার “কোয়ালিটি” নিচু। আসল ব্যাপারটা খুব কম মানুষই বুঝলো।
যে-বইটি নিয়ে আলোচনা করবো বলে এই বিস্তারিত শিবের গাজনটি গেয়ে শোনালাম, সেই বইয়ের শিরোনামটি নেওয়া হয়েছে একটি বিখ্যাত বাংলা কবিতা থেকে। এই কবিতাটির রচয়িতা আমাদের দেখিয়েছিলেন, আঞ্চলিকতার লক্ষণ এবং স্থানিক বিষয়বস্তুকে পরিত্যাগ না করেও কীভাবে আধুনিকতার চূড়ান্ত চর্চা করা সম্ভব। কবিতাটির নাম “বনলতা সেন”। কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। আলোচ্য বইটির ব্লার্বে কিছু ভুল কথা লেখা রয়েছে। গল্পগুলোকে বলা হয়েছে “নতুন যুগের গল্প”, “একবিংশ শতকের গল্প”। বলা হয়েছে গল্পগুলো “পুরুষের চোখে” নয়, “নারীর চোখে” দেখা হয়েছে। ইত্যাদি।
কিন্তু বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছে, আসলে তো গল্পগুলো চিরায়ত! ধ্রুপদী বাংলা ছোটগল্পের সুগন্ধে ভরপুর! আসলে তো গল্পগুলো আলাদাভাবে নারীর কিংবা পুরুষের নয়। এগুলো মানুষের গল্প! নারীচরিত্রগুলোকে পাল্টে দিয়ে পুরুষচরিত্র হিসেবে দেখালেও হিসেবের বিশেষ হেরফের হতো না। এমন সহজিয়া সাবলীল গদ্যভাষা, প্লটের এমন সুবিন্যস্ত গঠন, আটপৌরে ঘরোয়া প্রেক্ষাপটের ছায়ায় ঢাকা, বাস্তব মানুষের বাস্তব ঘরদুয়ার, অন্দর বাহির, মনের গহীন জটিলতা, মানুষের দৈনন্দিন মাপা-হাসি এবং চাপা-কান্নার এরকম সাবেকি প্রকাশ— বহু বহুদিন পরে আমার দৃষ্টিগোচর হলো! মুগ্ধ হয়েছি রিফাত আনজুম পিয়া-র ছোটগল্পগুলি পড়ে। বোদ্ধা পাঠকদের মগজের পুষ্টিসাধন হবে কিনা জানিনা, তবে লেখকের গল্পবলার মুন্সিয়ানা যে আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে, এ কথা আমি হলপ করে বলতে পারি।
এই বই আমার কিছুতেই পড়া হতোনা, বন্ধু আঞ্জুমান লায়লা নওশিনকে যদি জিজ্ঞেস না করতাম যে, ২০২২ সালে তার পড়া সবচেয়ে প্রিয় বই কোনটা। সে আমাকে বইয়ের নাম বলেই চুপ থাকেনি, বইটা কিনে সটান পাঠিয়ে দিয়েছে আমার বাড়িতে। তখন ভেবেছিলাম এ হয়তো নেহাতই তার সহৃদয় বন্ধুকৃত্য। বইটা পড়ার পরে এখন বুঝতে পারি, আমিও হয়তো এই একই কাজ করতাম। পরিচিত পাঠক, যাঁরা আমার মতো “সরল সোজা” গল্প পড়তে পছন্দ করেন, তাদের হাতে বইটা তুলে দিয়ে বলতাম, বইটা প্লিজ পড়ুন। লেখকের প্রথম বই, এখনও তেমন পরিচিতি অর্জন করেননি, কিন্তু তবুও পড়ুন। নওশিনের মতোই বইয়ের ভিতরে দৃঢ় অক্ষরে লিখে দিতাম : “পৃথিবীটা বইপড়ুয়াদের হোক!” এবং তার মতোই বারবার তাড়া দিতাম : বইটা পড়েছেন? পড়েছেন বইটা? এখনও পড়া শুরু করেননি? শুরু করেননি এখনও? সেকি!
শেষ হয়েও রয়ে যায় গল্পগুলোর শীতাতপ রেশ, চরিত্রদের উপস্থিতি ঘুরতে থাকে মাথার ভেতর। মনে পড়ে যায় “বনলতা সেন” কবিতাটির অন্তিম কয়েকটা লাইন :
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতনসন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজনতখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল ;সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন ;থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার...
আরো অনেক পাঠকের হাতে উঠে আসুক এই দারুন গল্পগুলো।